নিরুক্ত (বেদাঙ্গসূত্র)
যাস্কের নিরুক্তই শব্দের ব্যুৎপত্তি সম্পর্কে পৃথিবীর প্রথমতম গ্ৰন্থ। পণ্ডিতগণ এর রচনাকাল সম্পর্কে একমত হয়ে খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ থেকে ৫০০ অব্দের মধ্যে এর সময় নির্দেশ করেছেন যদিও খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের কাছাকাছি একে সংস্থাপিত করাই অধিক সম্ভব বলে মনে হয়। নিরুক্ত তিনটি কাণ্ড ও পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত। নৈঘণ্টুক কাণ্ডরূপে পরিচিত প্ৰথম তিনটি অধ্যায়ে প্রতিশব্দ; নৈগম কাণ্ড বা ঐকপাদিকরূপে অভিহিত চতুর্থ অধ্যায়ে সমার্থক শব্দ; এবং দৈবত কাণ্ড-রূপে পরিচিত পঞ্চম অধ্যায়ে বৈদিক দেবতাদের নামের ব্যুৎপত্তি আলোচিত হয়েছে। ঐকপদিকে আলোচিত শব্দসমূহের অধিকাংশ ঋগ্বেদের চূড়ান্ত পর্যায়ের রচনা থেকে সংগৃহীত। নৈঘন্টুকের তিনটি অধ্যায়ের প্রথমটিতে বায়ু, জল, পৃথিবী ইত্যাদির মতো ভৌত উপাদান; দ্বিতীয়ে মানুষ, তার দেহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, আবেগ ইত্যাদি এবং তৃতীয় মূলত দেবতা ও তৎসংসৃষ্ট কিছু বিমূর্ত ধারণাসমূহ আলোচিত হয়েছে। নিরুক্তের দুটি অর্ধে মোট বারোটি পরিচ্ছেদ আছে; প্রথম ছটি পরিচ্ছেদে নিঘণ্টর প্রথম দুটি কাণ্ড এবং শেষের ছ’টি পারচ্ছেদে দৈবত কাণ্ড ব্যাখ্যাত হয়েছে। প্রতি অর্ধে মৌলিক বিধি ও আলোচ্য বিষয়ের পরিধি সম্পর্কে সাধারণ ভূমিকা রয়েছে; সম্ভবত তাতে রচনার দুটি স্তরের মধ্যবর্তী ব্যবধান আভাসিত।
ব্যাকরণ ব্যুৎপত্তির কাঠামোও আঙ্গিকগত দিক সম্পর্কে নিরুক্ত অবহিত, অন্যদিকে শব্দের অর্থান্তর-সংক্রমণের তত্ত্বও বিশ্লেষণ করেছে। বহুলাংশে কাল্পনিক এবং অবাস্তব হলেও ব্যুৎপত্তি ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে এবং নিতান্ত প্ৰাথমিক রূপে ঋগ্বেদেও পাওয়া যায়। যাস্ক তার গ্রন্থে অন্তত ষোলজন পূর্বসূরী শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত উল্লেখ করেছেন। এতে মনে হয়, যাস্কের কয়েক শতাব্দী পূর্বেও সম্ভবত ব্যুৎপত্তি শাস্ত্ৰ অনুশীলিত হত। আমরা দেখেছি যে ছদ্মযুক্তিগ্রাহ্য ভিত্তিতে শব্দের অর্থসংক্রমণগত উৎস নির্ধারণের প্রথম অনুমাননির্ভর প্রচেষ্টার নিদর্শন পাওয়া যায় ব্ৰাহ্মণ-সাহিত্যে। যাস্ক তার পূর্বসূরী হিসাবে সংহিতা (সবগুলি শাখায় বিন্যস্ত রূপে), ব্ৰাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ ও প্রাতিশাখাগুলিকে পেয়েছিলেন। এসব রচনা থেকে তিনি উপাদান আহরণ করেছিলেন এবং এগুলির উপর ভিত্তি করেই নিজস্ব বক্তব্য শঠন করেছিলেন। সেযুগে বেদাধ্যয়ন যে পরিশীলিত স্তরে উপনীত হয়েছিল, তা বেদ বিষয়ক চিন্তার বিভিন্ন শাখা সম্বন্ধে যাস্কের উল্লেখ থেকে প্রমাণিত হয় যথা যাজ্ঞিক, বৈয়াকরণ, নৈদান, ঐতিহাসিক ও নিরুক্ত। বৈদিক মন্ত্রগুলিকে যিনি অর্থহীন বলে মনে করতেন, সেই কৌৎসের অভিমত সম্পর্কে নিরুক্তের আলোচনা (১ : ১৫) কিংবা ঐতিহাসিক পক্ষের অস্তিত্ব (৩ : ১২) থেকে প্রমাণিত হয় যে বস্তুবাদী ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছিল।
নিরুক্ত গ্রন্থটি প্রকৃতপক্ষে একটি বিলুপ্ত শব্দের তালিকার উপর ভাষ্য; একটি পৃথক শব্দ-তালিকা রূপে যদি কখনো তার অস্তিত্ব থেকে থাকে, ভাষ্যকৃত শব্দগুলি থেকে এখন তার পুননির্মাণ করা যেতে পারে। এই তালিকাকে নিঘন্টু বলা হত; তাই প্ৰথম অধ্যায় সম্পর্কে নৈঘণ্টক নামটি প্রযুক্ত হয়। মনে হয় যে নিঘণ্ট বলতে মূলত প্রতিশব্দ-বিষয়ক গ্ৰন্থই বোঝােত; পরবর্তীকালে অভিধাের বৃত্তকে প্রসারিত সমার্থক শব্দ ও দেবনামকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবার সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞতার ফলে প্রবলভাবে সীমাবদ্ধ হয়েও যাস্ক নিরুক্তে ব্যুৎপত্তি অনুশীলনের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অবদানের স্বাক্ষর রেখেছেন; তিনি দৃঢ়ভাবে এই তথ্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে শব্দসমূহের নির্বাচন সম্ভব, তবে এই অভিমতের উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপের ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি উদ্ভট ব্যুৎপত্তির সন্ধান দিয়েছেন। বহুক্ষেত্রে কোনো মূল ধাতু থেকেই ব্যুৎপত্তি সন্ধানের প্রবণতার ফলে তিনি ভ্ৰান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন; অনুরূপভাবে একটি দৃঢ় বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে ব্যুৎপত্তি অনুশীলন প্রক্রিয়ার অভাবের ফলে শব্দের বহুমুখী নির্বাচন দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এইসব ক্রটিবিচ্যূতি সত্ত্বেও যাস্ক একটি বিস্ময়কর সতর্ক ও যুক্তিনিষ্ঠ মনের পরিচয় দিতে পেরেছেন; এ ক্ষেত্রে তার অবদানের মূল্য মূলগত নির্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে বহুগুণ বর্ধিত হয়েছে যেহেতু তিনি বিরোধী পক্ষের সম্পূর্ণ প্রতিবাদী অভিমতকেও স্বীকৃতি দিতে ইতস্তত করেন নি। যাস্ক বিশ্বাস করেন যেন ব্যুৎপত্তি কখনোই অর্থ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া উচিত নয়; কারণ নিছক ব্যাকরণের নিয়ম কোনাে শব্দের উৎস নির্ণয়ে সফল না হলেও শব্দার্থ পরিবর্তনগত অনুষঙ্গকে অবলম্বন করে আমরা সেই শব্দের সম্ভাব্য উৎসস্থলে উপনীত হতে পারি। তাই যাস্ক সর্বদা ব্যুৎপত্তি নির্ণয় প্রক্রিয়াকে শব্দার্থ-পরিবর্তন তত্ত্ব ও শাব্দিক প্রসঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন।
যাস্ক চার ধরনের পদকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন-নাম (বিশেষ্য, বিশেষণ ও সর্বনাম, আখ্যাত (ক্রিয়া), উপসর্গ ও নিপাত (অব্যয়); এ আলোচনায় তিনি আশ্চর্য স্পষ্টতা ও বিজ্ঞানসম্মত ঋজুতার পরিচয় দিয়েছেন। কখনো কখনো যেন সে-সমস্ত ধ্বনিতাত্ত্বিক নিয়মের পূর্বাভাস পাওয়া যায়, পাণিনি তার ব্যাকরণে পরবর্তীকালে যেগুলি ব্যবহার করেছিলেন; কখনো বা কোনো ব্যুৎপত্তিতে বহু সম্ভাব্য ধাতুর সম্পর্ক নির্ণয় করে তিনি তার বিষয়বস্তুতে আশ্চর্য অন্তদৃষ্টির পরিচয় রেখেছেন। তাত্ত্বিকতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে তিনি বহু ভাষাতাত্ত্বিক প্রবণতাকে উপভাষার প্রভাব ও আঞ্চলিক চরিত্র বৈশিষ্ট্য এবং তৎপ্রসূত ভাষাগত সংমিশ্রণের আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন। যেসব ক্ষেত্রে তিনি সমন্বয় সাধনে ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানেও আমাদের বহু ভাষাতাত্ত্বিক প্রবণতাকে উপভাষার প্রভাব ও আঞ্চলিক চরিত্র বৈশিষ্ট্য এবং তৎপ্রসূত ভাষাগত সংমিশ্রণের আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন। যেসব ক্ষেত্রে তিনি সমন্বয় সাধনে ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানেও আমাদের বিবেচনার জন্য বহু তাৎপর্যপূর্ণ সূত্র রেখে গেছেন। যাস্ক স্পষ্টতই বহু বৈয়াকরণ ও ব্যুৎপত্তিবিদের দীর্ঘািয়ত ঐতিহ্যের পরিণত পর্বে আবির্ভূত হয়েছিলেন; কিন্তু তার নিজস্ব অবদান এত অসামান্য ছিল যে তা পূর্বসূরীদের কীর্তিকে সম্পূর্ণ স্নান করে দিয়েছিল; নিরুক্তের ভাষার মধ্যে বৈদিক ভাষার বিবর্তনের নিদর্শন স্পষ্ট; তাই যাস্ক বহু বৈদিক শব্দকে ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে পরবর্তী ও অধিকতর প্রচলিত রূপের সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন।
ব্যুৎপত্তি শাস্ত্রের অন্যতম প্রাচীনতর বিশেষজ্ঞ শাকটায়ন মনে করতেন যে সমস্ত বিশেষণকে ধাতু থেকে নিম্পন্ন করা সম্ভব। কিন্তু ব্যুৎপত্তিবিদরূপে মাস্ক অষ্টি, এক ভারসাম্য-বোধের পরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু এ ধরনের চরম অভিমতকে সমর্থন করেন নি। তাছাড়া কৌৎসের বক্তব্যকেও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতেও যে কৌৎস বৈদিক মন্ত্রসমূহককে অর্থহীন বলে ঘোষণা করে মৌলিক প্ৰতিবাদী চিন্তার স্বাক্ষর রেখেছিলেন-তা আমাদের বিস্ময় উদ্রেক করে।