০৬. টুনটুনি তার ম্যাকিনটস কম্পিউটারের সামনে

টুনটুনি তার ম্যাকিনটস কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। সে খুব অবাক হয়ে কম্পিউটারের পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে। পর্দায় অরণ্যর ছবি। স্ক্র্যাপ বুক বানানোর জন্যে সে ডিজিটাল ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলি কম্পিউটারে ঢুকিয়েছে। আগে তোলা ছবি এবং পরে তোলা ছবি পাশাপাশি দেখে তার খুবই অবাক লাগছে। প্রথমদিকে তোলা ছবিগুলির সঙ্গে শেষের দিকে তোলা ছবির বড় অমিল আছে। চোখের মণির রঙে অমিল। প্রথম যে ছবিগুলি তোলা হয়েছিল সেখানে চোখের মণির রঙ কালো। এখনকার ছবিতে হালকা নীল।

মানুষের চোখের মণির রঙ কি পাল্টাতে পারে? অসম্ভব। মানুষ গিরগিটি না যে রঙ পাল্টাবে। তাহলে কি ডিজিটাল ক্যামেরায় কোনো গণ্ডগোল হয়েছে? সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কারণ টুনটুনির মনে আছে সে খালি চোখে দেখেছে। অরণ্যের চোখের রঙ হালকা নীল।

যদি দেখা যায় যে মানুষটা ইচ্ছামতে চোখের মণির রঙ পাল্টাতে পারে তাহলে মন্দ হয় না। টুনটুনির ইচ্ছা করছে অরণ্যকে জিজ্ঞেস করতে। সেটা সম্ভব না, কারণ টুনটুনির বাবা অরণ্যকে লোক দিয়ে সাভার পাঠিয়ে দিয়েছেন। কেন পাঠিয়েছেন বলেন নি। জিজ্ঞেস করার পরেও বলেন নি। শুধু বাবাকে খুব চিন্তিত মনে হয়েছে। তিনি অরণ্যকে নিয়েই চিন্তিত এটা বোঝা যাচ্ছে। কারণ তিনি টুনটুনিকে ডেকে বলেছেন, তুমি যখন-তখন খলিলুল্লাহর ঘরে যাবে না।

টুনটুনি বলেছে কেন যাব না?

আমি নিষেধ করছি সেই জন্যে যাবে না।

তুমি নিষেধ করছ কেন?

নিষেধ করছি কারণ তুমি একটি অল্পবয়েসী মেয়ে। হুটহাট করে একটা যুবক ছেলের ঘরে কেন ঢুকবে?

বাবা অরণ্য কিন্তু আমাকে মা ডাকে।

সে তোমাকে মা ডাকুক, খালা ডাকুক, দাদি ডাকুক কিছু আসে যায় না। আমি তোমাকে যেতে নিষেধ করছি, তুমি যাবে না।

রেগে যাচ্ছ কেন বাবা?

রেগে যাচ্ছি না। আমার যা বলার আমি সহজভাবেই বলছি।

তুমি মোটেই সহজভাবে কিছু বলছ না। তোমার গলার স্বর নিচু, এটা ঠিক আছে। কিন্তু রাগে তোমার হাত-পা কাঁপছে। তোমার চোখ লাল হয়ে আছে। আমার ধারণা তুমি অসুস্থ। তুমি কি দয়া করে একজন ডাক্তার দেখাবে?

মাহতাব সাহেব জবাব দেন নি। তিনি মেয়ের সামনে থেকে সরে গিয়েছেন। তার কিছুক্ষণ পরই ডাক্তার আসতে দেখে টুনটুনি ভাবল বাবা তার নিজের জন্যে ডাক্তার এনেছেন। দেখা গেল ঘটনা তা না। ডাক্তার অরণ্যের জন্য এসেছে। ব্লাড প্রেসার মাপছে, রক্ত নিচ্ছে। নানান ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে।

টুনটুনি নিশ্চিত তার বাবা অরণ্যকে নিয়ে খুবই চিন্তিত। টুনটুনি চিন্তিত হবার মতো কিছু দেখছে না। মানুষটা রহস্যময় এবং বিস্ময়কর। কিন্তু চিন্তিত হবার মতো না। মানুষ চিন্তিত হবে হিংস্ৰ জন্তু দেখে। দুষ্ট মানুষ দেখে। অরণ্য হিংস্ৰ জন্তু না। দুষ্ট মানুষও না।

টুনটুনি অরণ্যের ছবির প্রিন্ট আউট দিয়েছে। কালার প্রিন্টার থেকে ছবি প্রিন্ট হচ্ছে। কী সুন্দর ছবি!

 

মাহতাব উদ্দিন তাঁর সাভারের বাগানবাড়ির পুকুর পাড়ে বসে আছেন। তাঁর পাশে জালাল খাঁ বসে আছে। পুকুর পাড়ে দ্বিতীয় কোনো প্রাণী নেই। মাহতাব উদ্দিন কঠিন নিষেধ জারি করেছেন পুকুর পাড়ে যেন কেউ না আসে। পুকুরে খলিলুল্লাহকে নামানো হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ হলো সে ডুব দিয়েছে। এখনো ভাসে নি। মাহতাব উদ্দিন বললেন, জালাল দেখ তো কতক্ষণ পার হয়েছে।

জালাল খাঁ বললেন, সতেরো মিনিট।

সতেরো মিনিট একটা মানুষ ডুব দিয়ে আছে। পানিতে নামানোর সময় একটা হাফপ্যান্ট পরে নেমেছে। এখনো ভেসে ওঠে নি। তোর কাছে কি কোন ব্যাখ্যা আছে?

না।

কোনো ব্যাখ্যা নেই?

না।

কোনো মানুষের পক্ষে কি এই কাজটা করা সম্ভব?

জালাল খাঁ গম্ভীর গলায় বললেন, মানুষের ক্ষমতা সীমাহীন। তার পক্ষে অনেক কিছুই সম্ভব, কিন্তু অক্সিজেন ছাড়া বাচা সম্ভব না।

মাহতাব উদ্দিন বললেন, লোকটা অক্সিজেন ছাড়া বেঁচে আছে?

জালাল খাঁ বললেন, হ্যাঁ।

মাছ যেমন পানি থেকে অক্সিজেন নেয় সে কি এইভাবে নিচ্ছে না?

না।

কীভাবে বুঝলি না?

অক্সিজেন নিলে তাকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছাড়তে হতো। তা সে করছে না। যদি করত পানিতে বুদবুদ দেখা যেত। পানিতে বুদবুদ দেখছি না। আরেকটা সম্ভাবনা আছে।

কী সম্ভাবনা?

আমাদের অরণ্য যদি তার শারীরবৃত্তীয় সমস্ত কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখে তাহলে অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়বে না।

সেটা কি সম্ভব?

প্রাচীন মুনিঋষিরা করতে পারতেন বলে বইপত্রে পড়ি। যোগীসাধকরাও না-কি পারেন। তবে আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য না। তোমার এই স্পেসিমেন আর যাই হোক কোনো মুনিঋষি না, যোগীসাধকও না।

মাহতাব উদ্দিন বললেন, সে কে?

জালাল খাঁ বললেন, জানি না। আমি একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি।

কী হাইপোথিসিস?

এখনো তেমন কিছু দাঁড় করাতে পারি নি, ভাবছি। আমাদের এগোতে হবে লজিকের মাধ্যমে। প্রসেস অব এলিমিনেশন পদ্ধতিতে।

জালাল খাঁ সিগারেট ধরালেন। ঘড়ি দেখলেন। পঁচিশ মিনিট পার হয়েছে। মানুষটা এখনো পানিতে ডুব দিয়ে আছে। মাহতাব উদ্দিন বললেন, প্রসেস অব এলিমিনেশনটা কী?

জালাল খাঁ বললেন, প্রথমে আমাদেরকে সিদ্ধান্তে আসতে হবে অরণ্য নামের জিনিসটি মানুষ না অন্য কিছু। যদি মানুষ হয় তাহলে এক ধরনের যুক্তি আর যদি অন্য কিছু হয় তাহলে অন্য ধরনের যুক্তি।

মাহতাব উদ্দিন বললেন, অন্য কিছুটা কী হতে পারে?

রোবট হতে পারে।

রোবট?

হ্যাঁ, রোবট। দেখতে মানুষের মতো। কথাবার্তা মানুষের মতো। যেহেতু রোবট, তার অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ছে না। সে পানির নিচে যতক্ষণ ইচ্ছা থাকতে পারবে।

তোর ধারণা সে রোবট?

আমার কোনো ধারণা নেই। প্রসেস অব এলিমিনেশনের ভেতর দিয়ে যেতে হলে প্রথমে তাকে রোবট ভাবতে হবে। তারপর যুক্তি দিয়ে দেখাতে হবে সে রোবট না। তখন রোবট ক্যাটাগরি বাদ পড়বে।

মাহতাব উদ্দিন ছোন্ত নিশ্বাস ফেলে বললেন, সে রোবট না। তার ব্লাড টেস্ট করা হয়েছে। ব্লাডের গ্রুপ 0 পজেটিভ। ইউরিন, স্টুল সব একজামিন করা হয়েছে, ইসিজি করা হয়েছে, প্রেশার মাপা হয়েছে, এক্স-রে নেয়া হয়েছে। সব কিছুই সাধারণ মানুষের মতো, শুধু হার্ট সামান্য এনলার্জড।

জালাল খাঁ বললেন, তাহলে তাকে বরং মানুষ হিসেবে ধরে নিয়ে এগোতে থাকি। ধরা যাক সে মানুষ, তবে অস্বাভাবিক ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ। Homo superior.

মাহতাব উদ্দিন বললেন, Homo superior ব্যাপারটা কী? তুই আগেও একবার বলেছিস।

জালাল খাঁ বললেন, জন বেরেসফোর্ড নামের একজন লেখক The Hampdensire Wonder নামে একটা বই লিখেছিলেন। বইটা ১৯১১ সনে প্রকাশিত হয়েছিল। এই বই-এ তিনি Homo superior-এর কথা প্রথম বলেছেন। তার ধারণা পৃথিবীর বর্তমান মানবসম্প্রদায়ের পরিবর্তে নতুন মানবসম্প্রদায় চলে আসবে। তারা দেখতে মানুষের মতো হলেও তাদের থাকবে অস্বাভাবিক ক্ষমতা। এরাই পৃথিবী শাসন করবে। এরাই গ্রহ-নক্ষত্র জয় করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে।

এরা আসবে কোত্থেকে?

মিউটেশনের মাধ্যমে মানুষের ডিএনএ পরিবর্তিত হয়ে Homo superior তৈরি হবে। এরা হলো কার্টুনে দেখা কল্পনার Superman।

ডারউইনের বিবর্তনবাদ? বিবর্তিত হয়ে মানুষ এরকম হবে?

জালাল খাঁ বললেন, ডারউইনের বিবর্তনবাদের সমস্যা হচ্ছে এই থিওরি অতীতের বিবর্তনের ধারা বলতে পারে কিন্তু ভবিষ্যতে কী বিবর্তন হতে যাচ্ছে তা বলতে পারে না। মানুষের ডিএনএ-র পরিবর্তনটা কীভাবে হবে ডারউইনের থিওরি সেটা বলছে না। হঠাৎ করে একজন Homo superior তৈরি হবে না-কি পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় এদের দেখা যাবে তা কেউ বলতে পারছে না।

জালাল, তোর ধারণা খলিলুল্লাহ নামের মাটিকাটা কুলি একজন Homo superior?

হতে পারে। তার অস্বাভাবিক ক্ষমতা তো চোখের সামনে দেখছি। যন্ত্রপাতির উপর তার কী পরিমাণ দখল সেটাও দেখতে পাচ্ছি।

আমাদের এখন করণীয় কী?

আমাদের করণীয় একটাই–অরণ্যের সঙ্গে কথা বলা। তার সাহায্য নিয়েই বের করা সে কে? তার DNA-র সিকোয়েন্সগুলি কী তা জানা। যে পড়াশোনা জানে না তাকে পড়াশোনা শেখাননা। সে যদি Homo superior হয় তাহলে মানবসম্প্রদায়ের অর্জিত জ্ঞানের সবটুকু সে নিজের ভেতর অতি দ্রুত নিতে পারবে।

মাহতাব উদ্দিন বললেন, কতক্ষণ পার হয়েছে দেখ তো?

এক ঘণ্টা পনেরো মিনিট।

তাকে কি ডেকে তুলব না সে আরো কিছুক্ষণ পানিতে থাকবে?

জালাল খাঁ বললেন, থাকুক পানিতে। আমাকে তুই একটা কাগজ কলম দে। তাকে যে সব প্রশ্ন করব তা লিখে ফেলি। থাক কাগজ কলম লাগবে না। জালাল খাঁ পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছেন। মাহতাব উদ্দিনও তাকিয়ে আছেন। কেউ কোনো কথা বলছেন না। পুকুরের পানি শান্ত। সেখানে কোনো আলোড়ন নেই।