০৬. নিজের হাতে হত্যা

মাজুর বলল, আমি এটাকে নিজের হাতে হত্যা করতে চাই।

মাজুর যাকে নিজের হাতে হত্যা করতে চাইছে সেই নিহনকে ইয়টের ডেকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। একজন মানুষকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখার মধ্যে এক ধরনের অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতা রয়েছে, যদিও এখানে কেউই সেই নিষ্ঠুরতাটুকু ধরতে পারছে না।

মাজুর তার হাতের অস্ত্রটি হাত বদল করে বলল, তোমরা নিশ্চয়ই আমাকে হত্যা করতে দেবে। দেবে না?

দ্রীমান জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন একে হত্যা করতে চাইছ?

মাজুর একটু অধৈর্য হয়ে বলল, কেন চাইব না? আমরা কি জলমানব শিকার করতে আসি নি?

কিন্তু শিকার করার জন্য প্রাণীটাকে মুক্ত থাকতে হয়। দ্রীমান গম্ভীর গলায় ব্যাখ্যা করল, বেঁধে রাখা প্রাণীকে শিকার করলে সেটা তো খুন করা হয়ে যায়।

মানুষকে হত্যা করলে সেটা খুন হয়। মাজুর নিহনকে দেখিয়ে বলল, এটা তো মানুষ নয়।

দ্রীমান বলল, আমার কাছে তো বেশ মানুষের মতোই মনে হচ্ছে। মাজুর রেগে গিয়ে বলল, মানুষের মতো দেখালেই একজন মানুষ হয়ে যায় না।

তা হলে কখন মানুষ হয়?

যখন ক্রোমোজমে নির্দিষ্ট জিনসগুলো পাওয়া যায় তখন তাকে বলে মানুষ।

দ্রীমান জিজ্ঞেস করল, তুমি কি এই মানুষটির জিনসগুলো পরীক্ষা করে দেখেছ?

কী বলছ তুমি আবোল-তাবোল? মাজুর রেগে গিয়ে নিজের অস্ত্রটি হাতে নিয়ে বলল, আমি তোমাদের কোনো কথা শুনব না। দশ হাজার ইউনিট খরচ করে আমি এসেছি জলমানব শিকার করতে! আমি অন্তত একটা জলমানব শিকার না করে যাব না।

কাটুস্কা এতক্ষণ চুপচাপ দুজনের কথা শুনছিল, এবার সে কথা বলল, মাজুরকে জিজ্ঞেস করল, তোমাকে তো শিকার করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সাগর-স্কুটারে করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে তুমি তো গিয়েছিলে শিকার করতে। যাও নি?

হ্যাঁ, গিয়েছিলাম।

তা হলে তখন শিকার করলে না কেন?

মাজুর থতমত খেয়ে বলল, মানে তখন-

কাটুস্কা হাসি গোপন করার চেষ্টা না করে বলল, তখন শিকার করতে পার নি। সত্যি কথা বলতে কী আরেকটু হলে এই জলমানবটাই তোমাকে শিকার করে ফেলত, মনে আছে? তোমাকে সে টেনে পানির ভেতর নিয়ে যায় নি? যদি তোমাকে ছেড়ে না দিত তা হলে কি তুমি এতক্ষণে পেট ফুলে পানিতে মরে ভেসে থাকতে না?

মাজুর মুখ শক্ত করে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ, কাটুস্কা?

আমি বলতে চাইছি, এই জলমানবের কাছে তোমার কৃতজ্ঞ থাকার কথা যে সে তোমাকে মারে নি। তোমাকে মেরে ফেলার তার যথেষ্ট কারণ ছিল।

মাজুরের মুখে কুটিল এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে, সে হাসিটাকে তার মুখে আরো বিস্তৃত হতে দিয়ে বলল, এই জলমানব তার সুযোগ পেয়েছিল, সুযোগটা সে ব্যবহার করতে পারে নি। এখন আমি আমার সুযোগ পেয়ে আমি আমার সুযোগটা ব্যবহার করব।

কাটুস্কা মাথা নাড়ল, বলল, না।

মাজুর অবাক হয়ে বলল, না?

হ্যাঁ, তুমি একে মারতে পারবে না।

কেন পারব না?

কাটুঙ্কা বলল, কারণ আমি আমার জীবনে এর চাইতে সুন্দর কোনো মানুষ দেখি নি। তুমি তাকিয়ে দেখ, এর মুখমণ্ডল কী অপূর্ব। খাড়া নাক, বড় বড় কালো চোখ। উঁচু চিবুক। মাথা ভরা কুচকুচে কালো চুল-দেখ, সেটা ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে! এর শরীরটা দেখে মনে হয় কেউ যেন গ্রানাইট পাথর খোদাই করে তৈরি করেছে। শরীরে এক ফোঁটা মেদ নেই। দেখ, বুকটা কত চওড়া, শরীরে কী চমৎকার মাংসপেশি! তাকিয়ে দেখ, এর শরীরের ভেতর কী পরিমাণ শক্তি লুকিয়ে আছে। দেখে মনে হয় যেন সে একটা চিতাবাঘের মতো, যে কোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে? তুমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখ মাজুর, তার হাতের আঙুলগুলো দেখ, লম্বা সুচালো, যেন একজন শিল্পীর হাত। দেখ, তার পা কত দীর্ঘ! তার কোমরটা দেখ, কেমন সরু হয়ে এসেছে। এই জলমানবটা একচিলতে কাপড় পরে আছে- দেখে কি মনে হচ্ছে না যার দেহ এত অপূর্ব তার এই একচিলতে কাপড়ই যথেষ্ট! তার এর চাইতে বেশি কাপড় পরে থাকা ঠিক নয়, তা হলে তার এই অসাধারণ সৌন্দর্য ঢাকা পড়ে যাবে। তাই কি মনে হয় না?

মাজুর হকচকিত হয়ে কাটুস্কার দিকে তাকিয়ে রইল। ইতস্তত করে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ, কাটুস্কা?

আমি বলতে চাইছি, গ্রিক দেবতা থেকেও সুন্দর এই জলমানবের পাশে তোমাকে দেখাচ্ছে একটা কৌতুকের মতন! তুমি আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ মাজুর, ফোলা মুখ, ঢুলুঢুলু লাল চোখ! শুকনো দড়ির মতো লাল চুল। ঢিলেঢালা থলথলে শরীর। কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছ। তোমার মুখ রাগে-ঘৃণায় বিকৃত হয়ে আছে। অথচ এই জলমানবটির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখ, সেখানে শিশুর মতো এক ধরনের নিষ্পাপ সারল্য–

মাজুর হিশহিশ করে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ, কাটুস্কা?

আমি বলছি তুমি এই জলমানবকে হত্যা করতে পারবে না। তোমার মতন একজন অসুন্দর মানুষকে আমি এই অপূর্ব মানুষটিকে হত্যা করতে দেব না।

তুমি তাই মনে কর?

কাটুস্কা তার মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি।

 তুমি দেখতে চাও আমি একে হত্যা করতে পারি কি না?

আমার সাথে হম্বিতম্বি করার কোনো প্রয়োজন নেই, মাজুর। তুমি জান আমার বাবা নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান। আমি স্যাটেলাইট ফোনে বাবাকে একটু বলে দিলেই এখানে দুটো হেলিকপ্টার চলে আসবে। আমি তোমার প্রতি একটু বিরক্তি প্রকাশ করলেই তারা তোমাকে হাতকড়া লাগিয়ে নিয়ে যাবে।

মাজুরের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়, সে নিচু গলায় বলে, তুমি কী বলতে চাইছ?

আমি বলছি তোমার নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে ভালো হবে আমাকে বিরক্ত না করা।

তু-তুমি আমাকে ভয় দেখাতে চাইছ?

এমনিতেই যদি আমার কথা শুনতে তা হলে আমার ভয় দেখানোর প্রয়োজন হত না মাজুর।

কাটুস্কা মাজুরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে যায়। সে চোখের পানি মুছে বলল, মাজুর, তুমি এখন সরে যাও।

কেন?

আমি এখন এই জলমানবটার সঙ্গে কথা বলব।

কী বলছ তুমি, কাটুস্কা! তুমি-জান এরা কত ভয়ঙ্কর? কত নিষ্ঠুর?

আমার কাছে মোটেও ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে না। মোটেও নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে না। বরং কী মনে হচ্ছে জান?

কী?

মনে হচ্ছে তুমি এর চেয়ে এক শ গুণ বেশি নিষ্ঠুর। এক শ গুণ বেশি ভয়ঙ্কর।

মাজুর হকচকিতের মতো কাটুস্কার দিকে তাকিয়ে রইল।

.

পায়ের শব্দ শুনে নিহন মাথা ঘুরিয়ে তাকাল-ঠিক তার বয়সী একটা মেয়ে কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। একটু আগে এই মেয়েটিও অন্যদের নিয়ে তাকে আর নাইনাকে গুলি করে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। কী ভয়ঙ্কর ছিল তার দৃষ্টি, চোখেমুখে কী আশ্চর্য রকম নিষ্ঠুরতা খেলা করছিল। এখন মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে একেবারেই কোমল স্বভাবের মেয়ে। চোখের দৃষ্টি নরম, ঠোঁটের কোনায় এক ধরনের হাসি। একটা মানুষ কেমন করে এক সময় এত ভয়ঙ্কর হতে পারে, আবার অন্য সময় এত কোমল চেহারার হতে পারে নিহন বুঝতে পারল না।

মেয়েটি কিছু একটা বলল, নিহন তার কথা ঠিক বুঝতে পারল না। ভাষাটি তাদের ভাষার মতোই তবে কথা বলার সুরটি অন্য রকম। নিহন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকাতেই মেয়েটি আবার কথা বলল। এবার নিহন কথাটি বুঝতে পারে, মেয়েটি বলছে, তোমার নাম কী?

নিহন নামটি বলতে গিয়ে থেমে যায়, কেন এই মেয়েটিকে তার নাম বলতে হবে? একটা পত্তকে মানুষ যেভাবে বেঁধে রাখে ঠিক সেভাবে শেকল দিয়ে তাকে বেঁধে রেখেছে, অথচ তার সঙ্গে মেয়েটা কথা বলছে খুব স্বাভাবিক একটা ভঙ্গিতে।

মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ?

হ্যাঁ। নিহন মাথা নাড়ল, বলল, বুঝতে পারছি।

মেয়েটি এবার হেসে ফেলে বলে, তুমি কী বিচিত্রভাবে কথা বল!

নিহন কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটি বলল, আমার নাম কাটুস্কা।

নিহন এবারও কোনো কথা বলল না। মেয়েটি বলল, একজন যখন তার নাম বলে তখন অন্যজনকেও তার নাম বলতে হয়।

নিহন বলল, একজন যখন গুলি করে তখন কি অন্যজনকেও গুলি করতে হয়?

নিহনের কথাটা বুঝতে কাটুস্কা নামের মেয়েটির একটু সময় লাগল, যখন বুঝতে পারল তখন হঠাৎ করে তার মুখটি একটু বিবর্ণ হয়ে যায়। কাটুস্কা এক পা এগিয়ে এসে বলল, আমি খুব দুঃখিত। আমি-আমি-আমি ভেবেছিলাম

কী ভেবেছিলে?

আমি ভেবেছিলাম তোমরা অন্য রকম।

সেজন্য তোমরা আমাদের গুলি করে মারতে চাইছিলে?

কাটুস্কা নিঃশব্দে নিহনের দিকে তাকিয়ে রইল। নিহন বলল, তোমরা দেরি করছ কেন? কখন মারবে আমাকে?

আসলে

আসলে কী?

এই পুরো ব্যাপারটা আসলে একটা খুব বড় ভুল।

নিহন মাথা নাড়ল, বলল,  না এটা ভুল না। আমি জানি আমাদের গুলি করে মারা তোমাদের জন্য এক ধরনের খেলা তোমরা সেই খেলা খেলতে এসেছ।

কাটুস্কা কোনো কথা বলল না। তার মুখটি আবার বিবর্ণ হয়ে যায়। নিহন বলল, তোমরা খেলা শেষ করবে না?

কাটুস্কা মাথা নাড়ল, বলল, না। আমরা খেলা শেষ করব না।

নিহন একটু অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল। বলল, সত্যি তোমরা খেলা শেষ করবে না?

কাটুস্কা মাথা নাড়ল। বলল, না।

কেন না?

অনেকগুলো কারণ আছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে-  কাটুস্কা হঠাৎ থেমে যায়।

নিহন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কাটুস্কার দিকে তাকাল। কাটুস্কা একটু হেসে বলল, কারণটা হচ্ছে আমি আমার জীবনে তোমার মতো সুন্দর কোনো মানুষ দেখি নাই! এত সুন্দর একজন মানুষকে কিছু করা যায় না।

নিহন এ ধরনের একটা কথার জন্য প্রস্তুত ছিল না, সে থতমত খেয়ে বলল, আমি সুন্দর মানুষ না। আমাদের দ্বীপে আমার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর মানুষ আছে।

থাকতে পারে। কিন্তু আমি তোমার মতো সুন্দর মানুষ আগে কখনো দেখি নাই।

নিহন কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, তুমিও অনেক সুন্দর।

কাটুস্কা খিলখিল করে হেসে বলল, আমার সঙ্গে তোমার ভদ্রতা করতে হবে না। আমি কী রকম আমি জানি।

নিহন কী বলবে বুঝতে না পেরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। কাটুস্কা বলল, আজকে আমরা যেটা করেছি সেটা খুব বড় একটা নির্বুদ্ধিতা ছিল।

এখন তা হলে কী করবে?

তোমাকে চলে যেতে দেব।

নিহন অবাক হয়ে বলল, সত্যি?

হ্যাঁ, সত্যি।

নিহন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি বিশ্বাস করি না।

তুমি বিশ্বাস কর না?

না।

কেন বিশ্বাস কর না?

আমরা পানিতে থাকি। সমুদ্রের পানিতে কিছু ভয়ঙ্কর প্রাণী থাকে, নৃশংস আর হিংস্র। কিন্তু আমরা জানি স্থলমানবেরা তার চেয়েও বেশি নৃশংস আর হিংস্র।

কাটুস্কা অবাক হয়ে নিহনের দিকে তাকিয়ে রইল। নিহন বলল, আমরা জানি কোনো টাইফুন আমাদের নিশ্চিহ্ন করবে না। যদি আমাদের কখনো কেউ নিশ্চিহ্ন করে দেয়, সেটা হবে তোমরা। স্থলমানবেরা।

কাটুস্কার মুখে হঠাৎ বেদনার একটা ছায়া পড়ল। সে তার ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখে বলল, এটা সত্যি নয়। তুমি আমাকে বিশ্বাস কর, আমি তোমাকে তোমার নিজের এলাকায় যেতে দেব! দেবই দেব।

কাটুস্কা একটু সরে গিয়ে তার যোগাযোগ মডিউলটা বের করে তার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করল, ছোট স্ক্রিনে বাবার ছবিটা ফুটে উঠতেই তার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা।

কী হল, কাটুস্কা! তোমাদের সমুদ্রের অ্যাডভেঞ্চার কেমন হচ্ছে?

আমি যে রকম ভেবেছিলাম সে রকম না।

কেন, কাটুস্কা?

একটা নিঃশ্বাস ফেলে কাটুস্কা বলল, আমি ভেবেছিলাম জলমানবেরা হবে মানুষের অপভ্রংশ। তারা দেখতে হবে ভয়ঙ্কর। বীভৎস। হিংস্র।

তারা তা হলে কী রকম?

তারা অপূর্ব সুন্দর, বাবা। তারা গ্রিক দেবতা থেকেও সুন্দর।

কাটুস্কার বাবা প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রধান রিওন কোনো কথা না বলে শিস দেওয়ার মতো একটা শব্দ করল। কাটুস্কা বলল, জলমানবকে শিকার করা সম্ভব না।

ঠিক আছে। তা হলে চলে এস।

একটা ব্যাপার ঘটেছে, বাবা।

কী ঘটেছে?

আমরা সবাই মিলে একটা জলমানব ধরেছি।

কী বললে? রিওন অবিশ্বাসের গলায় বলল, জলমানবকে ধরেছ? জ্যান্ত ধরেছ?

হ্যাঁ, বাবা। এখন আমি তাকে ছেড়ে দিতে চাই।

ছেড়ে দিতে চাও?

হ্যাঁ, বাবা। তুমি যেভাবে হোক তার ব্যবস্থা করে দাও।

রিওন এক মুহূর্ত কী যেন ভাবল, বলল, তুমি কেন তাকে ছেড়ে দিতে চাও?

কারণ আমি তাকে কথা দিয়েছি। সে আমার কথা বিশ্বাস করে নাই। আমি তাকে দেখাতে চাই আমরা সত্যি কথা বলি।

ও আচ্ছা! রিওন আস্তে আস্তে বলল, তুমি জলমানবের সঙ্গে কথাও বলেছ?

হ্যাঁ, বাবা। জলমানবটি খুব শান্ত। খুব চমৎকার।

রিওন আবার বলল, ও আচ্ছা।

তুমি তাকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর।

ঠিক আছে। আমি একটা হেলিকপ্টার পাঠাচ্ছি। হেলিকপ্টারে করে জলমানবটাকে তার এলাকায় নামিয়ে দিয়ে আসবে।

সত্যি?।

হ্যাঁ, সত্যি।

বাবা, তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব।

পাগলী মেয়ে, বাবাকে ধন্যবাদ দেওয়ার কী আছে।

বিদায়, বাবা!

বিদায়! সমুদ্রভ্রমণ উপভোগ কর।

.

কাটুস্কা তার যোগাযোগ মডিউলটা ভাজ করে পকেটে রেখে নিহনের দিকে এগিয়ে বলল, আমি সব ব্যবস্থা করে এসেছি।

কী ব্যবস্থা?

তোমাকে তোমার এলাকায় নামিয়ে দিয়ে আসবে।

নিহন কিছুক্ষণ অবাক হয়ে কাটুস্কার দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, কেমন করে?

হেলিকপ্টারে করে?

হেলিকপ্টারে?

হ্যাঁ।

তুমি কেমন করে হেলিকপ্টার আনবে।

আমার বাবা প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রধান। আমার বাবার অনেক ক্ষমতা।

ও।

তুমি এখন আমার কথা বিশ্বাস করেছ?

নিহন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, হ্যাঁ, বিশ্বাস করেছি।

চমৎকার! কাটুস্কা একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, তোমাকে এভাবে ধরে এনে আমার খুব খারাপ লাগছিল। তোমাকে তোমার এলাকায় ছেড়ে দিয়ে আসব ভেবে আমার এখন একটু ভালো লাগছে।

নিহন নিজেও এবার একটু হাসার চেষ্টা করল। কাটুস্কা বলল, তুমি একটু অপেক্ষা। কর। আমি তোমার শেকলটা খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করি।

কাটুস্কা চলে যেতে যেতে ফিরে এসে জিজ্ঞেস করল, তোমার কি খিদে পেয়েছে? তুমি কি কিছু খেতে চাও? কোনো পানীয়?

না, কাটুস্কা। ধন্যবাদ।  

কাটুস্কা চলে যাচ্ছিল, নিহন তাকে ডাকল, কাটুস্কা।

বল।

তুমি আমার নাম জিজ্ঞেস করেছিলে। আমার নাম নিহন।

কাটুস্কা তার হাতটি নিহনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নিহন, তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম।

নিহন কাটুস্কার হাতটা স্পর্শ করে বলল, আমিও খুব খুশি হলাম, কাটুস্কা।

.

হেলিকপ্টারটি বেশ বড়, ইয়টের ডেকে সেটি নামতে পারল না। ইয়টের ওপর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে নাইলন কর্ডের একটা মই নামিয়ে দিল। নিহন মই বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে মাঝখানে থেমে নিচে তাকাল, ইয়টের ডেকে বেশ কয়জন দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মধ্যে কাটুস্কাও আছে। নিহনকে তাকাতে দেখে কাটুস্কা হাত নাড়ল। নিহনও প্রত্যুত্তরে তার হাত নাড়ল।  

হেলিকপ্টারের দরজা দিয়ে একজন মাথা বের করেছিল। সে নিহনকে তাড়া দিয়ে। বলল, দেরি কোরো না। চট করে উঠে এস।

নিহন দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসে। ভেতরে পাশাপাশি কয়েকটা বসার জায়গা, একজন নিহনকে তার একটাতে বসার ইঙ্গিত করল। নিহন বসার সঙ্গে সঙ্গেই হেলিকপ্টারটা গর্জন করে উপরে উঠে যেতে শুরু করে। নিহন জানালা দিয়ে দেখতে পায় কাটুস্কা এখনো হাত নাড়ছে। নিহন জানালা দিয়ে এই অন্য রকম মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই মায়াবতী মেয়েটির সাথে তার আর কোনো দিন দেখা হবে না।

হেলিকপ্টারের ভেতর একজন মানুষ নিহনের দিকে এগিয়ে আসে, হাতে একটা গ্লাস, গ্লাসে স্বচ্ছ এক ধরনের পানীয়। মানুষটা গ্লাসটি নিহনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও। খাও।

নিহন মাথা নাড়ল, বলল, আমি কিছু খেতে চাই না।

তবু খাওয়া উচিত। তোমার শরীরে পানীয়ের অভাব হয়েছে, ছেলে।

নিহন হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিজের কাছে নিয়ে এসে চুমুক দিল, ঝাঁজালো এক ধরনের স্বাদ। নিহন কয়েক চুমুকে গ্লাসটা শেষ করে খালি গ্লাসটি মানুষটার হাতে ফিরিয়ে দেয়।

নিহন জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, সমুদ্রের নীল পানির ওপর দিয়ে হেলিকপ্টারটা ছুটে যাচ্ছে। সে কখনো কি ভেবেছিল যে সে একটা হেলিকপ্টারে উঠবে? সত্যিকারের হেলিকপ্টার, যেটা আকাশে উড়তে পারে? কী আশ্চর্য! নিহন নিজের ভেতরে এক ধরনের শিহরণ অনুভব করে।

নিহন হেলিকপ্টারের ভেতরে তাকাল, বড় হেলিকপ্টারের ভেতরে অনেকখানি ভোলা জায়গা, সুদৃশ্য কয়েকটা চেয়ার এবং ধবধবে সাদা টেবিল। দেয়ালে যন্ত্রপাতির একটা প্যানেল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ নিহন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। হেলিকপ্টারটি উত্তর দিকে যাওয়ার কথা, এখন যাচ্ছে পূর্ব দিকে।

নিহন ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে জিজ্ঞেস করল, আমাকে তোমরা কোথায় নামাবে? তোমরা পূর্ব দিকে যাচ্ছ কেন?

মানুষটা কোনো কথা বলল না, তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। নিহন আবার জিজ্ঞেস করল, কোথায় নামাবে?

মানুষটির মুখে এবার মৃদু হাসি ফুটে ওঠে, সে আস্তে আস্তে বলে, তোমাকে কোথাও নামানো হবে না, ছেলে!

নিহন চমকে উঠল, বলল, নামানো হবে না?

না। তোমাকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি।

কিন্তু কিন্তু  

কিন্তু কী?

কাটুস্কা নামের ওই মেয়েটি যে বলেছিল আমাকে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে।

মানুষটা বলল, কাটুস্কা তা-ই জানে।

তোমরা ওই মেয়েটিকে মিথ্যা কথা বলেছ?

মানুষটা শব্দ করে হাসল, যার সঙ্গে যেরকম কথা বলার প্রয়োজন তা-ই বলতে হয়। কাউকে বলতে হয় সত্যি কথা। কাউকে বলতে হয় মিথ্যা কথা। আর কাউকে বলতে হয় সত্য আর মিথ্যা মিশিয়ে।

তোমরা আমাকে নিয়ে কী করবে?

আমাদের জৈব ল্যাবে তোমাকে পরীক্ষা করা হবে।

কীভাবে পরীক্ষা করা হবে?

কাটাকুটি করে দেখবে মনে হয়

নিহন লাফিয়ে উঠতে গিয়ে আবিষ্কার করে তার হাতে-পায়ে কোনো জোর নেই। সে উঠতে পারছে না। এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে সে মানুষটার দিকে তাকাল-মানুষটা আবার তার দিকে তাকিয়ে হাসে, ফিসফিস করে বলে, নির্বোধ জলমানব, তোমার এখন ঘুমানোর কথা। তোমার পানীয়ের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। স্নায়ুগুলো কাজ করার কথা নয় 

নিহন আবিষ্কার করল, সত্যি-সত্যি তার শরীরের সব স্নায়ু শিথিল হয়ে আছে। সে নড়তে পারছে না। নিহন ঘোলা চোখে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল, সে এখনো কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না। ধীরে ধীরে তার চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে। নিহন ঠিক করে চিন্তা করতে পারছিল না। তার মনে হতে থাকে, কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না।