০৬. দুঃস্বপ্ন

দুঃস্বপ্ন

সুহানের ঘুম ভাঙল বিচিত্র শব্দ শুনে, শব্দটি সে ধরতে পারল না। আধো ঘুমের মাঝে শব্দটি কী হতে পারে ভাবতে ভাবতে সে আবার ঘুমিয়ে পড়ছিল, তখন সে দ্বিতীয়বার শব্দটি শুনতে পেল। সুহান এবার চোখ খুলে তাকায়, তার দুপাশে দু জোড়া সবুজাভ চোখ। সে লাফিয়ে উঠে বসতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন সে একটি ধাতব কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, আমার মনে হয় এখন নড়াচড়া করা অত্যন্ত অবিবেচকের মতো কাজ হবে।

সুহান কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে শুরু স্বরে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কে?

ঘরের একটা আলো জ্বলে ওঠে তখন। আলোটা কোথা থেকে আসছে সে ধরতে পারে না। তার পাশে দুটি রবোট। ট্রিনির মতো নয়, দেখতে অন্যরকম। দেহ আকারে আরেকটু ছোট, বুকের মনিটরটি আরো অনেক জটিল। দুটি রবোটের হাতেই একটি করে বিচিত্র অস্ত্র। অস্ত্র থেকে ছোট একটি আলো জ্বলছে এবং নিভছে, নিঃসন্দেহে তাকে দৃষ্টিবদ্ধ করা আছে, একটু ভুল হলেই শেষ করে দেবে। সুহান বিছানায় বসে আবার জিজ্ঞেস করল, তোমরা কে?

মহামান্য কিরি আমাদের এখানে পাঠিয়েছেন আপনাকে নিয়ে যাবার জন্যে।

আমি যদি যেতে না চাই?

আপনাকে শক্তি প্রয়োগ করে নেয়া হবে।

রবোটদের নীতিমালায় লেখা আছে তাদের মানুষের কোনো ক্ষতি করার ক্ষমতা নেই কিন্তু সে কথাটি তাদের বলা নিশ্চয়ই অর্থহীন। কিরি নিঃসন্দেহে তাদের অন্যভাবে প্রোগ্রাম করে রেখেছে। সুহানের হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে ওঠে। তার জীবনে সে ভয়ঙ্কর আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছে খুব কম, ব্যাপারটির সাথে তার ভালো পরিচয় নেই।

একটা রবোট হঠাৎ তার উপর ঝুঁকে পড়ল। সুহান তার শুকনো ঠোঁট দুটি জিভ দিয়ে ভিজিয়ে বলল, তুমি কী করছ?

আপনার শরীরে কন্ট্রালিনের একটি ইনজেকশান দিচ্ছি।

সেটি কী?

সেটি এক ধরনের ওষুধ। আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে।

আমি ঘুমাতে চাই না।

কিন্তু আমাদের ওপর সেরকম নির্দেশ।

সুহান দেখতে পায়, রবোর্টটি হাতে ছোট সিরিঞ্জের মতো কী একটা নিয়ে তার উপর ঝুঁকে পড়েছে। বাধা দেয়া অর্থহীন কিন্তু তার সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে রবোটটির হাত ধরে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল। পারল না। তার কজিতে সুচ ফোটানোর তীক্ষ্ণ একটু যন্ত্রণা অনুভব করল। সুহান বুঝতে পারে তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে, ভয়ঙ্কর হতাশায় সে ডুবে যাচ্ছিল, ফিসফিস করে বলল, ট্রিনি, তুমি কোথায়?

ট্ৰিনি পাশের ঘরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। চতুর্থ প্রজাতির কিউ-২২ রবোটের উপস্থিতিতে সে একটি জড় পদার্থ। বাধা দেয়া দূরে থাকুক, তার একটি আঙুল তোলারও ক্ষমতা নেই। সুহানের কাতর কণ্ঠস্বর শুনে তার কপোট্রনে বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ খেলা করতে থাকে, ডান হাতটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে ঝটকা দিয়ে কেঁপে উঠতে থাকে, সেটিকে সে থামানোর কোনো চেষ্টা করে না। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, সুহানের দেহকে দুপাশ থেকে ধরে দুটি রবোট তাদের বাই ভার্বালে উঠে যাচ্ছে। শক্তিশালী ইঞ্জিনকে গুঞ্জন করে উঠতে শুনল সে। তারপর সেটিকে মিলিয়ে যেতে দেখল দূরে।

ট্ৰিনি শূন্য ঘরটিতে কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘুরে বেড়াল। ঘরে সুহানের ছড়ানো ছিটানো যন্ত্রপাতিগুলো গুছিয়ে তুলে রাখল। তার শরীর থেকে বের করা পালসারের বাক্সটি দেখে মনে পড়ল, পালসারটি সুহানের কাছে রয়ে গেছে। কোথায় রাখা যায় ভেবে না পেয়ে গত রাতে সুহানের নখে টেপ দিয়ে লাগিয়ে রাখা হয়েছিল। সুহানের নিও পলিমারের কাপড় পরিষ্কার করতে নিয়ে যাওয়ার সময় ট্রিনি হঠাৎ করে বুঝতে পারল, এই কাজটি অর্থহীন। সুহান আর কখনো এই ঘরে ফিরে আসবে না। ট্রিনি আবিষ্কার করে, তার আর কিছু করার নেই।

সে ঘরের ঠিক মাঝখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

 

০২.

ঘুম ভাঙার পর সুহানের অনেকক্ষণ লাগল বুঝতে সে কোথায়। চোখের সামনে সবকিছু ধোয়াটে, যেন হালকা কুয়াশার আস্তরণ। কোথায় যেন কর্কশ একটা শব্দ হচ্ছে। তার শরীর শীতার্ত, মাথার মাঝে এক ধরনের ভোঁতা যন্ত্রণা। কপালের কাছে একটা শিরা দপদপ করছে। সুহানের প্রথমে মনে হল সে মারা গেছে, কিন্তু মৃত মানুষের কি মাথায় যন্ত্রণা হতে পারে?

সুহান আবার ভালো করে চোখ খুলে তাকাল। না, সে মারা যায় নি। মাথার কাছে মনিটরে আলো জ্বলছে। তার শরীরে নানা ধরনের সেন্সর লাগানো। সেগুলো থেকে নানারকম সঙ্কেত বিচিত্র যন্ত্রপাতিতে যাচ্ছে। মনিটরে তার তাপমাত্রা, রক্তচাপ, হৃৎস্পন্দন, মেটাবলিজম থেকে শুরু করে মস্তিষ্কের কম্পন পর্যন্ত লক্ষ রাখা হচ্ছে। মৃত মানুষের শরীরে কোনোকিছু লক্ষ রাখার প্রয়োজন হয় না।

সুহান উঠে বসে। বেশ বড় একটা ঘর। ঘরের দেয়াল ধবধবে সাদা। সারা ঘরে এক ধরনের নরম আলো, অনেকটা দ্বিতীয় সূর্যের আলোর মতো। আলোটা কোথা থেকে আসছে বোঝা যাচ্ছে না। সুহান নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে হ্যাচকা টান দিয়ে সবগুলো সেন্সর খুলে ফেলল। সাথে সাথে দূরে কোথাও তীক্ষ একটা শব্দ হতে থাকে এবং কিছুক্ষণের মাঝেই প্রথমে একটি রবোট এবং তার পিছু পিছু একজন দীর্ঘকায় মানুষ প্রবেশ করে। সুহান মানুষটিকে চিনতে পারল, মহাকাশযানের দলপতি কিরি এবং সাথে সাথে তার মনে পড়ল, মানুষের মতো দেখালেও কিরি একটি রবোর্ট।

কিরি সুহানের কাছে এসে বলল, শুভ সন্ধ্যা সুহান।

সুহান কিরির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার শরীর এখনো দুর্বল। মস্তিক হালকা, মনে হতে থাকে পৃথিবীর কোনোকিছুতেই কিছু আসে যায় না। কিরির দিকে তাকিয়ে সে নিজের ভিতরে এক ধরনের বিজাতীয় ঘৃণা অনুভব করতে থাকে। কিরি আরেকটু এগিয়ে এসে আবার বলল, শুভ সন্ধ্যা সুহান।

সন্ধ্যাটি কি সত্যিই আমার জন্যে শুভ?

কিরি শব্দ করে হেসে বলল, শুভ-অশুভ খুব আপেক্ষিক ব্যাপার। একজনের কাছে যেটি শুভ, অন্যজনের কাছে সেই একই ব্যাপার

সুহান কিরির আপাতদার্শনিক উত্তরে বাধা দিয়ে বলল, তুমি সত্যিই আমাকে মেরে ফেলবে?

কিরি তার প্রশ্নের উত্তর দিল না। সুহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, রবোটেরা মানুষের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। তুমি তাহলে কেমন করে একজন মানুষের ক্ষতি করতে পার?

কিরি অন্যমনস্কের মতো বলল, ব্যাপারটা খুব জটিল। মানুষ কথাটির একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে। শুধু জৈবিকভাবে মানুষ হলেই হয় না। মানুষ হতে হলে পৃথিবীর তথ্যকেন্দ্রে তার জন্ম-পরিচয় থাকতে হয়। তোমার সেই পরিচয় নেই, তাই তোমার সাথে একটা বন্যপশুর কোনো পার্থক্য নেই।

যদি তথ্যকেন্দ্রে জন্ম-পরিচয় থাকত?

তাহলে ব্যাপারটা অন্য রকম হতে পারত।

সুহান খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমাকে তুমি তোমার মহাকাশযানের মানুষদের সাথে দেখা করতে দেবে?

না।

কেন নয়?

সেটি পুরো ব্যাপারটাকে আরো জটিল করে দেবে।

সুহান আর কোনো কথা বলল না। কিরি ঘরে ইতস্তত হেঁটে এসে বলল, আমাকে স্বীকার করতেই হবে, তোমাকে আমি যত সহজে ধরে আনব ভেবেছিলাম তত সহজে ধরে আনতে পারি নি। তুমি সত্যি সত্যি আমাকে ধোকা দিতে পেরেছিলে। পুরো ব্যাপারটা যখন দ্বিতীয়বার চিন্তা করেছি তখন বুঝতে অসুবিধে হয় নি যে, পালসারটা তোমার শরীরেই আছে, তুমি দ্বিতীয় একটি পালসার গ্রহের সবচেয়ে দুর্গম অঞ্চলে পাঠিয়েছ—

আমাকে কি তুমি একা থাকতে দেবে?

কিরি একটু হকচকিয়ে গিয়ে বলল, তুমি আমাকে চলে যেতে বলছ?

হ্যাঁ। সুহান ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি নিম্ন শ্রেণীর রবোটকে দেখিয়ে বলল, তুমি যাবার সময় কি ওই রবোর্টটাকেও নিয়ে যাবে? তোমাদের রবোটদের আমার ভালো লাগে না।

কিরির মুখে অপমানের ছায়া পড়ল, তাকে এর আগে অন্য কেউ একটি দ্বিতীয় প্রজাতির রবোটের সাথে এক করে দেখে নি। সে শক্তমুখে বলল, এই রবোর্টটি তোমাকে চোখে চোখে রাখবে। সে তোমার সাথে এই ঘরে থাকবে। আমি যাচ্ছি, তোমাকে একা থাকতে দিচ্ছি।

কিরি লম্বা পা ফেলে ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ থেমে সুহানের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, সুহান, তোমার সাথে সম্ভবত আমার আর দেখা হবে না। তোমাকে একটা জিনিস বলা প্রয়োজন। তুমি মনে করছ তোমার মৃত্যু–

সুহান চিৎকার করে বলল, আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না।

কিন্তু–

বের হয়ে যাও। তুমি বের হয়ে যাও

কিরি বের হয়ে গেল। সাথে সাথে সুহান ছেলেমানুষের মতো কেঁদে উঠল। দুই হাতে মুখ ঢেকে সে বিছানায় মাথা গুজে আহত পশুর মতো ছটফট করতে থাকে। তার বুকে গভীর হতাশা, গভীর যন্ত্রণা—যে অনুভূতির সাথে তার পরিচয় নেই। সে ফিসফিস করে বলল, ট্রিনি! ট্রিনি তুমি কোথায়?

 

লাইনার ঘরে চতুষ্কোণ স্ক্রিনে হঠাৎ কিরির ছবি ফুটে ওঠে। লাইনাকে ডেকে বলল, লাইনা।

বল।

আমি তোমাকে একটি জিনিস দেখাতে চাই।

লাইনার বুক কেঁপে উঠল হঠাৎ। ভয় পাওয়া গলায় বলল, না, আমি দেখতে চাই না।

তোমাকে দেখতে হবে লাইনা।

না। লাইনা চিৎকার করে বলল, না—

কিরি লাইনার কথা শুনল না। স্ক্রিনে সুহানের ছবি ভেসে উঠল। বিছানায় মাথা গুজে ফুলে ফুলে কাদছে। অসহায় একটি কিশোর। অসহায়, ভীত একটি কিশোর। যে মানুষের আশ্রয়ে ছুটে এসেছিল, যে মানুষ তাকে রক্ষা করতে পারে নি।

লাইনা হিংস্র দৃষ্টিতে স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে থাকে। সে আর দেখতে পারছে না, টেবিল থেকে চতুষ্কোণ কমিউনিকেশান মডিউলটি তুলে সে স্ক্রিনটির দিকে ছুড়ে দেয়। ঝনঝন শব্দ করে ভেঙে পড়ে স্ক্রিনের স্বচ্ছ কাচ। কয়েকবার কেঁপে কেঁপে ছবিটা অদৃশ্য হয়ে যায় স্ক্রিন থেকে।

 

০৩.

সুহান কতক্ষণ বিছানায় মাথা গুঁজে ছিল সে জানে না। হঠাৎ একটি কণ্ঠস্বর শুনে সে ঘুরে তাকায়, রবোর্টটি কিছু খাবার নিয়ে এসেছে।

আমাকে তাহলে এই মুহূর্তে মারবে না, সুহান নিজেকে বোঝাল, তাহলে এখন খাবার এনে হাজির করত না। কিংবা কে জানে হয়তো পরিপাকযন্ত্র কীভাবে কাজ করে জানতে চাইছে, তাই খাবারটা মুখে দেয়ামাত্রই মেরে ফেলবে।

আপনার খাবার, মহামান্য সহান। রবোটটি দ্বিতীয়বার কথা বলল, যান্ত্রিক একঘেয়ে গলার স্বর। সুহান খাবারগুলোর দিকে তাকাল। সে তার মহাকাশযানের রসদ থেকে যে ধরনের খাবার খেয়ে অভ্যস্ত তার থেকে একটু ভিন্ন ধরনের। অন্য সময় হলে সে খাবারগুলো কৌতূহল নিয়ে দেখত, এখন কোনো কৌতূহল নেই। খাবারগুলো দেখে হঠাৎ সুহান বুঝতে পারে সে ক্ষুধার্ত। কিন্তু এই মুহূর্তে তার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। সে রবোটটিকে বলল, তুমি খাবারটি রেখে চলে যাও।

আমার চলে যাওয়ার নির্দেশ নেই।

তোমার কিসের নির্দেশ রয়েছে?

আপাতত আপনার জন্যে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা।

তাহলে দাঁড়িয়ে থাক।

আপনার খাবার, মহামান্য সুহান।

সুহান বুঝতে পারে এটি অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণীর রবোট। হঠাৎ করে তার মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল। এই নির্বোধ রবোটটিকে কি কোনোভাবে ধোকা দেয়া সম্ভব?

সুহান আবার রবোটটির দিকে ঘুরে তাকাল, চতুষ্কোণ দেহ, বর্তুলাকার মাথা, উপরের অংশটুকু সম্ভবত চোখ, পায়ের নিচে চাকা, সম্ভবত সহজে সমতল জায়গার বাইরে যেতে পারে না। সুহান ট্রে থেকে এক টুকরা তুলে নিয়ে বলল, তুমি কোন শ্রেণীর রবোট?

উত্তর দেয়ার অনুমতি নেই, মহামান্য সুহান।

তুমি কি আমাকে চোখে চোখে রাখছ?

হ্যাঁ, মহামান্য সুহান।

সুহান হেঁটে রবোটটির পিছনে গিয়ে দাঁড়াল, রবোটটি কিন্তু সাথে সাথে তার দিকে ঘুরে তাকাল না। সুহান বলল, তুমি আমার দিকে তাকিয়ে নেই, আমি ইচ্ছে করলেই দরজা খুলে বের হয়ে যেতে পারি।

রবোটটি তখন সুহানের দিকে ঘুরে তাকাল, তারপর বলল, মহামান্য সুহান, দরজার সাথে এলার্ম লাগানো হয়েছে। আপনি খুলে বের হতে পারবেন না। তাছাড়া দরজায় শক্তিবলয় লাগানো হয়েছে, আপনি বের হওয়ার চেষ্টা করলে আপনার শরীরে আনুমানিক তিন শ চৌত্রিশটি ফুটো হয়ে যাবে।

তিন শ চৌত্রিশটি?

জি, মহামান্য সুহান।

সুহান দরজাটির দিকে তাকাল। দরজার সাথে একটি এলার্ম লাগানো হয়েছে দেখা যাচ্ছে। সেটি বিকল করা কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। দরজা খোলার পর সম্ভবত অন্য পাশে রবোটটির শক্তিবলয় ব্যাপারটি দেখা যাবে। শক্তিবলয় কথাটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার হতে পারে। উচ্চচাপের বিদ্যুৎ বা অদৃশ্য লেজার সম্ভবত এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। যেহেতু রববাটটি জানে, বের হওয়ার চেষ্টা করলে তার শরীরে তিন শ চৌত্রিশটি ফুটো হয়ে যাবে, এটি সম্ভবত লেজার রশ্মি, দরজার দুই পাশে প্রতিফলিত হয়ে যাচ্ছে। কোথা থেকে বের হচ্ছে জানতে পারলে একটি চকচকে জিনিস দিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে আটকে রাখা যায়।

কিন্তু দরজা দিয়ে বের হওয়ার আগে রবোটটিকে ধোকা দিতে হবে। সেটি কেমন করে করা হবে?

সুহান আবার রবোটটির পিছনে হেঁটে গেল, রবোটটি সাথে সাথে তার দিকে ঘুরে গেল। সুহান জিজ্ঞেস করল, তুমি কি এখনো আমার দিকে লক্ষ রাখছ?

রাখছি, মহামান্য সুহান।

কেমন করে? তুমি আমার দিকে তাকিয়ে নেই।

আপনার দিকে না তাকিয়েও আমি আপনার দিকে লক্ষ রাখতে পারি মহামান্য সুহান।

সুহান ঘরে পায়চারি করতে থাকে। এটি অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণীর রবোট, তাকে লক্ষ রাখার জন্যে অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণীর একটি পদ্ধতি ব্যবহার করছে। পদ্ধতিটি কী হতে পারে?

হঠাৎ সে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে ওঠে, পালসার! তার শরীর থেকে পালসারটি বের করে সেটি কোথায় রাখা যায় চিন্তা করে না পেয়ে আপাতত তার বুড়ো আঙুলের নখে একটা টেপ দিয়ে লাগিয়ে রাখা হয়েছিল। পালসারটির কথা ভুলেই গিয়েছিল সে। একটু আগে কিরি যখন এর কথা উল্লেখ করেছিল সে বুঝতে পারে নি। কিউ-২২ রবোটগুলো তাই এত সহজে তাকে তার ইঞ্জিনঘরে খুঁজে পেয়েছিল। এখন এই রবোটটি নিশ্চয়ই সব সময় তার পালসারের সঙ্কেতটুকু লক্ষ করছে। ব্যাপারটি সত্যি কি না খুব সহজে পরীক্ষা করা যায়। রবোটটির পিছনে গিয়ে তার নখে লাগানো পালসারটি একটা ধাতব কিছু দিয়ে ঢেকে ফেলবে। রবোর্টটি তখন নিঃসন্দেহে তার দিকে ছুটে আসবে।

সুহান তার খাবারের টেবিল থেকে একটা চামচ তুলে নেয়, তারপর রবোটের পিছনে দাঁড়িয়ে চামচটা দিয়ে তার হাতের বুড়ো আঙুলের নখটা ঢেকে ফেলে। সাথে সাথে রবোটটি বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে যায় এবং পাগলের মতো তার দিকে ছুটে আসে। সে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও তাকে রবোটটি দেখতে পেল বলে মনে হল না, তার পাশ দিয়ে ছুটে যেতে শুরু করল।

সুহান তার নখের উপর থেকে চামচটা সরিয়ে বলল, কী হয়েছে তোমার?

আপনাকে খুঁজছিলাম, মহামান্য সুহান। মুহূর্তের জন্যে আপনি হারিয়ে গিয়েছিলেন।

না, আমি হারাই নি। আমি এখানেই আছি।

উত্তেজনায় সুহানের বুক কাঁপতে থাকে। এই ঘর থেকে পালিয়ে যাবার চমৎকার একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। তার বিছানার উপর পালসারটি রেখে সে দরজার কাছে যাবে। চামচটিকে একটা হাতের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এলার্মটি বন্ধ করে দেবে। তারপর দরজা খুলে লেজাররশ্মিটি কোন বিন্দু থেকে বের হচ্ছে বের করে সেটি চামচ দিয়ে ঢেকে দেবে। চামচটি চকচকে, লেজাররশ্মি সহজেই প্রতিফলিত হয়ে যাবে। তারপর সে লাফিয়ে এই ঘর থেকে বের হয়ে যাবে। এই মহাকাশযানটি ঠিক তার মহাকাশযানের মতো। একবার বের হতে পারলে কোনদিকে যেতে হবে সে জানে।

তাকে এই মুহূর্তে কেউ লক্ষ করছে কি না সে জানে না। সম্ভবত উপরে কোনো ক্যামেরা রয়েছে। কিন্তু সেটা নিয়ে সে এখন চিন্তা করবে না। সুহান তার কাজ শুরু করে দিল।

তিন মিনিট পর মহাকাশযানের করিডোর ধরে সুহানকে ব্যস্ত হয়ে ছুটে যেতে দেখা গেল।

 

০৪.

মহাকাশযানের তিনটি জেনারেটর নিচে। ঘরটি নির্জন, কোনো মানুষজন নেই। পারমাণবিক শক্তি দিয়ে জেনারেটরগুলো চালানো হয়। প্রথম জেনারেটরটি সর্বক্ষণ চলতে থাকে। কোনো কারণে সেটি অকেজো হয়ে গেলে দ্বিতীয় জেনারেটরটি চলতে শুল্ক করে। সম্ভাবনা খুব কম কিন্তু যদি কোনো কারণে একই সাথে প্রথম এবং দ্বিতীয়, দুটি জেনারেটরই অকেজো হয়ে যায়, তখন তৃতীয় জেনারেটরটি চলতে শুরু করে। যদি কোনোভাবে তৃতীয় জেনারেটরটিও অকেজো হয়ে যায় তখন মহাকাশযানের সংরক্ষিত এই ব্যাটারিগুলো কাজ করতে ক্ষ করে। এই ব্যাটারিগুলো দীর্ঘস্থায়ী কিন্তু তার মাঝে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ খুব কম। তখন মহাকাশযানের অপ্রয়োজনীয় কাজকর্ম বন্ধ করে দেয়া হয়। মহাকাশযানের বেশিরভাগ আলো নিভে যায়, কম্পিউটারে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণটুকু চাল রাখা হয়, কায়োজেনিক ঘরে অপ্রয়োজনীয় শীতলতা দূর করে দেয়া হয়। ভ্রূণ এবং অন্যান্য জীবন্ত প্রাণ রক্ষা করার জন্যে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম ছাড়া অন্যান্য সব ধরনের কাজকর্ম বন্ধ করে দেয়া হয়। মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে তিনটি জেনারেটরই একসাথে অকেজো হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে নি। সুহান জেনারেটর তিনটির সামনে দাঁড়িয়ে এই ইতিহাস তৈরি করার প্রস্তুতি নিতে থাকে।

প্রথম জেনারেটরটি চলছে বলে সেটি অকেজো করা সহজ নয় কিন্তু অন্য দুটি খুব সহজে অকেজো করে দেয়া যায়। বিদ্যুতের যে লাইন রয়েছে সেগুলো ঠিক গোড়াতে কেটে দিতে হবে। সেগুলো কাটার যন্ত্রপাতি ঘরটিতে পাওয়া গেল। সেগুলো রবোটেরা ব্যবহার করে বলে অনেক বড় এবং ভারি। টেনেহিঁচড়ে সে যন্ত্রগুলো এনে বৈদ্যুতিক তারগুলো কেটে দিতে শুরু করে। দূরে নিশ্চয়ই কোথাও কর্কশ স্বরে এলার্ম বাজতে রু করেছে। কিন্তু সমস্যাটি আবিষ্কার করে রবোটদের এখানে পৌছাতে পৌছাতে সে অনেকগুলো মূল্যবান সেকেন্ড পেয়ে যাবে।

সুহান প্রথম জেনারেটরটির সামনে এসে দাঁড়াল। জেনারেটরটি প্রচণ্ড বেগে ঘুরছে, ভেতরের গরম বাতাস বের হওয়ার জন্যে উপরের খানিকটা অংশ খোলা। নিরাপত্তার জন্যে সেটার কাছে যাওয়ার উপায় নেই। সুহান নিরাপত্তার অংশটুকু অকেজো করে দিয়ে এগিয়ে যায়। তার যখন দশ বছর বয়স সে তখন প্রথম জেনারেটরটি কৌতূহলী হয়ে অকেজো করেছিল। ব্যাপারটি সে খুব ভালো করে জানে।

সুহান জেনারেটরের খোলা অংশের ঢাকনাটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলতে শুরু করে। ঠিক তখন সে উপরে রবোটের পদক্ষেপ শুনতে পায়। আর বেশি দেরি করা ঠিক নয়। ভারি একটা ট্রান্সফর্মার দুই হাতে তুলে নিয়ে সে জেনারেটরের ভেতরে প্রচণ্ড বেগে ঘূর্ণায়মান শ্যাফটের মাঝে ফেলে দিল।

সাথে সাথে যে ব্যাপারটি ঘটল তার কোনো তুলনা নেই। ভয়ঙ্কর একটি বিস্ফোরণে বিশাল জেনারেটরটি কেঁপে ওঠে। বিদ্যুতের প্রচণ্ড ঝলকানি, তীব্র আলো আর কানফাটা শব্দে সমস্ত ঘরটি থরথর করে কেঁপে ওঠে। ধাতুর টুকরো চারদিকে উড়তে থাকে, ছোট একটি আগুন জ্বলতে শুরু করে এবং হঠাৎকরে মহাকাশযানের সমস্ত আলো নিভে গভীর অন্ধকারে চারদিক ঢেকে যায়। মহাকাশযানের অসংখ্য যন্ত্রপাতি থেমে গিয়ে হঠাৎ করে বিচিত্র এক ধরনের নৈঃশব্দ্য নেমে আসে।

সুহান কয়েক মুহুর্ত অপেক্ষা করে, ছোট আগুনটি তার নেভানোর প্রয়োজন নেই, রবোটদের সেটি আরো কিছুক্ষণ ব্যস্ত রাখতে পারবে। সে ঘোট একটি ঢাকনা খুলে একটি ছোট টানেলে ঢুকে যায়। এই ধরনের মহাকাশযানের খুঁটিনাটি তার থেকে ভালো করে আর কেউ জানে না।

 

৫.

লাইনা তার ঘরে জানালার কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সমস্ত মহাকাশযান গভীর অন্ধকারে ঢেকে আছে, যন্ত্রপাতির কোনো শব্দ নেই। এই নৈঃশব্দ্য এক ধরনের আতঙ্ক জাগিয়ে দেয়। কিন্তু লাইনার বুকে কোনো আতঙ্ক নেই। সে নিশ্চিত নয় কিন্তু তার ধারণা, এটি দুর্ঘটনা নয়। এটি খুব ঠাণ্ডা মাথায় কেউ করেছে। এই ধরনের কাজ খুব ঠাণ্ডা মাথায় শুধুমাত্র একটি মানুষ করতে পারে, সে হচ্ছে সুহান। যে মানুষ কোন যন্ত্র কেমন করে কাজ করে জানে শুধু সেই মানুষই সেই যন্ত্র এত সহজে ধ্বংস করতে পারে। লাইনা তাই তার ঘরে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, সে জানে না কেন, কিন্তু তার মনে হচ্ছে সুহান এখানে অসিবে।

লাইনা জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়, বহুদূরে একটা আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে তার লাল আভায় চারদিকে এক ধরনের বিচিত্র লাল আভা। কী বিচিত্র এই গ্রহটি!

লাইনা হঠাৎ ঘরে একটি পদশব্দ শুনতে পায়। কেউ একজন নিঃশব্দে হাঁটছে তার ঘরে। এই ঘরে নিঃশব্দে হাঁটতে পারে শুধু একজন, সে হচ্ছে কিরি। লাইনার বুক কেঁপে উঠল ভয়ে, চাপা গলায় বলল, কে? কে ওখানে?

আমি। আমি সুহান।

সুহান! লাইনা ছুটে গেল। সাথে সাথে অনুভব করল, একজোড়া শক্ত হাত তাকে নিজের কাছে টেনে নিচ্ছে। তার চুলে মুখ গুঁজে ফিসফিস করে বলছে, লাইনা, আমার মনে হয় আমি তোমার প্রেমে পড়েছি।

লাইনা মুখ তুলে অবাক হয়ে এই কিশোরটির দিকে তাকাল। আবছা অন্ধকারে তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। জানালা দিয়ে ক্ষীণ লাল আলো আসছে, সেই আলোতে মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি সে বুঝি এক ভিন্ন গ্রহের মানুষ।

সুহান মাথা নিচু করে লাইনার ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করে বলল, আমি তোমাকে নিতে এসেছি লাইনা, তুমি যাবে আমার সাথে?

সুহানের চোখে গ্রহটির লাল আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। কী বিচিত্র দেখাচ্ছে তাকে। লাইনা অবাক হয়ে সুহানের দিকে তাকিয়ে রইল, হঠাৎ করে পুরো জীবনটি তার মনে পড়ে যায়। সবকিছু অর্থহীন মনে হতে থাকে, মনে হতে থাকে, সে বুঝি এই আহ্বানটির জন্যেই সারা জীবন অপেক্ষা করে ছিল। লাইনা সুহানের মাথা নিজের কাছে টেনে এনে ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ সুহান, আমি যাব তোমার সাথে।

সত্যি যাবে?

সত্যি যাব।

চল তাহলে।

কেমন করে?

সুহান মৃদু স্বরে হেসে বলল, সেটা নিয়ে তুমি ভেবো না। এই মহাকাশযানের দূষিত বাতাস বের হওয়ার একটা টানেল আছে। সেই টানেল দিয়ে বের হয়ে যাব। দুটি বড় বড় ফ্যানের পিছনে একটা টারবাইন। ফ্যানগুলো যখন ঘুরতে থাকে কেউ বের হতে পারবে না, কিন্তু এখন সব থেমে আছে।

কতক্ষণ থেমে থাকবে?

অনেকক্ষণ। সুহান নিচু গলায় হেসে বলল, আমি সব ধ্বংস করে দিয়েছি।

কেমন করে ধ্বংস করলে?

বলব তোমাকে। এখন চল। টারবাইনটি হাত দিয়ে ঠেলে ঘুরাতে হবে। অনেক শক্ত হবে কিন্তু দুজনে মিলে যদি ঠেলি নিশ্চয়ই খুলে যাবে।

তুমি কেমন করে জান?

আমি জানি। আমি ঠিক এ রকম একটা মহাকাশযানে থাকি। আমারটা অবশ্যি ধসে আছে।

বাইরে কিছু মানুষের, কিছু রবোটের পদশব্দ শোনা যায়। একটা ছোট এলার্ম বাজতে থাকে, আলো দুলাতে দুলাতে কে যেন ছুটে যায়। সুহান বলল, আর দেরি করা ঠিক নয়, চল যাই।

চল। কিন্তু কী নিতে হবে?

তোমার কি অক্সিজেন মাস্ক আছে?

আছে।

সেটা নিয়ে নাও। এই গ্রহের বাতাসে আমি নিশ্বাস নিতে পারি কিন্তু তুমি পারবে কি না জানি না।

সুহানের পিছু পিছু গুড়ি মেরে লাইনা একটা অন্ধকার টানেলের ভিতর দিয়ে যেতে থাকে। সুহান না হয়ে পৃথিবীর অন্য কোনো মানুষ হলে সে তার সমস্ত ভবিষ্যৎ তার হাতে এভাবে তুলে দিত কি না সে জানে না। কিরির সাথে পাল্লা দিয়ে সে যেভাবে দুই দুইবার নিজেকে রক্ষা করেছে তার কোনো তুলনা নেই। মানুষের সনাতন পদ্ধতিতে জ্ঞান লাভের চেষ্টা করলে সে কখনোই পারত না। লাইনার হঠাৎ কেমন জানি বিশ্বাস হতে থাকে, এই আশ্চর্য কিশোরটি হয়তো সত্যিই কিরির চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে।

সম্পূর্ণ অন্ধকার একটি টানেলের ভিতর গড়িয়ে গড়িয়ে দুজন এক সময় একটি খোলা জায়গায় পৌছাল। সামনে শক্ত দেয়ালের মতো, লাইনা হাত দিয়ে দেখে তৈলাক্ত কিছু জিনিসে ভেজা। সুহান চাপা গলায় বলল, টারবাইন। ধাক্কা দিয়ে খুলতে হবে।

শক্ত পাথরের মতো অনড়, ধাক্কা দিয়ে খোলার কোনো উপায় আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু সুহানের দেখাদেখি লাইনাও হাত লাগায়। দীর্ঘ সময় চেষ্টা করে যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিল, তখন সত্যিই সেই বিশাল টারবাইন নড়ে উঠে একটু একটু করে খুলতে থাকে। সাবধানে একজন মানুষ বের হওয়ার মতো জায়গা করে তারা নিচে তাকাল, বাইরে মুক্ত গ্রহ।

সুহান বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে লাইনাকে বলল, তুমি অক্সিজেন মাস্কাট পরে নাও লাইনা।

মহাকাশযান থেকে সুহান অনায়াসে লাফিয়ে নেমে আসে। লাইনা ইতস্তত করছিল। সুহান হাত বাড়িয়ে বলল, ভয় নেই, আমি আছি।

লাইনা সুহানের হাত ধরে নেমে আসে। দুজনে গুড়ি মেরে সরে যেতে থাকে। মহাকাশযানের সেন্সরগুলো কোথায় আছে সুহান জানে। জেনারেটরগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে বলে সেগুলো এখন ঘুরে ঘুরে চারদিকে লক্ষ করছে না, কিন্তু সুহান কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। এই মহাকাশযান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যত দূরে চলে যাওয়া যায়। পাথরের উপর লাফিয়ে সুহান অভ্যস্ত পায়ে ছুটতে থাকে, লাইনা বার বার পিছিয়ে পড়ছিল। পিছনে গ্রহের লালচে আলোতে মহাকাশযানটিকে কেমন জানি ভূতুড়ে মনে হয়।

সামনে একটা বড় পাথর, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুহান তার আড়ালে লুকিয়ে পড়তে চাইছিল, তখন হঠাৎ লাইনা পিছন থেকে তার পিঠ খামচে ধরল। আর্ত চিৎকার করে বলল, সুহান, কী হয়েছে?

ওই দেখ।

সুহান মাথা তুলে তাকায়। সামনে একটি ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। হাতে উদ্যত অস্ত্র তাদের দিকে তাক করা। ছায়ামূর্তিটি এক পা এগিয়ে এসে ধাতব কণ্ঠে বলল, সুহান! আমি তোমার মৃতদেহ নিতে এসেছিলাম। মানুষের মৃতদেহ সমাহিত করতে হয়।

সুহান আনন্দে চিৎকার করে বলল, ট্রিনি!

হ্যাঁ। তোমার সাথে কে?

লাইনা।

আপনার সাথে পরিচয় হয়ে ধন্য অনুভব করছি মহামান্যা লাইন।

লাইনা তখনো ভয়ে একটু একটু কাঁপছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, হঠাৎ দেখে খুব ভয় পেয়ে গেছি।

আপনার ভয় পাওয়ার অনেক কারণ আছে মহামান্যা লাইনা।

কেন, এ রকম বলছ কেন?

সুহান দাবি করছে সে আপনার প্রেমে পড়েছে। এবং সে অনেক বিপজ্জনক কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।

লাইনা শব্দ করে হেসে বলল, সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজটি সে ইতিমধ্যে করে এসেছে। ট্রিনি!

সুহান চাপা গলায় বলল, কথা বলার সময় নেই, তাড়াতাড়ি পালাতে হবে।

আমি বাই ভার্বালে শক্তিশালী ব্যাটারি ভরে এনেছি। সুহান, তুমি মহামান্যা লাইনাকে নিয়ে আস।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বাই ভার্বালটি মাটি থেকে প্রায় এক-মানুষ উচ্চতা দিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটে যেতে থাকল।

সুহান চাপা গলায় বলল, আস্তে ট্রিনি, খারাপ দুর্ঘটনা হতে পারে।

ট্ৰিনি তার কথার কোনো উত্তর দিল না।