ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
০১.
ধীরে ধীরে টেলিফোন রিসিভারটা নামিয়ে পিছন ফিরে লুসিলির দিকে চাইলাম।
সে হাত দুটো দিয়ে হাঁটুটাকে চেপে ধরে ভয়ে ভয়ে বসেছিল।
কে? জিজ্ঞাসা করল, সে।
চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, জানি না, তবে মনে হয় যে লোকটা আজ সকালে তোমাকে ফোন করেছিল সে।
লোকটার কথাগুলো শুনে সে দু হাতে মুখ ঢাকল।
উঃ, চেস। আমরা কি করব?
জানি না। বেশ জটিল ব্যাপার।
দেখ, আমি ঠিকই বলেছি। লোকটা ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে।
সে তো ব্ল্যাকমেলের কথা কিছুই বলেনি।
নিশ্চয়ই সে আমাদের ব্ল্যাকমেল করতে চাইছে। তার কাছে সুইমস্যুটটা আছে। সে তোমাকে চেনে, আমরা সমুদ্রের ধারে ছিলাম সে জানে এবং পুলিশটা মারার জন্যে আমি দায়ী সেটাও জানে। সে নিশ্চয়ই আমাদের ব্ল্যাকমেল করতে চাইছে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা যাক। আমরা জানি না তার কাছে সুইমস্যুট আছে কিনা বা ও. ব্রায়ানকে তুমি চাপা দিয়েছ সেটা সে জানে কিনা। এটা অবশ্য নিশ্চিতভাবে জানা গেল যে, সে আমাদের সমুদ্রের ধারে দেখেছে।
নিশ্চয়ই তার কাছে সুইমস্যুট আছে এবং সে তোবড়ানো গাড়িটা দেখেছে।
কিন্তু আমরা নিশ্চিত জানি না সিলি। এই দুটো টেলিফোনকল যদি ব্ল্যাকমেলের প্রথম সূচনা হয়, তবে মনে হয় সে তোমার স্বামীকে বলে দেবার ভয় দেখাবে যে, সে আমাদের দুজনকে একসঙ্গে সমুদ্রের ধারে দেখেছিল। অ্যাকসিডেন্টের কথা সে হয়তো কিছুই জানে না।
তাতে কি আসে যায়? অ্যাকসিডেন্টের কথা যদি সে নাও জানে তবুও আমাদের তাকে টাকা দিতে হবে যদি অবশ্য তুমি চাকরী হারাতে আর আমি রোজারকে হারাতে না চাই।
আমরা পুলিশের কাছে যেতে পারি। ব্ল্যাকমেলারের সঙ্গে কি ভাবে আচরণ করা উচিত তারা তা জানে এবং আমাদের এড়িয়ে চলবে।
কি করে একথা বলছ? ঐ গাড়িটা নিশ্চয়ই দেখেছ।
আমরা এটাও সঠিক জানি না। অন্ধকারে সে নাও দেখতে পারে।
তুমি যেন কথার পিঠে কথা বলছ! আমার নিশ্চিত ধারণা অ্যাকসিডেন্টের বিষয় জানে।
তাহলে সে কেন একথা বলল না? ব্ল্যাকমেলের পক্ষে সেটা অনেক ধারালো অস্ত্র।
আমি জানি তোমার ধারণা ভুল, তবু যেমন খুশি ভাবতে পার। কি করবে ভাবছ?
এই মুহূর্তে কিছুই করতে যাচ্ছি না। লোকটা সত্যিই জটিলতার সৃষ্টি করেছে, তবে সে বিপদের প্রধান কারণ নয়। আসল বিপদ আসতে পারে পুলিশের কাছ থেকে। এই লোকটা যদি অ্যাকসিডেন্টের খবর জানে তাকে পয়সা দিয়ে থামান যাবে কিন্তু পুলিশকে টাকা দিয়ে কিছু করা যাবে না। তারাই হচ্ছে বিপদ।
বিষণ্ণ মুখে সে বলল, তুমি বলেছিলে দোষটা নিজের ঘাড়ে তুলে নেবে। আমার পক্ষে অবশ্য বিপদের কারণ এই লোকটা পুলিশ নয়।
আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি তোমাকে বিপদের বাইরে রাখব কিন্তু গ্যারান্টি দিতে পারি না। তুমি এতই অসাবধানী যে গাড়িতে সাঁতারের পোশাকটা ফেলে এলে? যদি কেউ সেটা পুলিশের কাছে নিয়ে যায় তবে আমি বিপদ থেকে তোমাকে রেহাই দিতে পারবো না। আমি দিব্যি করে বলছি, তাদের বলব যে আমিই গাড়িটা চালাচ্ছিলাম। কিন্তু তাতেও নরহত্যায় সাহায্য করার অপরাধে তুমি অপরাধী।
সে রেগে বলল, আমার স্থির বিশ্বাস যে সে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছে। আমি জানতে চাইছি যে তুমি কি ব্ল্যাকমেলারকে টাকা দেবে, না আমি রোজারের কাছে যাব?
শান্ত ভাবে বললাম, তুমি কি ভয় দেখাচ্ছ, লুসিলি? এটাও কিন্তু আমার কাছে ব্ল্যাকমেলের মত শোনাচ্ছে।
কি রকম শোনাচ্ছে আমি জানতে চাই না। আমি জানতে চাই, লোকটা টাকার দাবী করলে তুমি কি করবে?
দাবী না জানান পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে চাই।
তার চোখদুটো জ্বলছিল। আমার বিশ্বাস, তুমি কাঁধে দোষ তুলে নেওয়াটা এড়িয়ে যেতে চাইছ। তুমি প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্যে মনে হয় দুঃখ করতে শুরু করেছ। ঠিক আছে, তুমি কিছুতেই ছাড়া পাবে না।
তুমি কি নিজের চিন্তা ছাড়া কোনদিন অনন্যরটা ভেবেছ? তুমি বরাবর শুধু ভাবছ কেমন করে ঝামেলা থেকে তুমি নিষ্কৃতি পাবে।
তুমি না থাকলে আমি এই ঝামেলায় পড়তাম না। কেন আমি তোমার কথা ভাবব? দোষ পুরোটা তোমারই।
রাগ সামলে বললাম, তুমি ঠিক বলছ, লুসিলি? তুমি কি এতই নির্দোষ? তুমি গাড়ি চালানো শেখবার জন্য বারবার আমাকে প্ররোচিত করে অন্যায় করেছ। তুমিই আমাকে নিয়ে গিয়েছ এই নির্জন সমুদ্রতটে। তুমি যেভাবে আচরণ করছিলে যে কোন মানুষ ভাবতে পারত যে তুমি সহজলভ্যা।
সে ক্ষেপে গিয়ে বলল, এইসব বলার সাহস কে তোমাকে দিল?
উঃ, ঝগড়া করে সমস্যার সমাধান হবে না। প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তোমাকে ঝামেলার বাইরে রাখব এবং সম্ভব হলে আমি তা করব।
তুমি আমাকে ঝামেলার বাইরে রাখ। আমি রোজারকে হারাতে চাই না, জেনেও যেতে চাই না, তুমি একটা জন্তুর মত ব্যবহার করছ।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর সে বলল, এ নিয়ে আমি আর ভাবতে পারছি না। সমস্ত ব্যাপারটা তোমার হাতে ছেড়ে দিচ্ছি। আশা করি তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি রাখবে।
তুমি বরং এ আশা ছেড়ে দাও। তোমার কাছে প্রচুর শিক্ষা পেয়েছি। তুমি একটা স্বার্থপর কুপমণ্ডুক ভ্ৰষ্টা ছাড়া কিছুইনও। যে মুহূর্তে তুমি নিষ্কৃতি পাবে সেই মুহূর্তে চোখের পাতা ওলটাতে ছাড়বে না।
গত রাতে রোজারকে বললেই ভাল হত। এখনই আমি গিয়ে সব বলব।
তাতে কি এসে যাবে? আমি কি তাতে হাঁটু গেড়ে তোমার সামনে বসব? ঠিক আছে তুমি যদি তোমার ধনী, প্রভাবশালী রোজারকে এই ঝামেলায় আনতে চাও, আমিও তোমার সঙ্গে গিয়ে সব বলব। আমি বলব, তুমি স্বেচ্ছায় আমার কাছে এসে গাড়ি চালাতে শেখানোর জন্য অনুরোধ করেছিলে। তুমি মাঝরাতে সাঁতার কাটার প্রস্তাব করেছিলে। তুমিই ছায়া রং-এর টুপি ও সানগ্লাস পরে আমার বাংলোয় ছদ্মবেশে এসেছিলে এবং আমার সঙ্গে যে ঘুরতে সেটা তোমার স্বামীর কাছে চেপে গিয়েছিলে। যখন তোমাকে তার অনুমতি নিতে বলি, তুমি বলেছিলে তিনি মুখ, ঈর্ষাকাতর, তাই না? চল তাকে সব খুলে বলা যাক। দেখা যাক তিনি এসব পছন্দ করেন কিনা?
যদি সঙ্গে আসতে না চাও, এখানে অপেক্ষা কর, আমি যাচ্ছি। আমার অনেক শিক্ষা হয়েছে। আমাকে তুমি ব্ল্যাকমেল করতে পারবেনা। যদি ধাপ্পা দাও তবে আমি তোমার ধাপ্পা ধরে ফেলব।
হলঘর দিয়ে গিয়ে সদরের দরজা খুলে ফেললাম। লুসিলি আমার দিকে চেয়ে বলল, চেস…শোন…
সে ছুটে এসে আমাকে ধরে ফেলল, না…শোন…
রাগের সুরে বললাম, আমি যে বোকা, তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। সামনে থেকে বেরিয়ে যাও। যদি কঠিন পথ বেছে নাও, তবে সেই ভাবেই আমার কাছে ব্যবহার পাবে।
অশ্রুসজল কণ্ঠে সে বলল, আমি অত্যন্ত দুঃখিত চেস! তুমি জান না কি দারুণ ভয় পেয়েছিলাম। আমি রোজারকে কিছু বলব না। তোমাকে আমি বিশ্বাস করি। আমি নিজেই জানি না তোমাকে কি বলেছি।
জান না? কেবল ব্যবহার পালটাচ্ছ। প্রথমে আমাকে বিশ্বাস করেছিলে, পরে ভয় দেখাতে শুরু করলে, তারপর স্বামীর কাছে যেতে চাইলে। এখন আবার বিশ্বাস করতে শুরু করেছ। সোজাসুজি মিটিয়ে নাও, তুমি তোমার স্বামীকে জানাতে চাও, না চাও না?
না, চেস।
ঠিক? আর মত পালটাতে পারবে না।
না, চেস।
তুমি, কি চাও যে ব্যাপারটার মোকাবিলা আমিই করি?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
ঠিক? খুব সহজেই কিন্তু তুমি মত পালটাও, তাই না?
চেস, প্লীজ আমার উপর রাগ করো না। দিব্যি করে বলছি, কি করেছিলাম বা বলেছিলাম কিছুই জানি না। আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম।
তুমি কথা বলছ বেশি কিন্তু কিছুই করছ না। লাউঞ্জে চল। এতক্ষণ ধরে আমরা বাইরে কথা বলছি।
সে লাউঞ্জে গিয়ে এক নাটকীয় ভঙ্গিতে বসেছিল, কিন্তু তার কোন নাটকীয় ভঙ্গিই আর আমার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারছিল না।
একটা সিগারেট ধরিয়ে বসলাম।
লুসিলি, এ দিকটা ভেবে দেখেছে? হঠাৎ আমি বললাম, তোমার কি খেয়াল হয়েছে যে এর। ভিতর বিশ্রী ব্যাপার থাকতে পারে?
কি বলতে চাইছ?
জানি না?
কোন কারণে সে নিশ্চয় সেখানে গিয়েছিল। কোন গাড়ির বেপরোয়া চালককে ধরার জন্য গিয়েছিল মনে হয় না। কেন সে সেখানে গিয়েছিল, তোমার কি কিছু মনে হয় না?
মনে হয় না? আমার মনে হয়, বেশ ঠিক আছে। এখন ও আলোচনা বাদ দেওয়া যাক। আমি ভেবে দেখব। গোটা ঘটনাটা দুজনে আলোচনা করা যাক। সাঁতারের পর তুমি গাড়িতে ফিরে এসেছিলে, পোশাক পালটে সুইমস্যুটটা গাড়ির মেঝেয় রেখে এসেছিলে, ঠিক তত?
হ্যাঁ।
কাউকে দেখতে পেয়েছিলে?
না, নিশ্চয়ই না।
কিন্তু কেউ ছিল! যে লোকটা ফোন করেছিল সে আমাদের দুজনকে দেখেছে! কি করে সে জানবে যে আমরা দুজন একসঙ্গে সাঁতার কেটেছিলাম? আমার মনে আছে কোন আড়াল ছিল না। সে নিশ্চয়ই ওখানেই ছিল।
আমি ভাবছি, দিনের আলোয় চারপাশ দেখব। সে নিশ্চয় কোথাও লুকিয়ে ছিল। মনে হচ্ছে না সে থাকতে পারে। যতদূর মনে আছে আড়াল ছিল না। কিছুক্ষণ থেমে বলে ও তোমার কি মনে হচ্ছে যে তুমি যখন গাড়ির ভিতর সাঁতারের পোশাকটা রেখে এসেছিলে, সেই লোকটা গাড়ির কাছে গিয়ে সেটা তুলে নিয়েছিল?
আমার দিকে চাইল সে।
না, তা মনে হয় না।
আমরা যখন ঝগড়া করছিলাম তখন যদি সে নিয়ে থাকে তাহলে এটাই বোঝায় যে সে তোবড়ানো গাড়িটা দেখেনি।
কিন্তু গ্যারেজের দরজা ভাঙা ছিল–তখনই সে নিয়েছিল।
ঠিক আছে, আবার আলোচনা করা যাকঃ যখন তুমি গাড়িতে ফিরে চালাতে শুরু করলে তখন কি হয়েছিল?
নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম একেবারে। গাড়িটা চড়াই পথে চালাচ্ছিলাম। প্রায় মাইল খানেক যাওয়ার পর একজন লোকের চীৎকার শুনতে পেলাম…
লুসিলি এই জায়গাটা এড়িয়ে যেও না। কত জোরে গাড়ি চালাচ্ছিলে?
কত জোরে ঠিক জানি না।
মনে হয় সত্তর। ঠিক জানি না।
ও’ব্রায়ানকে তুমি দেখনি? তুমি যে তাকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছ জানতে পারনি?
হ্যাঁ।
তাহলে নিশ্চয়ই তার পাশ দিয়ে গিয়েছে। সে নিশ্চয় হেডলাইট নিভিয়ে সেখানেই অপেক্ষা করছিল এবং যখন তুমি তার পাশ দিয়ে যেতে চাইছিলে সেই সময় সে তোমার সামনে এসে পড়ে।
আমার তাই মনে হয়।
পরে কি ঘটল?
বলেছি তো। তার চীৎকার শুনতে পাই ও পাশ কাটিয়ে চলে আসি। গাড়ির পাশে ধাক্কার আওয়াজ শুনতে পাই।
তুমি মোটর সাইকেলটার শব্দ পাওনি?
মনে হয় পেয়েছিলাম।
তখন গাড়ির স্পীড কমিয়েছিলে? তখন সে তোমার কাছে এসে পড়েছিল। সে কি সামনে এসে পড়েছিল, না পাশে?
লুসিলি বলল, মনে পড়ছে না।
এবারে মনে করে বল আলোটা কি ডান দিকে ছিল?
পরে সে বলল : হ্যাঁ, সে পাশে এসে পড়ে এবং গাড়ির জানালার কাছে চীৎকার করে ওঠে। হ্যাঁ, এখন মনে পড়ছে।
সামনে ঝুঁকে অন্যদিকে চেয়ে বসে ছিল দুই হাঁটুর মাঝখানে হাত দুটো।
ঠিক বলছ?
হ্যাঁ, ঠিক বলছি।
কিন্তু, একটু আগেই অন্যরকম বলছিলে।
এখন ঠিক বলছি।
তুমি ঠিক বলছ না, লুসিলি। সামনের দিকের হেডল্যাম্পটা খুঁড়িয়ে গিয়েছিল। সে নিশ্চয়ই তোমার সামনে ছিল। সে হঠাৎ পিছন দিক থেকে তোমার ডানদিকে আসেনি। তাহলে সে ইচ্ছে করেই অ্যাকসিডেন্ট করতে চেয়েছিল।
তার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে শক্ত হয়ে গেল, তুমি যদি সব জান তবে জিজ্ঞাসা করছ কেন? সে কোন্ পাশে ছিল আমার মনে নেই।
যেভাবেই হোক তুমি তাকে আঘাত করেছিলে। শব্দ শোনার পর কি হয়েছিল?
আমি গাড়ি চালাতে লাগলাম।
খুব জোরে ধাক্কা লেগেছিল?
হ্যাঁ।
তাকে ধাক্কা দিয়েছিলে তুমি নিশ্চিত?
হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত।
তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছিল তুমি দাঁড়িয়ে তাকে না দেখে আরও জোরে গাড়ি চালিয়েছিলে?
তুমি কি প্রশ্ন করেই চলবে? কি ঘটেছিল আমি তো তোমাকে বলেছি।
আমার পরিষ্কার ভাবে জানা দরকার। তুমি বড় রাস্তায় এসে কি করলে?
বুঝতে পারলাম না লোকটার মোটর সাইকেলটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে তোমার গাড়িটাও, ভীষণ ভয় পেলাম। ভাবলাম তোমাকে সব বলব। পুলিশ দেখলে অবশ্য ফিরে আসার ইচ্ছা ছিল না।
একটা সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কোথায় থাকি কি করে জানলে?
সে টেনে টেনে যেন ভাববার সময় নিচ্ছে, আমি–আমি টেলিফোন গাইড থেকে জেনেছি। আমি–আমি একবার সাইকেলে যাবার সময় তোমার বাড়ির পাশ দিয়ে গিয়েছিলাম। তাই জানতাম তুমি কোথায় থাক।
সে সত্যি বলছে না দেখে অস্বস্তি বোধ করলাম।
এখানে আসতে তোমাকে দেড় মাইল পথ পার হতে হয়েছে। আসার সময় তুমি রাস্তায় আর কোন গাড়ি দেখেছ?
মনে হচ্ছে না।
তোমার মনে পড়া উচিত। যতই হোক এটা একটা বড় রাস্তা। তখন সাড়ে দশটা, নিশ্চয়ই। অনেক গাড়ি ঐ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল?
আমার চোখে পড়েনি।
আমার মনে হয় অন্ততঃ একটা গাড়ির পাশ দিয়ে এসেছিলে, লুসিলি।
গলা সপ্তমে সে বলল, যদি তাই হয় তাতে কি এসে যায়?
তুমি গাড়ির একটা আলো নিয়েই চালাচ্ছিলে যে কোন গাড়ির চালক তোমাকে দেখে ভেবে থাকবে যে তুমি মোটর সাইকেল চালাচ্ছিলে, কাছে এসে দেখে যে মোটর গাড়ি চালাচ্ছ। সে সেটা মনে রাখবে, তবে সে পুলিশকে জানাতে পারবে তুমি কোনদিকে গাড়ি চালাচ্ছিলে। তুমি শহর থেকে যাচ্ছিলে না। তোমাকে যদি দেখে থাকে তবে পুলিশ বুঝতে পারবে গাড়িটা কোথায় খুঁজতে হবে। তারা বুঝতে পারবে সারা শহর খোঁজার বদলে প্রথমে খোঁজ দরকার সমুদ্রের আশেপাশে মানে এখানে।
আমি এসব ভেবে দেখিনি।
এই জন্যেই আমি এসব জানতে চাইছি। ভয়ানক জরুরী, তুমি কি একটু মন দিয়ে শুনবে? তুমি একটু মনে করার চেষ্টা কর ফিরে আসার সময় কোন গাড়ি দেখেছিলে।
সে অসহায় ভাবে, মনে করতে পারছি না। তখন শুধু ভাবছিলাম কি করে তোমার বাড়ি পৌঁছাব।
ভাবলাম অবস্থা খুব খারাপ দাঁড়িয়েছে। বড় রাস্তায় অনেক গাড়িই সে দেখেছে। সে যে একটা হেডল্যাম্প নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল তা কেউ না কেউ নিশ্চয়ই দেখেছে। লোকটি পুলিশের কাছে রিপোর্ট করবে আর পুলিশ এই অঞ্চলে গাড়ির খোঁজ করবে।
ঠিক আছে, অনেক হয়েছে, তুমি বরং বাড়ি যাও। এ ব্যাপারে তোমার আর কিছুই করার নেই। বরং ব্যাপারটা আমার ওপরেই ছেড়ে দাও।
কিন্তু তুমি কি করতে চাও, চেস?
এখনই ঠিক বলতে পারছি না। যদি ঘটনাটা খারাপের দিকে যায় তোমাকে জানাব। আপাততঃ এইটুকুই বলতে পারি।
তার মুখ গম্ভীর, তোমার গাড়িটা নিয়ে কি করবে?
এ সম্বন্ধে ভাবতে হবে।
আর যে লোকটা ফোন করেছিল?
আবার সে ফোনের অপেক্ষা করতে হবে। যদি তোমাকে ফোন করে তবে আমাকে জানাবে।
কিন্তু ধর, যদি টাকা চায়?
যদি সে টাকা চায় বলে দিও, আমার সঙ্গে তোমার আগে কথা বলতে হবে।
আমি কি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেব?
না। টাকা চাইলে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলবে। আমিই তার সঙ্গে মোকাবিলা করব। মনে হচ্ছে তুমি টাকা দেওয়ার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী।
না, মোটেই নয়। আমি শুধু জানতে চাইছিলাম। আমি জানি সে ব্ল্যাকমেল করতে চায়। আমার কোন টাকা নেই। তুমিই বা কেমন করে জানবে যে কোন লোকটা তোমাকে ব্ল্যাকমেল করতে চায় এবং তুমিও টাকা দিতে পারছ না। ফলে সমস্ত ঘটনাটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটাই বা তোমার কেমন লাগবে?
ভগবানের দোহাই। সে এখনও তোমার কাছে কিছু চায়নি, চাইলে আমাকে জানাবে আমিই ব্যবস্থা করে নেব। এখন বাড়ি যাও। আমাকে ভাবতে দাও।
সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তাহলে এখন আমাকে শুধুই অপেক্ষা করতে হবে?
আজ রাত দশটায় আমাকে ফোন করবে। হয়ত কিছু বলতে পারব।
হঠাৎ লুসিলি দুহাতে আমাকে জোরে আঁকড়ে ধরেছিল, সে ফিসফিসিয়ে আমার গলা জড়িয়ে বলল, চেস…আমি ভয় পেয়েছি। তুমি আমাকে সামলাবে। সব কিছু কি ঠিক করে দেবে?
তাকে দুহাতে সরিয়ে দিয়ে জানালার কাছে এসে যেন, ধাতস্থ হলাম। তার ঠোঁটের স্পর্শ আমাকে উত্তেজিত করে তুলল।
তোমার উপর নির্ভর করে রইলাম, চেস। আজ রাতে ফোন করব।
তাই করো।
তার চলে যাওয়ার শব্দ শুনলাম। নিজেকে সংযত করে জানালার বাইরে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
.
০২.
এগারোটা বাজতে কুড়ি, একটা ইজিচেয়ারে বসে ভাবছিলাম…
সমস্ত ব্যাপারটা গোলমেলে। কোন সন্দেহ নেই যে লুসিলি একজন পুলিশের লোককে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলেছে। কিন্তু যেভাবে সে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছে সাক্ষ্য প্রমাণ অনুযায়ী যা ঘটা সম্ভব মনে হচ্ছে, পারস্পরিক মিল নেই। যে কারণেই তোক লুসিলি আমাকে মিথ্যা বলেছে। কেন সে বারবার বলছে যে ও’ব্রায়ান তাকে উল্টো দিকে ওভারটেক করার চেষ্টা করেছিল। তাকে বিশ্বাস করা যায় না। সে এতই ভয় পেয়েছে যে উপস্থিত বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে এবং ফাঁদে পড়া জন্তুর মত রেহাই পাবার চেষ্টা করছে।
বড় রাস্তায় নিশ্চয়ই তাকে কেউ দেখেছে এবং আমার ধারণা পুলিশ এখন গাড়িটার অনুসন্ধানে এই অঞ্চলেই মনোযোগ দিয়েছে।
ক্যাডিলাকের চাকায় রক্তের দাগ লেগে আছে মনে পড়তেই আমার শরীর দিয়ে ঘাম ছুটতে লাগল। যদি পুলিশ রক্তের দাগ দেখে তাহলে সত্যিই আমি ফেঁসে যাব।
বাংলোতে তালা লাগিয়ে গ্যারেজে গেলাম এবং একটা বালতি ও কিছু স্পঞ্জ জোগাড় করলাম। টুকিটাকি যন্ত্রপাতি রাখার জায়গায় একটা শক্ত তালা আর কড়া দেখতে পেলাম। তারপর পন্টিয়াকটা নিয়ে সিবোর্নের বাড়ির দিকে ছুটলাম।
দিনের আলোয় দেখলাম ক্যাডিলাকটার কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। হেডল্যাম্পটা সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে গেছে এবং তার চারপাশের ধাতব অংশটা এমন ভাবে বেঁকেছে যে মিস্ত্রী ছাড়া তাকে মেরামত করা সম্ভব নয়।
গাড়ির চারপাশটা ঘুরে দেখে চমকে উঠলাম রক্তের কোন দাগ নেই। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দু পাশের চাকাই খুঁটিয়ে দেখলাম। ডান পাশের পিছনের চাকাটায় একটু রক্তের দাগ দেখলাম।
পুরো দশ সেকেন্ড সেখানে হাঁটু গেড়ে বসে চাকার সাদা বেড়টায় রক্তের থকথকে দাগটা দেখতে দেখতে অনেক সন্দেহ এল মনে।
উঠে সামনের হেডল্যাম্পের দিকে এসে বুঝলাম ব্যাপারটা অন্যরকম। লোকটা হঠাৎ লুসিলির পিছনে আসে এবং সে চমকে উঠে ও গাড়ির পিছনে তাকে ধাক্কা লাগে লুসিলির এই কাহিনী সম্ভবতঃ সত্যি নয়। এটা আগে কেন বুঝিনি যে হেডল্যাম্পটা সে ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হলে ধাক্কাটা সামনের দিকে লাগাই স্বাভাবিক এবং এর অর্থ হচ্ছে অ্যাকসিডেন্ট যখন ঘটে তখন পুলিশের লোকটি তাকে ওভারটেক করছিল না। সে নিশ্চয়ই বিপরীত দিক থেকে এগিয়ে আসছিল। এর মানে আমি তার আরও একটি মিথ্যা ধরে ফেললাম এবং এটা অনেক গুরুতর মিথ্যা। সে বলেছিল যে সে পুলিশের লোক দেখেনি, তাকে চীৎকার করতে শুনেছিল এবং সে চমকে গাড়ি বেকায়দায় চালিয়ে দেয় তাতেই অ্যাকসিডেন্ট ঘটে। কিন্তু অ্যাকসিডেন্ট সে ভাবে ঘটেনি। গাড়িটা যখন নিচের দিকে নেমে আসছিল তখন লুসিলি নিশ্চয়ই লোকটার গাড়ির আলো দেখতে পেয়েছিল। লুসিলি স্বীকার করেছিল যে সে জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল। রাস্তা ছিল সংকীর্ণ। লুসিলি গাড়ির উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং লোকটা রাস্তা পেরিয়ে যাবার আগেই লুসিলি তাকে সোজাসুজি ধাক্কা দেয়। লোকটা তার পাশে এসে পড়ে এবং লুসিলিকে চমকে দেয়–এই কথাগুলো লুসিলির তৈরী করা। আমাকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছিল যে, তার দোষ নয়।
গাড়িটা পরীক্ষা করার পর কোন জুরি তার কথা বিশ্বাস করবে না। মনে পড়ল, তার দোষ নিজের ঘাড়ে নেবার প্রতিশ্রুতির কথা। যদি স্বীকার করতাম যে অ্যাকসিডেন্টের সময় আমিই গাড়ি চালাচ্ছিলাম, তাহলে যে কোন জুরিই বলত যে আমি মাতাল অবস্থায় এরকম অ্যাকসিডেন্ট করেছি। রাস্তাটা একদম সোজা চলে গেছে। এগিয়ে আসা আলোটা না দেখার কথা নয়। আমার গলাটা শুকিয়ে এল যখন বুঝলাম এরকম একটা ব্যাপারে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি। তারপর, গাড়ির ডান দিকের পিছনের চাকায় রক্তের দাগ। কিন্তু কি করে এ দাগ সেখানে হতে পারে? লুসিলি মোটর সাইকেলটাকে সামনের দিকে আঘাত করেছিল। পিছনের চাকাসুদ্ধ গাড়িটা পুলিশের লোকটার উপর দিয়ে সম্পূর্ণ চালিয়ে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
টায়ারের গায়ে বিশ্রী চটচটে লাল দাগটা আবার পরীক্ষা করে দেখলাম সত্যিই রক্ত।
ঠিক করলাম রক্তের দাগটা রেখে দেব। কেসটা যদি কোন চতুর আইনজ্ঞের হাতে পড়ে তাহলে দাগ কেননষ্ট করা হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ হতে পারে। প্রমাণটা নষ্ট করলে নিজের বিপদ ডেকে আনব।
গ্যারেজের দরজাটা লক্ষ্য করলাম। যে সব যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছিলাম তা দিয়ে তালাটা সোজা করলাম।
দরজাটা ঠিক করে বন্ধ করলাম। তারপর আলতারাপটা ভ্রু দিয়ে আটকে তালাটা লাগালাম। এবার নিশ্চিত হলাম পুলিশ তালা ভেঙে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করবে না। তারা প্রথমে সিবোর্নের খোঁজ করবে, চাবিটা চাইবে। তাতে আমি কিছুটা সময় পাব।
সমুদ্রের ধারে যেখানে আমি ও লুসিলি সাঁতার কেটেছিলাম দিনের আলোয় ভালভাবে পরীক্ষার জন্য সেখানে যেতে মনস্থ করলাম। পন্টিয়াকটার কাছে এলাম।
তখন বারটার কিছু বেশি। রাস্তায় সপ্তাহের শেষের ভ্রমণকারীদের মোটর গাড়ির ভিড়। সমুদ্রের ধারে যাবার নোংরা রাস্তাটায় আসতেই কুড়ি মিনিট সময় লাগলো।
দুই পাশের বালির গাদার সংকীর্ণ ঢালু রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে সতর্কভাবে দেখছিলাম।
তখন, আবার মনে হল, অদ্ভুত কাণ্ড, ও’ব্রায়ান কেমন করে এই রাস্তায় আসতে পারে। রাস্তার দুপাশে কোথাও কোন বড় গাছ কিংবা ঝোঁপ নেই, যার পিছনে সে লুকিয়ে থাকতে পারে।
ডানদিকে একটা বালির ঢিবি দেখতে পেলাম। মাটির বেশ খানিকটা অংশ থেতলিয়ে সমতল করে দেওয়া হয়েছে। এটাই কি তবে দুর্ঘটনার স্থান। গাড়ি থামিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে প্রায় দু মাইল পর্যন্ত সমুদ্র ও সমুদ্রতট দেখা যায়। ছোটখাট কয়েকটা বালির ঢিবি ছাড়া সব সমতল। দূরে পামগাছের যে সারি যার নীচে আমি ও লুসিলি বসেছিলাম। এ ছাড়া কোথায়ও কোন আড়াল ছিল না।
চারপাশের পরিবেশে আর কোন কিছুই দেখতে পেলাম না, পন্টিয়াকে ফিরে এলাম। সমুদ্রতটের দিকে এগিয়ে গেলাম। যেখানে গতকাল গাড়ি থমিয়েছিলাম তার কুড়ি গজের মধ্যে এসে থামালাম।
প্রথমে দেখলাম বালির উপর ক্যাডিলাকের টায়ারের ছাপ, ভয় পেলাম। আরও দেখলাম পামগাছগুলোর দিকে এগিয়ে যাওয়া আমার ও লুসিলির পায়ের ছাপ। এই জিনিসটা আগে আমার মাথায় আসেনি। যদি পুলিশ এখানে এসে থাকে, অথবা যদি আমাদের পায়ের ছাপ দেখে ফেলে।
যে লোকটা আমাদের ফোন করেছিল এবং সমুদ্রের ধারে আমাদের লক্ষ্য করেছিল তার পায়ের ছাপও নিশ্চয়ই থাকবে।
প্রায় তিনশ গজ পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে তার পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম না।
এ থেকে দুটো জিনিস পরিস্কার হল : পুলিশ এখানে আসেনি সুতরাং ক্যাডিলাকের টায়ারের ছাপ তারা দেখেনি। আর যে লোকটা ফোন করেছিল সেও ঘটনাস্থলে ছিল না। ব্যাপারটা আমার কাছে আরও ধোঁয়াটে মনে হল। যদি লোকটা সেখানে এসে থাকে। তবে আমাকে ও লুসিলিকে একসঙ্গে সাঁতার কাটতে ও তারপরে ঝগড়া করতে কি করে দেখল? সে নিশ্চয়ই কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে শক্তিশালী বাইনাকুলারের সাহায্যে দেখেছিল। সেই জন্যেই লুসিলি তাকে দেখতে পায়নি।
বালির ওপরের টায়ারের দাগ মুছতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো। তারপর পামগাছগুলোর কাছে এসে সাবধানে গতরাতের পায়ের ছাপগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে আবার রাস্তা ধরে ফিরে গেলাম যাতে আমার ও লুসিলির পায়ের ছাপগুলো মুছে যায়। এইভাবে আরও একবার রাস্তায় এসে উপস্থিত হলাম।
কাজ শেষ করে মনে একটা নিরাপত্তার ভাব এল যে পুলিশ যদি সমুদ্রের ধার পর্যন্ত অনুসন্ধান করতে আসে তাহলে আর পায়ের ছাপগুলো দেখতে পাবে না।
অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করে পন্টিয়াকে ফিরে এলাম। গাড়ির দরজা খুলছিলাম তখন একটা গাড়ির এগিয়ে আসার শব্দ শুনতে পেলাম এবং চারপাশে তাকিয়ে, একটা লাল হলুদ রং এর গাড়িকে রাস্তার মোড় ঘুরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম।
ধক্ করে উঠল হৃদপিণ্ডটা ভাবলাম যে গাড়িটা যদি আর তিন মিনিট আগে আসত তবে আমাকে ছাপগুলো মুছতে দেখতে পেত।
শখানেক গজ দূর থেকে দেখলাম গাড়িটার চালক একজন মহিলা। দশ গজ মত দুরে গাড়িটা থামল। আমার দিকে দেখে গাড়ি থেকে নেমে এল।
তার পরনে লাল পোশাক, মাথায় ছোট সাদা টুপি এবং হাতে সাদা নেটের দস্তানা। বেশ দোহারা চেহারা, গায়ের রং কালো। মুখটা ফ্লোরিডায় সমুদ্রের ধারে সর্বদা দেখতে পাওয়া যায় ল্যাটিন আমেরিককান মেয়েদের মত, যারা দর্শনাকাঙ্ক্ষীদের প্রয়োজন মত নিজেদের ভোগ্যপণ্যের মত দেখিয়ে বেড়ায়।
সে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে তার নাইলন ঢাকা সুন্দর পা দুটো দেখা গেল, ভারী নিতম্বের উপরের পোশাকটায় হাত বুলিয়ে সে তার কালো কৌতূহলী চোখে আমার দিকে চাইল।
এই জায়গাতেই কি পুলিশের লোকটি মারা পড়েছিল?
আশ্চর্য হচ্ছিলাম মেয়েটি কে। আর এখানে কি করতে এসেছে। বললাম। মনে হয় আরও উপরের দিকের রাস্তায় ঘটেছিল। বরং বলব আপনি আসল জায়গাটা ফেলে এসেছেন।
ও কাছে এসে বলল। আপনার মনে হয়। আরও পিছনে ওপর দিকের রাস্তায়?
কাগজে বলেছে, সে রাস্তার উপরে মারা গিয়েছিল।
সে একটা সিগারেট বার করে তার লাল ঠোঁটে চেপে আমার দিকে তাকাল।
আমার লাইটারটা বার করে ধরালাম সে যখন সিগারেটের প্রান্তটা ধরাতে এগিয়ে এল তখন তার চুলের গন্ধ পেলাম।
ধন্যবাদ।
সে আমার দিকে সোজা তাকাতে আমি তার কড়া মেকআপ করা মুখ আর মুখের উপর সরু গোঁফের রেখা দেখতে পেলাম যা ল্যাটিন আমেরিককান মেয়েদের বৈশিষ্ট্য।
আপনি কি সংবাদপত্রের লোক? সে বলল।
সংবাদপত্রের লোক? না তো। আমি এখানে এমনি এসেছিলাম। সাঁতার কাটতে।
সে মাথা ঘুরিয়ে বালির জায়গাটার দিকে চাইল। লুসিলি ও আমার পায়ের ছাপ মুছে ফেলার সময় গর্তের মত যে ছাপ পড়েছিল সেদিকে চাইল।
আপনি কি এই ছাপগুলো করেছেন?
বালির উপরের ছাপগুলোর কথা বলছে? যখন এখানে আসি তখনও দাগগুলো ওখানে ছিল।
দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন পায়ের ছাপ মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে।
আপনার তাই মনে হচ্ছে? বাতাসেও হতে পারে। বাতাসেও বালির উপর অদ্ভুত দাগ হয়।
হয় নাকি? উপরের রাস্তায় এখান থেকে মাইল দুয়েক দূরে একটা জায়গায় দেখলাম, মাটিটা যেন তেলিয়ে গেছে। ওখানেই কি লোকটা মারা গিয়েছিল?
হতে পারে। আমি ঠিক জানি না।
কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করছি, তা নয়। তার সঙ্গে আমার বিয়ে হত।
মনে পড়ল কোন একটা কাগজে দেখেছিলাম যে ও’ব্রায়ান একজন নাইট ক্লাবের গায়িকাকে বিয়ে করছে।
হ্যাঁ। আজ সকালেই কাগজে দেখলাম যে আপনি তাকে বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন।
সে হাসল। হাসিটা ঠাণ্ডা, তিক্ত হাসি। পড়েছেন? মনে হয় না কাগজে পড়ার আগে আপনি কোনদিন আমার নাম শুনেছিলেন। দশ বছর ধরে আমি এই কাজ করছি। এটা মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক নয় যে, প্রথম নাম প্রচারের সুযোগ পেলাম তখনই, যখন যে লোক আমাকে বিয়ে করবে বলে স্থির করেছিল। সে নিজেকে মেরে ফেলল, কারণ সে এতই বোকা ছিল যে এর চেয়ে ভাল কিছু করতে সে জানত না।
সে হঠাৎ পিছন ফিরে ওন্ডস মোবাইল গাড়ির দিকে ফিরে গেল। আমি সেখানেই তার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
সে গাড়িতে বসে উল্টো দিকে গাড়ি চালাল। আমার দিকে একবারও না তাকিয়ে বালি ও ধুলোর ঝড়ের মধ্যে জোরে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে গেল।