প্রকৃতি ও মানুষ
বিশ্বজগতের যেটুকু অংশে ভৌতিক স্তরে অভিব্যক্ত, শুধু সেইটুকুই প্রকৃতি-সম্বন্ধে আধুনিক ধারণার অন্তর্গত। মন বলিতে সাধারণতঃ যাহা বুঝায়, তাহা প্রকৃতিরূপে বিবেচিত হয় না।
ইচ্ছাশক্তির স্বাধীনতা প্রতিপন্ন করিতে গিয়া দার্শনিকগণ মনকে প্রকৃতি হইতে বাদ দিয়া থাকিবেন, কারণ প্রকৃতি নিয়মের—কঠোর অনমনীয় নিয়মের শাসনে আবদ্ধ, প্রকৃতির অন্তর্গত বিবেচিত হইলে মনও নিয়মের অধীন হইয়া পড়িবে। ফলে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির মতবাদ দাঁড়াইতে পারিবে না; কেন না যাহা কোন নিয়মের অধীন, তাহা কিরূপে স্বাধীন বা স্বতন্ত্র হইতে পারে?
যুক্তি ও তথ্যের উপর দণ্ডায়মান ভারতীয় দার্শনিকগণের দৃষ্টিভঙ্গী এ-বিষয়ে বিপরীত। তাঁহাদের মতে—ব্যক্ত অথবা অব্যক্ত সমগ্র বাস্তব জীবনই নিয়মের অধীন। তাঁহাদের মতে : মনও বাহ্য প্রকৃতি, দুই-ই নিয়মের—একই নিয়মের অধীন। মন যদি নিয়মের অধীন না হয়, আমরা এখন যাহা চিন্তা করিতেছি, তাহা যদি পূর্ব চিন্তার অনিবার্য ফলস্বরূপ না হয়, যদি একটি মানসিক অবস্থা আর একটি মানসিক অবস্থার অনুসরণ না করে, তবে মনকে অযৌক্তিক বলিতে হইবে। এমন কে আছে, যে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি স্বীকার করিয়া যুক্তির ক্রিয়া অস্বীকার করিতে পারে? অপর পক্ষে মন কার্য-কারণ নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, ইহা স্বীকার করিয়া কে বলিতে পারে যে, ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন?
নিয়মই কার্য-কারণের ক্রিয়া। পূর্ববর্তী কতকগুলি ঘটনার অনুযায়ী হইয়া পরবর্তী কতকগুলি ব্যাপার ঘটিয়া থাকে। প্রতিটি পূর্বগামী ঘটনার বা কারণের অনুবর্তী কার্য আছে। প্রকৃতি এইরূপেই চলিয়াছে। এই নিয়মের শাসন যদি মনের স্তরেও চালু থাকে, তাহা হইলে মন বদ্ধ—স্বাধীন নয়। না, ইচ্ছাশক্তিও স্বাধীন নয়। ইহা কিরূপে সম্ভব? কিন্তু আমরা সকলেই জানি, অনুভব করি যে, আমরা স্বাধীন। স্বাধীন না হইলে আমাদের জীবনের কোন অর্থ থাকে না, জীবনযাপন বৃথা হইয়া যায়।
প্রাচ্যদেশীয় দার্শনিকগণ এই মতবাদ গ্রহণ করিয়াছেন, বা বলা যায়—উদ্ভাবন করিয়াছেন যে, মন এবং ইচ্ছাশক্তি দেশকালনিমিত্তের দ্বারা তথা- কথিত জড়বস্তুর মতোই বদ্ধ; সুতরাং উহারা কার্যকারণের নিয়মে শাসিত। আমরা কালের মধ্যে চিন্তা করি, আমাদের চিন্তাগুলি কালের দ্বারা সীমিত; যাহা কিছুর অস্তিত্ব আছে, সে সব কিছুই দেশে ও কালে বর্তমান। সব কিছুই কার্য-কারণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ।
যাহাকে আমরা জড়পদার্থ বলি, এবং মন—এ দুইই একই উপাদানে গঠিত। প্রভেদ কেবল কম্পনের তারতম্যে। মনের অতি নিম্নগ্রামের স্পন্দনকেই আমরা জড়বস্তু বলিয়া জানি। আবার জড়পদার্থের দ্রুত স্পন্দনকে আমরা মন বলিয়া জানি। উভয়ের উপাদান একই। অতএব জড়পদার্থ এবং দেশকালনিমিত্ত্বের দ্বারা সীমিত বলিয়া জড়ের দ্রুত স্পন্দন মনও একই নিয়মের দ্বারা আবদ্ধ।
প্রকৃতির উপাদান সর্বত্র সমজাতীয়। প্রভেদ কেবল বিকাশের তারতম্যে। এই বিশ্বপ্রপঞ্চের সংস্কৃত প্রতিশব্দ হইল ‘প্রকৃতি’ এবং ইহার আক্ষরিক অর্থ ‘প্রভেদ’। সবই এক উপাদান, কিন্তু ইহা বিচিত্ররূপে অভিব্যক্ত।
মন জড়ে রূপান্তরিত হয়, আবার জড়ও মনে রূপান্তরিত হয়, ইহা শুধু কম্পনের তারতম্য।
একটি ইস্পাতের দণ্ড লও, উহাকে কম্পিত করিতে পারে—এইরূপ একটি শক্তি ইহাতে প্রয়োগ কর; তারপর কি ঘটিবে? যদি একটি অন্ধকার ঘরে এই পরীক্ষাটি করা হয়, তবে প্রথমে তুমি শুনিতে পাইবে একটি শব্দ—একটি গুনগুন শব্দ। শক্তিপ্রবাহ বর্ধিত কর, দেখিবে ইস্পাতের দণ্ডটি আলোকময় হইয়া উঠিয়াছে। শক্তি আরও বর্ধিত কর, ইস্পাতের দণ্ডটি আলোকময় হইয়া উঠিয়াছে। শক্তি আরও বর্ধিত কর, ইস্পাত-দণ্ডটি একেবারে অদৃশ্য হইয়া যাইবে। উহা মনে রূপান্তরিত হইয়া গিয়াছে।
আর একটি উদাহরণ লও : দশদিন আহার না করিলে আমি কোনপ্রকার চিন্তা করিতে পারি না। শুধু কয়েকটি এলোমেলো চিন্তা আমার মনে থাকিবে। আমি অত্যন্ত দুর্বল হইয়া পড়িব এবং সম্ভবতঃ আমার নামও ভুলিয়া যাইব। তারপর কিছু খাদ্য গ্রহণ করিলাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যে চিন্তা করিতে আরম্ভ করিব; আমার মনের শক্তি ফিরিয়া আসিয়াছে। খাদ্যই মনে রূপান্তরিত হইয়াছে। তেমনি স্পন্দনের গতিবেগ কমাইয়া মন দেহে অভিব্যক্ত হয়, জড়ে পরিণত হয়।
জড় ও মন—এ দুইটির কোনটি প্রথম? একটি উদাহরণসহ বুঝাইতেছি—একটি মুরগী ডিম পাড়িল, ডিমটি হইতে আর একটি মুরগীর জন্ম হইল; মুরগীটি আর একটি ডিম পাড়িল; ডিমটি হইতে আবার আর একটি মুরগী জন্মিল; অনন্ত কার্যকারণ-পরম্পরা এইরূপ চলিতে থাকিবে। এখন কোন্টি প্রথম—ডিম, না মুরগী? এমন কোন ডিমের কথা কল্পনা করিতে পার না, যাহা কোন মুরগী হইতে জন্মে নাই; অথবা এমন কোন মুরগীর বিষয় চিন্তা করিতে পার না, যাহা ডিম হইতে ফুটে নাই। যেটিই প্রথম হউক না কেন, তাহাতে কিছু আসে যায় না। আমাদের প্রায় সব চিন্তাধারাই এই ডিম ও মুরগীর ব্যাপারের মতো১।
মহত্তম সত্যগুলি অত্যন্ত সরল বলিয়াই বিস্মৃতির গর্ভে চলিয়া যায়। মহৎ সত্যগুলি সহজ, কেন না এগুলির প্রয়োগ সার্বকালিক। সত্য নিজেই সর্বদা সহজ ও সরল। যাহা কিছু জটিল, তাহা কেবল মানুষের অজ্ঞতার জন্য।
মানুষের স্বতন্ত্র কর্তৃত্ব মনেতে নাই, কেন না মন বদ্ধ। সেখানে কোন স্বাধীনতা নাই। মানুষ মন নয়, আত্মা। এই আত্মা সর্বদা মুক্ত, সীমাহীন ও চিরন্তন। এইখানেই—এই আত্মাতেই মানুষের মুক্তভাব। আত্মা সর্বদাই মুক্ত; কিন্তু মন উহার ক্ষণস্থায়ী তরঙ্গগুলির সঙ্গে নিজেকে এক মনে করিয়া আত্মাকে দেখিতে পায় না এবং দেশকালনিমিত্ত-রূপ গোলকধাঁধায়—মায়ায় নিজেকে হারাইয়া ফেলে।
ইহাই আমাদের বন্ধনের কারণ। আমরা সর্বদা মন এবং মনের অদ্ভুত পরিবর্তনগুলির সঙ্গে নিজেদের এক ভাবিতেছি।
মানুষের স্বতন্ত্রভাব আত্মাতেই অবস্থিত এবং নিজেকে মুক্ত উপলব্ধি করিয়া—মনের বন্ধন সত্ত্বেও সর্বদা ঘোষণা করিতেছে : আমি মুক্ত! আমি যা, আমি তাই; আমি সেই। ইহাই আমাদের মুক্তি। সদামুক্ত সীমাহীন চিরন্তন আত্মা যুগে যুগে তাঁহার মন-রূপ যন্ত্রের মধ্য দিয়া ক্রমে ক্রমে অধিকতর ব্যক্ত হইতেছেন।
তাহা হইলে মানুষের সহিত প্রকৃতির সম্পর্ক কি? জীবের নিম্নতম বিকাশ হইতে মানব পর্যন্ত—সর্বত্রই প্রকৃতির মধ্য দিয়া আত্মা বিকশিত হইতেছেন। নিম্নতম অভিব্যক্ত জীবনের মধ্যেও আত্মার শ্রেষ্ঠ বিকাশ নিহিত আছে, ক্রমবিকাশের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আত্মা নিজের বিকাশ সাধন করিতেছেন।
বিবর্তনের সমগ্র প্রক্রিয়াই আত্মার নিজেকে ব্যক্ত করিবার সংগ্রাম। ইহা প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম। প্রকৃতির অনুযায়ী কাজ করিয়া নয়, তাহার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়াই মানুষ আজ বর্তমান অবস্থা লাভ করিয়াছে। প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখিয়া জীবনধারণ করা, প্রকৃতির সঙ্গে একতানতা রক্ষা করা প্রভৃতি সম্বন্ধে বহু কথাই আমরা শুনিয়া থাকি। এরূপ ধারণা ভ্রম। এই টেবিলটি, এই জলের কুঁজাটি, এই খনিজ পদার্থগুলি, ঐ বৃক্ষ—ইহারা সকলেই প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখিয়া চলিতেছে। সেখানে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য বিদ্যমান—কোন বিরোধ নাই। প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের অর্থ নিশ্চেষ্টতা, মৃত্যু। মানুষ এই গৃহ কিরূপে নির্মাণ করিয়াছে—প্রকৃতির সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া? না, প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়াই ইহা নির্মিত হইয়াছে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামের পথেই মানুষের উন্নতি, প্রকৃতির অনুগত হইয়া নয়।
———-
১ তুলনীয় : বীজাঙ্কুর-ন্যায়