ধৃতরাষ্ট্র-আদিষ্ট বিবিধ রাজনীতি
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে বৎস! তুমি সতত আপনার, শত্ৰুদিগের, উদাসীনগণের এবং আপনার ও শত্ৰুদিগের হিতাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিসমুদয়ের মণ্ডলসমুদয় পরিজ্ঞাত হইবে। শত্রু, শত্ৰুমিত্র, শত্রুর পরাজয়ার্থী, শত্ৰুমিত্রের পরাজয়ার্থী, ছয় প্রকার আততায়ী এবং মিত্র ও মিত্রের মিত্র এই দ্বাদশবিধ লোকের বিষয় বিদিত হওয়া তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। শত্রুগণ সুযোগ পাইলে অমাত্য, জনপদ, দুর্গ ও বলসমুদয় অনায়াসে ভেদ করিতে পারে; অতএব যাহাতে তাহারা ঐ কাৰ্য্যে সমর্থ না হয়, তদ্বিষয়ে সতর্ক থাকা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। পূর্ব্বোক্ত দ্বাদশবিধ লোকও মন্ত্রিদিগের আয়ত্ত। কৃষ্যাদি ষষ্টি প্রকার গুণকে নীতিবিশারদ আচাৰ্য্যগণ মণ্ডল বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। ভূপতিগণ ঐ মণ্ডলের বিষয় বিশেষরূপে পরিজ্ঞাত হইতে পারিলে অনায়াসে রাজ্যরক্ষার ছয়প্রকার উপায় যথাস্থানে যথানিয়মে প্রয়োগ করিতে পারেন।
“স্ব স্ব ক্ষয়, বৃদ্ধি ও স্থিতির বিষয় পরিজ্ঞাত হওয়া ভূপতিগণের অবশ্য কর্ত্তব্য। যখন স্বপক্ষ বলবান্ ও শত্রুপক্ষ দুর্ব্বল হইবে, তখন নরপতি শত্ৰুদিগকে জয় করিতে চেষ্টা করিবেন। কিন্তু যখন শত্রুপক্ষ বলবান্ ও স্বীয় পক্ষ দুর্ব্বল হইবে, তখন শত্ৰুদিগের সহিত সন্ধিস্থাপনের চেষ্টা করা তাঁহার সর্ব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য। সৰ্ব্বদা দ্রব্যরাশি সঞ্চয় করিয়া রাখা ভূপালদিগের নিতান্ত আবশ্যক। যখন রাজা যুদ্ধ করিতে সমর্থ হইবেন, তখন তিনি বিপক্ষদিগকে অল্পশস্যোৎপাদক ভূমি, পিত্তলাদি ধাতু ও ক্ষীণবল মিত্র প্রদান করিয়া তাহাদিগের সহিত সন্ধিস্থাপন করিবেন; কিন্তু অন্যে যখন তাহার সহিত সন্ধি করিবার নিমিত্ত তাহার নিকট সমুপস্থিত হইবে, তখন তিনি উহার নিকট বহুশস্যোৎপাদক ভূমি, সুবর্ণ রৌপ্যাদি ধাতু ও বলবান মিত্ৰসমুদয় গ্রহণে যত্নবান হইবেন। সন্ধি করা আবশ্যক হইলে ভূপতি প্রতিদ্বন্দ্বীর বিশ্বাসার্থ তাঁহার পুত্রকে আপনার নিকট আনয়ন করিয়া রক্ষা করিবেন। ইহার অন্যথাচরণে প্রবৃত্ত হওয়া রাজার কদাপি বিধেয় নহে। তিনি বিবিধ যুক্তি ও উপায়দ্বারা বিপদ হইতে মুক্তিলাভের চেষ্টা করিবেন।
“দীন, দরিদ্র ও অনাথদিগের প্রতি দয়া করা রাজার নিতান্ত আবশ্যক। যে রাজা স্বয়ং রাজ্যরক্ষা করিতে বাসনা করেন, তিনি শত্ৰুদিগকে ক্রমে ক্রমে বা এককালে স্তম্ভন [নিষ্ক্রিয়—হস্তপদাদির গতিশক্তিহীন], বিনাশ ও তাহাদের কোষভঙ্গ করিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করিবেন। যে রাজার উন্নতিলাভের বাসনা থাকে, অধীনস্থ রাজাদিগের হিংসা করা তাঁহার নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। যে রাজা পৃথিবী জয় করিতে ইচ্ছা করিবেন, তাঁহার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত না হইয়া মন্ত্রিদিগের সহিত মন্ত্রণাপূর্ব্বক তাঁহার আত্মীয়ভেদ করিবার চেষ্টা করাই কর্ত্তব্য। সাধুদিগের প্রতি দয়া ও অসাধুদিগের দণ্ডবিধান করা ভূপতিদিগের নিতান্ত আবশ্যক। বলবান্ ভূপতি দুর্ব্বলদিগের প্রতি কদাচ অত্যাচার করিবেন না। যদি কোন পরাক্রান্ত রাজা দুর্ব্বল রাজাকে আক্রমণ করেন, তাহা হইলে দুর্ব্বল ভূপতি প্রথমে মন্ত্রিগণের সহিত তাঁহার শরণাপন্ন হইয়া বেতসের ন্যায় নম্রতা অবলম্বনপূর্ব্বক সামাদি উপায়দ্বারা এবং পরিশেষে কোষ, পৌরজন ও অন্যান্য প্রিয়বস্তুদানদ্বারা আত্মরক্ষা করিতে চেষ্টা করিবেন। যদি ঐ সমুদয় উপায়দ্বারাও তাঁহার কার্য্যসিদ্ধি না হয়, তাহা হইলে অগত্যা স্বয়ং যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া কলেবর পরিত্যাগপূর্ব্বক মুক্তিলাভ করাই তাহার পক্ষে শ্রেয়ঃ।”