তিষার আম্মু কেবিন থেকে বের হয়ে ক্লান্ত পায়ে হাসপাতালের করিডোর ধরে হেঁটে হেঁটে ওয়াটিং রুমের দিকে যেতে থাকেন। একটু পর বাইরে আলো হয়ে সূর্য উঠবে, কিন্তু তার ভেতরটুকু আর কখনোই আলোতে ঝলমল করে উঠবে না। প্রতি রাত তিনি তিষার পাশে বসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। গভীর কোমায় ঘুমন্ত তিষা কখন চোখ খুলে তার দিকে তাকাবে তিনি সেই আশায় গত তিন মাস বসে আছেন কিন্তু তিষা চোখ খুলে তাকায়নি। সম্ভবত কখনোই চোখ খুলে তাকাবে না, এইভাবে একটা বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিঃশব্দে একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে।
ওয়েটিং রুমের দরজা খুলে তিষার আম্মু ভেতরে ঢুকলেন। বড় একটা সোফায় একজন মহিলা কাত হয়ে বসে আছে। তার ছেলেটি গতকাল গাড়ী। একসিডেন্টে আহত হয়ে এখানে এসেছে। একটা ছোট শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে আরেকজন কমবয়সী মা পিঠ সোজা করে বসে আছে। তার স্বামী সম্ভবত আজ মারা যাবে।
আম্মু ঘরের এক কোনায় সোফায় বসলেন। দুই হাতের উপর মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করলেন। কতো অল্প ঘুম, কতো অল্প খাওয়া দিয়ে একজন মানুষ কতো দীর্ঘকাল বেঁচে থাকতে পারে সেটা তিনি গত তিনমাস ধীরে ধীরে আবিষ্কার করেছেন।
.
আই সি ইউয়ের এগারো নম্বর কেবিনে খুব ধীরে ধীরে তিষা চোখ খুলে তাকাল, “আমি এখন কোথায়?” এই ধরনের একটা ভাবনা তার মাথায় একবার উঁকি দিয়ে যায়। “আমার ঘরে আমার পায়ের দিকে বইয়ের শেলফ, এখানে শেলফ নেই, তাহলে কী আমি অন্য কোথাও?” তিষা আবার চোখ বন্ধ করল, “রাত্রি বেলা আমি লাইট নিভিয়ে ঘুমাই। এখানে আলো জ্বলছে। মাথার কাছে একটা টেলিভিশন! আমার ঘরে টেলিভিশন কেন? আমি এখন কোথায়?” তিষা আবার চোখ খুলে তাকাল, সে একটু নড়ার চেষ্টা করতেই শরীরে এক ধরনের আড়ষ্ট অনুভূতি কাজ করে, কোথায় জানি টান পড়ে আর সাথে সাথে দূরে কোথায় জানি এক ধরণের এলার্ম বেজে ওঠে। তিষা একটু অবাক হল, “এলার্ম কেন বাজে?”
প্রায় সাথে সাথে একজন মহিলা ঘরে এসে ঢুকল, মহিলাটির মাথায় নার্সদের মত ক্যাপ, তিষার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে মহিলটি বলল, “হানি, তুমি কী জেগেছ?”
তিষা মহিলাটির মুখের দিকে তাকায়, তাদের স্কুলের নার্স মিসেস স্মিথের মতো চেহারা কিন্তু সে মিসেস স্মিথ নয়। তিষা জিজ্ঞেস করল, “আমি কোথায়?”
“তুমি খুব ভালো জায়গায় আছ, হানি।”
“আমার কী কিছু হয়েছে?”
“তোমার অনেক কিছু হয়েছিল।”
“এখন?”
“হানি, এখন তুমি আমাদের সবার সব দুশ্চিন্তা দূর করে দিয়েছ।”
তিষা অবাক হয়ে লক্ষ্য করে একটি দুটি কথা বলতেই তার উপর বিচিত্র এক ধরনের ক্লান্তি এসে ভর করছে। সে এতো দুর্বল কেন? সে ফিসফিস করে বলল, “আমার আব্বু আর আম্মু কই?”
“তুমি এক সেকেন্ড অপেক্ষা কর আমি তোমার আম্মুকে ডেকে আনি। তুমি আবার ঘুমিয়ে যেয়ো না যেন!”
তিষা বলল, “না। আমি ঘুমাব না।”
ওয়েটিং রুমের দরজা খুলে নার্স ভিতরে উঁকি দেয়। কোনার একটা সোফায় দুই হাতের ওপর মাথা রেখে তিষার আম্মু চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। ঘুমিয়ে আছেন না জেগে আছেন বোঝা যায় না। নার্স কাছে গিয়ে নিচু গলায় ডাকল, “মিসেস আহমেদ।”
সাথে সাথে আম্মু চোখ খুলে তাকালেন। নার্স তার ঘাড়ে হাত রেখে নরম গলায় বলল, “তোমার মেয়ে জেগে উঠে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
আম্মুর মুখ দেখে মনে হল আম্মু বুঝি কথাটা বুঝতে পারেন নি, কিন্তু তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। খুব ধীরে ধীরে আম্মু উঠে দাঁড়ালেন, হঠাৎ করে তাঁকে দেখে মনে হল তার শরীরে বুঝি কোনো শক্তি নেই। নার্সের হাত ধরে আম্মু যখন ওয়েটিং রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন তখন শিশুকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকা মহিলাটি বলল, “এই যে, তুমি শুনো।”
আম্মু ঘুরে তার দিকে তাকালেন, মহিলাটি তার ঘুমন্ত বাচ্চাটিকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে বলল, “তুমি এভাবে তোমার মেয়ের কাছে যেতে পারবে না। তিন মাস কোমায় থেকে জেগে উঠে তোমাকে এভাবে দেখলে তোমার মেয়ে আবার কোমায় চলে যাবে।”
আম্মু অবাক হয়ে মহিলাটির দিকে তাকালেন, মহিলাটি বলল, “তোমাকে দেখে বোঝা যায় তুমি তিন মাস আয়নার সামনে যাও নাই। তুমি একজন সুন্দরী মহিলা, তোমার চেহারার কী অবস্থা করেছ তুমি জান না! দাঁড়াও, তুমি চুল আঁচড়াও, ঠোঁটে লিপস্টিক দাও। তোমার দরকার ডার্ক শ্যাডো–আমারটা দিয়ে কাজ চলে যাবে! নাও লিপস্টিক দাও, তোমার ভয় নাই, আমার কোনো সংক্রামক রোগ নাই।”
মহিলাটি আম্মুর চুল খুলে আঁচড়ে দিল, ঠোঁটে লিপস্টিক দিল, গালে পাউডার দিল তারপর বুকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।
.
তিষা তার আম্মুকে দেখে বলল, “আম্মু তোমার কী হয়েছে? তুমি এত শুকিয়ে গেছ কেন?”
আম্মু বললেন, “আমার কিছু হয়নি মা। আমি খুব ভালো আছি। সারা পৃথিবীতে আমার থেকে ভালো কেউ নেই।”
“আমার কী হয়েছে আম্মু? আমি হাসপাতালে কেন?” “সেটা অনেক বড় একটা কাহিনী মা। তোকে বলব।”
“আজকে কী বার আম্মু? বৃহস্পতিবার আমার মায়া সভ্যতার উপর একটা রিপোর্ট জমা দেবার কথা ছিল।”
আম্মু হেসে ফেললেন, বললেন “তুই রিপোর্ট লেখার অনেক সময় পাবি মা। আজকে কী বার সেটা তো আমিও জানি না!”
.
সন্ধেবেলা তিষা তার ঘরে টেলিভিশনে স্থানীয় খবরে নিজেকে দেখতে পেল। স্থানীয় সংবাদদাতা বলল, “গত ২৪ জানুয়ারী সাসকুয়ান হদে বরফের আস্তরণ ভেঙ্গে টিশা আমেদ (আমেরিকান সংবাদদাতা তিষা আহমেদ নামটা এর চাইতে ভালো করে উচ্চারণ করতে পারে না!) নামে কাউন্টি জুনিয়র স্কুলের ছাত্রী হিম শীতল পানিতে ডুবে যায়। বরফের নিচ থেকে তার পোষা কুকুর টুইটি টিশা আমেদের দেহ উদ্ধার করে আনে। ততক্ষণে তার দেহ হাইপোথারমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গেছে। মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় রক্ত সঞ্চালিত না হওয়ায় সে কোমাতে চলে যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সমস্ত আশংকাকে অমূলক প্রমাণ করে আজ সে জেগে উঠেছে। চিকিৎসকেরা অনুমান করছেন তার শরীর হাইপোথারমিয়াতে আক্রান্ত হওয়ার কারণেই মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় রক্ত সঞ্চালিত না হওয়ার পরও তার মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
টিশা আমেদের জ্ঞান ফিরে আসার খবরে তার স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বিপুল আনন্দোচ্ছাস দেখা যায়।”
।তিষা তখন তার স্কুলের ছেলে মেয়েদের দেখল। সবাই দুই হাত তুলে আনন্দে চিৎকার করছে। তিশা জনকেও দেখতে পেল। সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে বলল “আমরা তোমাকে ভালোবাসি তিশা।”
খবর শেষ হবার পর তিশা আম্মুর হাত ধরে বলল, “টুইটি কেমন আছে আম্মু?”
আম্মু কোন উত্তর দিলেন না। তখন তিষার গলার স্বর কেঁপে গেল, “কেমন আছে টুইটি?”
আম্মা তিষার মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করে বললেন, “নিশ্চয়ই খুব ভালো আছে মা। যেখানে গেলে সবাই খুব ভালো থাকে তোক বাঁচিয়ে দিয়ে টুইটি সেখানে চলে গেছে।”
তিষা দুই হাতে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে বসে রইল।
.
একজন মানুষ পুরো তিন মাস এক ভাবে বিছানায় শুয়ে থাকলে তার শরীরের অনেক কিছুই সাময়িকভাবে অচল হয়ে যায়, হঠাৎ করে সেটাকে সচল করা যায় না। তাই তিষাকে চট করে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হল না। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটু আধটু বই পড়তে দিলেও বেশীর ভাগ সময় তাকে টেলিভিশন দেখে সময় কাটাতে হল। টেলিভিশনে সে পৃথিবীর অনেক খবর জানতে পারলেও যে খবরটি তাকে সবচেয়ে চমকৃত করল সেটি হচ্ছে পোষা প্রাণী হিসেবে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে তৈরি করা নূতন একটা প্রাণী যার নাম এনিম্যান। সে যখন আচেতন হয়েছিল তখন এই ছোট প্রাণীটির আবিষ্কার নিয়ে প্রথম একটা সাংবাদিক সম্মেলন হয়। সারা পৃথিবীতেই এটা নিয়ে খুব হইচই শুরু হয়েছিল, মানুষের বাচ্চাকে কুকুর বেড়ালের মতো পোষা প্রাণী হিসেবে বিক্রি করা যাবে না এই রকম একটা দাবী নিয়ে পত্র পত্রিকায় লেখালেখি হল, টেলিভিশনে আলোচনা হল, ইনটারনেটে তুমুল বাকবিতণ্ডা হল। যে কোম্পানী এটা তৈরি করেছে তারা দাবী করল এটা মোটেও মানুষের বাচ্চা নয়, এটা জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে তৈরী করা একটা কৃত্রিম প্রাণী। এটি কেনো মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়নি, এটি তৈরী হয়েছে ল্যাবরেটরির বায়োসেলে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে তাতে সায় দিলেন। মনোবিজ্ঞানীরা প্রাণীটাকে নিয়ে গবেষণা করে বললেন এর বুদ্ধিমত্তা কুকুর বিড়াল জাতীয় স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সমান। তাই কেউ যদি কুকুর বিড়াল পোষা প্রাণী হিসেবে বেচাকেনা করতে পারে তাহলে এটা বেচাকেনা করতে দোষ কী?
শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসে আলোচনা হল এবং দীর্ঘ শুনানীর পর এনিম্যান নামের প্রাণীটাকে বিক্রি করার অনুমতি দেয়া হল। এটি রাতারাতি অসম্ভব জনপ্রিয় একটা পোষা প্রাণী হয়ে গেল। আমেরিকার প্রত্যেকটা পরিবার এখন একটা এনিম্যান চায়।
তিষা অবশ্যি কারণটা বুঝতে পারে। এতো মিষ্টি চেহারার একটা প্রাণী, অনেকটা মানবশিশুর মতো আবার মানব শিশু নয়, বড় বড় মায়া কাড়া চোখ, শরীরে কোমল পশম, মুখের মাঝে একটা ছেলেমানুষী প্রায় দুষ্টুমীর হাসি–এই প্রাণীটাকে একজন ভালো না বেসে পারে কীভাবে?
যারা যারা এনিম্যানকে কিনে এনেছে তারা সবাই এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এটি খুবই মিষ্টি স্বভাবের। এটি শান্ত এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এর প্রয়োজন খুবই কম, বাথরুম নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। প্রাণীটি খুবই হাসিখুশী, যার বাসায় একটি এনিম্যান আছে সেই বাসাটিতেই হতাশা বা দুঃখ রাতারাতি কমে গেছে।
সেই রাতে যখন তিষার আব্বু তিষাকে দেখতে এলেন তিষা বলল, “আব্বু আমাকে একটা এনিম্যান কিনে দেবে?”
আব্বু তিষাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “শুধু এনিম্যান কেন, তুই চাইলে তোকে আমি রয়াল বেঙ্গল টাইগার কিনে দেব।”
তিষা হি হি করে হেসে বলল, “না আব্বু, আমার রয়েল বেঙ্গল টাইগার দরকার নেই। একটা এনিম্যান হলেই হবে।”
আব্বু বললেন, “এনিম্যানের তো এখন খুব ডিমান্ড তাই চাইলেই পাওয়া যায় না, বুকিং দিতে হয়। বুকিং দেওয়ার পর কম পক্ষে ছয় সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়। আমি আজকেই বুকিং দিয়ে দেব, ছয় সপ্তাহের মাঝে চলে আসবে।”
আম্মু বললেন, “তুই যখন প্রথম কুকুর পুষতে চেয়েছিলি তখন আমি কতো আপত্তি করেছিলাম মনে আছে?”
তিষা মাথা নাড়ল, “মনে আছে।”
“ভাগ্যিস তোকে পুষতে দিয়েছিলাম, সেজন্যে তুই বেঁচে আছিস।”
তিষা নিচু গলায় বলল, “আমি টুইটির কথা ভুলতে পারি না আম্মু!”
আম্মু বললেন, “আমরাও পারি না।”
আব্বু বললেন, “যখন এনিম্যান চলে আসবে তখন হয়তো একটু ভুলে থাকতে পারবি।”
তিষা বলল, “কিন্তু সে জন্য তো ছয় সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।”
আম্মু বললেন, “দেখতে দেখতে ছয় সপ্তাহ কেটে যাবে।”
.
তিষার অবশ্য ছয় সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হল না তার আগেই একটা এনিম্যান পেয়ে গেল।
জ্ঞান ফিরে পাবার তিন সপ্তাহ পর তিষাকে তার বাসায় যাবার অনুমতি দেয়া হল। যদিও সে আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে কারো সাহায্য না নিয়েই হাঁটতে পারছে তারপরও তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হল একটা হুইল চেয়ারে বসিয়ে। ঠিক যখন তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হচ্ছে তখন তার স্কুলের বেশ কয়জন ছেলে মেয়ে এসে হাজির। বাসায় যাবার আগে তাকে তাদের স্কুল হয়ে যেতে হবে, সেখানে সবাই মিলে তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে বিশাল একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে রেখেছে।
স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছে তিষার আব্বু আম্মু দেখলেন সত্যিই বিশাল আয়োজন। স্কুলের ঢোকার রাস্তায় বেলুন দিয়ে একটা গেট তৈরী করা। হয়েছে। গেটের ওপর বিশাল ব্যানার সেখানে হাস্যোজ্জল তিষার ছবি, বড় বড় করে লেখা, তিষার জন্য ভালোবাসা।
তিষাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে কে তাকে ঠেলে নেবে সেটা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে একটা ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত যাকে সে সুযোগটা দেয়া হল তার নাম জন। ছেলেটি কানে শুনতে পায় না এবং সাইন ল্যাংগুয়েজে কথা বলে, আলু আর আম্মু আগেই তিষার মুখে বেশ কয়েকবার জনের কথা শুনেছিল, তিষার ভাষায় জন হচ্ছে কম্পিউটারের জিনিয়াস। তিষাকে স্কুলের করিডোরে আনা মাত্রই ড্রামের শব্দ হতে থাকে। ড্রামের সাথে সাথে ছেলে মেয়েদের চিৎকার শোনা যায়। তিষাকে হুইল চেয়ারে করে স্কুলের অডিটরিয়ামে নেয়া হয়। স্টেজে কয়েকটা চেয়ার রাখা হয়েছে সেখানে এখনো কেউ বসে নেই। অডিটরিয়ামে সব ছেলে মেয়েরা বসে চেঁচামেচি করছে। হুইল চেয়ার ঠেলে যখন তিষাকে স্টেজে তোলা হল। তখন ছেলে মেয়েদের চেঁচামেচিতে অডিটরিয়ামের ছাদ ধ্বসে পড়ার মতো অবস্থা হল।
স্কুলের প্রিন্সিপাল মিসেস সাস্টিক আর তিষার ক্লাশ টিচার মিসেস রামজি স্টেজে উঠলেন, হাত নেড়ে বাচ্চাদের থামানোর চেষ্টা করলেন। বাচ্চারা চিৎকার করতেই থাকল, মিসেস সাস্টিক তখন মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বললেন, “বাচ্চারা তোমরা শান্ত হও! টিশা এই মাত্র হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে, তোমরা চিৎকার করে তাকে আবার অসুস্থ করে দিও
বাচ্চারা তখন একটু শান্ত হল, মিসেস সাস্টিক তখন বললেন, “তোমরা সবাই জান আমাদের টিশা সাসকুয়ান লেকে বরফের ফাটলে পড়ে গিয়েছিল। লেকের উপর সেই ফাটল কেন তৈরী হয়েছিল সেটি এখনো একটি রহস্য। জিওলজিস্টরা বের করার চেষ্টা করছেন, অনুমান করা হয় একটা ভূকম্পনের কারণে এটা ঘটেছিল। যাই হোক সেই হিমশীতল পানিতে টিশা ডুবে গিয়েছিল, মানুষ নিঃশ্বাস না নিয়ে এক দুই মিনিটের বেশী বেঁচে থাকতে পারে না, টিশা সেই পানিতে প্রায় সাতাইশ মিনিট ডুবেছিল, তার বেঁচে থাকার কোনো কথা ছিল না কিন্তু তোমরা সবাই দেখছ টিশা শুধু যে বেঁচে আছে তা নয় সে আমাদের সামনে বসে আছে।”
বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে উঠল। মিসেস সাস্টিক বললেন, “এই দীর্ঘ সময় মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ না হলে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিন্তু আমরা সবাই জানি, হাসপাতালের ডাক্তারদের টিম রিপোর্ট দিয়েছেন টিশার মস্তিষ্ক পুরোপুরি ঠিক আছে।”
বাচ্চারা আবার আনন্দে চিৎকার করে উঠল। মোটাসোটা একটা ছেলে চিৎকার করে বলল, “আমরা টিশার বেন ফাংশান টেস্ট করতে চাই। টিশা বল পাঁচ আর পাঁচে কত হয়?”
টিশা হাসল, বলল, “দুইশ বারো!”
সবাই আনন্দে চিৎকার করে ওঠে! মিসেস সাস্টিকও হাসলেন, হেসে বললেন, “আমরা এই মাত্র টিশার মস্তিষ্ক টেস্ট করলাম, তোমরা সবাই দেখেছ সেটা শুধু যে ঠিক আছে তা নয় এটা এখন ওভার ড্রাইভ মোডে কাজ করছে। যাই হোক, আমরা আজকে টিশাকে কিছুক্ষণের জন্যে আমাদের স্কুলে এনেছি কারণ আমরা সবাই তাকে বলতে চাই, আমরা তোমাকে ভালোবাসি টিশা!”
সবাই চিৎকার করে বলল, “আমরা তোমাকে ভালোবাসি, টিশা।”
দর্শকের সারিতে বসে থাকা তিষার আম্মু শাড়ীর আঁচল দিয়ে তার চোখ মুছলেন।
এবারে তিষার ক্লাশ টিচার মিসেস রামজী হাতে মাইক্রোফোন নিলেন, মোটাসোটা হাসিখুশী মহিলা, চশমা ঠিক করে বললেন, “আমরা টিশাকে এখানে এনেছি, তার দুটো কারণ আছে। প্রথম কারণটা সবাই জান। সে হচ্ছে সারা পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী মেয়ে। এরকম নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসা মানুষ সারা পৃথিবীতে বলতে গেলে নেই। তাই আমরা টিশাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের স্কুল থেকে একবার ঘুরিয়ে নিতে চাই, যেন আমাদের স্কুলে টিশার সৌভাগ্যের ছিটেফোঁটা ছড়িয়ে পড়ে এবং তোমাদেরও সেই সৌভাগ্য স্পর্শ করে আর তোমারাও লেখাপড়া না করেই ভালো গ্রেড পাও!”
সবাই মিসেস রামজির কথা শুনে হাসিতে ফেটে পড়ে। মিসেস রামজি হাসির শব্দ থেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন তারপর গলার স্বর পরিবর্তন করে বললেন, “তোমরা নিশ্চয়ই জান টিশার একটা পোষা কুকুর ছিল, সেই কুকুরটি নিজের জীবন দিয়ে টিশাকে বাঁচিয়েছে। আমরা সবাই সেই অসম্ভব ভালো পোষা কুকুরটাকে অনেক ভালোবাসা দিয়ে স্মরণ করব। আমরা জানি টিশা নিশ্চয়ই সেই কুকুরটাকে অনেক ভালোবাসত এবং তার অভাবটা নিশ্চয়ই আর কখনো পূরণ হবে না।”
বাচ্চারা সারাক্ষণই আনন্দে চেঁচামেচি করছিল, তিষার পোষা কুকুরের প্রসঙ্গটি আসতেই সবার মন ভারী হয়ে যায়। তারা নিঃশব্দে মিসেস রামজির কথা শোনে। মিসেস রামজী নরম গলায় বললেন, “আমরা কখনো টিশার প্রিয় কুকুরটার অভাব পূরণ করতে পারব না। তারপরও সে যেন একটু হলেও তার দুঃখটা ভুলে থাকতে পারে সে জন্যে তাকে একটা পোষা প্রাণী উপহার দিতে চাই। এখানে টিশার বাবা মা আছেন, তারা যদি অনুমতি দেন। তাহলে আমরা টিশাকে একটা এনিম্যান দিতে চাই!”
সবাই এবার শুধু আনন্দে চিৎকার করে উঠল না, উত্তেজনায় নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল! তিষার আব্বু আম্মু মাথা নেড়ে অনুমতি দিলেন তখন স্টেজের পাশ থেকে একটা বড় বাক্স আনা হল। সেটি সুন্দর রিবন দিয়ে বাঁধা। তিষা হুইল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রিবনের এক মাথা ধরে টান দিতেই বাক্সটা খুলে যায় এবং সবাই অবাক হয়ে দেখে বাক্সের মাঝামাঝি ছোট একটা এনিম্যান গুটি গুটি মেরে বসে আছে। সেটি সাবধানে তার দুই পা আর দুই হাতে ভর দিয়ে দাঁড়াল, তারপর তার বড় বড় চোখে চারদিকে তাকাল। তিষা হাত বাড়িয়ে দিতেই এনিম্যানটি তার নিজের দুই হাত বাড়িয়ে তিষাকে ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। তিষা সাবধানে তাকে কোলে তুলে নিয়ে তার মাথায় হাত বুলাতেই সেটি তার ফোকলা দাঁত বের করে ফিক করে হেসে দিল
তিষা এনিম্যানটি কোলে নিয়ে আবার তার হুইল চেয়ারে বসে পড়ে।
মিসেস রামজি তিষাকে বললেন, “টিশা তুমি কী কিছু বলতে চাও?”
তিষা মাথা নেড়ে বলল, “আমি কিছু বলার চেষ্টা করলেই কেঁদে ফেলব।”
“একটু না হয় কেঁদেই ফেল।”
তিষা মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলল। তার কাঁদার কারণটা তবু বোঝা যায় কিন্তু ছটফট দুরন্ত বাচ্চাদের অনেকেই কেন তার সাথে সাথে কেঁদে ফেলল তার কারণটা ঠিক বোঝা গেল না!