০৬. তদন্তের আগের সময়টা

তদন্তের আগের সময়টাতে পোয়ারো এতটুকু বিশ্রাম নেবার সময় পায়নি। দুবার গোপনে মিঃ ওয়েলসের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত রইল পোয়ারো, বেশ কয়েকবার গ্রামের বাইরেও ঘুরে এল সে। ব্যাপারটা আমার এতটুকু ভালো লাগছিল না, কারণ পোয়ারো ওর কাজকর্মের কথা আমাকে একটুও জানাল না।

তদন্তের নির্দিষ্ট দিন এবার এগিয়ে এল। শুক্রবার দিন গ্রামেরই একটা বাড়িতে করোনারের শুনানি বসল। শেষ পর্যন্ত পোয়ারোর দেখা মিলল, আমরা দুজনেও হাজির হলাম ওখানে। আমাদের সাক্ষ্যের প্রয়োজন না থাকায় আমরা পেছনেই বসে রইলাম।

প্রথমে খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো শেষ হল। জুরীরা মৃতদেহ দেখার পর জন ক্যাভেণ্ডিস সনাক্ত করে সাক্ষ্য দিল। প্রশ্নের উত্তরে জন ঐ দিনের ঘটনার একটা বিবরণ দিয়ে মিসেস ইঙ্গলথর্পের মারা যাওয়ার পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে দিল।

এরপর ডাক্তারী সাক্ষ্য গ্রহণ করা হল, সারা ঘরের লোক লণ্ডনের সর্বশ্রেষ্ঠ বিষ বিশেষজ্ঞ ডাঃ বরস্টিনের বক্তব্য শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। অল্প কথায় তিনি ময়না তদন্তের বিবরণ বুঝিয়ে দিলেন জুরীদের।

ময়না তদন্তের ফলাফল বিশ্লেষণ করে এটুকুই বোঝা গেছে মিসেস ইঙ্গলথর্প স্ট্রিকনিন বিষ প্রয়োগে মারা গেছেন।

ওঁর দেহে স্ট্রিকনিনের পরিমাণ দেখে জানা যায় উনি প্রায় পৌনে এক গ্রেন স্ট্রিকনিন খেয়েছিলেন।

এরপর করোনার প্রশ্ন করলেন মিসেস ইঙ্গলথর্প কি না জেনে ঐ বিষ গ্রহণ করে থাকতে পারেন?

ওঃ বরস্টিন জানালেন এটা অসম্ভব কারণ স্ত্রিকনিন সাধারণভাবে ওষুধে ব্যবহার করা হয় না, এর বিক্রির ওপরও বিধিনিষেধ আছে।

জুরী জিজ্ঞাসা করলেন ডাঃ কি পরীক্ষা করে বুঝতে পেরেছেন কিভাবে ঐ বিষ উনি গ্রহণ করেছেন।

বরস্টিন জানালেন যে তিনি বুঝতে পারেননি।

জুরী এবার প্রশ্ন করলেন ডাঃ উইলকিন্স আসার আগেই ডাঃ বরস্টিন স্টাইলস কোর্টে উপস্থিত হয়েছিলেন কিনা।

ডাঃ বরস্টিন জানালেন গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে তার দরজার কাছে দেখা হয়েছিল, সেখানে সব শুনে তিনি তাড়াতাড়ি ঘটনাস্থলে চলে যান।

জুরী এরপরের ঘটনাগুলো জানতে চান। ডাঃ বরস্টিন বলে যেতে লাগলেন যে মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরে ঢুকেই তিনি দেখতে পান যে তার দেহটা ধনুষ্টংকারের রোগীর মত বেঁকে যাচ্ছে, তাকে দেখে মিসেস ইঙ্গলথর্প শুধু আলফ্রেড, আলফ্রেড বলে উঠলেন।

করোনার প্রশ্ন করলেন রাত্রের খাওয়ার পর মিসেস ইঙ্গলথর্প ওঁর স্বামীর এনে দেওয়া যে কফি পান করেছিলেন, তার মধ্য দিয়ে ওঁর দেহে বিষ প্রয়োগ করতে পারে কিনা।

ডাঃ বরস্টিন বললেন সেটা অসম্ভব নয়। তবে স্ট্রিকনিন খুব দ্রুত কাজ করে, সাধারণতঃ গ্রহণ করার দু এক ঘণ্টার মধ্যেই এর উপসর্গ দেখা দেয়। অবশ্য বিশেষ কোনো কারণে একটু দেরিও হতে পারে। যদিও বর্তমান ক্ষেত্রে এটা ঘটেনি। মিসেস ইঙ্গলথর্প খাওয়ার পরে রাত প্রায় আটটার সময় কফি পান করেছিলেন অথচ উপসর্গগুলো পরদিন ভোরের আগে দেখা দেয়নি। এতে সন্দেহ হয়, উনি বিষ গ্রহণ করেছিলেন আরও পরে।

করোনার বললেন মিসেস ইঙ্গলথর্পের অভ্যাস ছিল মাঝরাতে এক কাপ কোকো পান করা ওর মধ্য দিয়ে বিষ ওঁর শরীরে ঢুকে থাকতে পারে।

ডাঃ বরস্টিন বললেন তা হতে পারে না কারণ ঐ পাত্রের কোকো তিনি বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, তাতে স্ট্রিকনিন নেই।

পোয়ারো যেন অস্ফুট স্বরে কিছু বলে উঠল। আমি পোয়ারোকে বলতে গেলাম ডাঃ বরস্টিন যা বলছেন সেও তো তাই বলেছিল।

পোয়ারো আমাকে বাধা দিয়ে চুপচাপ শুনতে বলল।

ডাঃ বরস্টিন জানালেন, স্ট্রিকনিনের স্বাদ অত্যন্ত তেতো। কোনো দ্রবণের ৭০,০০০ ভাগের এক ভাগ যদি স্ট্রিকনিন থাকে তাহলে এর উপস্থিতি বুঝতে পারা যায়, অত্যন্ত গন্ধযুক্ত কিছু দিয়ে স্ট্রিকনিনের স্বাদ অবশ্য দূর করা যায়, তবে কোকোর সে শক্তি নেই।

জুরীদের মধ্যে একজন জানতে চাইলেন কফিতে স্ট্রিকনিনের স্বাদ নষ্ট হয় কিনা।

ডাঃ বরস্টিন উত্তরে জানালেন কফির নিজস্ব স্বাদ যেহেতু তেতো, সেহেতু এর মধ্যে স্ট্রিকনিনের স্বাদ চাপা পড়তে পারে।

জুরী বললেন তাহলে ডাঃ বরস্টিনের মতে সম্ভবতঃ কফির মধ্য দিয়েই বিষ প্রয়োেগ করা হয়েছে, অবশ কোনো অজানা কারণে এর উপসর্গ ফুটে উঠতে দেরি হয়েছে।

ডাঃ বরস্টিন বললেন কফির কাপটা সম্পূর্ণ গুড়ো হয়ে যাওয়ায় ঐ কাপের তলানি বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়নি।

ডাঃ বরস্টিনের সাক্ষ্য দেওয়া শেষ হলে ডাঃ উইলকিন্স এলেন। তিনি ডাঃ বরস্টিনের কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করলেন।

মিসেস ইঙ্গলথর্প আত্মহত্যা করতে পারেন কিনা প্রশ্ন করা হলে ডাঃ উইলকিন্স দৃঢ়তার সঙ্গে সে কথা অস্বীকার করে বললেন, মৃতা মিসেস ইঙ্গলথর্পের হার্ট একটু দুর্বল থাকলেও অন্যদিক দিয়ে তার স্বাস্থ্য বেশ ভালোই ছিল, মানসিক প্রফুল্লতারও কোনো অভাব ছিল না। তাই এসব বিবেচনা করেই বলা যায় আত্মহত্যা করার মত মহিলা উনি ছিলেন না।

এরপর সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য লরেন্স ক্যাভেণ্ডিসের ডাক পড়ল। লরেন্সের সাক্ষ্য জনের সাক্ষ্যেরই পুনরাবৃত্তি। তবে লরেন্স চলে আসার সময় একটু ইতস্ততঃ করে করোনারকে বলল তার ধারণা তার মার মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে, অবশ্য তার ধারণা ভুলও হতে পারে।

করোনার গভীরভাবে জানতে চাইলেন তার এরকম মনে হওয়ার কারণ কি।

লরেন্স বলল তার মা মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে থেকেই একটা টনিক খাচ্ছিলেন, যাতে স্ট্রিকনিন থাকত।

করোনার একথা শুনে বিস্মিত হলেন। জুরীরাও নড়েচড়ে বসল।

লরেন্স বলে যেতে লাগল, সে শুনেছে এরকম ওষুধ ক্রমাগত ব্যবহার করার ফলে কখনও কখনও মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। তার মা হয়ত সেদিন ঐ ওষুধ একটু বেশি মাত্রায় খেয়ে ফেলেছিলেন ভুল করে।

করোনার বললেন তারা এই প্রথম জানতে পারলেন যে মিসেস ইঙ্গলথর্প স্ক্রিকনিন খেতে অভ্যস্ত ছিলেন। এই সূত্রটি জানানোর জন্য তারা লরেন্সের কাছে কৃতজ্ঞ।

এরপর ডাঃ উইলকিন্সকে করোনার আবার আহ্বান করলেন। তিনি ব্যাপারটা শুনেই উড়িয়ে দিলেন, বললেন মিঃ ক্যাভেণ্ডিসের কথাটা একেবারে অসম্ভব। স্ত্রিকনিন এক হিসাবে একটু ক্ষতিকারক বিষ, তবে ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করলে এতে হঠাৎ মৃত্যু ঘটার কোনো কারণ নেই। এটা দীর্ঘদিন ধরে অতি মাত্রায় ব্যবহার করতে থাকলে নানা উপসর্গ দেখা দিতে বাধ্য। কিন্তু মিসেস ইঙ্গলথর্পের ক্ষেত্রে এরকম হলে তার নিশ্চয়ই নজরে আসত।

করোনার প্রশ্ন করলেন মিসেস ইঙ্গলথর্প যদি অতিমাত্রায় ঐ টনিক গ্রহণ করে থাকেন তাহলে কি হতে পারে?

ডঃ উইলকিন্স জানালেন, তিন-চার দাগ ওষুধ খেলেও মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা নেই। মিসেস ইঙ্গলথর্প প্রত্যেবার বেশি করেই ঐ ওষুধ তৈরি করে আনতেন ট্যাডমিনস্টারের কুটসের ওষুধের দোকান থেকে। দেহে ময়না তদন্তের সময় যে পরিমাণ স্ট্রিকনিন পাওয়া গেছে সেটা পেতে হলে পুরো বোতলের ওষুধ একেবারে খাওয়ার কথা, যা একেবারেই অবাস্তব।

একজন জুরী জিজ্ঞাসা করলেন ওষুধের দোকানের কোনো কর্মচারী ভুল করতে পারে কি না। ডাঃ উইলকিন্স বললেন সেটা হলেও হতে পারে।

কিন্তু এরপরেই ডরকাসের সাক্ষ্য শুনে ঐ সম্ভাবনা বাতিল করে দিতে হল। ডরকাস জানাল ওষুধটা নতুন তৈরি করা হয়নি, বেশ কিছুদিন ধরেই মিসেস ইঙ্গলথর্প সেটা খাচ্ছিলেন। মারা যাওয়ার দিন শেষ দাগটা খেয়েছিলেন।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য ওষুধের ব্যাপারটা বাতিল করতে হল। করোনার অন্যান্য সাক্ষ্য গ্রহণ করতে শুরু করলেন। ডরকাস জানাল দুর্ঘটনার দিন কিভাবে মিসেস ইঙ্গলথর্প ঘন্টা বাজালে ডরকাস বাড়ির সকলকে ডেকে তোলে।

এরপর মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে সাক্ষী দিতে ডাকা হল। বেশ ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে শান্তভাবে সাক্ষ্য দিতে লাগলেন তিনি। করোনারের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন কিভাবে রাত সাড়ে চারটের সময় ঘড়ির অ্যালার্ম শুনে তিনি উঠে পড়েন তারপর হঠাৎ একটা ভারী কিছু পড়ার শব্দ পান।

করোনার বললেন সম্ভবতঃ খাটের পাশের টেবিলটা পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে থাকতেন।

মেরী ক্যাভেণ্ডিসের ঘন্টার শব্দ শোনার পর কি কি হয়েছিল বলতে লাগলে করোনার বললেন সে সব কথা তো জানা হয়ে গেছে। তারা শুধু আগের দিনের ঝগড়ার সম্বন্ধে জানতে চান।

মেরী ক্যাভেণ্ডিস অবাক হয়ে বললেন তিনি এ ব্যাপারে কি বলবেন। তার কণ্ঠস্বর একটু উদ্ধত শোনাল।

করোনার আবার বলতে লাগলেন মেরীকে একথা জিজ্ঞাসা করার পেছনে একটা কারণ আছে। তিনি শুনেছেন মেরী ঐ সময় ছোট ঘরের বড় জানলার পাশে একটা বেঞ্চে বসে বই পড়ছিলেন।

মেরী বলতে বাধ্য হলেন যে তিনি ওখানে বসেছিলেন। করোনার প্রশ্ন করলেন ঘরের জানালাটা নিশ্চয়ই খোলা ছিল।

ফ্যাকাশে মুখে মেরী স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে জানলা খোলা ছিল।

করোনার এবার প্রশ্ন করলেন তাহলে নিশ্চয়ই ঘরের ভেতরের কথাবার্তা তিনি শুনতে পেয়েছিলেন।

মেরী বললেন কোনো কথা তার কানে আসেনি তা নয়, তবে পরের গোপনীয় কথা শোনার অভ্যেস তার নেই। মেরীর মুখটা সামান্য লাল হয়ে উঠল।

করোনার মেরীকে যা শুনেছেন তা বলার জন্য চাপ দিলেন।

মেরীর দিকে তাকিয়ে মনে হল তিনি যেন কিছু চিন্তা করছেন। বাইরের শান্ত ভাবটা অবশ্য বজায় রাখছে। একটু পরে তিনি বললেন তার মনে পড়েছে। মিসেস ইঙ্গলথর্প স্বামী-স্ত্রীর কলঙ্ক বা এরকম ধরনের কোনো কথা বলছিলেন।

করোনারকে সন্তুষ্ট মনে হল। তিনি এবার বললেন মেরী যখন বুঝলেন ব্যাপারটা স্বামী-স্ত্রীর গোপনীয় কিছু তখন তিনি সেখান থেকে সরে গেলেন না কেন?

মেরী ক্যাভেণ্ডিসের চোখে মনে হল যেন একটু ঝিলিক খেল গেল। এই প্রশ্নটা শুনে করোনারের প্রতি যে একটা ক্রোধ ফুটে উঠছে তা বুঝতে অসুবিধা হল না। তবুও বেশ শান্ত স্বরেই মেরী বললেন তিনি সরে যাননি কারণ সেখানে বসে থাকতে ভালো লাগছিল, তবে মনটা তার বইয়ের মধ্যেই ছিল।

এর বেশি কিছু মেরী জানেন কিনা করোনার জিজ্ঞাসা করল। মেরী জানাল এর চেয়ে বেশি কিছু তারা জানা নেই।

প্রশ্নোত্তর শেষ হয়ে গেলেও আমার মনে হল, করোনার ওর সাক্ষ্যে খুব একটা সন্তুষ্ট হননি। হয়ত তার ধারণা মেরী ক্যাভেণ্ডিস অনেক কিছু গোপন করেছেন।

এরপর দোকান কর্মচারী অ্যামি হিল সাক্ষী দিতে এল। ওর সাক্ষ্যে জানা গেল, ১৭ই বিকালে স্টাইলসের মালী উইলিয়াম আর্লকে ও একটা ছাপানো উইলের ফর্ম বিক্রি করেছিল।

এবার উইলিয়াম ও ম্যানিং সাক্ষ্য দিতে এল। ওরা জানাল সেদিন একটা উইলে সাক্ষী হিসাবে তারা সই দিয়েছিল। সে সময় ছিল প্রায় বিকাল সাড়ে চারটে।

সিনথিয়া মারডকের ডাক পড়ল। সিনথিয়া অবশ্য কিছুই জানতে পারল না কারণ মেরী ক্যাভেণ্ডিস ওকে জাগানোর আগে পর্যন্ত দুর্ঘটনার কথা সে কিছুই জানতে পারেনি।

অতঃপর করোনার সিনথিয়াকে বিদায় দিলেন।

এবার ডাক এল ইভিলিন হাওয়ার্ডের।

মিস হাওয়ার্ড মিসেস ইঙ্গলথর্পের ১৭ তারিখের লেখা চিঠি দাখিল করলেন। চিঠিটা আমি আর পোয়ারো আগেই দেখেছিলাম। চিঠিটা এই রকম ছিল :

স্টাইলস কোর্ট
এসেক্স
১৭ জুলাই

প্রিয় ইভিলিন,
ঝগড়াটা কি মেটানো যায় না? আমার প্রিয় স্বামীর সম্বন্ধে তুমি যা বলেছে, তা অবশ্য ভুলে যাওয়া অসম্ভব আমার পক্ষে, বয়স হয়ে গেছে তো…তবুও তোমাকে ভালোবাসি।
তোমারই একান্ত
এমিলি ইঙ্গলথর্প।

জুরীরা মনোযোগ সহকারে চিঠিটা দেখলেন।

করোনার একটু হতাশ হয়ে বললেন এই চিঠি থেকে এমন কিছুই জানা গেল না যা সমস্যা সমাধানের সহায়ক হতে পারে।

মিস হাওয়ার্ড বলতে লাগলেন বেচারী এমিলি বুঝতে পেরেছিলেন ওকে বোকা বানানো হয়েছিল। করোনার বললেন চিঠিতে তো এরকম কোনো কথা নেই। ইভি উত্তরে বললেন এমিলি পছন্দ করতেন না বলেই চিঠিতে সেরকম কিছু লেখা ছিল না। তিনি বললেন এমিলি নাকি চাইছিলেন তিনি ফিরে আসুন। কিন্তু এমিলি নিজের ভুল স্বীকার করতে চাননি।

আমি লক্ষ্য করলাম করোনার, মিঃ ওয়েলস, আর অন্যান্য জুরীরা একটু মৃদু হাসলেন। মিস হাওয়ার্ডের চরিত্র ওরা সকলেই বুঝে নিয়েছেন।

করোনার এবার মিস হাওয়ার্ডকে বিদায় জানালেন।

এরপরই সবচেয়ে উত্তেজনার ব্যাপার ঘটল যখন করোনার ওষুধের দোকানের কর্মচারী অ্যালবার্ট মেসকে সাক্ষ্য দিতে ডাকলেন।

মেস শুকনো মুখে এসে দাঁড়াল। করোনারের প্রশ্নের উত্তরে জানাল যে সে একজন যোগ্য ওষুধ প্রস্তুতকারক। তবে ঐ দোকানে সে নতুন এসেছেন আগের কর্মচারী যুদ্ধে চলে যাওয়ার জন্য।

দু-একটা সাধারণ কথাবার্তার পর করোনার জানতে চাইলেন মেস কয়েকদিনের মধ্যে কারও কাছে স্ত্রিকনিন বিক্রি করেছিলেন কিনা। মেস মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। করোনার জানতে চাইলেন কবে সে বিক্রি করেছে। মেস জানাল সোমবার ১৬ তারিখে সে স্ট্রিকনিন বিক্রি করে। করোনার এবার জানতে চান সে কাকে বিক্রি করেছে।

সারা ঘর নির্বাক নিস্তব্ধ হয়ে সাক্ষীর দিকে তাকিয়ে আছে। মেস জানাল সে মিঃ ইঙ্গলথর্পকে স্ট্রিকনিন বিক্রি করেছিল।

ঘরের সকলের নজর গিয়ে পড়ল এক পাশে বসে থাকা অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পের ওপর। কিন্তু লোকটার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। শুধু নিথরভাবে একবার মেসের মুখের দিকে তাকিয়েছিল যখন মেস তার নাম বলছিল। আমি ভেবেছিলাম লোকটা হয়ত তীব্র প্রতিবাদ করবে, কিন্তু সেরকম কিছুই হল না–মুখে শুধু একটা বিস্ময়ের ঝিলিক খেলে গেল।

করোনার মেসকে তীব্র স্বরে প্রশ্ন করল সে এইভাবে যখন তখন স্ত্রিকনিন বিক্রি করে নাকি। মেস প্রশ্নটা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেল, তবু তাড়াতাড়ি বলে উঠল মিঃ ইঙ্গলথর্প একটা কুকুর মারার জন্য বিষটা চেয়েছিলেন বলে সে বিক্রি করেছিল।

করোনার আবার প্রশ্ন করলেন সে বিষ কিনলে একটা খাতায় সই করতে হয় কিনা, মেস তাড়াতাড়ি খাতাটা বের করে দেখাল। করোনার তাকে ভবিষ্যতের জন্য সাবধান করে বিদায় দিলেন।

এরপর ডাক পড়ল অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পের। লোকটাকে অদ্ভুত সংযত দেখাল। করোনারের সোজাসুজি আক্রমণের উত্তরে অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্প জানালেন তিনি বিষ কেনেননি, স্টাইলসে কোনোও কুকুর নেই, শুধু বাইরে একটা ছোট কুকুর বহাল তবিয়তেই আছে।

করোনোর সই করা খাতাটা সামনে বাড়িয়ে ধরে মিঃ ইঙ্গলথর্পকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি এই সইটা অস্বীকার করতে চাইছেন কিনা।

মিঃ ইঙ্গলথর্প বললেন ঐ হাতের লেখাটা তার নয়। তিনি পকেট থেকে একটা পুরনো খাম বের করে নিজের নাম সই করে জুরীদের সামনে ধরলেন। সত্যিই লেখা দুটোর মধ্যে কোনো মিল দেখা গেল না।

করোনোর মিঃ ইঙ্গলথর্পকে জিজ্ঞাসা করলেন তাহলে মিঃ মেসের সাক্ষ্য সম্বন্ধে তার বক্তব্য কি? মিঃ ইঙ্গলথর্প শান্ত কণ্ঠে বললেন, মিঃ মেস ভুল করেছেন।

এবার একটু ইতস্ততঃ করে করোনার জানতে চাইলেন সোমবার ১৬ তারিখে সন্ধ্যাবেলায় মিঃ ইঙ্গলথর্প কোথায় ছিলেন? ইঙ্গলথর্প বললেন তাঁর মনে পড়ছে না। করোনার তাকে ভালোভাবে ভাবতে বললেন। ইঙ্গলথর্প মাথা নেড়ে জানালেন তার যতদূর মনে পড়ছে সম্ভবত তিনি কোথাও বেড়াচ্ছেন। করোনার গম্ভীরভাবে জানতে চাইলেন ইঙ্গলথর্প কোনো দিকে বেড়াচ্ছিলেন, তার সঙ্গে কেউ ছিল কিনা। ইঙ্গলথর্প জানালেন তিনি একাই ছিলেন তবে কোথায় ছিলেন তার মনে পড়ছে না।

করোনার বললেন তাহলে ইঙ্গলথর্প সেই সময় কোথায় ছিলেন তা বলতে তিনি অস্বীকার করছেন? ইঙ্গলথর্প বললেন করোনার যা খুশী ভেবে নিতে পারেন।

পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। অস্ফুট স্বরে সে বলে উঠল ইঙ্গলথর্প গ্রেপ্তার হতে চায় নাকি।

মিঃ ইঙ্গলথর্প সত্যি একটা বাজে ধারণার সৃষ্টি করলেন।

করোনার এবার অন্য প্রশ্ন করলেন। তিনি জানতে চাইলেন মঙ্গলবার বিকালে মিঃ ইঙ্গলথর্প তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি করেছিলেন কিনা।

মিঃ ইঙ্গলথর্প জানালেন যে জুরীরা ভুল শুনেছেন তার স্ত্রীর সঙ্গে ঐ সময় তার কোনো ঝগড়া হয়নি। কারণ সারা বিকাল তিনি বাড়িতেই ছিলেন না।

করোনার জানালেন দুজন সাক্ষী তাদের স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া শুনেছেন। ইঙ্গলথর্প নির্বিকারভাবে বলল ওরা ভুল করেছে।

পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে হেঁয়ালির মত মনে হতে লাগল। পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার মুখে একটা অদ্ভুত হাসির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে।

করোনোর জিজ্ঞাসাবাদ চালাতে লাগলেন। তিনি জানতে চাইলেন মিসেস ইঙ্গলথর্প তার মৃত্যুকালে যে দুটো কথা বলেছিলেন সে সম্বন্ধে মিঃ ইঙ্গলথর্পের মতামত কি।

ইঙ্গলথর্পপ বললেন সেই সময় ঘরে খুবই কম আলো ছিল। ডাঃ বরস্টিনের চেহারার সঙ্গে তার চেহারার যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে অর্থাৎ বরস্টিনের মত তার মুখে দাড়ি রয়েছে। সেই অল্প আলোতে মিসেস ইঙ্গলথর্প ডাঃ বরস্টিনকেই মিঃ ইঙ্গলথর্প বলে মনে করেছিলেন।

পোয়ারো অস্ফুট স্বরে স্বগতোক্তি করে বলল যে মিঃ ইঙ্গলথর্প বেশ ভালোই বলেছেন।

ইঙ্গলথর্প বলতে লাগলেন সকলে তার স্ত্রীর শেষ সময়ের কথাকে দোষারোপ বলে কেন ভাবছেন। তার মতে তার স্ত্রী আসলে তাকে কিছু অনুরোধ করতে চেয়েছিল।

করোনার এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। তারপর বললেন তাদের বিশ্বাস মিঃ ইঙ্গলথর্প নিজেই তার স্ত্রীর জন্যে কফি ঢেলে নিয়ে গিয়েছিলেন।

মিঃ ইঙ্গলথর্প জানালেন কফিটা তিনিই ঢেলেছিলেন, কিন্তু তিনি নিয়ে যেতে পারেননি, কারণ এক বন্ধু সেই সময় তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, পরে যখন তিনি ফিরে আসেন তখন আর কাপটাকে টেবিলের ওপর দেখতে পাননি।

কথাটা সত্যি কিনা বুঝতে পারলাম না। ইঙ্গলথর্পের এতে কতটা সুবিধা হল তাও বুঝলাম না কারণ কফিতে বিষ মেশানোর যথেষ্ট সুযোগ উনি পেয়েছিলেন।

হঠাৎ পোয়ারোর ধাক্কা খেয়ে চমকে গেলাম, পোয়ারো দরজার কাছে বসে থাকা দুজন মানুষের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। দুজনের মধ্যে একজন বেশ দীর্ঘ, সুপুরুষ আর অন্যজন ছোটোখাটো বুদ্ধিদীপ্ত।

আমি ফিসফিস করে পোয়ারোকে জিজ্ঞাসা করলাম যে ওরা কারা। আমার কানে প্রায় মুখ ঠেকিয়ে পোয়ারো বলল ঐ ছোটখাটো মানুষ হল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ডিটেকটিভ ইনসপেক্টর জিমি জ্যাপ। অন্যজনও ইয়ার্ডেরই লোক।