মুনি বলে শুন জন্মজয় নরপতি।
গৃহে যান ধর্ম্মরাজ শোকাকুল মতি।।
ভীমার্জ্জুন মাদ্রীসুত পাঞ্চাল কুমারী।
ধৃতরাষ্ট্র বধূগণ দুঃশলা সুন্দরী।।
শোকাকুল হয়ে সবে কান্দে সর্ব্বজন।
রজনী দিবস শোক নহে নিবারণ।।
না রুচে আহার জল সদা ঝরে আঁখি।
শোকাকুল মন সবে হৈল বড় দুঃখী।।
ধর্ম্ম অগ্রে কান্দি কহে মাদ্রীর তনয়।
এতদিনে মৃত্যুকাল হইল নিশ্চয়।।
ধরিতে না পানি প্রাণ জননী বিহনে।
দশদিক অন্ধকার লাগে রাত্রিদিনে।।
ভোজন না করে অনুক্ষণ মহাশয়।
রজনী দিবস নিদ্রা চক্ষে নাহি হয়।।
এইক্ষণে যদি আমি নাহি দেখি মায়।
অবশ্য মরিব দোঁহে কহিনু নিশ্চয়।।
এত বলি দুই ভাই কান্দে উচ্চৈঃস্বরে।
অস্থির হইয়া পড়ে ভূমির উপরে।।
ভীমসেন অর্জ্জুন কান্দেন দুইজন।
দ্রুপদনন্দিনী কৃষ্ণা কান্দে অনুক্ষণ।।
ধৃতরাষ্ট্র বধূগণ করে হাহাকার।
রাত্রিদিন শোক বিনা অন্য নাহি আর।।
কান্দিয়া রাজার প্রতি কহে সর্ব্বজন।
নিশ্চয় না রহে প্রাণ শুনহ রাজন।।
কুরুকুলনাথ অন্ধ সুবলনন্দিনী।
বিদুর সঞ্জয় আর কুন্তী ঠাকুরানী।।
তাঁহা সব বিহনে জীবন নাহি রয়।
ইহার বিধান শীঘ্র কর মহাশয়।।
এ শোক সাগরে কেহ তিলেক না জীবে।
যথা গেল অন্ধরাজ তথা যাব সবে।।
এইরূপ নৃপতিরে কহে সর্ব্বজন।
শুনিয়া ভাবিত চিত্তে ধর্ম্মের নন্দন।।
দিবারাত্রি কান্দিলেক মাদ্রীর তনয়।
শরীর ত্যজিবে দোঁহে হেন মনে লয়।।
কোনমতে প্রবোধ না হয় দুই ভাই।
পুরজন আদি সবে কাতর সবাই।।
অন্যমতে না হইবে শোক নিবারণ।
জ্যেষ্ঠতাত নিকটেতে যাইব কানন।।
সবারে কাতর দেখি পান্ডবের পতি।
বাহুড়িয়া আসিবেন হেন লয় মতি।।
কদাচিত বাহুড়িয়া যদি না আইসে।
সেইরূপে সবাই রহিব তাঁরপাশে।।
এইরূপ অনুমানি ধর্ম্মের নন্দন।
সবারে আশ্বাস করি প্রবোধিয়া কন।।
শোক দুঃখ ছাড়ি সবে স্থির কর মন।
সেই বনে সবে মোরা করিব গমন।।
রাজার বচনে সবে তুষ্ট হয়ে মনে।
সেইক্ষণে বাহির হইল সর্ব্বজনে।।
যুধিষ্ঠির পঞ্চ ভাই দ্রৌপদী সহিত।
ভীমসেন সুভদ্রা উত্তরা পরীক্ষিত।।
ধৃতরাষ্ট্র বধূগণ দুঃশলা সুন্দরী।
লিখনে না যায় যত চলে নরনারী।।
ত্রিবিধ বাহনে চলে আর পদব্রজে।
পঞ্চম শব্দেতে তাহে নানা বাদ্য বাজে।।
পূর্ব্বেতে ভারত যুদ্ধে সৈন্যের সাজনি।
তেমনি সাজিল অষ্টাদশ অক্ষৌহিনী।।
তাহা সবাকার ছিল যত নারীগণ।
সবাই চলিল ধৃতরাষ্ট্র দরশন।।
অষ্টাদশ অক্ষৌহিনী হেন অনুমানি।
মহারোলে কম্পমান হইল মেদিনী।।
হেনমতে ধর্ম্মরাজ চলিল ত্বরিত।
দ্বৈপায়ন কাননেতে হৈল উপনীত।।
গঙ্গাজলে স্মান করি প্রবেশি কাননে।
চলিলেন পঞ্চভাই সহ নারীগলে।।
বসিয়াছে ধৃতরাষ্ট্র কুটীর ভিতর।
মৌনভাবে একাসনে যুড়ি দুই কর।।
প্রণমিয়া পঞ্চভাই অন্ধের চরণে।
জৌষ্ঠতাত বলিয়া ডাকেন পঞ্চজনে।।
সমাধি ত্যজিয়া অন্ধ শুনিবারে পায়।
কে তুমি বলিয়া জিজ্ঞাসেন কুরুরায়।।
শুনি যুধিষ্ঠির কহিলেন সবিনয়।
তব ভৃত্য যুধিষ্ঠির শুন মহাশয়।।
এত শুনি অন্ধ যুধিষ্ঠিরে কোলে নিল।
অঙ্গে হাত বুলাইয়া শুভ জিজ্ঞাসিল।।
কহ তাত পুরের কুশল সমাচার।
কুশলে আছেতো সব বন্ধু পরিবার।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন কি কহিব আর।
তোমার সাক্ষাতে এই সব পরিবার।।
তোমা না দেখিয়া সব হৃদয় বিদরে।
আপনি রহিলা আদি কানন ভিতরে।।
কহ তাত কোথা মম গান্ধারী জননী।
কোথা কুন্তী মাতা মোর ভোজের নন্দিনী।।
খুল্লতাত কোথায় বিদুর মহাশয়।
তাঁ সবারে না দেখিয়া প্রাণ বাহিরায়।।
এত শুনি কহিতে লাগিল কুরুপতি।
ও কুটীরে তব মাতা গান্ধারী সংহতি।।
বিদুরের সমাচার নিশ্চয় না জানি।
জীয়ে কি না জীয়ে ভাই ক্ষতা গুনমণি।।
অনশন ব্রত করি ত্যজিয়া আহার।
একেশ্বর গেল ক্ষত্তা নিকটে গঙ্গার।।
চারিদিন আমা সহ নাহি দরশন।
জীয়ে কি না জীয়ে ভাই কর অন্বেষণ।।
শুনিয়া আকুল ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির।
চলিলেন গঙ্গাতীরে অন্তরে অস্থির।।
গঙ্গাতীরে বটমূলে দেখি একেশ্বর।
দীর্ঘ জটাভার পড়িয়াছে পৃষ্ঠোপরে।।
করপুটে বসিয়া আছেন মহাশয়।
প্রণাম করেন গিয়া ধর্ম্মের তনয়।।
আছে কিনা আছে প্রাণ না জানি নিশ্চয়।
উচ্চৈঃস্বরে ডাকে পঞ্চ পান্ডুর তনয়।।
ওহে খুল্লতাত বলি ডাকে ঘন ঘন।
কৃতাঞ্জলি করি ডাকে ভাই পঞ্চজন।।
ওহে মহাশয় পান্ডবের প্রাণদাতা।
ভৃত্যগণ ডাকে তুমি উঠি কহ কথা।।
বিষম সঙ্কট রক্ষা কৈলে পুনঃ পুনঃ।
যুধিষ্ঠির ডাকয়ে উত্তর নাহি কেন।।
ওহে খুল্লতাত কেন না শুন শ্রবণে।
কোন অপরাধে এত কোপ কৈলা মনে।।
এইরূপে পঞ্চ ভাই করেন রোদন।
দেখিলেন আকাশে থাকিয়া দেবগণ।।
দুই আখিঁ নিয়োজিল যুধিষ্ঠির পানে।
বিদুরের তেজ নিঃসরিল সেই ক্ষণে।।
দ্বিতীয় দেখায় যেন রবির কিরণ।
যুধিষ্ঠির অঙ্গে লিপ্ত হইল তখন।।
আকাশে অমরগণ পুষ্পবৃষ্টি করে।
জয় জয় শব্দ হৈল অমর নগরে।।
ভ্রাতৃগণে বলিলেন রাজা যুধিষ্ঠির।
দ্বিগুণ হইল তেজ আমার শরীর।।
পূর্ব্বের যতেক তেজ অঙ্গে মম ছিল।
অকস্মাৎ এখন দ্বিগুণ তেজ হৈল।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুন্যবান।।