একে বঙ্গোপসাগর স্বভাবচঞ্চল, তাতে আবার এই বর্ষাকালে, মৌসুমের সময়, জাহাজ খুব হেলতে দুলতে যাচ্চেন। তবে এই তো আরম্ভ, পরে বা কি আছে! যাচ্চি মান্দ্রাজ। এই দাক্ষিণাত্যের বেশীর ভাগই এখন মান্দ্রাজ। জমিতে কি হয়? ভাগ্যবানের হাতে পড়ে মরুভূমিও স্বর্গ হয়। নগণ্য ক্ষুদ্র মান্দ্রাজ শহর যার নাম চিন্নাপট্টনম্, অথবা মান্দ্রাসপট্টনম্, চন্দ্রগিরির রাজা একদল বণিককে বেচেছিল। তখন ইংরেজের ব্যবসা জাভায়। বান্তাম শহর ইংরেজদিগের এশিয়ার বাণিজ্যের কেন্দ্র। মান্দ্রাজ প্রভৃতি ইংরেজী কোম্পানির ভারতবর্ষের সব বাণিজ্যস্থান বান্তামের দ্বারা পরিচালিত। সে বান্তাম কোথায়? আর সে মান্দ্রাজ কি হয়ে দাঁড়াল! শুধু ‘উদ্যোগিনং পুরুষসিংহমুপৈতি লক্ষ্মীঃ’ নয় হে ভায়া; পেছনে মায়ের বল। তবে উদ্যোগী পুরুষকেই মা বল দেন—এ-কথাও মানি। মান্দ্রাজ মনে পড়লে খাঁটি দক্ষিণদেশ মনে পড়ে। যদিও কলকেতার জগন্নাথের ঘাটেই দক্ষিণদেশের আমেজ পাওয়া যায় (সেই থর-কামানো মাথা, ঝুটি বাঁধা, কপালে অনেক চিত্র বিচিত্র, শুঁড়-ওল্টানো চটিজুতো, যাতে কেবল পায়ের আঙুল-কটি ঢোকে, আর নস্যদরবিগলিত নাসা, ছেলেপুলের সর্বাঙ্গে চন্দনের ছাপা লাগাতে মজবুত) উড়ে বামুন দেখে। গুজরাতী বামুন, কালো কুচকুচে দেশস্থ বামুন, ধপধপে ফর্সা বেরালচোখো চৌকা-মাথা কোকনস্থ বামুন, সব ঐ এক প্রকার বেশ, সব দক্ষিণী বলে পরিচিত—অনেক দেখেছি, কিন্তু ঠিক দক্ষিণী ঢঙ মান্দ্রাজীতে। সে রামানুজী তিলক-পরিব্যাপ্ত ললাটমণ্ডল—দূর থেকে যেন ক্ষেত চৌকি দেবার জন্য কেলে হাঁড়িতে চুন মাখিয়ে পোড়া কাঠের ডগায় বসিয়েছে, যে তিলকের শাগরেদ রামানন্দী তিলকের মহিমা সম্বন্ধে লোকে বলে, ‘তিলক তিলক সব কোই কহে, পর রামানন্দী তিলক দিখত গঙ্গা-পারসে যম গৌদ্বারকে খিড়ক্!’ (আমাদের দেশে চৈতন্যসম্প্রদায়ের সর্বাঙ্গে ছাপ দেওয়া গোঁসাই দেখে মাতাল চিতেবাঘ ঠাওরেছিল—এ মান্দ্রাজী তিলক দেখে চিতেবাঘ গাছে চড়ে!); আর সে তামিল তেলেগু মলয়ালম্ বুলি—যা ছয় বৎসর শুনেও এক বর্ণ বোঝবার যো নাই, যাতে দুনিয়ার রকমারী ল-কার ও ড-কারের কারখানা; আর সেই ‘মুড়গ্তন্নির রসম্’১৪ সহিত ভাত সাপড়ানো—যার এক এক গরাসে বুক ধড়ফড় করে ওঠে (এমনি ঝাল আর তেঁতুল!); সে ‘মিঠে-নিমের পাতা, ছোলার দাল, মুগের দাল, ফোড়ন, দধ্যোদন’ ইত্যাদি ভোজন; আর সে রেড়ির তেল মেখে স্নান, রেড়ির তেলে মাছ ভাজা—এ না হলে কি দক্ষিণ মুলুক হয়?
আবার এই দক্ষিণ মুলুক, মুসলমান রাজত্বের সময় এবং তার কত দিনের আগে থেকেও হিন্দুধর্ম বাঁচিয়ে রেখেছে। এই দক্ষিণ মুলুকেই—সামনে টিকি, নারকেল-তেলখেকো জাতে—শঙ্করাচার্যের জন্ম; এই দেশেই রামানুজ জন্মেছিলেন; এই মধ্বমুনির জন্মভূমি। এঁদেরই পায়ের নীচে বর্তমান হিন্দুধর্ম। তোমাদের চৈতন্যসম্প্রদায় এ মধ্বসম্প্রদায়ের শাখামাত্র; ঐ শঙ্করের প্রতিধ্বনি কবীর, দাদু, নানক, রামসনেহী প্রভৃতি সকলেই; ঐ রামানুজের শিষ্যসম্প্রদায় অযোধ্যা প্রভৃতি দখল করে আছে। এই দক্ষিণী ব্রাহ্মণরা হিন্দুস্থানের ব্রাহ্মণকে ব্রাহ্মণ বলে স্বীকার করে না, শিষ্য করতে চায় না, সেদিন পর্যন্ত সন্ন্যাস দিত না। এই মান্দ্রাজীরাই এখনও বড় বড় তীর্থস্থান দখল করে বসে আছে। এই দক্ষিণদেশেই—যখন উত্তরভারতবাসী ‘আল্লা হু আক্বর, দীন্ দীন্’ শব্দের সামনে ভয়ে ধনরত্ন ঠাকুর-দেবতা স্ত্রী-পুত্র ফেলে ঝোড়ে জঙ্গলে লুকুচ্ছিল, [তখন] রাজচক্রবর্তী বিদ্যানগরাধিপের অচল সিংহাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই দক্ষিণদেশেই সেই অদ্ভুত সায়ণের জন্ম্—যাঁর যবনবিজয়ী বাহুবলে বুক্করাজের সিংহাসন, মন্ত্রণায় বিদ্যানগর সাম্রাজ্য, নয়মার্গে ১৫ দাক্ষিণাত্যের সুখ-সাচ্ছন্দ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল, যাঁর অমানব প্রতিভা ও অলৌকিক পরিশ্রমের ফলস্বরূপ সমগ্র বেদরাশির টীকা, যাঁর আশ্চর্য ত্যাগ বৈরাগ্য ও গবেষণার ফলস্বরূপ ‘পঞ্চদশী’ গ্রন্থ—সেই সন্ন্যাসী বিদ্যারণ্যমুনি সায়ণের১৬ এই জন্মভূমি। মান্দ্রাজ সেই ‘তামিল’ জাতির আবাস, যাদের সভ্যতা সর্বপ্রাচীন, যাদের ‘সুমের’ নামক শাখা ‘ইউফ্রেটিস’ তীরে প্রকাণ্ড সভ্যতা-বিস্তার—অতি প্রাচীনকালে করেছিল, যাদের জ্যোতিষ, ধর্মকথা, নীতি, আচার প্রভৃতি আসিরি বাবিলি সভ্যতার ভিত্তি, যাদের পুরাণসংগ্রহ বাইবেলের মূল, যাদের আর এক শাখা মালাবার উপকূল হয়ে অদ্ভুত মিসরি সভ্যতার সৃষ্টি করেছিল, যাদের কাছে আর্যেরা অনেক বিষয়ে ঋণী। এদেরই প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মন্দির দাক্ষিণাত্যে বীরশৈব বা বীরবৈষ্ণবসম্প্রদায়ের জয় ঘোষণা করেছে। এই যে এত বড় বৈষ্ণবধর্ম—এ-ও এই ‘তামিল’ নীচবংশোদ্ভূত শঠকোপ হতে উৎপন্ন, যিনি ‘বিক্রীয় সূর্পং স চচার যোগী’। এই তামিল আলওয়াড় বা ভক্তগণ এখনও সমগ্র বৈষ্ণবসম্প্রদায়ের পূজ্য হয়ে রয়েছেন। এখনও এদেশে বেদান্তের দ্বৈত, বিশিষ্ট বা অদ্বৈত—সমস্ত মতের যেমন চর্চা, তেমন আর কুত্রাপি নাই। এখনও ধর্মের অনুরাগ এদেশে যত প্রবল, তেমন আর কোথাও নাই।
চব্বিশে জুন রাত্রে আমাদের জাহাজ মান্দ্রাজে পৌঁছাল। প্রাতঃকালে উঠে দেখি, সমুদ্রের মধ্যে পাঁচিল দিয়ে ঘিরে-নেওয়া মান্দ্রাজের বন্দরে রয়েছি। ভেতরে স্থির জল; আর বাইরে উত্তাল তরঙ্গ গজরাচ্চে, আর এক বার বন্দরের দ্যালে লেগে দশ বার হাত লাফিয়ে উঠছে, আর ফেনময় হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। সামনে সুপরিচিত মান্দ্রাজের ষ্ট্র্যাণ্ড রোড। দুজন ইংরেজ পুলিশ ইন্স্পেক্টর, একজন মান্দ্রাজী জমাদার, এক ডজন পাহারাওয়ালা জাহাজে উঠল। অতি ভদ্রতাসহকারে আমায় জানালে যে, কালা আদমীর কিনারায় যাবার হুকুম নাই, গোরার আছে। কালা যেই হোক না কেন, সে যেরকম নোংরা থাকে, তাতে তার প্লেগবীজ নিয়ে বেড়াবার বড়ই সম্ভাবনা, তবে আমার জন্য মান্দ্রাজীরা বিশেষ হুকুম পাবার দরখাস্ত করেছে, বোধ হয় পাবে। ক্রমে দু-চারটি করে মান্দ্রাজী বন্ধুরা নৌকায় চড়ে জাহাজের কাছে আসতে লাগল। ছোঁয়াছুঁয়ি হবার যো নাই, জাহাজ থেকে কথা কও। আলাসিঙ্গা, বিলিগিরি, নরসিংহাচার্য, ডাক্তার নঞ্জুণ্ডরাও, কিডি প্রভৃতি সকল বন্ধুদেরই দেখতে পেলুম। আঁব, কলা, নারিকেল, রাঁধা দধ্যোদন, রাশীকৃত গজা, নিমকি ইত্যাদির বোঝা আসতে লাগল। ক্রমে ভীড় হতে লাগল—ছেলে, মেয়ে, বুড়ো—নৌকায় নৌকা। আমার বিলাতী বন্ধু মিঃ শ্যামিএর, ব্যারিষ্টার হয়ে মান্দ্রাজে এসেছেন, তাঁকেও দেখতে পেলেম। রামকৃষ্ণানন্দ আর নির্ভয়১৭ বারকতক আনাগোনা করলে। তারা সারাদিন সেই রৌদ্রে নৌকায় থাকবে—শেষে ধমকাতে তবে যায়। ক্রমে যত খবর হল যে আমাকে নাবতে হুকুম দেবে না, তত নৌকায় ভীড় আরও বাড়তে লাগল। শরীরও ক্রমাগত জাহাজের বারাণ্ডায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবসন্ন হয়ে আসতে লাগল। তখন মান্দ্রাজী বন্ধুদের কাছে বিদায় চাইলাম, কেবিনের মধ্যে প্রবেশ করলাম। আলাসিঙ্গা ‘ব্রহ্মবাদিন্’ ও মান্দ্রাজী কাজকর্ম সম্বন্ধে পরামর্শ করবার অবসর পায় না; কাজেই সে কলম্বো পর্যন্ত জাহাজে চলল। সন্ধ্যার সময় জাহাজ ছাড়লে। তখন একটা রোল উঠল। জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি, হাজারখানেক মান্দ্রাজী স্ত্রী-পুরুষ, বালক-বালিকা বন্দরের বাঁধের উপর বসেছিল—জাহাজ ছাড়তেই, তাদের এই বিদায়-সূচক রব! মান্দ্রাজীরা আনন্দ হলে বঙ্গদেশের মত হুলু দেয়।
মান্দ্রাজ হতে কলম্বো চার দিন। যে তরঙ্গভঙ্গ গঙ্গাসাগর থেকে আরম্ভ হয়েছিল, তা ক্রমে বাড়তে লাগল। মান্দ্রাজের পর আরও বেড়ে গেল। জাহাজ বেজায় দুলতে লাগল। যাত্রীরা মাথা ধরে ন্যাকার করে অস্থির। বাঙালীর ছেলে দুটিও ভারি ‘সিক্’। একটি তো ঠাউরেছে মরে যাবে; তাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে দেওয়া গেল যে কিছু ভয় নেই, অমন সকলেরই হয়, ওতে কেউ মরেও না, কিছুই না। সেকেণ্ড কেলাসটা আবার ‘ষ্ক্রুর’ ঠিক উপরে। ছেলে-দুটিকে কালা আদমী বলে, একটা অন্ধকূপের মত ঘর ছিল, তারই মধ্যে পুরেছে। সেখানে পবনদেবেরও যাবার হুকুম নাই, সূর্যেরও প্রবেশ নিষেধ। ছেলে-দুটির ঘরের মধ্যে যাবার যো নাই; আর ছাতের উপর—সে কি দোল। আবার যখন জাহাজের সামনেটা একটা ঢেউয়ের গহ্বর বসে যাচ্চে, আর পেছনটা উঁচু হয়ে উঠছে, তখন ষ্ক্রুটা জল ছাড়া হয়ে শূন্যে ঘুরছে, আর সমস্ত জাহাজটা ঢক ঢক ঢক ঢক করে নড়ে উঠছে। সেকেণ্ড কেলাসটা ঐ সময় যেমন বেড়ালে ইঁদুর ধরে এক একবার ঝাড়া দেয়, তেমনি করে নড়ছে।
যাই হোক এখন মন্সুনের সময়। যত—ভারত মহাসাগরে—জাহাজ পশ্চিমে চলবে, ততই বাড়বে এই ঝড়ঝাপট। মান্দ্রাজীরা অনেক ফলপাকড় দিয়েছিল; তার অধিকাংশ, আর গজা দধ্যোদন প্রভৃতি সমস্তই ছেলেদের দেওয়া গেল। আলাসিঙ্গা তাড়াতাড়ি একখানা টিকিট কিনে শুধু পায়ে জাহাজে চড়ে বসল। আলাসিঙ্গা বলে, সে কখনও কখনও জুতো পায়ে দেয়। দেশে দেশে রকমারী চাল। ইওরোপে মেয়েদের পা দেখানো বড় লজ্জা; কিন্তু আধখানা গা আদুড় রাখতে লজ্জা নেই। আমাদের দেশে মাথাটা ঢাকতে হবেই হবে, তা পরনে কাপড় থাক বা না থাক। আলাসিঙ্গা পেরুমল, এডিটার ‘ব্রহ্মবাদিন্’, মাইসোরী রামানুজী ‘রসম্’-খেকো ব্রাহ্মণ, কামানো মাথায় সমস্ত কপাল জুড়ে, ‘তেংকলে’ তিলক, ‘সঙ্গের সম্বল গোপনে অতি যতনে’ এনেছেন কি দুটো পুঁটলি! একটায় চিঁড়ে ভাজা, আর একটায় মুড়ি-মটর। জাত বাঁচিয়ে, ঐ মুড়ি-মটর চিবিয়ে, সিলোনে যেতে হবে! আলাসিঙ্গা আর একবার সিলোনে গিয়েছিল। তবে বেরাদারিলোক একটু গোল করবার চেষ্টা করে; কিন্তু পেরে ওঠেনি। ভারতবর্ষে ঐটুকুই বাঁচোয়া। বেরাদারি যদি কিছু না বলল তো আর কারও কিছু বলবার অধিকার নেই। আর সে দক্ষিণী বেরাদারি—কোনটায় আছেন সবশুদ্ধ পাঁচ-শ, কোনটায় সাত-শ, কোনটায় হাজারটি প্রাণী—কনের অভাবে ভাগনীকে বে করে! যখন মাইসোরে প্রথম রেল হয়, যে যে ব্রাহ্মণ দূর থেকে রেলগাড়ী দেখতে গিছল, তারা জাতচ্যুত হয়! যাই হোক, এই আলাসিঙ্গার মত মানুষ পৃথিবীতে অতি অল্প; অমন নিঃস্বার্থ, অমন প্রাণপণ খাটুনি, অমন গুরু-ভক্ত আজ্ঞাধীন শিষ্য জগতে অল্প হে ভায়া! মাথা কামানো ঝুটি-বাঁধা, শুধু-পায়, ধুতি-পরা মান্দ্রাজী ফার্ষ্টক্লাসে উঠল; বেড়াচ্চে-চেড়াচ্চে, খিদে পেলে মুড়ি-মটর চিবুচ্চে! চাকররা মাদ্রাজীমাত্রকেই ঠাওরায় ‘চেট্টি’, আর [বলে] ‘ওদের অনেক টাকা আছে, কিন্তু কাপড়ও পরবে না, আর খাবেও না’! তবে আমাদের সঙ্গে পড়ে ওর জাতের দফা ঘোলা হচ্ছে—চাকররা বলছে। বাস্তবিক কথা—তোমাদের পাল্লায় পড়ে মান্দ্রাজীদের জাতের দফা অনেকটা ঘোলা কেন, থক্থকিয়ে এসেছে!