০৬. দুটো হাতিকে সঙ্গী করে

দুটো হাতিকে সঙ্গী করে একজন মহিলা এমন নির্জন জঙ্গলে আছেন এবং তিনি নিজেকে বাঙালি ভাবেন। যদিও ওঁর কাজের মহিলা এখানে আছেন, কিন্তু সেই বৃদ্ধার থাকা আর না-থাকা একই। মেজর খুব নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনার অসুবিধে হয় না?

না। কিসের অসুবিধে? সবই তো আছে এখানে। নিজের নলকূপ, ইলেকট্রিক আনিয়েছি খুব লড়াই করে। খাই-দাই, বংশী বাজাই। অবশ্য প্রায়ই বেরিয়ে যেতে হয় এ-জঙ্গল সে-জঙ্গল। এখানে আর থাকি কতদিন! এই মাসি থাকে। এদিকের মানুষ, সাহস খুব।

পার্বতী বললেন, আসুন, কাজের কথা বলি। এত কষ্ট করে এখানে এলেন কেন?

মেজর বললেন, বিদেশের একটা কাগজে পড়েছি, এদিকের জঙ্গলে নাকি এখন এক ধরনের ফুল ফোটে, যার গন্ধ নাকে গেলে বড় জন্তুও মারা যায়। আসলে আমি একজন অভিযাত্রী। পৃথিবীর নানা প্রান্ত ঘুরেছি। অভিযান করেছি মেরুতেও। খবরটা পেয়ে স্থির থাকতে পারলাম না।

ফুলটাকে পেয়েছেন?

আমরা আজই জলপাইগুড়ি থেকে এখানে এসেছি।

কী জানি বাবা। এতকাল এখানে পড়ে আছি, কোনও দিন তো শুনলাম এমন ফুলের কথা!

আপনিও শোনেননি? মেজর যেন অবিশ্বাস করলেন।

না। কাগজে ওরকম উলটোপালটা কথা খুব লেখে। এই যেমন আমাকে নিয়ে বিদেশের কাগজ লিখল আমি নাকি ম্যাজিক জানি, তাই হাতিরা আমার কথা শোনে। একটা কাগজ লিখল আমি নাকি কুইন অব ফরেস্ট। ভাবুন। কিন্তু আমার কাছে কেন?

একটু আগে, যখন পরিচয় হয়েছিল, তখন পার্বতী অর্জুনের দিকে কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। সে সত্যসন্ধান করে, জানার পরেও কিছু বলেননি। অর্জুন এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। এবার বলল, আমি আপনার কথা খুব শুনেছি। আপনাকে দেখার আগ্রহ ছিল। বুদ্ধদেব গুহর লেখায় আপনার বাবার কথাও পড়েছি। এত কাছাকাছি যখন এলাম, তখন ঠিক করলাম আলাপ করতে হবে।

এই সময় দুটো প্লেটে গরম-গরম হালুয়া এসে গেল। পার্বতী একটা বেতের টুলে ডিশদুটো রেখে বললেন, নিন, খেয়ে নিন।

মেজর তাকালেন, সুজি? মিষ্টি দেওয়া?

আপনার মিষ্টি খাওয়া বারণ?

হ্যাঁ, মানে, রক্তে চিনির পরিমাণ বাড়ছে।

বাড়ুক। আপনাকে একটা টোটকা দিচ্ছি। সপ্তাহে দু দিন বাজার থেকে একটা ছোট চারাপোনা কিনে আনন। মাছটা যেন জ্যান্ত হয়। ওর পিত্তিটা ঠিকঠাক বের করে পাকা কলার ভেতর ঢুকিয়ে খেয়ে নেবেন। সুগার বেশি থাকলে একদিন অন্তর খেতে হবে। দেখবেন অসুখটা আর শরীরে নেই। খান।

মেজর অর্জুনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, চারাপোনা মানে?

অর্জুন বলল, রুই-মৃগেলের বাচ্চা। আপনাকে বাজারে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দেব।

ওরা সুজির প্লেটে হাত দিল। এক চামচ মুখে পুরে মেজর বললেন, ডিলিসিয়াস।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, হাতির সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কত দিনের?

ছ মাস বয়স থেকে। বাবার কোলে চেপে জঙ্গলে-জঙ্গলে ঘুরতাম। আমি যা জেনেছি, তা বাবার কাছ থেকেই পাওয়া। ওঁকে সরকার খুব সম্মান করত, উপদেষ্টা করে রেখেছিল। তখন আবহাওয়া অন্যরকম ছিল। এখন বেশির ভাগ মানুষ দায়িত্বহীন। জঙ্গলকে না ভালবেসে ফরেস্টের চাকরি করে। এই কিছু দিন আগে রাত্তিরবেলায় জিপ এল আমার কাছে। শুনলাম মাদারিহাট জঙ্গলে একটা হাতি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। গেলাম। সারা রাত থেকে হাতিটাকে সুস্থ করে তুললাম। এর পরে কী কী করতে হবে, বলে এলাম। কিন্তু নিশ্চয়ই তা করেনি। পরে খবর পেলাম বেচারা মরে গেছে। এসব দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়।

আমি শুনেছি ভুটান থেকে একদল মানুষ আসে হাতি ধরার জন্যে।

হ্যাঁ। ওরা আমার বাবার আমল থেকে আসে। বছরে দু-তিন মাস। অদ্ভুত ধৈর্য। সরকার যেকটা বাচ্চা হাতি চান, ত আমি ওদের নিয়ে ধরে দিই। যে টাকা পাওয়া যায়, তার অনেকটাই ওদের দিয়ে দিই। জীবন বিপন্ন করে রোজগার করতে হয়।

বিপন্ন বলছেন কেন?

যে-কোনও মুহূর্তেই, একটু অসতর্ক হলে প্রাণ যাবে বনের হাতির পায়ে।

আপনার কথা সেই হাতি শুনবে না?

শোনে কখনও? যে মা জানছে তার বাচ্চাকে আমি নিতে এসেছি, সে কখনও আমাকে পছন্দ করবে? কক্ষনো না। সে অনেক গল্প। নিন, চা খান।

চা এসেছিল। কাপে চুমুক দিয়ে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি সুন্দরকে চেনেন?।

কোন সুন্দর?

কাছাকাছি কোনও গ্রামে থাকে। জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে পাখি ধরে।

পার্বতীর মুখ আচমকা কঠিন হয়ে গেল, ওকে আপনি চিনলেন কী করে?

দু দিন আগে ওকে দেখেছি জলপাইগুড়িতে। অদ্ভুত ধরনের পাখি খাঁচায় করে নিয়ে গিয়েছিল বিক্রি করতে। আমি ওকে পুলিশে দিতে চেয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত ও কথা দিয়েছে, চাকরি পেলে আর পাখি চুরি করবে না। আমার সঙ্গে ডি এফ ওর কথা হয়েছে। তাই ওর খোঁজ করছি। অর্জুন বলল।

আপনি কি মনে করেন চাকরি পেলে সুন্দর পালটে যাবে?

ও শপথ করে তাই বলেছে।

কী জানি! তবে আজকাল বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। লোকটা একটা ক্রিমিন্যাল। প্রথম-প্রথম টিয়া, ময়না ধরত। সংসারী মানুষের শখ মেটাতে ওই সব পাখিদের খাঁচায় ঢুকতে হত। তারপর কানে এল সুন্দর আর টিয়া, ময়না ধরে না। ও ধরছে হিল প্যাট্রিজ, লেসার ফ্লোরিকান অথবা রিটার্ন। আমি অনেক বলেছি, কিন্তু কানে তোলেনি। শুনেছি, মাঝে-মাঝেই ওর কাছে গাড়ি চালিয়ে তোকজন আসে। কী বলে তা জানি না, কিন্তু অবস্থা ফিরে যাচ্ছে সুন্দরের। ওই সব পাখি ধরার জন্যে ওর যেমন শাস্তি হওয়া উচিত, তেমনই রোজগার ছিথাকতে খুব ভাল পিঠে উঠে যায়।

যারা ওর কাছে পাখিগুলো কেনে, তাদেরও জেলে পাঠানো দরকার।

সুন্দর রায় কোথায় থাকে?

বেশি দূরে নয়। আমার বাড়িতে আসতে যে ভাঙা ব্রিজটা দেখলেন, তার থেকে সিকি মাইল মাদারিহাটের দিকে গেলে ডান হাতে ছোট্ট গ্রাম পাবেন। এদিকে পায়ে হাঁটা পথ আছে, আরও কম দূরত্বের। আমি তো আজকাল ওর মুখ দেখতে চাই না।

কিন্তু ও আপনার নাম করেছে। এমনভাবে বলেছে যাতে মনে হয় সম্পর্ক ভাল।

বদমাশ। আসলে ও জানে, আমি ওর বউ-ছেলেকে ভালবাসি। যখন ওর রোজগার ছিল না তখন ওদের ডেকে এনে খাওয়াতাম। সুন্দরের ছেলেটা হাতির সঙ্গে থাকতে খুব ভালবাসে। হাতির কাজ শিখতে চায়। মাত্র সাত বছর বয়স কিন্তু স্বচ্ছন্দে হাতির পিঠে উঠে যায়। দেখুন, ওর বাপকে যদি চাকরি করাতে পারেন, তা হলে পরিবারটা রক্ষা পায়।

কথা বলায় ব্যস্ত থাকলেও পার্বতীর কান যে পরিষ্কার, তা বোঝা গেল। তিনি আপন মনে বললেন, এই সময়ে আবার কে আসছে।

খুব ক্ষীণ একটা আওয়াজ এগিয়ে আসছিল। আওয়াজটা গাড়ির ইঞ্জিনের। তারপরেই ওরা গাড়িটাকে দেখতে পেল। নীল মারুতি। বাঁক নিয়ে যেই দেখল আর-একটি জিপসি দাড়িয়ে আছে, অমনি মারুতিটা থেমে গেল। মারুতিতে দুজন আরোহী। তারপরই হর্ন বাজাল।

অর্জুন দেখল আওয়াজ হওয়ামাত্র হাতিদুটো ধীরে-ধীরে এদিকে এগিয়ে আসছে। তাই দেখে তাদের ড্রাইভার চটপট গাড়িতে উঠে বসল। একেবারে বাড়ির সামনে পৌঁছে হাতিদুটো স্থির হয়ে দাড়াল। যেন তাদের অতিক্রম করে কেউ যেন পার্বতীর কাছে পৌঁছ: না পারে এমন ভঙ্গি। মারুতির লোকদুটো কী করবে বুঝতে পারছিল না। হাতিদুটোর ভঙ্গি ওদের সাহস কেড়ে নিয়েছে। একজন চিঙ্কার করল, ওখানে কেউ আছেন?

পার্বতী উঠে ব্যালকনির একধারে এগিয়ে গেলেন, কী চাই ভাই?

আপনি পার্বতী বড়ুয়া?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

সুন্দর কি এখানে এসেছে?

প্রশ্নটা শুনে অর্জুন চমকে তাকাল। এবং তারপরেই সে চিনতে পারল। অমলদার খবর নিয়ে হাবু যে-সকালে তাকে ডাকতে গিয়েছিল, সেই সকালেই ওই নীল মারুতিটাকে সে জলপাইগুড়ির রাস্তায় বেপরোয়া চালাতে দেখেছে। এক ঝলক যে-মুখটাকে সেদিন দেখেছিল, তার সঙ্গে আজকের ড্রাইভারের কোনও পার্থক্য নেই। রামদা বলেছিলেন বরেন ঘোষালের ছোট ভাই।

পার্বতী চেঁচিয়ে জবাব দিলেন, এখানে সে আসবে কেন?

সেটা আপনি জানেন। আমরা খবর পেলাম ও এখানে আসতে পারে, তাই জিজ্ঞেস করছি।

আপনারা কারা?

এবার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না ওরা। ওই ছোট রাস্তাতেই গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে গেল দ্রুতগতিতে। গাড়ির আওয়াজ মিলিয়ে যাওয়ামাত্র কচি গলায় অদ্ভুত শব্দ বাজল। অর্জুন দেখল হাতিদুটো বেশ সহজ হয়ে শুড় নেড়ে ফিরে যাচ্ছে নিজের জায়গায়। আর পাশের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে একটি বাচ্চার সঙ্গে ঘোমটা টানা মহিলা।

পার্বতী বললেন, নিশ্চয়ই কোনও গোলমাল হয়েছে। সুন্দরের বউ-ছেলে আসছে।

বাচ্চাটা এদিকে না এসে হাতিদের কাছে চলে গেল। নিজের মনে কথা বলে। চলেছে সে। একটা হাতি বসে পড়তেই সে চট করে পিঠে উঠে একেবারে আকাশের দিকে মুখ করে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। মহিলাটি সিঁড়ির নীচে এসে দাড়াতেই পার্বতী জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? সুন্দরের কী হয়েছে?

মহিলা দিশি ভাষায় জড়ানো গলায় যা বলল, তার সারার্থ হল : এবার শহর থেকে ফিরে এসে সুন্দরের হাবভাব পালটে গিয়েছিল। কেবলই বলত, অনেক অন্যায় করেছি, আর নয়। এবার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। ঘর থেকে বের হত না। গম্ভীর মুখ দেখে মহিলা কিছু বলতে সাহস পায়নি। গতকাল হাসিমারা থেকে একটা লোক এসেছিল ডাকতে, সে দেখা করেনি। স্ত্রীকে বলেছিল বলতে, বাড়ি নেই। লোকটা বলে গিয়েছিল সুন্দর যেন নীলুবাবুর সঙ্গে দেখা করে। শোনার পর বেশ ভয় পেয়ে যায় সুন্দর। স্ত্রীকে বলে, কিছু দিনের জন্য সে এই জঙ্গল ছেড়ে চলে যাবে। দরকার হলে আরও ভেতরে ভুটানের জঙ্গলে ঢুকে যাবে। যা টাকা আছে, তাতেই বউ যেন কোনও মতে চালিয়ে যায়। জলপাইগুড়ি থেকে কেউ যদি তাকে চাকরি করার জন্য খোঁজ করে, তা হলে বলতে হবে পরে দেখা করবে। মহিলা অনেক জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও সুন্দর কারণ বলেনি। আজ একটু আগে ওই নীল গাড়িটা সুন্দরের খোঁজে এসেছিল। ও সঙ্গে-সঙ্গে পেছনের দরজা দিয়ে জঙ্গলে ঢুকে যায়। এখন দুশ্চিন্তায় মাথা ঠিক রাখতে পারছে না মহিলা। তাই ছেলেকে নিয়ে ছুটে এসেছে পার্বতীর কাছে।

সব শোনার পর পার্বতী জিজ্ঞেস করলেন, আমার কথা ওদের কে বলেছে? তুমি?

মহিলা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। কারণ, একটা লোক এমন শাসাচ্ছিল যে, মহিলা মনে করেছিল দিদির কাছে পাঠিয়ে দিলে ওরা শায়েস্তা হয়ে যাবে।

পার্বতী ঘুরে দাড়ালেন, কী করি বলুন তো! এই মেয়েটার স্বামী হল সুন্দর রায়। নিশ্চয়ই কোথাও কোনও অন্যায় করে এসেছে, তাই লোকজন ওকে খুঁজছে। এখন উপায় না দেখে বউ-ছেলেকে ফেলে জঙ্গলে পালিয়ে গেছে। এইরকম লোককে কখনও বিশ্বাস করা যায়?

অর্জুন বলল, আপনি যা ভাবছেন, তা নাও হতে পারে। শুনলেন তো, শহর থেকে ফিরে আসার পর ওর মধ্যে পরিবর্তন এসেছিল। লোকটার মধ্যে অন্যায়বোধ ছিল, হয়তো আমার সঙ্গে কথা বলার পর সেটা বেড়ে যাওয়ায় ও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। এই লোকগুলো হয়তো কোনও অন্যায় কাজে লাগাতে চায় বলেই ও জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে চাইছে। সুন্দরকে না পেলে এর কারণ জানা যাবে না। তা ছাড়া ওই নীলগাড়ির ড্রাইভার লোক ভাল নয়। ওর সম্পর্কে শহরের লোকদের ধারণা ভাল নয়।

মেজর জিজ্ঞেস করলেন, কে ও?

জলপাইগুড়ির শিল্পসমিতি পাড়ায় বরেন ঘোষালের ছোট ভাই। উনি থাকেন বোম্বাইয়ে, সম্প্রতি উদয় হয়েছেন। কিন্তু অর্জুন হঠাৎ চুপ করে গেল। সে দুটো মানুষের মধ্যে সম্পর্ক কী হতে পারে ভেবে পাচ্ছিল না। মেজর বললেন, সেন্টেন্স শেষ করোনি।

ওই মহিলা বললেন একটা লোক এসে হুকুম করে গিয়েছিল, নীলুবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। এই নীলুবাবুর পরিচয় আপনি জানেন? অর্জুন পার্বতীকে জিজ্ঞেস করল।

পার্বতী মাথা নাড়লেন, ব্যানার্জি টি এস্টেটের ওনারের ভাই। শুনেছি খুব বাজে লোক, কিন্তু আমার সঙ্গে কখনও পরিচয় হয়নি।

বাঃ। নীলুবাবুর সঙ্গে বরেন ঘোষালের ছোটভাইয়ের একটা যোগসূত্র থাকা অসম্ভব নয়। গাড়ি চালানোর ব্যাপারে দুজনের তো চমৎকার মিল। কিন্তু এই জঙ্গলে কোনও মানুষের পক্ষে বেশি দিন লুকিয়ে থাকা কি সম্ভব? যত দূর জানি, এদিকের জঙ্গলে ফলটল তেমন নেই। অর্জুন বলল।

ঠিকই শুনেছেন। মানুষ যেসব ফল খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে, তা পাওয়া যাবে না। তবে মাটির নীচে যেসব হয়, যেমন শাঁকালু খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। তাই সুন্দরকে খাবারের জন্য বেরিয়ে আসতেই হবে। তবে এদিকে সে নাও আসতে পারে। জঙ্গলের বুকেই ছোট-ছোট পাহাড়ি গ্রাম আছে। সেখানেই যাওয়া ওর পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু এদের এখন কী বলি। পার্বতীকে চিন্তিত দেখাল। তিনি ব্যালকনি থেকেই গলা তুললেন, ঠিক আছে। তুমি ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। মনে হয়, রাত নামলে সুন্দর বাড়িতে ফিরে যাবে। আর যদি না যায়, তা হলে কাল সকালে এসো। বাচ্চাটাকে কিছু খাইয়েছ?

হ্যাঁ। কিন্তু যে-টাকা ও শহর থেকে পাখি বিক্রি করে এনেছে, তাতে হাত দেইনি। ও বলেছে, পাপের টাকা।

সেই টাকা কোথায়?

হাঁড়িতে রেখে দিয়েছে।

পার্বতী একটু চিন্তা করলেন, তা হলে ও এখানে থাক। তুমি জামা কাপড় নিয়ে চলে এসো।

মহিলা দ্রুত জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল। ওপাশে ছেলেটা তখনও হাতির পিঠে শুয়ে আছে। মেজর সেটা লক্ষ করে মন্তব্য করলেন, জুনিয়ার টারজান।

পার্বতী চিৎকার করলেন, মধু, নেমে আয়। সন্ধে হয়ে আসছে।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর যে সংখ্যায় আপনার ছবি ছাপা হয়েছিল, সেটা কি এখানে আছে? থাকলে দেখতাম।

পার্বতী ভেতরে চলে গেলেন। এই সময় দূরে রেলের কয়লার ইঞ্জিনের হুইল শোনা গেল। আর তারপরই চরাচর কঁপিয়ে একটা রেলগাড়ি দূরের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলে গেল আসামের দিকে। শেষ আলোয় মাখামাখি আকাশ এবং জঙ্গলের পটভূমিকায় রেলগাড়ির চলন্ত দৃশ্য কী মনোরম! ছেলেটা চট করে হাতির ওপর উঠে দাড়িয়ে সেই রেলগাড়ির ছুটে যাওয়া দেখছিল। হঠাই অর্জুনের মনে পড়ে গেল পথের পাঁচালির অপুর রেলগাড়ি দেখার দৃশ্য। ওই ছেলেটার সঙ্গে অপুর এই মুহূর্তে কোনও পার্থক্য নেই। দুজনের চোখের অভিব্যক্তি একই।

পার্বতী একটা ঝকঝকে রঙিন পত্রিকা নিয়ে এলেন। পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান পত্রিকা, যার মলাটে হাতির পিঠে বসে থাকা পার্বতীকে দেখা যাচ্ছে। পার্বতী সম্পর্কে একটা সুন্দর ক্যাপশন রয়েছে মলাটে। ভেতরেও তাকে নিয়ে অনেকটা লেখা।

এটা বের হওয়ার পর কেউ যোগাযোগ করেনি আপনার সঙ্গে?

হ্যাঁ, বিদেশিরা করেছেন। তাঁরা ক্যামেরা নিয়ে আসেন টিভির জন্যে। এই তো, বিখ্যাত এক ইংরেজ সাহেব আসছেন দিল্লিতে। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। তার অফিসের লোকজন আমাকে দিল্লিতে যেতে লিখেছেন। কে যাবে? আমার কাজ নেই নাকি? যাদের দরকার, তাঁরা আসুন আমার কাছে। আমি কেন যাব? তাই জানিয়ে দিয়েছি।

অর্জুনের খুব শ্রদ্ধা বাড়ল। সে বলল, দিদি, আপনার কাছে আবার আসব।

আসুন ভাই। এসেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, এখানে একা থাকতে ভয় লাগে কি না। বনের জন্তুকে আমি মোটেই ভয় করি না। ভয় মানুষকে। মানুষের মতো লোভী জানোয়ার ভগবান আর সৃষ্টি করেননি।