কহেন বৈশম্পায়ন, শুনহ রাজন।
সভা হৈতে উঠি যদি গেল দুর্য্যোধন।।
কারো বাক্য না শুনিল কুরু কুলাঙ্গার।
অধোমুখ হৈয়া তথা রহে দণ্ড চার।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ আদি যত সভাজন।
সভা হৈতে উঠি সবে চলিল তখন।।
অদৃষ্ট মানিয়া সবে গেল নিজ স্থান।
বিদুর বলেন, ধৃতরাষ্ট্র বিদ্যমান।।
কুলক্ষয় হেতু দুর্য্যোধনের বিধান।
উত্তর বচনে তাহা হইল প্রমাণ।।
অর্দ্ধ রাজ্য ছাড়ি দেহ পাণ্ডুর নন্দনে।
নতুবা তোমার রাজ্য রহিবে কেমনে।।
আপনার হিত যদি রাঞ্ছন রাজন।
পাণ্ডবের সঙ্গে কর সম্প্রীতে মিলন।।
পূর্ব্বের কাহিনী কিছু কহিব তোমারে।
কত শত রাজা হয়েছিল এ সংসারে।।
আছিল উত্তানপাদ ধর্ম্ম-অবতার।
সপ্তদ্বীপা পৃথিবীতে যাঁর অধিকার।।
ইন্দ্রের সম্পদ তুল্য যাঁহার গণন।
জলবিম্ব প্রায় সব দেখিল রাজন।।
হিংসা হেন বস্তু তাঁর না জন্মিল মনে।
সকল ছাড়িয়া রাজা প্রবেশিল বনে।।
তপোযোগে আরাধিয়া পায় দিব্যগতি।
তাঁর পুত্র হৈল ধ্রুব জগতে সুকৃতি।।
যাঁহার মহিমা যশে পূরিল সংসার।
মহাধর্ম্মশীল ছিল ধর্ম্ম-অবতার।।
তদন্তরে সূর্য্যবংশে রঘুরাজা ছিল।
যাঁর যশ মহিমায় ভুবন ভরিল।।
অপার মহিমা যাঁর দিতে নারে সীমা।
শৈত্যগুণে চন্দ্র যেন, ক্ষমাগুণে ক্ষমা।।
অতুল সম্পদ ভোগ করিল জগতে।
হিংসা হেন বস্তু কভু না করিল চিতে।।
এইরূপে কত রাজা চন্দ্র সূর্য্য কুলে।
নানা দান নানা যজ্ঞ করিল সকলে।।
তব পুত্র দুর্য্যোধন হয়েছে যেমন।
পৃথিবীতে হেন নাহি জন্মে কোন জন।।
কপটী হিংসক ক্রূর মহা দুষ্টমতি।
ইহার কারণে রাজা হইবে দুর্গতি।।
কুলক্ষয় হইবেক, লোকে উপহাস।
কুযশ ঘোষণা হবে, কলঙ্ক প্রকাশ।।
সে কারণে নরপতি মুন সাবধানে।
দ্বন্দ্ব না করিহ রাজা পাণ্ডবের সনে।।
ভীমের বিক্রম তুমি শুনিয়াছ কাণে।
যুদ্ধেতে করিল জয় যক্ষ রক্ষগণে।।
হিড়িম্ব কির্ম্মীর আর বক নিশাচর।
বাহুবলে সংহারিল কত বীরবর।।
মত্ত দশ সহস্র মাতঙ্গ বল ধরে।
গদাধারী মধ্যে সেই অজেয় সংসারে।।
ভীম ক্রুদ্ধ হৈলে বল রক্ষা হবে কার।
মুহূর্ত্তেকে সবাকারে করিবে সংহার।।
অর্জ্জুনের প্রতাপ যে অতুল ভুবনে।
বাহুযুদ্ধে পরাভব করে পঞ্চাননে।।
স্নেহ করি ইন্দ্র যারে স্বর্গ লয়ে গেল।
নানা অস্ত্র শস্ত্র বিদ্যা শিক্ষা করাইল।।
নিবাতকবচ কালকেয় দৈত্যগণ।
দেবের অবধ্য রিপু, প্রতাপে তপন।।
সবারে মারিয়া সন্তোষিল দেবগণে।
কোন্ বীর যুঝিবেক অর্জ্জুনের সনে।।
উত্তর গোগৃহ কথা শুনেছ শ্রবণে।
একেশ্বর ধনঞ্জয় সবাকারে জিনে।।
পরকার্য্য হেতু কারে না মারিল প্রাণে।
তথাপিহ জ্ঞান না জন্মিল দুর্য্যোধনে।।
আপনার মৃত্যু বুঝি বাঞ্ছিল আপনে।
পাণ্ডবের সহ দ্বন্দ্ব ইচ্ছা করে মনে।।
এখন যে হিত কহি, শুনহ রাজন।
দূত পাঠাইয়া দেহ বিরাট ভবন।।
সম্প্রীতে এখানে আন পাণ্ডুর কুমার।
সেই ইন্দ্রপ্রস্থে পুনঃ দেহ অধিকার।।
এ কর্ম্ম উচিত তব, দেখি হে রাজন।
দ্বন্দ্ব হৈলে হইবেক সবার নিধন।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে, ভাই কহিলে প্রমাণ।
সম্প্রীতি করিয়া আন পাণ্ডুর নন্দন।।
যেই সত্য করেছিল পাণ্ডুর কুমার।
ধর্ম্মবলে তাহে ভাই হৈলে তারা পার।।
আপন বিভাগ রাজ্য পাইতে উচিত।
দুর্য্যোধনে তুমি গিয়া বুঝাবে সুনীত।।
অন্ধ দেখি দুর্য্যোধন আমারে না মানে।
ধর্ম্মনীতি-শাস্ত্র তুমি বুঝাই আপনে।।
বিদুর বলিল, আমি কি বুঝাব নীত।
মম বাক্য নাহি শুনে বুঝে বিপরীত।।
পাশাকালে কহিলাম যে সব বিধান।
না শুনিল মম বাক্য করি অল্পজ্ঞান।।
এখন কহিয়া মম কিবা প্রয়োজন।
কহিবেক তাহা, যাহে লয় তার মন।।
বিদুর এতেক বলি বসে অধোমুখে।
ধৌম্য পুরোহিত তবে কহিল রাজাকে।।
মহামত্ত দুর্য্যোধনে আমি ভাল জানি।
সম্প্রীতে পাণ্ডবে নাহি দিবে রাজধানী।।
পূর্ব্বে যথা বলি বিরোচনের কুমার।
বাহুবলে পরাজিল সকল সংসার।।
সম্পদে হইয়া মত্ত না মানিল কারে।
জ্ঞাতি-বন্ধুজনে হিংসা করে অহঙ্কারে।।
বলিরে বান্ধিয়া হরি পাতালে রাখিয়া।
ইন্দ্রেরে ইন্দ্রত্ব পুনঃ দিলেন ডাকিয়া।।
সেই হরি পাণ্ডবের সহায় আপনি।
তাহার প্রসাদে প্রাপ্ত হবে রাজধানী।।
এত শুনি জিজ্ঞাসিল অম্বিকা-নন্দন।
কহ শুনি মুনিবর ইহার কারণ।।
কি কারণে বলি দ্বেষ কৈলা সুরগণে।
ইন্দ্রসহ বিবাদ বা করে কি কারণে।।
ধৌম্য বলে, সেই কথা কহিতে বিস্তার।
সংক্ষেপে কহিব কিন্তু, শুন সারোদ্ধার।।
উদ্যোগপর্ব্বের কথা অমৃত-সমান।
পাণ্ডবের উপাখ্যান অদ্ভূত কথন।।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে, হরে ভবভয়।
পয়ার প্রবন্ধে কাশীরাম দাস কয়।।