তবে জন্মেজয় কহে, শুন তপোধন।
তার পরে কি হইল, কহত এখন।।
মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
তার পর যা হইল, কহি বিবরণ।।
ব্যাস বলে, শুন এবে ধর্ম্মের নন্দন।
চিত্ত শান্ত করি শুন, ত্যজ শোক-মন।।
উত্তানপাদ রাজা সেই পূর্ব্বেতে আছিল।
ধ্রুবে রাজ্য দিয়া রাজা তপস্যায় গেল।।
সরয়ূর তীরে সেই বৈসে কুতূহলে।
মন্ত্র জপ করে সেই, পূজে ফল-ফুলে।।
ধ্যান করি মহারাজ, নিজ মন্ত্র জপে।
হরিপদে চিত্ত, মহাতেজ হৈল ভূপে।।
হেনকালে মৃগী এল জল খাইবারে।
আচম্বিতে সিংহনাদ হৈল তথাকারে।।
গর্ভবতী হরিণীর হৈল গর্ভপাত।
প্রসব করিয়া মৃগী হইল নিপাত।।
হরিণী মরিল যদি হরিণীর শিশু।
ধীরে ধীরে আসিলেক নৃপ পিছু পিছু।।
হরিণীর শিশু রাজা করিলেন কোলে।
তপস্যা ছাড়িয়া রাজা হরিণকে পালে।।
তপ জপ গেল রাজা পালে মৃগশিশু।
এইরূপে পালন করয়ে সেই পশু।।
নবীন নবীন দূর্ব্বা তাহারে ভুঞ্জায়।
হরিণীর সেই শিশু পিছে পিছে যায়।।
সদাই করেন রাজা হরিণে পালন।
রাজার হরিণ বিনা অন্যে নাহি মন।।
এইরূপে দিন যায়, শুন তার পর।
দূর বনে হরিণ চলিল অতঃপর।।
একদিন সিংহ তারে করিল ভক্ষণ।
দূরে থাকি মহারাজ দেখিল তখন।।
মৃগের মরণে রাজা বড় দুঃখ পেল।
হরিণ হরিণ করি শোকে রাজা মৈল।।
হরিণীর গর্ভে হৈল রাজার জনম।
যেই যাহা ভাবি মরে, হয় তার সম।।
হরিণ জনম যদি পাইল রাজন।
জাতিস্মর হৈল রাজা, শুনহ কারণ।।
তারপরে গেল রাজা যমুনার তীর।
জলপান করি শেষে ত্যজিল শরীর।।
পুনর্জ্জম হৈল তার ব্রাহ্মণের ঘরে।
জাতিস্মর হইল ভরত নাম ধরে।।
তার সাত ভাই পরে পরম যোগ্যতা।
সর্ব্বশাস্ত্রে বিশারদ জানে সর্ব্বকথা।।
ভরত সুস্থির বড় হরিপদে মন।
নাম তার হৈল জড়ভরত তখন।।
কোন কর্ম্ম নাহি করে, সদা হরি বলে।
হরিকথা বিনা মুখে অন্য না নিকলে।।
দেখি তার ভাই সব হইল দুঃখিত।
খাইতে না দেয় তারে, করয়ে উৎপাত।।
পোড়া অন্ন, ব্যঞ্জন সে খায় অবশেষ।
তাহা খেয়ে জপে হরি, নাহি দুঃখ লেশ।।
পোড়া অন্ন বিনা সেই ভাল নাহি পায়।
তাহা খেয়ে তুষ্ট হয়ে হরিগুণ গায়।।
সে বিপ্রের পাকা ধান্য ক্ষেতে সমুদায়।
শূকরে খাইয়া যায়, রক্ষা নাহি পায়।।
দেখিয়া সকল ভাই দুঃখিত হইল।
ধাণ্যের প্রহরী করি ভরতেরে দিল।।
ভরত ধান্যের রক্ষা করে এইমতে।
ধান্য রাখে নিরন্তর ফিরে চারিভিতে।।
দিবানিশি ফিরে সেই হরি হরি বলি।
নৃত্য করি ফিরে সেই দিয়া করতালি।।
দিবসে বায়স রাখে, রাত্রিতে শূকর।
এই মত ধান্য কৃষি রাখে নিরন্তর।।
আর দিন কহি কথা, শুনহ রাজন।
যেরূপে প্রকাশ হৈল দ্বিজের নন্দন।।
সুবাহু নামেতে রাজা রাজ্যের ঈশ্বর।
জ্ঞান শিখিবারে গেল কপিলের ঘর।।
দোলায় চড়িয়া রাজা চলে ততক্ষণ।
বাহক চলিতে নারে তার একজন।।
বেগার চাহিয়া ফিরে নৃপতির লোকে।
কেহই চলিতে নারে, পড়িল বিপাকে।।
পাইল ধান্যের ক্ষেত্রে জড়ভরতের।
হৃষ্ট পুষ্ট দেখিয়া ধরিয়া আনে তারে।।
ধরিয়া লইয়া গেল রাজার গোচর।
রাজা বলে, কার্য্য সিদ্ধ হইল আমার।।
বেগার দেখিয়া রাজা দোলায় চলিল।
দোলা কান্ধে কর তুমি, মহারাজ কৈল।।
শুনিয়া রাজার বাক্য উঠি শীঘ্রগতি।
দোলা কান্ধে করি তবে লইল সম্প্রতি।।
সাবধানে চলিলা ভরত মহাশয়।
পিপীলিকা পাছে পদাঘাতে নষ্ট হয়।।
সতর্কে ভরত যায়, প্রাণী পাছে মরে।
প্রাণী মৈলে হবে বাস নরক ভিতরে।।
টলমল করে দোলা, রাজা তারে বলে।
কিরূপে চালাও দোলা, যাই কি প্রকারে।।
তবে বলে, মহারাজ করি নিবেদন।
দোলা টলমল করে যাহার কারণ।।
দুল্যা বলে, এই জন চলিতে না পারে।
বেগার বহিছে, তাই টলমল করে।।
ফিরিয়া রাজন তারে করে নিরীক্ষণ।
হৃষ্টপুষ্ট বহে দোলা, না কহে বচন।।
ভাল করি বহ মোরে, কহে মহাশয়।
ভরত বলিল, রাজা কেবা কারে বয়।।
পৃথিবীই বহে পদ, পদ বহে জানু।
জানু বহে ঊরুদেশ, ঊরু বহে তনু।।
তনু বহে বক্ষঃস্থল, বক্ষ বহে গ্রীবা।
গ্রীবাই মস্তক বহে কারে বহে কেবা।।
তুমি ত দোলায় আছ, জান নৃপবর।
তোমাকে বহিব কেন, শুন নরেশ্বর।।
ইহা শুনি নরপতি বিস্মিত হইল।
দোলা হৈতে মহারাজ তখনি নামিল।।
রাজা বলে, তবে আমি যাব কোথাকারে।
কোন মহাশয় বিধি মিলাইল মোরে।।
তবে রাজা দণ্ডবৎ করে ভূমে পড়ি।
অনেক স্তবন করে দুই হাত যুড়ি।।
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি মহাশয়।
বহু পাপ কৈনু আমি, জানিনু নিশ্চয়।।
মোরে কৃপা করি যদি দেহ উপদেশ।
তোমার কৃপায় পাই পথের উদ্দেশ।।
ভরত ঠাকুর তবে তারে মন্ত্র দিল।
সেবক লইয়া রাজা দোলা চাপি গেল।।
তবে ত ভরত সেই এই মতে ফিরে।
কৃষ্ণ বিনা মুখে তার কিছু নাহি স্ফুরে।।
বীরবাহু নামে এক আছে মহারাজা।
সুবর্ণ-মন্দিরে করে অম্বিকার পূজা।।
এক সৎবৎসর রাজা মেরুয়াকে পোষে।
বৎসর অন্তর কাটে দেবীর উদ্দেশে।।
বৎসর হইল পূর্ণ, পূজার সময়।
পলাইয়া যায় সেই শুন ধর্ম্মরায়।।
দেবালয়ে কোটালের রক্ষী যত জন।
বিস্তর করিল সেই মেরুয়ার অন্বেষণ।।
সকল কোটাল ফিরে একত্র হইয়া।
পোষা মেরুয়া কোথা গেল পলাইয়া।।
এই মতে ফিরে তারা মেরুয়া চাহিয়া।
জড়ভরতের তারা পাইলেক গিয়া।।
তাহারে ধরিয়া আনে কোটালের গণ।
ভরতে লইয়া তারা করিল গমন।।
হৃষ্টপুষ্ট দেখি অতি শরীর-সুন্দর।
সুবর্ণ-সদৃশ রূপ অতি-মনোহর।।
দেখিয়া কোটাল তবে আনন্দিত মন।
তাহারে লইয়া দিল রাজার সদন।।
ভরতে দেখিয়া রাজা সন্তুষ্ট হইল।
দেবীপূজা দিতে রাজা উদযোগ করিল।।
নারীগণ আভরণে ভূষিত হইয়া।
দেবীপূজা দেখিবারে আইল চলিয়া।
বাল বৃদ্ধ যুবা আসে পূজা দেখিবারে।।
নানা বাদ্য ভেরী বাজে দেবীর মন্দিরে।
পুরোহিত দ্বিজগণ পূজে বিধিমতে।।
দধি দুগ্ধ চিনি মধু রম্ভা আর ঘৃতে।
নানা উপচার যত করি রাশি রাশি।।
অম্বিকা পূজয়ে রাজা দেবীপাশে বসি।।
তার পর রাজা বলি আনিয়া তখন।
ছাগ মেঘ মহিষাদি দিলেক রাজন।।
এইমত আর সব দিল বলিদান।
অবশেষে বলে রাজা নরবলি আন।।
নরবলি আনিবারে বলিল রাজন্।
ভরতেরে স্নান করাইল ততক্ষণ।।
দিব্য বস্ত্র পরাইল, দিল বনমালা।
চন্দনে ভূষিত করি অলঙ্কার দিলা।।
দেবগণ বলে, ধন্য রাজার জীবন।
হেন মহাজনে রাজা করিল পূজন।।
তবে ভরতেরে রাজা করিল পূজন।
তবে ভরতেরে রাজা উৎসর্গ করিল।।
বলি দিতে হস্তে খড়্গ নৃপতি লইল।
কাটিবারে উঠে রাজা হাতে খড়্গ ধরি।।
নরবলি দিতে রাজা হৈল ত্বরাত্বরি।
আর সব বলি কাটে খড়্গধারিগণ।।
নরবলি নিজ হস্তে কাটয়ে রাজন।
মনে মনে মহাদেবী ভাবয়ে তখন।।
মোর ভাগ্য ভরতের হৈল দরশন।
রাজা নাহি জানে এই হয় কোন জন।।
এতেক ভাবিয়া দেবী নিকলে তখন।
পাষাণ প্রতিমা হৈতে বাহির হইয়া।।
রাজার হাতের খড়্গ লইলা কাড়িয়া।
দেবল কোটাল আর রক্ষী যত জন।।
সবাকারে ধরি দেবী করিলা ভক্ষণ।
সবাকার রক্ত-মাংস করিলা ভোজন।।
দেখিয়া নৃপতি হৈল বিস্ময় বদন।
দেবীকে কহেন রাজা করি যোড় হাত।।
নিবেদন করি মাতা, করি প্রণিপাত।
জননি এই যে বলি হয় কোন্ জন।।
ইহার বৃত্তান্ত মাতা কহিবে এখন।
দেবী বলে, শুন রাজা আমার বচন।।
পরম বৈষ্ণব এই সাধু মহাজন।
ইহার দর্শনে হয় পাপের বিনাশ।।
দেহে যার সদা হরি করেন বিকাশ।
হেন জনে আন তুমি কাটিতে হেথায়।।
দোষ মাগি লহ রাজা পড়ি তার পায়।
তবে রাজা বলে জড়ভরতেরে দেখি।।
অপরাধ ক্ষম মোর, হই আমি সুখী।
আপনি পরম সাধু, হও মহামতি।।
কাটিতে নারিনু তোমা, রাখিলা পার্ব্বতী।
জড়ভরত বলে, রাজা শুনহ বচন।
সকলের সার হরি, না জান কারণ।।
কেবা কারে মারে ইথে কেবা কারে রাখে।
মারেন রাখেন হরি, আপনার সুখে।।
যাহারে মারেন হরি, রাখে কোন জন।
কৃষ্ণ বিনা ত্রিভুবনে নাহিক তারণ।।
তবে রাজা সিংহাসন দিয়া ভরতেরে।
কহিলেক বৈস সিংহাসনের উপরে।।
ভরত বলেন, রাজা মোর কথা শুন।
না বুঝহ রাজা তুমি, বলি পুনঃ পুনঃ।।
কি নিকৃষ্ট, কি উৎকৃষ্ট আর সিংহাসনে।
সমান জানিহ রাজা আমার জীবনে।।
এইরূপ কহিল অনেক নীতিকথা।
দীক্ষামন্ত্র রাজারে ভরত দিল তথা।।
রাজা শিষ্য হৈল তবে ভরতের স্থানে।
এই ত কহিনু জড়ভরত-কথনে।।
ইহার শ্রবণে লোক পায় দিব্য জ্ঞান।
পৃথিবীতে নাহি সুখ ইহার সমান।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম কহে, সদা শুনে পুণ্যবান।।