০৬. পলিলন কর্ডটি ঝুলিয়ে রেখেছিলাম

পরিত্যক্ত খনিটিতে আমি যে পলিলন কর্ডটি ঝুলিয়ে রেখেছিলাম সেটি এখনো ঝুলছে। আমি সেটা ধরে নিচে নামতে থাকি, আগেরবার যখন এই কর্ড বেয়ে নেমে এসেছিলাম তখন নানা ধরনের উত্তেজক বায়োকেমিক্যাল দিয়ে আমাকে একটি হিংস্র শ্বাপদের মতো সজাগ করে রাখা হয়েছিল। এবারে আমার মাঝে কোনো উত্তেজনা নেই। খনির নিচে আমি একা নেমে এসেছি সত্যি কিন্তু উপরে আমার জন্য প্রতিরক্ষা দপ্তরের বিশাল বাহিনী একাধিক ভাসমান যান নিয়ে অপেক্ষা করছে।

খনির নিচে অন্ধকার সুড়ঙ্গের বাতি জ্বালিয়ে আমি নির্দিষ্ট পথে যেতে থাকি, বড় বড় দুটি গুহার মতো অংশ পার হয়ে একটি সরু সুড়ঙ্গের পরেই আমি ক্ষীণ আলোকরশ্মি দেখতে পেলাম। ফাঁকা জায়গাটাতে পৌঁছে আমি ডাকলাম, লাইনা, তুমি কোথায়?

আমার কথার কেউ উত্তর দিল না। হঠাৎ আমার বুকের ভিতর একটা আশঙ্কা উঁকি দিয়ে গেল, ভয় পাওয়া গলায় আবার ডাকলাম, লাইনা, তুমি কোথায়?

ঠিক তখন আমি লাইনাকে দেখতে পেলাম, শক্ত পাথরের মেঝেতে নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছে। আমি ছুটে গিয়ে তার উপর ঝুঁকে পড়লাম, আবার ডাকলাম, লাইনা।

লাইনা খুব ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল, তার দৃষ্টি দেখে আমি হঠাৎ শিউরে উঠলাম, কী ভয়ঙ্কর শূন্যতা সেখানে। আমি কাঁপা গলায় বললাম, কী হয়েছে তোমার?

লাইনা ফিসফিস করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল আমি ঠিক শুনতে পেলাম না। আমি তার হাত ধরে তার আরো কাছে ঝুঁকে পড়লাম, হাতটি বরফের মতো শীতল। লাইনা ফিসফিস করে বলল, বিদায়।

আমি প্রায় আর্তনাদ করে কাতর গলায় বললাম, কী হয়েছে তোমার লাইনা?

লাইনা দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে চোখ বন্ধ করল। আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম সে আত্মহত্যা করতে শুরু করেছে। আমাকে বলেছিল যখন সে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেবে তার দেহ নিজে থেকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে–স্বেচ্ছামৃত্যু! সত্যিই কি সেটা হতে চলেছে?

আমি পাগলের মতো লাইনাকে জাপটে ধরে ঝাঁকুনি দিতে থাকি, চিৎকার করে ডাকতে থাকি, লাইনা লাইনা, তুমি যেও না, যেও না।

লাইনা অনেক কষ্টে চোখ খুলে তাকিয়ে শোনা যায় না এ রকম স্বরে বলল, আমি ভেবেছিলাম তুমি আর আসবে না।

এই তো এসেছি। তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।

দেরি হয়ে গেছে কিরি। লাইনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, বিদায়।

না। আমি চিৎকার করে বললাম, তুমি এটা করতে পার না। তুমি যেতে পারবে।

লাইনার নিশ্বাস আর স্পন্দন আরো বিলম্বিত হতে থাকে। শরীর শীতল হয়ে আসছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠতে শুরু করেছে। আমি লাইনাকে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চিৎকার করে বললাম, তুমি যেতে পারবে না লাইনা। যেতে পারবে না। আমি তোমার জন্য প্রতিরক্ষা দপ্তরে গিয়েছি, গ্রুটাসের মুখোমুখি হয়েছি, আমি নিজের জীবন পণ করেছি শুধু তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য। তুমি এভাবে যেতে পারবে না। পারবে না।

লাইনার শরীর আরো নির্জীব হয়ে ওঠে। তার অনিন্দ্যসুন্দর মুখাবয়বে কেমন জানি এক ধরনের শীতলতার ছাপ এসে পড়েছে। মাথায় এলোমেলো ঘন কালো চুলের মাঝে নিখুঁত মুখাবয়ব ফুটে রয়েছে। ভরাট টুকটুকে লাল দুটি ঠোঁট অল্প ফাঁক করে রেখেছে, মুক্তার মতো ঝকঝকে দাঁত দেখা যাচ্ছে সেই ফাঁক দিয়ে। বড় বড় বিস্ময়কর চোখ দুটি বুজে আছে। আমার মনে হতে থাকে এই চোখ দুটি খুলে আমার দিকে আরো একবার না তাকালে আমি আর বেঁচে থাকতে পারব না। এক সম্পূর্ণ অপরিচিত অনুভূতি আমার বুককে গুঁড়িয়ে দিতে থাকে। আমার সমস্ত হৃদয় এক ভয়াবহ শূন্যতায় ঢেকে যেতে থাকে। আমি নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না। লাইনাকে টেনে তুলে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো হু হু করে কেঁদে উঠলাম। তার মাথায় হাত বুলিয়ে ভাঙা গলায় বললাম, না লাইনা, তুমি এটা করতে পারবে না। আমাকে ছেড়ে তুমি যেতে পারবে না। পারবে না। আমি তা হলে কাকে নিয়ে থাকব?

আমি কতক্ষণ এভাবে লাইনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিলাম জানি না। তার মাথায় মুখ ঘষে আমি অপ্রকৃতিস্থের মতো কাঁদছি ঠিক তখন আমার মস্তিষ্কে একজন ডাকল, কিরি।

আমি চমকে উঠলাম, কে কথা বলছে? এটা কি আমার ট্রাকিওশান ইশি?

না, কিরি। আমি লাইনা।

লাইনা! আমি চমকে উঠলাম, কেমন করে সে আমার মস্তিষ্কে কথা বলছে?

আমি পারি কিরি। আমি অতিমানবী। আমি চলে যেতে যেতে ফিরে এসেছি কিরি। আমি তোমার জন্য ফিরে এসেছি। আমি বড় দুঃখী। আমি বড় একাকী, বড় নিঃসঙ্গ। আমি বড় ভালবাসার কাঙাল। বল, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না। বল। কথা দাও।

আমি লাইনার শীতল দেহকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে, তার চুলে মুখ ডুবিয়ে কাতর গলায় বললাম, কথা দিচ্ছি লাইনা। কথা দিচ্ছি। আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাব না। কখনো যাব না। তুমি ফিরে এস আমার কাছে।

আমি হঠাৎ অনুভব করতে পারি লাইনার দেহে আবার উষ্ণতা ফিরে আসছে। জীবনের উষ্ণতা। প্রাণের উষ্ণতা। আমার সমস্ত দেহ–মন এক বিচিত্র অনুভূতিতে অভিভূত হয়ে ওঠে, একেই কি ভালবাসা বলে?

.

ভাসমান যানে লাইনাকে নিয়ে পাশের শহরে সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলের একটি পরিত্যক্ত এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙের সামনে দাঁড়ালাম। বিল্ডিঙের দু শ এগার তলার বিধ্বস্ত একটি ঘরের সামনে দাঁড়াতেই দরজা খুলে একটি মেয়ে বের হয়ে এল। মনে হল মেয়েটি আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। মেয়েটি দেখতে হুবহু লাইনার মতো, আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত না থাকলে নিশ্চিতভাবে ধরে নিতাম ঘরের ভিতর থেকে লাইনাই বের হয়ে এসেছে। মেয়েটি এসে লাইনার সামনে দাঁড়াল, একজন আরেকজনকে আঁকড়ে ধরে চোখে চোখে তাকিয়ে রইল, তাদের মুখে অনুভূতির কোনো চিহ্ন ফুটে উঠল না, শুধু মনে হল অসম্ভব একাগ্রতায় কিছু একটা বুঝে নিতে চেষ্টা করছে। মানুষের চোখ আসলে মস্তিষ্কের একটা অংশ, চোখে চোখে তাকিয়ে আমরা তাই অনেক কিছু বুঝে ফেলতে পারি। লাইনা এবং তার এই সত্তাটি অতিমানবী, তারা নিশ্চয়ই চোখে চোখে তাকিয়ে তাদের এই দীর্ঘ সময়ের সব না–বলা কথা বলে নিচ্ছে, অবরুদ্ধ আবেগের বিনিময় করছে। কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে তারা একজন আরেকজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে এবং আমি প্রথমবার বুঝতে পারি লাইনা ঠিকই বলেছে আলাদাভাবে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই, সবাইকে নিয়েই তাদের পরিপূর্ণ জীবন।

লাইনার দ্বিতীয় সত্তাকে সাথে নিয়ে আমরা শহরের বাইরের একটি নির্জন পাহাড় থেকে তৃতীয় সত্তাকে তুলে নিলাম। আমরা যখন তাকে তুলতে গিয়েছি সে তখন প্রস্তুত হয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এবারেও ঠিক আগের মতো একজন আরেকজনকে ধরে একাগ্র দৃষ্টিতে চোখের দিকে তাকিয়ে একে অপরকে বুঝে নিতে শুরু করল।

এভাবে এক জন এক জন করে নয় জনকে ভাসমান যানে তুলে নিলাম। তারা সবাই একই ধরনের ক্লোন, তাদের চেহারা হুবহু একই রকম, শুধু তাই নয়, তারা সবাই একই পোশাক পরে আছে। তারা দীর্ঘসময় আলাদা হয়ে ছিল, দেখা হবার পর নিজেরা নিজেদের সাথে কথাবার্তা বলবে বলে আমার যে ধারণা ছিল সেটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে, কারণ আমি জানতাম না লাইনারা নিজেদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য কথা বলতে হয় না, বিচিত্র একটি উপায়ে তারা মস্তিষ্কের ভিতরে কথা বলতে থাকে। লাইনাকে তার মৃত্যুর সীমানা থেকে টেনে আনার সময় সে আমার সাথে একবার কথা বলেছিল। ব্যাপারটি কীভাবে করে কে জানে, সুযোগ পেলে একবার জিজ্ঞেস করতে হবে। আমি ভাসমান যানে বসে দেখতে পাচ্ছি নয় জন লাইনা পাশাপাশি বসে আছে, কেউ কারো দিকে তাকিয়ে নেই কিন্তু তাদের মুখভঙ্গি একই রকম, সবারই একসাথে হাসিমুখ হয়ে আবার একই সাথে গাঢ় বিষাদে ঢেকে যাচ্ছে, সবাই একই সাথে একই জিনিস ভাবছে তারা আলাদা মানুষ হয়েও তাদের মস্তিষ্ক একটি। না জানি এই মস্তিষ্কের মাঝে কী ভয়ানক ক্ষমতা লুকিয়ে আছে।

ভাসমান যানটি আমাদেরকে প্রজেক্ট অতিমানবীর ল্যাবরেটরির ভিতরে নামিয়ে দিয়ে উড়ে চলে গেল। ভাসমান যানটির লাল বাতিটি পুরোপুরি অদৃশ্য না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। আমরা এখন এই দেয়ালে ঘেরা ল্যাবরেটরিতে পুরোপুরি প্রতিরক্ষাহীন। বলা যেতে পারে পুরোপুরি গ্রুটাসের অনুকম্পার ওপরে নির্ভর করে আছি। আমি বুকের ভিতর এক ধরনের অশুভ আতঙ্ক অনুভব করতে থাকি, বাইরে সেটা প্রকাশ না করে আমি নিচু গলায় বললাম, চল ভিতরে যাওয়া যাক।

আমার মস্তিষ্কের মাঝে কেউ একজন মৃদু স্বরে বলল, তুমি ভয় পেয়ো না কিরি। ভয়ের কিছু নেই।

আমি চমকে উঠে নয় জন লাইনার দিকে তাকালাম, তাদের মাঝে কে কথাটি বলেছে বুঝতে পারলাম না। আমার মনেই ছিল না এই নয় জন অতিমানবী, আমার মস্তিষ্কের মাঝে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াতে পারে।

ল্যাবরেটরির দরজার কাছে পৌঁছানো মাত্রই আবার চতুষ্কোণ দরজাটি খুলে গেল। প্রথমে আমি এবং আমার পিছু পিছু বাকি নয় জন ভিতরে এসে ঢুকল। আজকে দরজার পাশে চার হাতের সেই মানুষটি দাঁড়িয়ে নেই, যে দাঁড়িয়ে আছে সে আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক এবং নিরস্ত্র। মানুষটি উঁচু গলায় বলল, তোমাদের জন্য মহামান্য গ্রুটাস অপেক্ষা করছেন।

আমরা কেউ কোনো কথা বললাম না। মানুষটি হাঁটতে শুরু করল এবং আমরা দশ জন তার পিছু পিছু যেতে শুরু করলাম। আমি হাঁটতে হাঁটতে ঘুরে একবার নয় জন অতিমানবীর মুখের দিকে তাকালাম, তাদের চেহারায় আতঙ্ক বা অস্থিরতার কোনো চিহ্ন নেই, বরং এক বিস্ময়কর প্রশান্তি। এদের মাঝে কোনজন লাইনা কে জানে, কিংবা কে জানে এই প্রশ্নটিই কি এখন করা সম্ভব?

হ্যাঁ সম্ভব। আমার মাথার মাঝে লাইনা বলল, শুধু আমাকে একটি নাম দিয়েছ তুমি, এখানে আর কারো নাম নেই।

আমি আবার ঘুরে তাকালাম এবং লাইনা এবারে হাত তুলে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। সে নিজে থেকে পরিচয় না দিলে এই নয় জনের ভিতর কোনজন লাইনা আমার পক্ষে বোঝা সেটি একেবারেই অসম্ভব। আমি লাইনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কীভাবে এটি কর? ব্যাপারটি প্রায় ভৌতিক।

লাইনা এবারে শব্দ করে হেসে বলল, মানুষ যেটা বুঝতে পারে না সেটাকেই বলে ভৌতিক। এটি অত্যন্ত সহজ একটি ব্যাপার। দুটি মস্তিষ্কের স্টেট পুরোপুরি এক হলে তার স্বাভাবিক কম্পন এক হয়ে যায় তখন খুব সহজে সুষম উপস্থাপন করা যায়। আমরা নিজেরা সেটা করি অনায়াসে, তোমারটাতে একটু অসুবিধে হয়

কিন্তু যেহেতু এটা তথ্যের এক ধরনের আদান-প্রদান, এর বিনিময় হয় কিসে?

সবই বিদ্যুৎ চৌম্বকীয়। মানুষের শরীরে নার্ভাস সিস্টেমের সমস্ত তথ্যের আদান প্রদান হয় ইলেকট্রো কেমিক্যাল সিগনাল দিয়ে।

ব্যাপারটি বোঝার জন্য আমি আরো একটা প্রশ্ন করতে চাইছিলাম কিন্তু তার আগেই যে মানুষটি পথ দেখিয়ে আনছে সে একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, এখানে মহামান্য গ্রুটাস তোমাদের সাথে দেখা করবেন।

আমি একটু অবাক হয়ে ঘরটিতে প্রবেশ করলাম। আমার পিছু পিছু লাইনারা নয় জন এবং সবার শেষে মানুষটি নিজেও ভিতরে ঢুকে গেল। ঘরটি ছোট এবং সেখানে গ্রুটাস নেই, আমি যেভাবে গ্রুটাসকে দেখেছি সে এখানে কীভাবে আসবে বুঝতে পারলাম না। আমি ব্যাপারটি বোঝার চেষ্টা করছিলাম ঠিক তখন ঘরঘর শব্দ করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ ঘরের ভিতরে একটা অত্যন্ত বিচিত্র ব্যাপার ঘটতে শুরু করল। কোনো একটা জিনিস ফেটে যাবার মতো শব্দ করে আমাদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি বাতাস বের হয়ে যাওয়া বেলুনের মতো শব্দ করে চুপসে যেতে শুরু করল। আমি অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম এটি সত্যিকার মানুষ নয়। আমার সামনে মানুষটি দুমড়েমুচড়ে ভেঙেচুরে যেতে শুরু করল এবং হঠাৎ করে আমার নাকে তীব্র একটি ঝাজালো গন্ধ এসে লাগল। গন্ধটি অপরিচিত, এটি বিষাক্ত কোনো গ্যাস, মানুষের মতো দেখতে এই যন্ত্রটির ভিতরে করে পাঠানো হয়েছে। আমার চেতনা হঠাৎ করে লুপ্ত হয়ে যেতে শুরু করে, জ্ঞান হারানোর আগে আমি ঘুরে তাকালাম—অতিমানবীরাও বুক চেপে ধরে দেয়াল আঁকড়ে ধরে কোনোভাবে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে। এটি শুধু মানুষের জন্য বিষাক্ত নয়, অতিমানবীদের জন্যও বিষাক্ত। আমরা একটা ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে পা দিয়েছি।

জ্ঞান হারানোর আগের মুহূর্তে শুনতে পেলাম আমার মস্তিষ্কে কেউ একজন বলল, ভার্ন গ্যাস!

.

জ্ঞান ফিরে পাবার পর চোখ খুলে দেখলাম আমার মুখের উপরে একটি যন্ত্র ঝুঁকে আছে। আমাকে জেগে উঠতে দেখে যন্ত্রটি সরে দাঁড়াল–এটি একটি প্রাচীন রোবট। আমি উঠে বসার চেষ্টা করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম সেটি সম্ভব নয়, আমাকে ধবধবে সাদা একটা বিছানায় শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। আমি রোবটটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কোথায়?

রোবটটি এগিয়ে এসে বলল, তুমি প্রজেক্ট অতিমানবীর ল্যাবরেটরির রেট্রো ভাইরাস অংশে।

এখানে কেন?

এই ল্যাবরেটরি যেসব রেট্রো ভাইরাস তৈরি করেছে সেগুলো পরীক্ষা করার উপযোগী মানুষের খুব অভাব। তোমাকে পাওয়ায় কিছু পরীক্ষা করা যাবে।

আমি বৃথাই আবার ওঠার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম, আমার ওপরে পরীক্ষা চালানো হবে?

হ্যাঁ।

কিসের পরীক্ষা!

সেটা তুমি সম্ভবত বুঝবে না। মহামান্য গ্রুটান বলে থাকেন মানুষমাত্রই নির্বোধ।

তুমি বলে দেখ। হয়তো বুঝতে পারব।

তুমি নিশ্চয়ই জান রেট্রো ভাইরাস তার ডি, এন. এ. মানুষের ক্রোমোজমে পাকাপাকিভাবে ঢুকিয়ে দেয়।

আমি জানতাম না কিন্তু সেটা প্রকাশ করলাম না। রোবটটি তার একঘেয়ে গলায় বলল, মহামান্য গ্রুটাস কিছু চমৎকার রেট্রো ভাইরাস তৈরি করেছেন, তাদের ডি. এন. এ. তে কিছু মজার জিনিস ঢোকানো আছে।

সেই মজার জিনিসগুলো কী?

একটি মানুষের নিউরনের সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।

কীভাবে?

মস্তিষ্কের আয়তন বাড়িয়ে দিয়ে।

আমি পুরো পদ্ধতিটি ভালো করে বুঝতে পারলাম না, রোবটটি ব্যাখ্যা করারও চেষ্টা করল না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মানুষের নিউরনের সংখ্যা বেড়ে গেলে মানুষেরা কি বেশি বুদ্ধিমান হয়ে যায়?

সেটি এখনো প্রমাণিত হয় নি। কারণ খুলির আকার বাড়ানো হয় নি বলে মস্তিষ্কের চাপে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণায় শেষ মানুষটির মৃত্যু হয়েছে।

আমি শিউরে উঠে রোবটটির দিকে তাকালাম, রোবটটি যান্ত্রিক গলায় বলল, নতুন রেট্রো ভাইরাসে খুলিটাকেও বড় করার ব্যবস্থা হয়েছে। এখনো পরীক্ষা করে দেখা হয় নি।

তার অর্থ আমাকে দিয়ে যে পরীক্ষা হবে সেটি সফল হলে আমার মস্তিষ্ক অনেক বড় হবে, সফল না হলে আমি মারা যাব?

যদি দেখা যায় তুমি মারা যাচ্ছ তা হলে তোমার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটেকুটে নেওয়া হবে। তোমার কিছু ক্লোন তৈরি হবে। ক্লোন তৈরি হতে সময় নেয় সেটাই হচ্ছে সমস্যা।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমি রাজি নই।

কিসের রাজি নও?

আমাকে নিয়ে পরীক্ষা করায়। আমি কোনো রেট্রো ভাইরাসে আক্রান্ত হব না।

রোবটটি এক পা এগিয়ে বলল, তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না। এখানে তোমার ইচ্ছের কোনো মূল্য নেই। মহামান্য গ্রুটাস যেভাবে চান সেভাবেই হবে।

কোথাও কিছু গোলমাল হয়েছে। আমি বললাম, আমাকে তোমরা এভাবে হত্যা করতে পারবে না। আমি সারা পৃথিবীতে অতিমানবীর টিস্যু ছড়িয়ে রেখেছি। আমাকে

মিথ্যাবাদী! রোবটটি শান্ত গলায় বলল, তোমার মাথায় একটা ট্রাকিওশান লাগানো ছিল, আমরা জানতাম না। তুমি যখন অচেতন ছিলে আমরা সেটা বের করে এনেছি।

বের করে এনেছ? তার মানে আমার মাথায় এখন ট্রাকিওশান নেই?

না। আমরা সেই ট্রাকিওশানটিকে বিশ্লেষণ করেছি। সেটি সব কথা স্বীকার করেছে। সে বলেছে তুমি সারা পৃথিবীতে অতিমানবীদের টিস্যু ছড়িয়ে দাও নি। তুমি অতিমানবীদের জীবকোষ বাঁচিয়ে রাখ নি। তুমি প্রতিরক্ষা দপ্তরকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছ, নানা কেন্দ্রে জীবকোষ সংরক্ষণের ভান করেছ।

আমি হতচকিত হয়ে রোবটটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। প্রতিরক্ষা দপ্তরের বিরুদ্ধে আমার এবং অতিমানবীদের নিরাপত্তার পুরো ব্যাপারটি নির্ভর করেছিল এই ছলনাটির ওপর। সেটি ধরা পড়ে গেলে আমাদের রক্ষা করবে কে?

রোবটটি একটু এগিয়ে এসে বলল, তুমি মিথ্যাবাদী। আমরা মিথ্যাবাদীদের কঠোর শাস্তি দিই। মহামান্য গ্রুটাস তোমাকে কঠোর শাস্তি দেবেন। শাস্তি দেওয়ার আগে তোমার ওপর এই পরীক্ষাটি করতে চান। আমরা আশা করছি এই পরীক্ষায় তোমার যেন মৃত্যু না হয়।

না। আমি অক্ষম আক্রোশে চিৎকার করে বললাম, না! তোমরা সেটা করতে পার না।

মহামান্য গ্রুটাস ঠিকই বলেছেন। মানুষমাত্রই নির্বোধ।

আমি চিৎকার করে বললাম, আমাকে ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও।

তুমি বুঝতে পারছ না। এই পরীক্ষাগারে সত্যিকার মানুষ খুব দুষ্প্রাপ্য জিনিস। তোমাকে কিছুতেই ছাড়া যাবে না। রিগা কম্পিউটারের সাথে ষড়যন্ত্র না করেই তোমাকে ব্যবহার করা যাবে। তুমি একই সাথে বড় অপরাধী।

আমি ছটফট করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললাম, ছেড়ে দাও আমাকে, ছাড়।

রোবটটি আরেকটু এগিয়ে এসে বলল, তুমি মিছেমিছি ছটফট করছ। আমি তোমার দেহে প্রবেশ করানোর জন্য রেট্রো ভাইরাসটি নিয়ে এসেছি। তুমি স্থির হয়ে শুয়ে থাকলে আমি ভাইরাসটি তোমার রক্তে মিশিয়ে দেব।

সরে যাও। আমি চিৎকার করে বললাম, সরে যাও।

নির্বোধ মানুষ

আর এক পা এগিয়ে এলে আমি তোমাকে শেষ করে দেব। ধ্বংস করে দেব।

তুমি শুধু মিথ্যাবাদী নও। তুমি বাকসর্বস্ব একজন নিষ্ফল মানুষ। তুমি নির্বোধ এবং দুর্বল। মানুষ জাতির বড় দুর্ভাগ্য যে গ্রুটাসের মতো মানুষের সংখ্যা এত কম।

রোবটটি আরেকটু এগিয়ে আসতেই আমি তার হাতে লাল রঙের সিরিজটি দেখতে পেলাম। আমি চিৎকার করে বললাম, আর আমার কাছে আসবে না। ধ্বংস করে দেব।

রোবটটি আমার কথা না শুনে আরেকটু এগিয়ে আসতেই আমি মুখের ভিতরে রাখা বিস্ফোরকটি ছুঁড়ে দিলাম। মুখ থেকে প্রচণ্ড বেগে ছোট ক্ষেপণাস্ত্রটি বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমি একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি অনুভব করলাম। ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে সমস্ত ঘর কেঁপে উঠল, অন্ধকার হয়ে এল চারদিক, ধোঁয়া সরে যেতেই দেখতে পেলাম ঘরের দেয়ালে কয়েক মিটার ব্যাসের একটি ফুটো। রোবটটিকে কোথাও দেখতে পেলাম না। সম্ভবত প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ভস্মীভূত হয়ে গেছে, শুধু তার একজোড়া পা অনিয়ন্ত্রিতভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বিস্ফোরণের কারণেই কি না জানি না আমি নিজেও ঘরের একমাথায় ছিটকে সরে এসেছি, শরীরের বাঁধনও খুলে গেছে হঠাৎ। আমি শরীরের ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। চারদিকে প্রচণ্ড হইচই হচ্ছে, লোকজন–রোবট ছোটাছুটি করছে। আমার দিকে চার হাতের কয়েকজন মানুষ ছুটে এল। আমি হাত তুলে ডাকলাম একজনকে, বললাম, আমাকে গ্রুটাসের কাছে নিয়ে যাও। যদি না নাও তা হলে তোমাদের ল্যাবরেটরির বাকি যেটুকু আছে সেটুকুও আমি উড়িয়ে দেব।

কেন উড়িয়ে দেব, কীভাবে উড়িয়ে দেব মানুষটি সেই যুক্তিতর্কে না গিয়ে মাথা নুইয়ে আমাকে অভিবাদন করে বলল, চলুন, এই পথে।

আমি মানুষটির পিছু পিছু হেঁটে যেতে থাকি। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সমস্ত ল্যাবরেটরি তছনছ হয়ে গেছে, স্থানে স্থানে ভাঙা দেয়াল আসবাবপত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। বিচিত্র ধরনের নানারকম আধা–মানুষ আধা–প্রাণী ভয় পেয়ে ছোটাছুটি করছে, আবার ধ্বংসস্তূপের মাঝে পুরোপুরি নির্লিপ্ত হয়ে কেউ কেউ বসে আছে। বড় একটা করিডোর ঘুরে আমি গ্রুটাসের হলঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। চার হাতের মানুষটি দরজা খুলে আমাকে ভিতরে ঢুকতে দিল।

আমি ভিতরে ঢুকতেই গ্রুটাস সরসর করে ঘরের মাঝামাঝি সরে গিয়ে বলল, তুমি কী চাও আমার কাছে?

তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে যে অতিমানবীদের সাধারণ মানুষে পাল্টে দেবে। আমি জানতে এসেছি তার কত দূর।

গ্রুটাস কোনো কথা না বলে আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি দাঁতে দাঁত ঘষে বললাম, আমি তোমার একটি রোবটের সাথে রেট্রো ভাইরাস ল্যাবরেটরির বড় অংশ ধ্বংস করে এসেছি। আমার শরীরের ভিতরে এখনো যে পরিমাণ বিস্ফোরক রয়েছে সেটা দিয়ে তোমার এই পুরো হলঘর উড়িয়ে দিতে পারি।

আমি জানি।

তা হলে আমার কথার উত্তর দাও। তুমি কি তোমার কথা রাখবে? নাকি আমি তোমার ঐ বিদঘুঁটে মাথাসহ পুরো ঘরটি উড়িয়ে দেব?

গ্রুটাস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি দুঃখিত কিরি। তুমি একটু দেরি করে ফেলেছ।

কী হয়েছে? আমি ভয় পাওয়া গলায় বললাম, আমি কিসের জন্য দেরি করে ফেলেছি?

নয় জন অতিমানবীকে আমি একটা বিশেষ পরীক্ষায় ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম। তারা রাজি হয় নি। তারা স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নিয়েছে।

স্বেচ্ছামৃত্যু?

হ্যাঁ। আমি তাদেরকে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিতে দিতে পারি না। আমি তাই আমার টেকনিশিয়ানদের নির্দেশ দিয়েছি তাদের শরীরকে বিকল করে দিতে। ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রায় নিয়ে সমস্ত শারীরিক কাজকর্ম বন্ধ করে দেওয়া হবে।

কেন? কেন তুমি তাদের কষ্ট দিচ্ছ?

আমি, আমি—

তুমি কী?

আমি তাদের মস্তিষ্ককে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। তাদের ভিতরে বিচিত্র সব অনুভূতি খেলা করে, সেগুলোকে লিপিবদ্ধ করার আগে তাদেরকে কিছুতেই স্বেচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করতে দেওয়া হবে না।

আমি ঘুরে পিছনে তাকালাম। চার হাতের মানুষটি তখনো দাঁড়িয়ে ছিল, আমি তার একটি হাত ধরে ঘুরিয়ে চাপ দিতেই সে ভয়ংকর যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। আমি দাঁত দাঁত ঘষে বললাম, আমি ইচ্ছে করলে তোমার হাত মুচড়ে খুলে আনতে পারব–সেটা করতে চাই না। এক্ষুনি আমাকে অতিমানবীদের কাছে নিয়ে চল। এক্ষুনি।

নিচ্ছি। মানুষটি কাতর গলায় বলল, এক্ষুনি নিচ্ছি।

আমি মানুষটিকে ঠেলে ঘর থেকে বের করার আগে ঘুরে গ্রুটাসের দিকে তাকিয়ে। বললাম, গ্রুটাস তুমি শুনে রাখ। আমাকে কথা দিয়ে সেই কথা না রাখার জন্য আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করব না। কখনো না।

আমি চার হাতের মানুষটির হাত মুচড়ে পিছন দিকে ধরে রেখে তার পিছু পিছু ছুটে যেতে থাকি, আমার মনে হতে থাকে আমি পৌঁছানোর আগেই ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যাবে এবং আমার সাথে আর কখনো লাইনার দেখা হবেনা!

চার হাতের মানুষটি আমাকে একটা ঘরের সামনে দাঁড় করিয়ে বলল, এখানে আছে সবাই।

আমি মানুষটিকে ছেড়ে দিয়ে লাথি মেরে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেলাম। ঘরের ভিতর সারি সারি কালো ক্যাপসুল সাজানো, উপরে ক্রায়োজেনিক পাম্প মৃদু গুঞ্জন করছে। ক্যাপসুলগুলোর পাশে কিছু রোবট, কিছু সাদা পোশাক পরা রোবটের মতো মানুষ। দরজা খোলার শব্দ শুনে সবাই ঘুরে তাকাল। আমি দুই পা ছড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, যে যেখানে আছ সেখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক।

কাছাকাছি পঁড়িয়ে থাকা একটি রোবট একটু এগিয়ে এসে যান্ত্রিক গলায় বলল, এই ঘরে মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। তুমি প্রবেশ করে প্রতিরক্ষা দপ্তরের বড় একটি নিয়ম ভঙ্গ করেছ। তোমাকে

আমি রোবটটিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে চিৎকার করে বললাম, আমার হাতের মাঝে যে পরিমাণ বিস্ফোরক রয়েছে সেটা ব্যবহার করে আমি ইচ্ছা করলে এ রকম দুই চারটে ল্যাবরেটরি উড়িয়ে দিতে পারি। একটু আগে আমি রেট্রো ভাইরাস ল্যাবরেটরিটা উড়িয়ে দিয়ে এসেছি, তোমরা হয়তো সেটা এখানে বসে টের পেয়ে থাকবে।

রোবটটি যান্ত্রিক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, পেয়েছি।

আমার কথা না শুনলে আমি এই মুহূর্তে তোমাদের ধ্বংস করে দেব।

রোবটের মতো দেখতে একজন মানুষ এগিয়ে এসে শুষ্ক গলায় বলল, তুমি কী চাও?

এই ক্রায়োজেনিক পাম্প বন্ধ করে অতিমানবীদের দেহ উষ্ণ করে তোল। আমি তাদের সাথে কথা বলতে চাই।

সেটি সম্ভব নয়।

সেটি সম্ভব করতে হবে।

রোবটের মতো দেখতে মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, সেটি কিছুতেই সম্ভব নয়।

আমি আমার হাতটি ক্রায়োজেনিক পাম্পের দিকে লক্ষ্য করে মাংসপেশি ব্যবহার করে একটি ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটালাম। হাতের যে অংশটি দিয়ে ক্ষুদ্র কিন্তু শক্তিশালী বিস্ফোরকটি বের হয়ে এসেছে সেখান থেকে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছিল, আমি সাবধানে সেটা চেপে ধরে রেখে উপরের দিকে তাকালাম, একটু আগে যেখানে একটি বিশাল ক্রায়োজেনিক পাম্প ছিল এখন সেখানে একটি বিশাল গর্ত। সারা ঘরে বিস্ফোরণের ধ্বংসপ্প ছড়িয়ে পড়ছে। আমি রোবটের মতো মানুষটির দিকে তাকিয়ে বললাম, এখন কি সম্ভব হয়েছে?

মানুষটি তার উপর থেকে ধুলোবালি ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, হ্যাঁ। সম্ভব হয়েছে। অতিমানবীদের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করবে এক্ষুনি।

আমি তাদের সাথে কথা বলতে চাই।

তারা স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছে। তোমার কথা শুনবে না।

আমি তবু কথা বলতে চাই।

সেটি সম্ভব নয়।

আমি আমার হাত উদ্যত করে বললাম, আমার হাতে এখনো আরো একটি বিস্ফোরক রয়েছে।

মানুষটি হঠাৎ দ্রুত কাছাকাছি একটা ক্যাপসুলের পাশে রাখা একটি মাইক্রোফোন। আমার হাতে তুলে দিল। বলল, তুমিই চেষ্টা কর।

আমি মাইক্রোফোনটি হাতে নিয়ে ডাকলাম, লাইনা, তুমি কোনজন?

সারি সারি রাখা নয়টি ক্যাপসুলে নয়টি অতিমানবীর শীতল দেহ, তার মাঝে কোনোটি সাড়া দিল না। আমি আবার বললাম, আমি জানি তুমি আমার কথা শুনছ। তুমি সাড়া দাও লাইনা।

কেউ সাড়া দিল না। আমি কাতর গলায় বললাম, লাইনা, আমি ক্রায়োজেনিক পাম্পটি ধ্বংস করে দিয়েছি। আমি জানি তোমাদের দেহ ধীরে ধীরে উষ্ণ হয়ে উঠছে। তোমাদের জেগে উঠতে হবে লাইনা। তোমাদের বেঁচে উঠতে হবে। তোমাদের ওপর যে ভয়ঙ্কর অবিচার করা হয়েছে তার প্রতিকার না করে তোমরা চলে যেতে পারবে না। কিছুতেই চলে যেতে পারবে না।

নয়টি ক্যাপসুলে নয় জন অতিমানবী নিথর হয়ে শুয়ে রইল। আমি একটি একটি করে সব কয়টি ক্যাপসুলের সামনে দাঁড়ালাম, কোনোটির মাঝে এতটুকু প্রাণের চিহ্ন নেই। মাইক্রোফোন হাতে আমি চিৎকার করে উঠলাম, লাইনা, সোনা আমার। জেগে ওঠ। দোহাই তোমার–জেগে ওঠ।

কেউ জেগে উঠল না। আমি ভাঙা গলায় বললাম, তোমরা নয় জন অতিমানবী, তোমাদের মস্তিষ্ক হবহু এক পর্যায়ে, তোমাদের প্রত্যেকের প্রতিটি নিউরন একরকম, তার মাঝে তথ্য একরকম। প্রতিটি সিনান্স একইভাবে জুড়ে আছে–সারা পৃথিবীতে এর থেকে বড় সুষম উপস্থাপন কি আর কোথাও আছে? নেই! একটিও নেই! তোমরা ইচ্ছে করলে অসাধ্য সাধন করতে পার। নয় জন একসাথে যদি তোমাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক তরঙ্গকে উজ্জীবিত কর, কী ভয়ঙ্কর রেজোনেন্স হবে তোমরা জান? একটিবার চেষ্টা করে দেখ–মাত্র একটিবার! ইচ্ছে করলে তোমরা সারা পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করতে পার। তা হলে কেন এত বড় একটা অবিচার সহ্য করে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছ? কেন?

আমি ক্যাপসুলগুলোর মাঝে খ্যাপার মতো ঘুরে বেড়ালাম। তাদের ঢাকনা টেনে খোলার চেষ্টা করলাম। ক্যাপসুলগুলো ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে নাড়ানোর চেষ্টা করলাম, মুখ লাগিয়ে চিৎকার করে কথা বলার চেষ্টা করলাম, কোনো লাভ হল না। আমি বুকের ভিতরে এক ভয়াবহ শূন্যতা অনুভব করতে থাকি, ইচ্ছে হতে থাকে ক্যাপসুলে মাথা কুটে আকুল হয়ে কঁদি, কিন্তু আমি তার কিছুই করলাম না। ঘরে অসংখ্য রোবট এবং রোবটের মতো মানুষ আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, তাদের সামনে ব্যথাটুকু প্রকাশ করতে আমার সংকোচ হল।

আমি একসময় চোখ মুছে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। এই ভয়ঙ্কর অবিচারের প্রতিশোধ আমার একাই নিতে হবে। আমার হাতে এখনো দ্বিতীয় বিস্ফোরকটি রয়ে গেছে, সেটি দিয়েই আমি গ্রুটাসকে হত্যা করব। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি চিৎকার করে বলব, তুমি একজন দানব। পৃথিবীর বাতাসে নিশ্বাস নিয়ে তাকে তুমি কলুষিত করতে পারবে না। তারপর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে আমি তাকে ছিন্নভিন্ন করে দেব। তার কুৎসিত দেহ, বীভৎস মস্তিষ্ক আমি চূর্ণ করে দেব।

আমি শেষবার একবার কালো স্টেনলেস স্টিলের ক্যাপসুলে হাত বুলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। ল্যাবরেটরিতে এখনো আধা–মানুষ আধা–যন্ত্র বিচিত্র প্রাণীরা ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছে, আমাকে দেখে সেগুলো ভয়ে ছিটকে সরে গেল। আমি পাথরের মতো মুখ করে সোজা হেঁটে গেলাম গ্রুটাসের সাথে শেষ বোঝাপড়া করতে।

.

গ্রুটাসকে দেখে মনে হল সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ঘরের মাঝামাঝি সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেও সে একটি কথাও বলল না। আমি কঠোর গলায় বললাম, গ্রুটাস।

বল।

তুমি কি নিজেকে মানুষ বলে দাবি কর?

দুর্ভাগ্যক্রমে করি। আমার ক্রমোজম ৪৬টি।

মানুষের একটি সংজ্ঞা আছে গ্রুটাস। সেটি হচ্ছে পরস্পর পরস্পরের জন্য ভালবাসা। তোমার মাঝে তার এতটুকুও নেই।

অপ্রয়োজনীয় অনুভূতি কোনো কাজে আসে না।

তুমি মানুষ নও গ্রুটাস। তুমি পশুও নও। তুমি একটি তুচ্ছ কলকব্জা। তুচ্ছ যুক্তিতর্ক। তুচ্ছ নিয়মকানুন। এই পৃথিবীতে তোমার কোনো প্রয়োজন নেই।

সেটি ব্যক্তিগত বিশ্বাস–অবিশ্বাসের ব্যাপার।

তোমার এই তুচ্ছ জীবনকে আমি শেষ করে দেব গ্রুটাস। আমি তোমাকে হত্যা করতে এসেছি।

আমারও তাই ধারণা। গ্রুটাস ভেসে ভেসে খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, তুমি চেষ্টা করে দেখতে পার।

আমি আমার হাতটি উদ্যত করতে গিয়ে থেমে গেলাম, গ্রুটাস হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল। এই প্রথম আমি এ প্রাণীটিকে হাসতে দেখলাম। গ্রুটাস হাসতে হাসতে বলল, তুমি প্রথমবার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছ, আমরা সেটা থামাতে পারি নি। দ্বিতীয়বারও পারি নি তার অর্থ এই নয় যে, আমি তোমাকে তৃতীয়বার এখানে বিস্ফোরণ ঘটাতে দেব।

গ্রুটাস হঠাৎ সরসর করে আমার একেবারে কাছে এসে হাজির হল, আমি তার হলুদ চোখ, চোখের ফুলে ওঠা রক্তনালী পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পেলাম। সে ষড়যন্ত্রীদের মতো নিচু গলায় বলল, এই মুহূর্তে ঘরের চারপাশে চারটি প্রতিরক্ষা ডিভাইস তোমার হাতের মাঝে লুকানো বিস্ফোরকটিকে লক ইন করে আছে। তোমার হাত যদি এক সেন্টিমিটার উপরে ওঠাও চারটি এক শ মেগাওয়াটের আই. আর. লেজার তোমাকে ভস্মীভূত করে দেবে।

গ্রুটাস ভেসে ভেসে আমার আরো কাছে চলে এল, আমি তার কুঞ্চিত চামড়া, চুলহীন বীভৎস মাথা, মাথার ভিতরে নড়তে থাকা যন্ত্রাংশ স্পষ্ট দেখতে পেলাম, কটু গন্ধে হঠাৎ আমার সারা শরীর গুলিয়ে এল। গ্রুটাস প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমার কথা বিশ্বাস না করলে তুমি চেষ্টা করে দেখতে পার। আমি তোমার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছি কিরি। আমি শুনেছি তুমি নাকি চিতাবাঘের চাইতেও ক্ষিপ্র।

আমি এতটুকু না নড়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বিকৃত দেহের এই মানুষটার প্রতি একটা অচিন্তনীয় ঘৃণা আমার ভিতরে পাক খেতে থাকে, ভয়ঙ্কর বিজাতীয় একটা ক্রোধ এবং আক্রোশ আমার সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে থাকে। ইচ্ছে করতে থাকে সত্যি সত্যি আমি চিতাবাঘের মতো এই কুৎসিত প্রাণীটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। টুটি চেপে ধরে তার বীভৎস মস্তিষ্ক মেঝেতে ঠুকে ঠুকে ভিতর থেকে থলথলে ঘিলুটাকে বের করে আনি।

কিরি তুমি শান্ত হও। আমি চমকে উঠলাম, কে আমার মস্তিষ্কের মাঝে কথা বলছে?

তুমি নিজেকে সংবরণ কর কিরি।

কে কথা বলছে? আমার মাথা থেকে তো ট্র্যালিওশান সরিয়ে নিয়েছে। এখন তো আর কিছুই সরাসরি আমার মস্তিষ্কে কথা বলতে পারবে না। কে কথা বলছে? তা হলে কি অতিমানবীরা নিজেদের মুক্ত করে চলে এসেছে?

দরজায় একটা মৃদু শব্দ হল এবং আমি মাথা ঘুরে তাকালাম, দেখতে পেলাম ধীর পদক্ষেপে এক জন এক জন করে নয় জন অতিমানবী ঘরে এসে ঢুকছে। তাদের মুখমণ্ডল শান্ত, সেখানে এক ধরনের স্নিগ্ধ কোমলতা।

কিরি, নিজেকে শান্ত কর। আমি আবার শুনতে পেলাম কেউ একজন বলল, আমি লাইনা।

লাইনা! আমি আনন্দে চিৎকার করতে গিয়ে থেমে গেলাম, এই ঘরে চারটি এক শ মেগাওয়াট আই. আর. লেজার আমার দিকে তাক করা আছে, ইচ্ছে করলেই আমাদের ভস্মীভূত করে দেবে।

নয় জন অতিমানবী খুব শান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে হেঁটে আমার দুপাশে এসে দাঁড়াল। আমি কাঁপা গলায় বললাম, খুব সাবধান। চারটি আই. আর. লেজার–

কোনো ভয় নেই। ঠিক আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অতিমানবীটি বলল, গ্রুটাসের মস্তিষ্ক এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে। তুমি সত্যি কথাই বলেছিলে কিরি। আমরা নয় জন যখন আমাদের মস্তিষ্কের সুষম উপস্থাপন করি ভয়ঙ্কর রেজোনেন্স হয় তখন যা ইচ্ছে করতে পারি আমরা।

তোমরা সত্যিই গ্রুটাসকে নিয়ন্ত্রণ করছ? সত্যি?

হ্যাঁ। শুধু গ্রুটাস নয়, এই ল্যাবরেটরির সকল জীবিত প্রাণীকে নিয়ন্ত্রণ করছি। ইচ্ছে করলে তোমাকেও করতে পারি, কিন্তু তার তো কোনো প্রয়োজন নেই।

আমি হেসে বললাম, না, আমি যেটুকু জানি তাতে মনে হয় প্রয়োজন নেই।

তোমার ধারণা সত্যি কিরি। আমরা সবাই মিলে একটা অস্তিত্ব সেটি আমরা জানতাম কিন্তু আমাদের সবার মস্তিষ্ক যে একসাথে সুষম উপস্থাপন করতে পারে আমরা সেটা জানতাম না। এখন আমরা সেটা করছি। আমাদের এখন কী ভয়ঙ্কর শক্তি তুমি চিন্তাও করতে পারবে না।

আমি জানি। আমি অনুভব করতে পারছি।

আমরা ইচ্ছে করলে পৃথিবীর যে কোনো জীবিত প্রাণীর মস্তিষ্কে প্রবেশ করে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। সেটাকে পরিবর্তন করতে পারি। মস্তিষ্কের নিউরন থেকে তথ্য মুছে দিতে পারি, সিনান্সের জোড় খুলে দিতে পারি। ইচ্ছে করলে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন থামিয়ে দিতে পারি, ফুসফুসকে নিথর করে দিতে পারি। আমরা যদি চাই এই মুহূর্তে গ্রুটাসকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারি।

আমি জানি।

আমরা অতিমানবী। কিন্তু এই পৃথিবী, পৃথিবীর সভ্যতা অতিমানবীর জন্য তৈরি হয় নি। আমরা এখানে অনাহুত। মা–বাবার ভালবাসায় আমরা জন্ম নিই নি, মা–বাবার ভালবাসায় বড় হই নি। কিন্তু মা–বাবার ভালবাসায় সিক্ত হওয়া সেই জিন আমাদের মাঝে রয়ে গেছে। আমরা ভালবাসার জন্য, স্নেহের জন্য কাঙাল–একটি কোমল কথার জন্য তৃষ্ণার্ত, কিন্তু সমস্ত পৃথিবীতে আমরা বড় নিঃসঙ্গ। আমাদেরকে এতটুকু স্নেহ দেবার জন্য কেউ নেই।

আছে। নিশ্চয়ই আছে। আমি ব্যাকুল হয়ে বললাম, আমি আছি।

আমরা জানি তুমি আছ। তোমার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ কিরি। অতিমানবীদের ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ জগতে তুমি আমাদের একমাত্র বন্ধু

যে মেয়েটি কথা বলছিল সে একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, মানুষের শরীরের সীমাবদ্ধতা আমাদের নেই। আমাদের দেহে অচিন্তনীয় শক্তি, পরিচিত রোগ–শোক আমাদের স্পর্শ করতে পারে না, অল্প একটু খাবারে আমরা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারি, একটু অক্সিজেনেই আমাদের চলে যায়। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন থেকে বেঁচে থাকতে পারি, আমরা চিতাবাঘের চাইতেও ক্ষিপ্র, মত্ত হাতি থেকেও শক্তিশালী। তুমি একটু আগে আমাদের নতুন শক্তির সন্ধান দিয়েছ, মস্তিষ্কের সুষম উপস্থাপন করে এখন আমরা অন্যের মনকেও নিয়ন্ত্রণ। করতে পারি। এই পৃথিবীতে আমাদের বাধা দেবার কেউ নেই। আমরা ইচ্ছে করলে পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে অতিমানব জাতি সৃষ্টি করতে পারি।

আমি হতবাক হয়ে নয় জন অতিমানবীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটি আবার বলল, পৃথিবীতে মানবজাতির জন্য এর চেয়ে বড় আশঙ্কার ব্যাপার কিছু ঘটে নি।

কিন্তু 

হ্যাঁ। কিন্তু আমাদের প্রকৃত জিন মানুষ থেকে এসেছে। মানুষের জন্য আমাদের প্রকৃত ভালবাসা। মানুষকে রক্ষাও করব আমরা।

কী করবে তুমি? তোমরা?

আমরা নিজেদের ধ্বংস করে ফেলব। শুধু নিজেদের নয়, এই ল্যাবরেটরিকে, এর প্রতিটি তথ্যকে।

না। আমি চিৎকার করে বললাম, না লাইনা।

আমাদের কোনো উপায় নেই কিরি।

তা হলে তোমরা কেন জেগে উঠে এসেছ?

তোমার জন্য। গ্রুটাসের নৃশংস থাবা থেকে তোমাকে উদ্ধার করে নিরাপদে এখান থেকে সরিয়ে দেবার জন্য। প্রতিরক্ষা দপ্তর যেন আর কখনো তোমাকে স্পর্শ না কতে পারে সেটি নিশ্চিত করার জন্য।

না। আমি কাতর গলায় বললাম, আমি যাব না। লাইনাকে না নিয়ে আমি যাব না।

নয় জন অতিমানবী কোমল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমি জানি না এর মাঝে কোনজন লাইনা। কিংবা কে জানে যখন নয় জন অবিকল ক্লোন তাদের মস্তিষ্কে অবিকল একই তথ্য নিয়ে থাকে তখন এই প্রশ্নটির আদৌ কোনো অর্থ আছে কি না। আমি তাদের মুখের দিকে তাকালাম, একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, তোমরা ইচ্ছে করলে আমার মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন খুলে দেখতে পার। দেখ, তোমরা দেখ। আমার নিজের চেয়ে তোমরা বেশি জান আমি লাইনাকে ছাড়া থাকতে পারব না।

নয় জন অতিমানবী থেকে এক জন হঠাৎ আমার দিকে এগিয়ে এল, হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে, কোমল গলায় বলল, কিরি। আমি লাইনা।

লাইনা! আমি তাকে জাপটে ধরে বুকের মাঝে টেনে নিলাম। তার রেশমের মতো চুলে মুখ গুঁজে বললাম, লাইনা, সোনা আমার।

আমি আরো অনেক কথা বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু তার কিছুই বলতে পারলাম না, হঠাৎ এক ভয়াবহ শূন্যতায় আমার হৃদয়–মন হাহাকার করে ওঠে।

লাইনা মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। তার চোখে চিকচিক করছে পানি। দুই হাতে আমার মাথাকে ধরে নিজের মুখের কাছে টেনে এনে ফিসফিস করে বলল, কিরি, এই নয় জন অতিমানবীর মাঝে থেকেও আমি আলাদা। আমি একজন অতিমানবী যে তোমার আসল ভালবাসাটুকু পেয়েছি। সেই ভালবাসা আমি অন্যদের মাঝে সঞ্চারিত করেছি। আমাদের এই ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ জীবনে তোমার ভালবাসাটুকু একমাত্র সুখের স্মৃতি।

আমি লাইনার অনিন্দ্যসুন্দর মুখমণ্ডলে হাত দিয়ে স্পর্শ করে কাতর গলায় বললাম, লাইনা, তুমি যেও না। তুমি আমার সাথে চল।।

না কিরি। লাইনা অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, তুমি আমাকে এ কথা বোলো না, আমার শেষ সময়টুকু তুমি আরো কঠিন করে দিও না।

আমি ভাঙা গলায় বললাম, লাইনা, সোনা আমার! তুমি চল আমার সাথে। দূর নির্জন এক দ্বীপে শুধু তুমি আর আমি থাকব। পৃথিবীর মানুষ জানবে না। শুধু তুমি আর আমি। তুমি আর আমি। 

লাইনা হাত দিয়ে চোখ মুছে বলল, আমাকে এভাবে বোলো না। এভাবে লোভ দেখিও না কিরি। আমাকে স্বার্থপরের মতো শুধু নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখিও না।

তা হলে আমি কী নিয়ে থাকব?

লাইনা আমাকে গভীর ভালবাসায় আলিঙ্গন করে বলল, আমার চোখের দিকে তাকাও কিরি।

আমি লাইনার চোখের দিকে তাকালাম। লাইনা ফিসফিস করে বলল, তোমার সব দুঃখ আমি ভুলিয়ে দেব কিরি। আমাকে নিয়ে তোমার সব স্মৃতি আমি মুছে দেব।

না। আমি ভুলতে চাই না। আমি চিৎকার করে বললাম, আমি ভুলতে চাই না।

তোমাকে ভুলতে হবে কিরি। আমি একজন অতিমানবী–অতিমানবীর স্মৃতি তুমি নিজের মাঝে রেখো না।

না। লাইনা। না—

আমার চোখের দিকে তাকাও কিরি।

আমি লাইনার চোখের দিকে তাকালাম। কী অপূর্ব আয়ত কালো দুটি চোখ–সেই চোখে চিকচিক করছে পানি। চোখের মাঝে কী বিস্ময়কর গভীরতা! আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি, তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটি গভীর বেদনায় আমার বুক দুমড়ে–মুচড়ে যেতে থাকে। সেই অপূর্ব কালো গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার মনে হতে থাকে আমি বুঝি সেই চোখের গভীরে প্রবেশ করে যাচ্ছি। মনে হতে থাকে সেই গভীরে এক বিশাল শূন্যতা। মনে হয় আদি নেই, অন্ত নেই এক বিশাল বেলাভূমিতে আমি দাঁড়িয়ে আছি, সমুদ্রের কল–কল্লোল ভেসে আসছে দূর থেকে। নীল মহাসমুদ্রের ঢেউ ভেসে এসে একের পর এক আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে, সিক্ত হয়ে যাচ্ছে আমার পা। আমি মাথা তুলে তাকালাম, আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে লাইনা, বাতাসে উড়ছে তার দেহের অর্ধস্বচ্ছ কাপড়। আমি ম বালুতে পা ফেলে এগিয়ে গেলাম লাইনার দিকে, লাইনা তখন সরে গেল আরো দূরে। আমি আবার এগিয়ে গেলাম–লাইনা তখন আরো দূরে সরে গেল। আমি আবার এগিয়ে গেলাম, লাইনা তখন আরো দূরে সরে গেল। আমি তাকিয়ে রইলাম, দেখতে পেলাম লাইনা চলে যাচ্ছে দূরে…..বহুদূরে, আমি তাকে ধরতে পারছি না। দূরদিগন্তে সে মিশে যাচ্ছে মিলিয়ে যাচ্ছে চিরদিনের জন্য। বালুবেলায় আমি হাঁটু ভেঙে পড়ে যাচ্ছি। সমুদ্রের পানি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাকে। ঢেউয়ের পর ঢেউ আসছে। এক গভীর শূন্যতায় আমি হারিয়ে যাচ্ছি, এক ভয়াবহ নিঃসঙ্গতায় আমি ডুবে যাচ্ছি। হারিয়ে যাচ্ছি এক অন্ধকারে–এক নির্জনতায়–এক নিসঙ্গতায়…

শেষ কথা

উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ের পাদদেশে গভীর অরণ্যে প্রতিরক্ষা দপ্তরের একটি গোপন ল্যাবরেটরি ভয়ঙ্কর একটি অগ্নিকাণ্ডে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। ল্যাবরেটরির কাছাকাছি অরণ্যে একজন অপ্রকৃতিস্থ স্মৃতিশক্তিহীন যুবককে পাওয়া যায়, তার হাতে একটি অস্ত্রোপচারের চিহ্ন। যুবকটির নাম কিরি, সে কেন এখানে এসেছে জানে না। কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটি অনুসন্ধান করে দেখছে।