৫১*
আবু পাহাড়
৩০ এপ্রিল, ১৮৯১
প্রিয় গোবিন্দ সহায়,
তুমি কি সেই ব্রাহ্মণ বালকটির উপনয়ন সম্পন্ন করিয়াছ? তুমি সংস্কৃত পড়িতেছ কি? কতদূর অগ্রসর হইলে? আশা করি প্রথমভাগ নিশ্চয়ই শেষ করিয়া থাকিবে। … তুমি শিবপূজা সযত্নে করিতেছ তো? যদি না করিয়া থাক তো করিতে চেষ্টা করিও। ‘তোমরা প্রথমে ভগবানের রাজ্য অন্বেষণ কর, তাহা হইলেই সব পাইবে।’ ভগবানকে অনুসরণ করিলেই তুমি যাহা কিছু চাও পাইবে। … কম্যাণ্ডার সাহেবদ্বয়কে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাইবে; তাঁহারা উচ্চপদস্থ হইয়াও আমার ন্যায় একজন দরিদ্র ফকিরের প্রতি বড়ই সদয় ব্যবহার করিয়াছিলেন। বৎসগণ, ধর্মের রহস্য শুধু মতবাদে নহে, পরন্তু সাধনার মধ্যে নিহিত। সৎ হওয়া এবং সৎ কর্ম করাতেই সমগ্র ধর্ম পর্যবসিত। “যে শুধু ‘প্রভু প্রভু’ বলিয়া চীৎকার করে সে নহে, কিন্তু যে সেই পরমপিতার ইচ্ছানুসারে কার্য করে, সেই ধার্মিক।” তোমরা আলোয়ারবাসী যে কয়জন যুবক আছ, তোমরা সকলেই চমৎকার লোক, এবং আশা করি যে অচিরেই তোমাদের অনেকেই সমাজের অলঙ্কারস্বরূপ এবং জন্মভূমির কল্যাণের হেতুভূত হইয়া উঠিবে। ইতি
আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
পুঃ—যদিই বা মাঝে মাঝে সংসারে এক-আধটু ধাক্কা খাও, তথাপি বিচলিত হইও না; নিমিষেই উহা চলিয়া যাইবে এবং পুনরায় সব ঠিকঠাক হইয়া যাইবে।
৫২*
আবু পাহাড়, ১৮৯১
প্রিয় গোবিন্দ সহায়,
মন যে দিকেই যাউক না কেন, নিয়মিত জপ করিতে থাকিবে। হরবক্সকে বলিও যে, সে যেন প্রথমে বাম নাসায়, পরে দক্ষিণ নাসায়, এবং পুনরায় বাম নাসায়, এইক্রমে প্রাণায়াম করে। বিশেষ পরিশ্রমের সহিত সংস্কৃত শিখিবে। ইতি
আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
৫৩*
[শ্রীযুক্ত হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখিত]
১৮৯১
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,২৫
আমার স্বাস্থ্য ও সুখ-সুবিধার সংবাদ লইতে আপনি যে একজন লোক পাঠাইয়াছেন, ইহা আপনার অপূর্ব সহৃদয়তা ও পিতৃসুলভ চরিত্রের একটুখানি পরিচয় মাত্র। আমি এখানে বেশ আছি। আপনার সহৃদয়তায় এখানে আর আমার কিছুরই অভাব নাই। আমি দু-চার দিনের মধ্যে আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিব বলিয়া আশা করি। এখান হইতে নামিবার সময় আমার কোন যানবাহনের প্রয়োজন নাই। অবরোহণ কষ্টসাধ্য; কিন্তু অধিরোহণ আরও কষ্টসাধ্য এবং এ কথা জগতের সব কিছু সম্বন্ধেই সমভাবে সত্য। আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করিবেন। ইতি
চির বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
৫৪*
বরোদা
২৬ এপ্রিল, ১৮৯২
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
আপনার প্রীতিপূর্ণ পত্রখানি এখানেই পেয়ে ভারী আনন্দ হল। নাড়িয়াদ ষ্টেশন থেকে আপনার বাড়ী যেতে আমার মোটেই অসুবিধা হয়নি। আপনার ভাইদের কথা কি আর বলব? আপনার ভাইদের যেমনটি হওয়া উচিত, তাঁরা ঠিক তাই! ভগবান্ আপনার পরিবারের উপর তাঁর অশেষ আশীর্বাদ বর্ষণ করুন। আমার সমস্ত পরিব্রাজক জীবনে এমন পরিবার তো আর দেখলাম না। আপনার বন্ধু শ্রীযুক্ত মণিভাই আমার সব রকম সুবিধা করে দিয়েছেন; কিন্তু তাঁর সঙ্গে মেলামেশার এইটুকু সুযোগ হয়েছে যে, আমি তাঁকে মাত্র দুবার দেখেছি—একবার এক মিনিটের জন্য, আর একবার খুব বেশী হয়তো দশ মিনিটের জন্য। দ্বিতীয়বারে তিনি এই অঞ্চলের শিক্ষাপ্রণালীর আলোচনা করেছিলেন। তবে আমি পুস্তকালয় ও রবিবর্মার ছবি দেখেছি; আর এখানে দেখবার মত এই তো আছে! সুতরাং আজ বিকালে বোম্বে চলে যাচ্ছি। এখানকার দেওয়ানজীকে (বা আপনাকেই) তাঁর সদয় ব্যবহারের জন্য আমার ধন্যবাদ জানাবেন। বোম্বে হতে সবিশেষ লিখিব। ইতি
আপনার স্নেহাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
পুনশ্চ—নাড়িয়াদে শ্রীযুক্ত মণিলাল নাভুভাই-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি অতি বিদ্বান্ ও সাধুপ্রকৃতির ভদ্রলোক। তাঁর সাহচর্যে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি।
৫৫*
পুনা
১৫ জুন, ১৮৯২
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
আপনার শেষ চিঠি পাবার পর দীর্ঘকাল কেটে গেল; আশা করি, আমি আপনার কোনরূপ বিরাগ ঘটাইনি। আমি ঠাকুরসাহেবের সহিত মহাবালেশ্বর হতে এখানে এসেছি এবং তাঁরই বাড়ীতে আছি। এখানে আরও দু-এক সপ্তাহ থাকবার ইচ্ছা আছে; তারপর হায়দরাবাদ হয়ে রামেশ্বর যাব।
ইতোমধ্যে জুনাগড়ে আপনার পথের সমস্ত বাধা হয়তো দূর হয়ে গেছে—অন্ততঃ আমার আশা তাই। আপনার স্বাস্থ্যের সংবাদ পেতে বিশেষ আগ্রহ হয়—বিশেষতঃ সেই মচকানোটার।
ভবনগরের রাজকুমারের শিক্ষক ও আপনার বন্ধু সেই সুরতি [সুরাটি?] ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়েছে—তিনি অতি সজ্জন। তাঁর পরিচয়লাভে আমি নিজেকে ভাগ্যবান্ মনে করি; তিনি বড়ই অমায়িক ও উদারপ্রকৃতির লোক।
আপনার মহামনা সহোদরগণকে এবং আমাদের ওখানকার বন্ধুবর্গকে আমার অকৃত্রিম অভিনন্দন জানাবেন। বাড়ীতে পত্র লেখার সময় দয়া করে শ্রীযুক্ত নাভুভাইকে আমার ঐকান্তিক শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করবেন। আশা করি, সত্বর উত্তর দিয়ে কৃতার্থ করবেন।
আপনাকে ও পরিবারস্থ সকলকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এবং সকলের মঙ্গল কামনা করছি। ইতি
ভবদীয়
বিবেকানন্দ
৫৬*
বোম্বে
১৮৯২
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
এই পত্রের বাহক বাবু অক্ষয়কুমার ঘোষ আমার বিশেষ বন্ধু। সে কলিকাতার একটি সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান। তার পরিবারকে আমি যদিও পূর্ব হতেই জানি, তবু তাকে দেখতে পাই খাণ্ডোয়াতে এবং সেখানেই আলাপ-পরিচয় হয়।
সে খুব সৎ ও বুদ্ধিমান্ ছেলে এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আণ্ডারগ্রাজুয়েট। আপনি জানেন যে, আজকাল বাঙলাদেশের অবস্থা কি কঠিন; তাই এই যুবকটি চাকরির অন্বেষণে বেরিয়েছে। আমি আপনার স্বভাবসুলভ সহৃদয়তার সহিত পরিচিত আছি; তাই মনে হয় যে, এ যুবকটির জন্য কিছু করতে অনুরোধ করে আমি নিশ্চয়ই আপনাকে উত্ত্যক্ত করছি না। অধিক লেখা নিষ্প্রয়োজন। আপনি দেখতে পাবেন যে, সে সৎ ও পরিশ্রমী। কোন মানুষের প্রতি একটু দয়া দেখালে তার জীবন সুখময় হয়ে উঠতে পারে, এ বালক সেই দয়ার উপযুক্ত পাত্র; আপনি মহৎ ও দয়ালু, আপনাকে একথা মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন বোধ করি না।
আশা করি, আমার এই অনুরোধে আপনি বিব্রত বা উত্ত্যক্ত হচ্ছেন না। এই আমার প্রথম ও শেষ অনুরোধ এবং বিশেষ ঘটনাচক্রে এটা করতে হল। এখন আপনার দয়ালু প্রাণই আমার আশা ও ভরসা। ইতি
ভবদীয়
বিবেকানন্দ
৫৭*
বোম্বে
২২ অগষ্ট, ১৮৯২
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
আপনার পত্র পেয়ে খুবই কৃতার্থ হলাম—বিশেষতঃ তাহাতে আমার প্রতি আপনার পূর্বের মত স্নেহের প্রমাণ পেয়ে।
আপনার ইন্দোরের বন্ধুর … সহৃদয়তা ও সৌজন্য সম্বন্ধে বেশী কিছু না বলাই ভাল। তবে অবশ্য সব দক্ষিণীই কিছু সমান নয়। আমি শঙ্কর পাণ্ডুরঙ্গকে যখন পত্রে জানিয়েছিলাম যে, আমি লিমডির ঠাকুরসাহেবের বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করেছি, তখন তিনি তার উত্তরে মহাবালেশ্বরে আমায় যা লিখেছিলেন, তা উদ্ধৃত করলেই আপনি বিষয়টা বুঝতে পারবেনঃ
‘আপনি লিমডির ঠাকুরকে ওখানে পেয়েছেন জেনে বড়ই খুশী হলাম; নতুবা আপনাকে বড়ই মুশকিলে পড়তে হত; কারণ আমরা—মারাঠারা গুজরাতীদের মত তেমন অতিথিপরায়ণ নই।’ …
আপনার গাঁটের ব্যথা এখন প্রায় সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়েছে জেনে খুব সুখী হলাম। দয়া করে আপনার ভাইকে আমার প্রতিজ্ঞাভঙ্গের জন্য মাপ করতে বলবেন। আমি এখানে কিছু সংস্কৃত বই পেয়েছি এবং অধ্যায়নের সাহায্যও জুটেছে। অন্যত্র এরূপ পাবার আশা নাই; সুতরাং শেষ করে যাবার আগ্রহ হয়েছে। কাল আপনার বন্ধু শ্রীযুক্ত মনঃসুখারামের সঙ্গে দেখা হল; তিনি তাঁর এক সন্ন্যাসী বন্ধুকে বাড়ীতে রেখেছেন। তিনি আমার প্রতি খুব সহৃদয়; তাঁর পুত্রও তাই।
এখানে পনর-কুড়ি দিন, থেকে রামেশ্বর যাবার বাসনা আছে। ফিরে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করব নিশ্চিত।
আপনার ন্যায় উচ্চমনা, মহাপ্রাণ ও দয়ালু ব্যক্তিদের দ্বারাই জগতের প্রকৃত উন্নতি হয়। অন্যেরা সংস্কৃত কবির ভাষায় ‘জননীযৌবন-বনকুঠারাঃ।’
আমার প্রতি আপনার পিতৃসুলভ স্নেহ ও যত্ন আমি মোটেই ভুলতে পারি না; আবার আমার মত একজন ফকির আপনার ন্যায় একজন মহাশক্তিমান্ মন্ত্রীর উপকারের কী প্রতিদান দিতে পারে? আমি শুধু এইটুকু প্রার্থনা করতে পারি যে, সর্বমঙ্গলবিধাতা ভগবান্ আপনাকে ইহলোকে বাঞ্ছিত সমস্ত ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ করুন; আর আপনাকে অতি দীর্ঘায়ু দান করে অবশেষে তাঁর অনন্ত মঙ্গল ও শান্তিময় পবিত্র কোলে টেনে নিন। ইতি
ভবদীয়
বিবেকানন্দ
পুনশ্চ—একটি বিষয় অতি দুঃখের সহিত উল্লেখ করছি—এ অঞ্চলে সংস্কৃত ও অন্যান্য শিক্ষার সম্পূর্ণ অভাব। এতদঞ্চলের লোকদের মধ্যে ধর্মের নামে পানাহার ও শৌচাদি বিষয়ে একরাশ কুসংস্কারপূর্ণ দেশাচার আছে—আর এগুলিই যেন তাদের কাছে ধর্মের শেষ কথা!
হায় বেচারারা! দুষ্ট ও চতুর পুরুতরা যত সব অর্থহীন আচার ও ভাঁড়ামিগুলোকেই বেদের ও হিন্দুধর্মের সার বলে তাদের শেখায় (কিন্তু মনে রাখবেন যে, এসব দুষ্ট পুরুতগুলো বা তাদের পিতৃ-পিতামহগণ গত চারশ-পুরুষ ধরে একখণ্ড বেদও দেখেনি); সাধারণ লোকেরা সেগুলি মেনে চলে আর নিজেদের হীন করে ফেলে। কলির ব্রাহ্মণরূপী রাক্ষসদের কাছ থেকে ভগবান্ তাঁদের বাঁচান!
আমি আপনার কাছে একটি বাঙালী ছেলেকে পাঠিয়েছি। আশা করি, তার প্রতি একটু সদয় ব্যবহার করবেন। ইতি
বি
৫৮*
ঈশ্বরো জয়তি
বোম্বাই
২০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯২
প্রিয় পণ্ডিতজী মহারাজ,
আমি যথাসময়ে আপনার পত্র পাইয়াছি। আমি প্রশংসার উপযুক্ত না হইলেও, আমাকে কেন যে প্রশংসা করা হয়, তাহা বুঝিতে পারি না। প্রভু যীশুর কথায় বলিতে গেলে বলিতে হয়, ‘ভাল একজন মাত্রই আছেন—স্বয়ং প্রভু ভগবানই একমাত্র ভাল।’ অপর সকলে তাঁহারই হস্তের যন্ত্রমাত্র। ‘মহতো মহীয়ান্’ পরমধামে অধিষ্ঠিত ঈশ্বর এবং উপযুক্ত ব্যক্তিগণই মহিমামণ্ডিত হউন, আমার ন্যায় অনুপযুক্ত ব্যক্তি নয়। বর্তমান ক্ষেত্রে ‘ভৃত্যটি মজুরিলাভের উপযুক্তই নহে’; বিশেষতঃ ফকিরের কোনরূপ প্রশংসালাভের অধিকার নাই। আপনার ভৃত্য যদি শুধু তাহার নির্দিষ্ট কর্তব্য করে, তবে কি সেজন্য আপনি তাহাকে প্রশংসা করেন?
আশা করি, আপনি সপরিবারে সর্বাঙ্গীন কুশলে আছেন। পণ্ডিত সুন্দরলালজী ও মদীয় অধ্যাপক২৬ যে অনুগ্রহপূর্বক আমাকে স্মরণ করিয়াছেন, সেজন্য তাঁহাদের নিকট আমি চিরকৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ।
এখন আপনাকে আমি অন্য এক বিষয় বলিতে চাইঃ হিন্দুগণ চিরকালই সাধারণ সত্য হইতে বিশেষ সত্যে উপনীত হইতে চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু কখনই বিশেষ বিশেষ ঘটনা ও সত্যের বিচার দ্বারা সাধারণ সত্যে উপনীত হইবার চেষ্টা করেন নাই। আমাদের সকল দর্শনেই দেখিতে পাই—প্রথমে একটি সাধারণ ‘প্রতিজ্ঞা’ ধরিয়া লইয়া, তারপর চুলচেরা বিচার চলিতেছে; কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞাটিই হয়তো সম্পূর্ণ ভ্রমাত্মক ও বালকোচিত। কেহই এই সকল সাধারণ প্রতিজ্ঞার সত্যাসত্য জিজ্ঞাসা অথবা অনুসন্ধান করে নাই। সুতরাং আমাদের স্বাধীন চিন্তা একরূপ নাই বলিলেই হয়। সেইজন্যই আমাদের দেশে পর্যবেক্ষণ ও সামান্যীকরণ২৭ প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ বিজ্ঞানসমূহের অত্যন্ত অভাব দেখিতে পাই। ইহার কারণ কি? ইহার দুইটি কারণঃ প্রথমতঃ এখানে গ্রীষ্মের অত্যন্ত আধিক্য আমাদিগকে কর্মপ্রিয় না করিয়া শান্তি ও চিন্তা-প্রিয় করিয়াছে। দ্বিতীয়তঃ পুরোহিত ব্রাহ্মণেরা কখনই দূরদেশে ভ্রমণ অথবা সমুদ্রযাত্রা করিতেন না। সমুদ্রযাত্রা বা দূরভ্রমণ করিবার লোক ছিল বটে, তবে তাহারা প্রায় সবই ছিল বণিক; পৌরোহিত্যের অত্যাচার ও তাহাদের নিজেদের ব্যবসায়ে লাভের আকাঙ্ক্ষা, তাহাদের মানসিক উন্নতির সম্ভাবনা একেবারে রুদ্ধ করিয়াছিল। সুতরাং তাহাদের পর্যবেক্ষণের ফলে মনুষ্যজাতির জ্ঞানভাণ্ডার বর্ধিত না হইয়া উহার অবনতিই হইয়াছিল। কারণ, তাহাদের পর্যবেক্ষণ দোষযুক্ত ছিল, এবং তাহাদের প্রদত্ত বিবরণ এতই অতিরঞ্জিত ও কাল্পনিক হইত যে, বাস্তবের সঙ্গে তাহার মোটেই মিল থাকিত না।
সুতরাং আপনি বুঝিতেছেন, আমাদিগকে ভ্রমণ করিতেই হইবে, আমাদিগকে বিদেশে যাইতেই হইবে। আমাদিগকে দেখিতে হইবে, অন্যান্য দেশে সমাজ-যন্ত্র কিরূপে পরিচালিত হইতেছে। আর যদি আমাদিগকে যথার্থই পুনরায় একটি জাতিরূপে গঠিত হইতে হয়, তবে অপর জাতির চিন্তার সহিত আমাদের অবাধ সংস্রব রাখিতে হইবে। সর্বোপরি আমাদিগকে দরিদ্রের উপর অত্যাচার বন্ধ করিতে হইবে। আমরা এখন কি হাস্যকর অবস্থাতেই না উপনীত হইয়াছি! ভাঙ্গীরূপে যদি কোন ভাঙ্গী কাহারও নিকট উপস্থিত হয়, সংক্রামক রোগের ন্যায় সকলে তাহার সঙ্গ ত্যাগ করে; কিন্তু যখনই পাদ্রী সাহেব আসিয়া মন্ত্র আওড়াইয়া তাহার মাথায় খানিকটা জল ছিটাইয়া দেয়, আর সে একটা জামা (যতই ছিন্ন ও জর্জরিত হউক) পরিতে পায়, তখনই সে খুব গোঁড়া হিন্দুর বাড়ীতেই প্রবেশাধিকার পায়! আমি তো এমন লোক দেখি না, যে তখন তাহাকে একখানা চেয়ার আগাইয়া না দিতে ও তাহার সহিত সপ্রেম করমর্দন না করিতে সাহস করে! ইহার চেয়ে আর অদৃষ্টের পরিহাস কতদূর হইতে পারে? এখন এই পাদ্রীরা দক্ষিণে কি করিতেছে, দেখিবেন—আসুন দেখি। উহারা লাখ লাখ নীচ জাতকে খ্রীষ্টান করিয়া ফেলিতেছে—আর পৌরোহিত্যের অত্যাচার ভারতের সর্বাপেক্ষা যেখানে বেশী, সেই ত্রিবাঙ্কুরে, যেখানে ব্রাহ্মণগণ সমুদয় ভূমির স্বামী, এবং স্ত্রীলোকেরা—এমন কি রাজবংশীয়া মহিলাগণ পর্যন্ত—ব্রাহ্মণগণের উপপত্নীরূপে বাস করা খুব সম্মানের বিষয় জ্ঞান করিয়া থাকে, তথাকার সিকি ভাগ খ্রীষ্টান হইয়া গিয়াছে। আর আমি তাহাদের দোষও দিতে পারি না। তাহাদের আর কোন্ বিষয়ে কি অধিকার আছে বলুন? হে প্রভু, কবে মানুষ অপর মানুষকে ভাইয়ের ন্যায় দেখিবে?
আপনারই
বিবেকানন্দ
৫৯
[হরিপদ মিত্রকে লিখিত]
মাড়গাঁও, ১৮৯৩
কল্যাণবরেষু,
আপনার এক পত্র এইমাত্র পাইলাম। আমি এ স্থানে নিরাপদে পৌঁছিয়া ও তদনন্তর পঞ্জেম প্রভৃতি কয়েকটি গ্রাম ও দেবালয় দর্শন করিতে যাই—অদ্য ফিরিয়া আসিয়াছি। গোকর্ণ, মহাবালেশ্বর প্রভৃতি দর্শন করিবার ইচ্ছা এক্ষণে পরিত্যাগ করিলাম। কল্য প্রাতঃকালের ট্রেনে ধারবাড় যাত্রা করিব। ষষ্টি আমি লইয়া আসিয়াছি। ডাক্তার যুগড়েকরের মিত্র আমার অতিশয় যত্ন করিয়াছেন। ভাটেসাহেব ও অন্যান্য সকল মহাশয়কে আমার যথাযোগ্য সম্ভাষণ জানাইবেন। ঈশ্বর আপনার ও আপনার পত্নীর সকল কল্যাণ করুন। পঞ্জেম শহর বড় পরিষ্কার। এখানকার খ্রীষ্টিয়ানেরা অনেকেই কিছু কিছু লেখাপড়া জানে। হিন্দুরা প্রায় সকলেই মূর্খ। ইতি
সচ্চিদানন্দ২৮
৬০*
C/o বাবু মধুসূদন চট্টোপাধ্যায়
সুপারিণ্টেণ্ডিং ইঞ্জিনিয়র
খার্তাবাদ, হায়দরাবাদ
২১ ফেব্রুআরী, ১৮৯৩
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তোমার বন্ধু সেই গ্রাজুয়েট যুবকটি ষ্টেশনে আমাকে নিতে এসেছিলেন—একটি বাঙালী ভদ্রলোকও এসেছিলেন। এখন আমি ঐ বাঙালী ভদ্রলোকটির কাছেই রয়েছি—কাল তোমার যুবক বন্ধুটির কাছে গিয়ে কিছুদিন থাকব; তারপর এখানকার দ্রষ্টব্য জিনিষগুলি দেখা হয়ে গেলে কয়েক দিনের মধ্যেই মান্দ্রাজে ফিরছি। কারণ আমি অত্যন্ত দুঃখের সহিত তোমায় জানাচ্ছি যে, আমি এখন আর রাজপুতানায় ফিরে যেতে পারব না—এখানে এখন থেকেই ভয়ঙ্কর গরম পড়েছে; জানি না রাজপুতানায় আরও কি ভয়ানক গরম হবে, আর গরম আমি আদপে সহ্য করতে পারি না। সুতরাং এরপর আমাকে বাঙ্গালোরে যেতে হবে, তারপর উতকামণ্ডে গ্রীষ্মটা কাটাতে যাব। গরমে আমার মাথার ঘিটা যেন ফুটতে থাকে।
তাই আমার সব মতলব ফেঁসে চুরমার হয়ে গেল; আর এই জন্যই আমি গোড়াতেই মান্দ্রাজ থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়বার জন্যে ব্যস্ত হয়েছিলাম। সে ক্ষেত্রে আমায় আমেরিকা পাঠাবার জন্য আর্যাবর্তের কোন রাজাকে ধরবার যথেষ্ট সময় হাতে পেতাম। কিন্তু হায়, এখন অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। প্রথমতঃ এই গরমে আমি ঘুরে বেড়াতে পারব না—তা করতে গেলে মারা যাব, দ্বিতীয়তঃ আমার রাজপুতানার ঘনিষ্ঠ বন্ধুগণ আমাকে পেলে তাঁদের কাছেই ধরে রেখে দেবেন, পাশ্চাত্য দেশে যেতে দেবেন না। সুতরাং আমার মতলব ছিল, আমার বন্ধুদের অজ্ঞাতসারে কোন নূতন লোককে ধরা। কিন্তু মান্দ্রাজে এই বিলম্ব হওয়ার দরুন আমার সব আশাভরসা চুরমার হয়ে গেছে; এখন আমি অতি দুঃখের সহিত ঐ চেষ্টা ছেড়ে দিলাম—ঈশ্বরের যা ইচ্ছা, তাই পূর্ণ হোক। এ আমারই প্রাক্তন—অপর কারও দোষ নেই। তবে তুমি এক রকম নিশ্চিতই জেনো যে, কয়েক দিনের মধ্যেই দু-এক দিনের জন্য মান্দ্রাজে গিয়ে তোমাদের সঙ্গে দেখা করে বাঙ্গালোরে যাব, আর সেখান থেকে উতকামণ্ডে গিয়ে দেখব, যদি ম—মহারাজ আমায় পাঠায়। ‘যদি’ বলছি তার কারণ, আমি ‘—’রাজার অঙ্গীকারবাক্যে বড় নিশ্চিত ভরসা রাখি না। তারা তো আর রাজপুত নয়, রাজপুত বরং প্রাণ দেবে, কিন্তু কখনও কথার খেলাপ করবে না। যাই হোক, ‘যাবৎ বাঁচি, তাবৎ শিখি’—অভিজ্ঞতাই জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক।
‘স্বর্গে যেরূপ মর্ত্যেও তদ্রূপ তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হোক, কারণ অনন্তকালের জন্য তোমারই মহিমা জগতে ঘোষিত হচ্ছে এবং সবই তোমারই রাজত্ব।’২৯
তোমরা সকলে আমার শুভেচ্ছা জানবে। ইতি
তোমাদের
সচ্চিদানন্দ