০৬. প্রফেসর শর্মার দিকে তাকিয়ে

কিরীটী সম্মুখে উপবিষ্ট প্রফেসর শর্মার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ প্রফেসার আপনি যা বলছিলেন এবার বলুন।

প্রফেসর শর্মা বললেন, জিনজার খাবার পর সেক্রেটারী শুভঙ্করকে নিয়ে আমি খাবার ঘরে যাই। সেখানে আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে শুভঙ্কর নীচে চলে যায়।

অনুমান তখন রাত্ৰি কটা?

প্রফেসর শর্মা মৃদু একটু হাসলেন, ক্ষমা করবেন মিঃ রায়, আগে তো বুঝিনি আজকের রাত্রের প্রতিটি ঘণ্টা, প্রতিটি মিনিটের হিসেবনিকেস কারো কাছে দিতে হবে তাহলে না হয় ঘড়িধরে সব কাজগুলো করে রাখতাম। তবে যতদূর মনে হয়। রাত্রি তখন নটা হবে বা নটা বাজবার মিনিট চার-পাঁচ আগেও হতে পারে। তারপর হঠাৎ ব্যঙ্গ-মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, কিন্তু ব্যাপারটা কি বলুন তো মিঃ রায়, গরীবকে ফঁাসাবার মতলবে জেরা করছেন না তো?

কিরীটী ও-কথার কোন জবাব না দিয়ে গভীর স্বরে প্রশ্ন করলে, আপনি তাহলে তারপর খাবার ঘরেই রয়ে গেলেন?

হ্যাঁ খাবার ঘরে পরিষ্কার টেবিল চেয়ার পাতা ছিল, কেননা আজ খাবার আয়োজন হয়েছিল নীচে। হঠাৎ আমার নজরে পড়ে, টেবিলের ওপর একখানি হিন্দী ভাষায় অনুদিত ছোটদের রূপকথা সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে পড়ে আছে। আমি হিন্দী ভাষা বেশ ভালই জানি এবং হিন্দীতে অনুদিত ছোটদের একখানি রূপকথা দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না; তাছাড়া রূপকথা পড়তে চিরদিনই বড় ভালবাসি। বইখানি হাতে পেয়ে অন্যমনস্ক ভাবে একটা চেয়ারের ওপরে বসে পড়লাম। বেশী লোকের গোলমাল আমি কোন দিনই পছন্দ করি না, ভাবলাম বাঁচা গেল। হাতের কাছে বইটা পেয়ে তাতেই মনঃসংযোগ করলাম। বইটা সত্যিই ভাল। রুপকথা পড়তে আপনার কেমন লাগে মিঃ রায়?

ব্রাভো! চমৎকার! কিরীটী চাপা উল্লাস ভরা কণ্ঠে বলে উঠল, এ যে দেখছি। একটা মজার রহস্য উপন্যাস হয়ে দাঁড়াচ্ছে! চারদিকে উৎসবের কলোচ্ছাস, একজন ছায়ার মত এসে স্নানের ঘরে মাটি কোপানোর খুরপি ফেলে গেলেন; আর একজন খাবার ঘরে এসে সাত সমুদ্র তেরা নদীর পারে রুপকথা কুড়িয়ে পেলেন এবং তখনি সেই রূপকথা পড়ায় মত্ত হয়ে উঠলেন। এমন সময় এক সাংঘাতিক খুনী রক্ত দেখবার নেশায় পাশের ঘরে হায়েনার মত হিংস্র হয়ে উঠছে! সব কিছুর মধ্যেই একটা মানে থাকা দরকার। যদি এই পর পর ঘটনাগুলোর আদপে কোন মানেই না থাকে, তাহলে এই পৃথিবীতে কোন কিছুরই মানে श्ा না!

পরমুহুর্তেই যেন হঠাৎ কিরীটী আবার গভীর হয়ে প্রফেসার শমর্যকে পুনঃপ্রশ্ন করল, খুব ভাল, ঘড়ির সময় নিয়ে আপনি একটু আগে আমাদের ঠাট্টা করছিলেন, আবার কিছু সময়-সম্পৰ্কীয় অতি আবশ্যকীয় দু-চারটে কথা এসে যাচ্ছে! ক্ষমা করবেন প্রফেসার, আমি সিঁড়ির ও খাবার ঘরের ঘড়ি মিলিয়ে দেখেছি। আমার ঘড়ি আর ওই দুটো ঘড়ি একই সময় দিচ্ছে— আপনার ঘড়িতে এখন কটা প্রফেসার?

প্রফেসর শর্মা পকেট থেকে একটা মূল্যবান রৌপ্য-নির্মিত ঘড়ি বের করে হাতের ওপরে নিয়ে দেখে বললেন, ঠিক দশটা বেজে বারো মিনিট হয়েছে।

আমারও ঠিক তাই, কিরীটী আপন হাতঘড়ি দেখে বললে, তোমার ঘড়িতে কত সুব্রত?

দশটা বেজে চব্বিশ মিনিট। আমার ঘড়ি দেখে বললাম।

বেশ! প্রফেসার, আপনার যদি আপত্তি না থাকে। তবে দয়া করে যদি বলেন, রাত্রি ঠিক সাড়ে নটার সময় আপনি কোথায় ছিলেন? কিরীটী প্রশ্ন করল প্রফেসারের মুখের দিকে চেয়ে, অর্থাৎ যখন মিঃ মিত্ৰ কুমারসাহেবর প্রাইভেট ঘরে গিয়ে ঢোকেন?

নিশ্চয়ই। বলে সহসা প্রফেসার হাঃ হাঃ করে উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন। তারপর কেনমতে হাসি চাপিতে চাপতে বললেন, সাড়ে নটার সময় হলঘরে দাঁড়িয়ে আমি আপনারই পাহারারত ভদ্রলোকটির সঙ্গে কথা বলছিলাম। তারসঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রায় আট-দশ মিনিট কথাবার্তা বলেছি। তারপর তার সামনেই এই ঘরে এসে ঢুকি এবং কুমারসাহেব এইখানে দাঁড়িয়ে আপনাদের সকলের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন, আশা করি আপনার মহামান্য তীক্ষ্মবুদ্ধি বন্ধুবর এত তাড়াতাড়ি সে কথা ভুলে যাননি!

কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম অসহ্য বিরক্তিতে সে এবার নিশ্চয়ই কোন কিছু বলে বসবে, কিন্তু হঠাৎ যেন সে নিজেকে সামলে নিয়ে সামনেই ঝোলানো ভৃত্যদের ডাকবার ঘণ্টার দড়িটায় ধীরে ধীরে একটা টান দিয়ে ছেড়ে দিল।

আমরা সকলে নির্বক বিস্ময়ে কিরীটীর মুখের দিকে উদ্‌গ্ৰীব হয়ে চেয়ে রইলাম।

হরিচরণ ঘরে এসে ঢুকল।

প্রফেসারের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কি ইঙ্গিত করতেই ঘাড় হেলিয়ে বললে, হ্যাঁ, স্যার, ঐ ভদ্রলোক আমার কাছেই ছিলেন। এক সময় আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মশাই, ঠিক এখন সময় কত বলতে পারেন? আমার মনে হচ্ছে আমার ঘড়িটা বোধ হয় একটু slow যাচ্ছে। আমি বললাম, আমার ঘড়ি ঠিকই আছে—সাড়ে নটা বেজেছে। আমরা দুজনে এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ির ঘড়িটাও একবার দেখে নিজেদের ঘড়ির সঙ্গে মিলিয়ে নিলাম। কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমের ঠিক সামনাসামনি ওঠবার সিঁড়ি, আমরা দুজনেই সিঁড়ির মাথা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিলাম। ভদ্রলোক আমার ঘড়িটা সিঁড়ির সঙ্গে একই টাইম দিচ্ছে দেখে নিজের ঘড়িটি মিলিয়ে নিতে নিতে আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন।

কিরীটী বাধা দিল, তাহলে তুমি তখন ঠিক সিঁড়ির মাথায় ছিলে, যখন মিঃ মিত্র কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমে প্রবেশ করেন।

হ্যাঁ, সেই সময় প্রায় পাঁচ মিনিট উনি আমার সঙ্গেই ছিলেন। তারপর তিনি এই ঘরে এসে প্রবেশ করেন।

ঐ সময় তুমি নিশ্চয়ই হলঘর থেকে প্রাইভেট রুমে যাবার দরজাটার প্রতি বেশ ভাল নজর রেখেছিলে হরিচরণ, কী বল?

খুব কঠিন দৃষ্টিতে নজর না রাখলেও, মোটামুটি ভাল করেই নজর রেখেছিলাম স্যার। এবং বেয়ারা যখন ঘরে ঢেকে আমি তখনও তার পিছনেই দাঁড়িয়ে এবং আমি ওর সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের মধ্যে ঢুকে মৃতদেহ দেখতে পাই। আপনি না। আসা পর্যন্ত আমি একবারের জন্যও ওখান থেকে নড়িনি।

হঠাৎ প্রফেসর শর্মা বললেন, আচ্ছা, এবারে আমি আসতে পারি কী মিঃ রায়? রাত্রি অনেক হল। এই আমার নামের কার্ড রইল, যখন ইচ্ছা ফোনে একটু খবর দিলেই আমার দেখা পাবেন। বলতে বলতে একটা সুদৃশ্য কার্ড কিরীটীর হাতের দিকে প্রফেসর এগিয়ে ধরলেন। কিন্তু কিরীটী তাঁর কথায় কোন জবাবই দিল না, চুপচাপ বসেই রইল, যেন কথাগুলো কানেই যায়নি। তারপর নীরবে হাত বাড়িয়ে প্রফেসার হাত থেকে কার্ডটা নিয়ে ভু কুঁচকে কী যেন ক্ষণেক ভােবল, তারপর মৃদু অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বললে, প্রফেসর শর্মা, আশা করি ও-ঘরের তলোয়ারটার কথা এর মধ্যেই একেবারে ভূলে, যাননি!

সহসা প্রফেসারের চোখের দৃষ্টিটা তীক্ষ ও উগ্র হয়ে উঠল। তিনি পলকহীন ভাবে কিরীটীর দিকে চাইলেন, কিরীটীও তার নিভীক দৃষ্টিতে প্রফেসারের দিকে চেয়ে রইল।

চারজোড়া তীক্ষ্ম চোখ পরস্পর পরস্পরের দিকে কিছুক্ষণ অপলকে চেয়ে রইল। দুজনেই ভয়ঙ্কর রকম যেন সজাগ হয়ে উঠেছে।

তারপর সহসা আবার প্রফেসার প্রবলভাবে হেসে উঠলেন এবং চিবিয়ে চিবিয়ে অদ্ভুত ভাবে বলে উঠলেন, চমৎকার! তাহলে মান্যবর ডিটেকটিভ বন্ধু আমার আমাকেই খুনী বলে সাব্যস্ত করলেন শেষটায়! ওয়ানডারফুল! অভাবনীয় চিন্তাশক্তি!

না। জলদগন্তীর স্বরে কিরীটী বলে উঠল, অন্ততঃ বর্তমানে আপনাকে খুনী বলে সন্দেহ করিনি। কোন মানুষ আগে থেকে চিন্তা করে খুন করতে পারে, কিন্তু আগে থেকে চিন্তা করে শয়তান হতে পারে না! আমি শুধু কয়েকটা আবশ্যকীয় প্রশ্নই জিজ্ঞাসা করেছি মাত্র। ও-কথা যাক প্রফেসার, বলুন, মিঃ মিত্র কি হিন্দী ভাষা বলতে-কইতে পারতেন?

সত্যি কথা বলতে কি, প্রফেসার বলতে লাগলেন, মোটেই না। হিন্দী ভাষায় তার জ্ঞান, ‘করেঙ্গ’ ‘খায়েঙ্গা’ পর্যন্তই। শুভঙ্কর ছিল আমার ছোটবেলার বন্ধু, তার নাড়ীনক্ষত্র আমি জানি। বড়লোক বাপের একমাত্র ছেলে ছিল ও। লোক জানত ও বিলাতফেরত, উচ্চশিক্ষিত; আসলে ওর পড়াশুনা তেমন ছিল না। ম্যাট্রিক পর্যন্ত বিদ্যার দৌড়। চেহারাটা ছিল সুন্দর আর common sense ছিল প্রচুর, যার ফলে কিছু না জেনেও অনেক কিছুই জািনবার ভান করতে পারত। কিন্তু খেলাধূলায় ওর মত ওস্তাদ বড় একটা দেখা যেত না। টেনিস খেলতে, সাঁতার কাটতে, ঘোড়ায় চড়তে, তরবারি বা ছোরা খেলতে, বন্দুক ছুড়তে, বড় বড় জানোয়ার শিকার করতে ও ছিল একেবারে যাকে বলে অদ্বিতীয়। আচ্ছা, এবারে Good Night জানাচ্ছি। my friend! আশা করি ক্ষণিকের চেনা গরীব বন্ধুর কথাটা ভুলে যাবেন না।

নিশ্চয়ই না। বিশেষ করে না ভুলতে যখন আপনিই এত করে অনুরোধ জানিয়ে যাচ্ছেন! কিরীটী গম্ভীর স্বরে জবাব দিল।

ধীর মন্থরপদে জুতোর শব্দ তুলে প্রফেসার কালিদাস শৰ্মা ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।

কিরীটী এক সময় বললে, দেখ হরিচরণ, তুমি একবার এখানে যাঁরা যাঁরা উপস্থিত আছেন প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলে জানিবার চেষ্টা কর, তাদের মধ্যে কে কে আজ রাত্রে এখানে প্রফেসার কালিদাস শর্মাকে দেখেছেন! আর খাবার ঘরে গিয়ে একবার দেখ সেখানে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে নামে বইখানা পাও নাকি! আর চেষ্টা কর জানতে কে ঐ বইখানা এনেছিল সঙ্গে করে? হ্যাঁ, আর যাবার সময় কুমারসাহেবের ম্যানেজারটিকে একবার এখানে পাঠিয়ে দিও তো?

হরিচরণ ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই কিরীটী আমাদের দিকে তাকিয়ে বললে, আমি যতদূর জানি, এই কালিদাস শর্মারই বছর তিন-চার আগে কী একটা ব্যাপার নিয়ে দুর্নাম রটে, ফলে কলেজের চাকরি যায়, তারপর থেকেই লোকটা সম্পূর্ণ বেকার; কিন্তু বর্তমানে বেকার অবস্থায় এত বাবুয়ানা ওর আসে কোথা থেকে? খুব সম্ভব কুমারসাহেবকে ও নেশার বস্তু যোগায়!

আমারও যেন তাই মন হয়, ডাঃ চট্টরাজ চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, বোধ হয় সেইজন্যই কুমারসাহেব যখন আজ রাত্রে আমাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে উঠে গিয়ে দ্বিতীয়বার ফিরে এলেন, তখন তাঁকে একরকম যেন অসুস্থের মত দেখাচ্ছিল। মাথাটা নিচের দিকে নামিয়ে শ্লথ মন্থর গতিতে হ্যাঁটছিলেন। তখনই আমার মনে হয়েছিল, ভদ্রলোক বোধ হয় কোন একটা নেশাটেশায় অভ্যস্ত।

আপনি ঠিকই বলেছেন ডাক্তার, কিরীটী বলে উঠল, খুব সম্ভবত দ্বিতীয়বার তিনি যখন আমাদের কাছে আসেন, তখন কোন একটা কিছু নেশা করে এসেছিলেন। আপনি বোধ হয় লক্ষ্য করেননি।

আমি বাধা দিলাম, উনি না লক্ষ্য করলেও, আমার দৃষ্টিকে তুমি এড়াতে পারনি বন্ধু। কুমারসাহেব যখন আমাদের দেওয়া সিগার না খেয়ে নিজের সিগারেট খেয়ে উঠে যান, তখন তাঁর অ্যাসট্রের মধ্যে সেই নিক্ষিপ্ত নিঃশেষিত সিগারেটের টুকরোটা তুমি তুলে নিয়ে পকেটস্থ করেছা!

এতদিনে সত্যসত্যই সুব্রতর চোখ একটু সজাগ হতে আরম্ভ করেছে। কিরীটী হাসতে হাসতে বলতে লাগল, চেয়ে দেখুন ডাক্তার, কিরীটী পকেটে হাত চালিয়ে সিগারেটের টুকরো বের করে আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরল, একটু ভাল করে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন, এ সিগারেট কেনা নয়, হাতে পাকিয়ে তৈরি করা, তাছাড়া সিগারেটের মসলা যেমন হয় এর মধ্যকার মসলা ঠিক তেমন নয়; একটু মোটা এবং কোনমতে কাগজ দিয়ে জড়িয়ে সিগারেট বানানো হয়েছে। শুকে দেখুন…। বলতে বলতে কিরীটী সিগারেটটা খুলে ফেললে।

তাছাড়া দেখুন, মসলাটা কেমন ফিকে ব্রাউন রংয়ের ‘মরিহুয়ানা’ (‘morihuanna) কিংবা ‘হ্যাসহিস’ (‘hashish’) ভাং সিদ্দি বা গাঁজা জাতীয় জিনিস। তবে আসলে কোন জিনিসটা দিয়ে যে এই সিগারেটের মসলা তৈরী হয়েছে তা রাসায়নিক পরীক্ষাগার থেকে পরীক্ষিত না হয়ে আসা পর্যন্ত সঠিক বলা চলছে না। তোমরা হয়তো জান না, ইজিপ্টের লোকেরা হ্যাসহিসের সবুজ বা কাঁচা পাতা খায়। তাতে নাকি নেশা হয়। মেক্সিকোতে যে হ্যাসহিস পাওয়া যায়, তার পাতা আরো তীব্র নেশা আনে। খুব সম্ভব প্রফেসর শর্মা এই ধরনের সিগারেট তৈরী করে কুমারসাহেবকে নেশায় পরিতুষ্ট করে থাকেন। প্রফেসর শর্মা উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন বলে ওঁর সিগারেটের ওপরে সর্বপ্রথম আমার সন্দেহ জাগে, যে মুহুর্তে উনি আমার দেওয়া সিগারেটের অফার ফিরিয়ে দিলেন, অথচ ঠিক সেই সময়ই নিজের কেস হতে সিগারেট বের করে ধূমপান শুরু করলেন। কোন সভায় বা দুদশজন যেখানে মিলিত হয়েছে, সেখানে কেউ সিগারেট কাউকে অফার করলে তাকে refuse করে পরমুহুর্তেই নিজের সিগারেট ব্যবহার করা এটিকেট-বিরুদ্ধ। একমাত্র সেই কারণেই আমি কুমারসাহেবের নিঃশেষিত ফ্যাগ end টা অ্যাসট্রে হতে তুলে নিয়েছিলাম। তারপর একটু থেমে আবার বললে, হ্যাঁ ভাল কথা ডাক্তার, আপনাদের ডাক্তারী শাস্ত্ৰে ভাং সিদ্ধি প্রভৃতির নেশা করলে কি কি লক্ষণ দেখা যায় বলে?

চোখের মণিতে অবস্থিত আলো প্রবেশের ছিদ্রপথ pupil সঙ্কুচিত (contracted) হয়ে যায়। জোরে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে শুরু করে, সামান্য একটু চলাফেরা করলেই exhaustion হয়ে গা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কল্পনায় সব নানা রকম অদ্ভুত অদ্ভুত দৃশ্য চোখের ওপর ভাসতে থাকে; যাকে আমরা ডাক্তারী শাস্ত্ৰে hallucination বলি! এখন বোধ হয় বুঝতে পারছ রায়, কুমারসাহেব যে অদ্ভূত গল্প আমাদের শোনাচ্ছিলেন তা ঐ নেশারই প্রভাবে।

অদ্ভুত আর তাকে বলা চলে না ডাক্তার, আজকের রাতের ঘটনার কথা ভাবতে গেলে কিছুই আর আশ্চর্য বা অদ্ভুত লাগে না। আমি এখনও স্থিরনিশ্চিত নই কুমারসাহেবের গল্পটা নেশা থেকেই উদ্ভূত না কল্পনা মাত্র। আপনি যে জিনিসটার প্রভাবের কথা বলছেন সেটাও ঐ গাঁজা বা ভাং জাতীয় গাছের পাতা থেকে হয়, এবং ঐ ধরনের নেশার বস্তু একটা সিগারেটের মধ্যে যতটুকু থাকে তাতে করে আমন নেশা হতে পারে বলে আমার কিন্তু মনে হয় না। সামান্য একটু উত্তেজকের কাজ করতে পারে মাত্র। আমার মনে হয় এ ধরনের নেশায় কুমার সাহেব অনেকদিন থেকেই বেশ অভ্যস্ত। না হলে তিনি এ ধরনের নেশা করে নিশ্চয়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন এবং সেটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া এই জাতীয় নেশায় অভ্যস্ত যেসব নেশাখের, তাদের এই সামান্য একটু নেশার দ্রব্য সেবন করলে আর যাই হোক অন্ততঃ কল্পনায় স্বপ্ন যে দেখতে শুরু করবে না এটাও ঠিক। অর্থাৎ আমি বলতে চাই, আপনাদের ডাক্তারী শাস্ত্রে ঐ hallucination দেখা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়তো না হওয়াটাই বেশী সম্ভব। আরো একটা কথা এই সঙ্গে আমাদের ভুললে চলবে না যে, এ জাতীয় জিনিসের লোককে মেরে ফেলবারও একটা ক্ষমতা আছে, তবে একটু দীর্ঘ সময় লাগে। যেমন ধরুন দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত ভাবে ঐ ধরনের নেশা করে আসলে, অনবরত এগুলো slow poisoning-য়ের কাজ করতে পারে অনায়াসেই। এমনও হতে পারে যে, ঐভাবে নেশার মধ্য দিয়ে slow poisoning করে কেউ ঐ উপায়ে অনেক দিন ধরেই ওঁকে সবার অলক্ষ্যে এ জগৎ থেকে নিঃশব্দে সরিয়ে ফেলবার চেষ্টা করছিল।

এমন সময় ম্যানেজারবাবু এসে ঘরে ঢুকলেন। —এমন করে আর কুমারসােহবের সর্বনাশ করবেন না। স্যার, আপনার লোকেদের আদেশ দিন যাতে করে তঁরা এবার এখানে উপস্থিত সম্মানিত অতিথি-অভ্যাগতদের অন্ততঃ চলে যেতে বাধা না দেন। একেই তো তীরা সব নানা অদ্ভুত প্রশ্ন করে করে আমাদের প্রায় পাগল কর তোেলবার যোগাড় করেছেন। এমন কি এর মধ্যে কেমন করে না জানি প্রকাশও হয়ে গেছে যে কুমারসাহেবের সেক্রেটারীকে কে হত্যা করেছে। আমি যদিও তঁদের বুঝিয়ে বলেছি, তিনি আত্মহত্যা করেছেন, কেউ তাঁকে হত্যা বা খুন করেনি, কিন্তু এ ধরণের কথা একবার রটলে কি কেউ আর কারও কথা বিশ্বাস করে বা করতে চায়?

কিরীটী হাসতে হাসতে বললে বসুন। আপনার মনিবের সেক্রেটারী আত্মহত্যা করেছেন শুনলে নিশ্চয়ই আপনার প্রভুর আত্মমর্যাদা বেড়ে যাবে, কি বলেন ম্যানেজারবাবু? কিন্তু সে কথা থাক, ব্যস্ত হবেন না, এখন বলুন তো দেখি, আজ রাত্রে এই উৎসবে এমন কি কেউ এখানে এসেছেন যাঁকে আপনি চেনেন না বা ইতিপূর্বে কোন দিন দেখেননি?

না, কই এমন কাউকে দেখছি বলে তো আমার আজ মনে পড়ছে না! ম্যানেজারবাবু বলে উঠলেন, তাছাড়া এ উৎসবে আমন্ত্রিতদের প্রত্যেকেই নিমন্ত্রণ-লিপি দেওয়া হয়েছিল এবং নিমন্ত্রণ-লিপি ছাড়া আর কাউকেই প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। সেক্রেটারীবাবুর এ বিষয়ে কড়া নজর ছিল।

সহসা আবার কিরীটী প্রশ্ন করল, আচ্ছা ম্যানাজারবাবু, বলতে পারেন, আপনাদের কুমারসাহেবের সেক্রেটারী মিঃ মিত্র কতদিন থেকে আফিং খাওয়াটা অভ্যাস করেছিলেন? দেখুন অস্বীকার করবেন না বা অস্বীকার করবার চেষ্টা করবেন না। আপনি নিশ্চয়ই তীর অনেক কথাই জানেন, কেননা বেশীর ভাগ সময়ই দুজনে আপনারা সহকমী হিসাবে এখানে কাজ করছিলেন। বলুন না মশাই, চুপ করে আছেন কেন? খেতেন নাকি তিনি?

আজ্ঞে!

বলুন! কঠিন আদেশের সুর কিরাটীর কণ্ঠে ঝঙ্কত হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ ম্যানেজারবাবু মাথা নীচু করে কি যেন ভাবলেন, তারপর একসময় মৃদুস্বরে বললেন, আজ্ঞে মাসখানেক হবে, তিনি আফিং একটু একটু করে গরম কফির সঙ্গে খেতেন। বলতেন, অন্য কোন বদ নেসার থেকে আফিং খাওয়াটা নাকি ভাল। তাছাড়া তার পেটের গোলমাল আছে বলে ডাক্তার নাকি পরামর্শ দিয়েছিল প্রত্যহ একটু একটু করে আফিং খেতে। আফিং ধরবার পর উপকারও নাকি পাচ্ছিলেন।

ভাল কথা! খুব ভাল কথা! কিন্তু আপনাদের কুমারসাহেবও কি ঐ সঙ্গে কোন নেশায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন নাকি?

আজ্ঞে, তিনি বোধ হয় ঐ একই সময় থেকে আফিং খাওয়ার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়েছেন, কিন্তু আমার মনে হয় কুমারসাহেব আফিংয়ে অনেক দিন থেকে অভ্যস্ত।

বেশ। আচ্ছা আজ রাত্রে কুমারসাহেবকে আপনারা ভাং বা সিদ্ধি জাতীয় কোন জিনিস দিয়ে সিগারেট তৈরী করে দিয়েছিলেন?

আজ্ঞে–

বলুন, জবাব দিন!

আজ্ঞে হ্যাঁ। কেননা আমি ভেবেছিলাম সিদ্ধি খেলে তিনি একটু চাঙ্গা হয়ে উঠবেন। জানি না কেন যেন আজ চার-পাঁচদিন একটা চিঠি পেয়ে অবধি তিনি অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। সর্বদাই মনমরা, যেন কি কেবলই ভাবছেন তাই ভাবলাম, আজকের এই উৎসবের দিন, সাধারণ সিদ্ধির সরবত-টরবত দিলে হয়তো তিনি আপত্তি করতে পারেন, তাই সিগারেট তৈরী করে রেখেছিলাম। এ রকম মাঝে আরো দুবার সিগারেট করে খাইয়েছিও তাকে। সন্ধ্যার অল্প পরেই আমি তখন কুমারসাহেবের লাইব্রেরী ঘর বসে কয়েকটা হিসাবপত্র মিলিয়ে নিচ্ছি, কুমারসাহেব যেন খুব উত্তেজিত হয়েছেন এমন অবস্থায় এসে লাইব্রেরী ঘরে ঢুকলেন, বললেন, এক কাপ গরম কফি খাওয়াতে পারেন ম্যানেজারবাবু? আর আপনার সেই সিগরট কয়েকটা দিতে পারেন? তারপর তিনি আমাকে একটু আগে বাথরুমে কী দেখেছেন তাই বলতে লাগলেন। আমি নিজে তাকে কফি নিয়ে এসে দিলাম ও পকেট থেকে তৈরী করা গোটাপাঁচেক সিগারেটও দিলাম।

আজকেই আপনি তাহলে প্রথম তাকে ঐ ধরনের সিগারেট দিয়েছিলেন বোধ হয়?

আজ্ঞে না। দিন পাঁচেক আগে একবার গোটাপাঁচেক তৈরী করে দিয়েছিলাম।

তবেই দেখুন ডাক্তার, ভাং বা সিদ্ধির প্রভাবে কুমারসাহেব কল্পনার বিভীষিকা দেখেননি, সিগারেট পান করবার আগেই দেখেছেন। তারপর ম্যানেজারের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, বেশ। আচ্ছা ম্যানেজারবাবু কুমারসাহেবের সঙ্গে যখন আপনার দেখা হয় তখন ঠিক কত রাত্রি হবে বলতে পারেন? মানে রাত্রি তখন কটা বাজে?

আজ্ঞে রাত্ৰি নটা হবে।

আচ্ছা, তারপর আপনি কী করলেন?

তারপর আরও কিছুক্ষণ আমি ঐখানেই ছিলাম, কেননা কুমারসাহেব সিগারেট নিয়েই ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন দ্রুতপদে। তারপর হিসাবপত্র দেখা হয়ে গেলে প্রায় রাত্ৰি সাড়ে নটার সময় আমি নীচে নেমে যাই।

এর পর ম্যানেজারবাবুকে কিরীটী বিদায় দিল।

ভদ্রলোকও যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন, কেননা তিনি একপ্রকার দৌড়েই ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।

ম্যানেজার ঘর থেকে চলে যাবার পর সকলেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কিরীটীও বোধ করি কি ভাবছিল।