জ্ঞান ও জ্ঞানতত্ত্ব
আরণ্যক ও উপনিষদকে যে জ্ঞানকাণ্ড বলে অভিহিত করা হয়, তা যুক্তিযুক্ত; কারণ, ইতোপূর্বে জ্ঞানের প্রতি কখনো এত শ্ৰদ্ধা প্রকাশিত হয় নি। ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে জ্ঞান অর্জনের পুরস্কার সর্বতোভাবে ছিল পার্থিব–কেননা পার্থিব আনন্দের চিরায়িত, মহিমান্বিত, পরিবর্তিত প্ৰকাশই স্বৰ্গকল্পনার ভিত্তি; কিন্তু আরণ্যক পর্বে এর তাৎপর্য সম্পূর্ণ পরিবর্তিত। ব্রাহ্মণ সাহিত্যের লক্ষ্য ছিল, যজ্ঞানুষ্ঠানের নিগূঢ় রহস্যবাদী দুর্জেয় ব্যাখ্যা বা স্তোত্রসমূহের অতীন্দ্ৰিয় তাৎপৰ্যনিৰ্ণয়, কিন্তু আরণ্যকের উৎসাহ বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের নির্যাস ও মানবজীবনের আধ্যাত্মিক ও উম্ভবত্ত্বমূলক তাৎপৰ্য আবিষ্কারে। এই যুগে অন্য যে নুতন দিকে আগ্ৰহ দেখা গেল, তা হ’ল জ্ঞানতত্ত্ব। সময় জ্ঞানের নুতন নুতন ক্ষেত্ৰ উন্মোচিত ও প্রসারিত হচ্ছিল-জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত প্ৰাথমিক অনুমান-নির্ভর আলোচনা, ধাতুবিদ্যা ও স্বভাবত প্ৰাথমিক পর্যায়ের রসায়ণবিদ্যা, কিছু কিছু ভূতত্ত্ব, অস্থিসংস্থান বিদ্যা, শরীরবিদ্যা, মনস্তত্ব, ভাষাতাত্ত্বিক দর্শন (ব্যাকরণ ও নিরুক্তি), অধিকতর সুবিন্যস্ত ধর্মতত্ত্ব ও অনুষ্ঠান-বিদ্যা, সঙ্গীত এবং অন্যবিধ শিল্পকলা। সুতরাং জ্ঞানচর্চার মূল্য এযুগে সাধারণভাবে উন্নতমানের স্বীকৃতি লাভ করেছিল।
আরণ্যকের বহুস্থানে জ্ঞানের জন্য নবজাগ্ৰত তৃষ্ণা অভিব্যক্ত হয়েছে। এমন কিছু জ্ঞানের জন্য আগ্রহ তখন দেখা গেছে যেগুলির সঙ্গে ব্ৰাহ্মণ্য অনুষ্ঠান বা ঔপনিষদীয় অধ্যাত্মবিদ্যার কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন, প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের উপায় কিংবা প্রকৃতি ও জীবনের মর্মগত বাস্তবতার সন্ধান। আবার যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পর্কিত প্রাচীন জ্ঞান যেহেতু এযুগে অপৰ্যাপ্ত ও অতৃপ্তিকর বলে বিবেচিত হল, পরম সত্য অনুভবের আকাঙ্ক্ষা তাই বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে গেল-বস্তুজীবন থেকে অধ্যাত্মজীবনের তাৎপৰ্য সন্ধানের উত্তরণ প্ৰবলতর হল। ইন্দ্র, সরস্বতী ও অশ্মীদের উদ্দেশে মেধার জন্য প্রার্থনা আরণ্যকের এক নূতন বৈশিষ্ট্য। সম্ভবত, এর মধ্যে নিহিত রয়েছে, সে যুগে পুরোহিতদের বর্ধিতভাবে বুদ্ধি-আয়ত্ত সূক্ত অনুষ্ঠানবিদ্যা মুখস্থ করার কৌশল এবং উপলব্ধি বর্জিত জ্ঞানের অন্তঃসারশূন্যতার বিরুদ্ধে প্ৰতিবাদী মানসতা ।
সৃষ্টিতত্ত্ব ও হেতুসন্ধান সম্পর্কিত জ্ঞানের জন্য যে অন্বেষণ শুরু হয়েছিল, আরণ্যকে তা অব্যাহত থাকে। তবে, বিভিন্ন প্ৰত্নকথায় বিশ্বস্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা যেমন পরিবর্তিত হয়েছে, তেমনি সেগুলির উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি কোথাও এক নয়। কোথাও বলা হয়েছে, আত্মার আকাঙ্ক্ষায় সমস্ত কিছু সৃষ্টি হয়েছিল, কোথাও বা প্ৰজাতির সৃষ্টি-আকাঙ্ক্ষা, তার তপস্যা ও তৎপ্রসূত সৃষ্টি পরম্পরা বর্ণিত হয়েছে। কোথাও সৃষ্টির অব্যবহিত পরে প্রজাপতির ক্লান্তি ও ছন্দের সাহায্যে বর্ষাকাল পরে তীর পুনরুজ্জীবন বর্ণনা করা হয়েছে। কোনো উপাখ্যানে বলা হয়েছে যে, অসৎ বা নাস্তি থেকে সৃষ্টির উদ্ভব ঘটেছিল। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ সাহিত্যে সৃষ্টি যেখানে যজ্ঞসভূত, আরণ্যকে এই প্ৰথম সর্বতোভাবে নুতন সৃজনশীল উপাদােনরূপে কামনা জ্ঞান ও তপস’-এর উপর গুরুত্ব আরোপ করা হল। তপসী যজ্ঞের সম্পূর্ণ বিপরীত, কারণ তার দ্বারা যজ্ঞের মৌল বস্তুটি অর্থাৎ কর্ম প্রত্যাখ্যাত হয়; তীব্র ধ্যানের উপর আরণ্যকের নুতন তত্ত্বটি লক্ষ্যকে কেন্দ্রীভূত করেছে। দ্বিতীয় তাৎপৰ্যপূৰ্ণ বৈশিষ্ট্য হ’ল, স্ৰষ্টার সৃষ্টি করার আকাঙ্ক্ষা, আকাঙ্ক্ষাই এখন সৃজন-প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।
শরীরবিদ্যা চর্চার সূত্রপাত হওয়ায় মানুষ যেহেতু মৃত্যুর কারণ ও মরণোত্তর অবস্থান সম্পর্কে কৌতুহলী হয়ে উঠেছিল, তাই এই যুগের চিন্তায় প্রাণবায়ু বিশেষ প্ৰাধান্য রয়েছে। একটি জনপ্রিয় দেবকাহিনীতে বিভিন্ন ইন্দ্ৰিয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতার মধ্যে চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রাণের শ্রেষ্ঠত্ব ও অপরিহার্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ-সময় থেকে প্ৰাণের নূতন নূতন বিশেষণ আবিষ্কৃত হতে থাকে, যা পরম দেবতার সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। যুক্তিযুক্তভাবে পরবর্তী স্তরে প্রাণই স্রষ্টার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হ’ল (ঐতরেয় আরণ্যক ২ : ১ : ৭)। আরণ্যকের অধ্যাত্মবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে তাই প্ৰাণ, যজ্ঞানুষ্ঠান ও অধ্যাত্মভাবনার মধ্যবতী যোগসূত্ররূপে প্রতীকে মূল্য অর্জন করেছিল। কৌষীতকি ও পৈঙ্গ্য অনুযায়ী প্ৰাণ ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মীভূত।
বিমূর্তায়নের ক্রমবর্ধমান যে প্রবণতা বৈদিক যুগের শেষ পর্বে সুরু হয়েছিল, তা আরণ্যকে অধিকতর পরিস্ফুট। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে ‘শ্রদ্ধা ও কাল’-এর মতো বিমূর্ত ধারণার উদ্ভব; তৈত্তিরীয় আরণ্যকের সূচনায় ‘কাল’ সম্পর্কিত আলোচনা রয়েছে। সেখানে অত্যন্ত প্ৰবল অধ্যাত্মবাদী ধারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অবিভাজ্য মহাকালকে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতালব্ধ সময় থেকে পৃথকরূপে দেখা হয়েছে ও সমুদ্র ও নদীর তুলনা করা হয়েছে। মানবজীবনের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে অনুরূপ পার্থক্য প্ৰদৰ্শন প্রসঙ্গে দেহ ও মনের দ্বৈততা আলোচিত হয়েছে। দেহের নশ্বরতার সঙ্গে সঙ্গে আত্মার অমরতার দ্যোতনাও এখানে পাওয়া যায়। শাখায়ন আরণ্যক প্রাচীনতর। ঐতিহ্যের উল্লেখ করে অতিজাগতিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক উপাদানসমূহের মধ্যে প্রায়-যৌন সম্পর্কের অবস্থা কল্পনা করেছে। সমস্ত কিছুর মধ্যে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের তৃষ্ণা অভিব্যক্ত। তবে, নুতন প্রবণতার মধ্যে দেহ ও আত্মার দ্বৈতবোধ সম্পর্কে সচেতনতা নিয়ত উপস্থিত; দৈহিক ক্রিয়া ও তথ্যকে সতর্কভাবে মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্তর থেকে পৃথক করে নেওয়া হয়েছে। অবশ্য এই নবজাগ্ৰত অধ্যাত্মবাদী চিন্তা কখনো কখনো তৎকালীন লোকায়ত কুসংস্কারের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। তাই, আন্তরিকভাবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পর্যবেক্ষণ শুরু করেও বহু জ্ঞানান্বেষণ প্রক্রিয়া নানাবিধ সংস্কারের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বাস্তবতা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক মননের পরিচয় যেমন আছে, তেমনি পাশাপাশি রয়েছে ঐন্দ্ৰজালিক বিশ্বাসে প্রণোদিত দৃষ্টিভঙ্গি।
বৈদিকযুগের শেষ পর্বের সূচনায় চিন্তাশীল ও ধর্মতত্ত্ববিদরা মরণোত্তর জীবন সম্পর্কে কৌতুহলী হয়ে ওঠেন। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে [ ১ : ৮ : ৪; ৫ ] চার ধরনের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে; স্বাভাবিক, সোম, অগ্নি ও চন্দ্র। একই গ্রন্থে চার ধরনের নরকও বর্ণিত [ ১ : ১৯ : ১ ] : বিসর্পী, অবিসর্পী, বিষাদী ও অবিষাদী। এরই বিপরীত মেরুতে রয়েছে স্বৰ্গকল্পনা [ ২ : ৬ : ১ ]; প্রাচীন মানুষের ভাবনায় ব্যাধি থেকে মুক্ত এবং অতীত ও আগামী প্ৰজন্মগুলি দ্বারা ভোগ্য এমন একটি কল্প রাজ্য বর্ণিত হয়েছে, যা সুকর্মের দ্বারা অর্জন করা যায়। আবার শাখায়ন আরণ্যকে [৩ : ১ : ৭ ] সদ্য স্বর্গে উপনীত আত্মার বর্ণনায় ব্রহ্মের সঙ্গে আত্মার একাত্মীভবন বিষয়ে উপনিষদের প্রধান ভাবনার অন্যতম প্রাচীনতর দৃষ্টান্ত পাওয়া যাচ্ছে। প্ৰজ্ঞানের মাধ্যমে স্বৰ্গলাভ করা যায়–এরকম নূতন চিন্তাধারার উন্মেষও আরণ্যকে ঘটেছে। লক্ষণীয় যে, কর্মের পরিবর্তে এখানে জ্ঞানের মাধ্যমে আকাঙ্ক্ষা পূরণ ও অমরতা লাভের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু, সংহিতা ব্ৰাহ্মণের যুগে শুনি যে, শুধু জ্যোতিষ্টোমের মতো নির্দিষ্ট কিছু যজ্ঞ করার মধ্যে দিয়ে স্বৰ্গলাভ করা যায়। আরণ্যক ও উপষিদের যুগে জ্ঞানের দ্বারা পুনর্জন্মধারা থেমে মুক্তিলাভের কথা বিবৃত হয়েছে। এটা স্পষ্ট যে, আরণ্যক যুগ-সন্ধিক্ষণের সাহিত্য যখন প্রাচীনতর উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি নূতনতর ভাবনার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সংমিশ্রিত হচ্ছিল। স্বৰ্গলাভের তপস্যার ভূমিকা যেমন স্বীকৃত তেমনি ‘বৈরাগ্য’-ও দেহশুদ্ধি ও মৃত্যুজয়ের উপায় রূপে বৰ্ণিত হয়েছে। তৈত্তিরীয় আরণ্যক দেবযান ও পিতৃষাণের কথা বলেছে; আত্মা প্ৰথম মার্গ দিয়ে যাত্রা করে ও দ্বিতীয় মার্গ দিয়ে পুনর্জন্মে উপনীত হয়। পরবর্তী সাহিত্যে যে পুনর্জন্ম অবিমিশ্র অমঙ্গলের প্রকাশ, আরণ্যকে তাকে সাধারণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হলেও এ সম্পর্কে কোন স্পষ্ট বক্তব্য এখনো রূপ নেয়নি। তেমনি মুক্তি সম্পর্কিত ভাবনাও অস্পষ্ট অবস্থায় ছিল; কখনো মুক্তি মৃত্যুজয়ের সমার্থক, কখনো বা এর তাৎপর্য হ’ল দেব-সান্নিধ্য।
জীবনের প্রকৃত তাৎপর্য সম্পর্কে ও আনন্দময় চূড়ান্ত অবস্থানে উপনীত হওয়ার নির্ভরযোগ্য পথের বিষয়ে আরণ্যক শেষ পর্যন্ত অনিশ্চিত রয়ে গেছে বলেই মুক্তি সম্পর্কে প্রকৃতপক্ষে বেশ কিছু পরস্পরবিরোধী বক্তব্য উপস্থাপিত করেছে। ‘ব্ৰহ্ম’ শব্দের পুংলিঙ্গ ও ক্লীবলিঙ্গগত প্রয়োগের মধ্যে কোনো স্পষ্ট ভেদরেখাও দেখা যায় না। তবে পুংলিঙ্গগত ব্রিহ্মের অবশিষ্ট দেবকাহিনী ও নবরাপগত বৈশিষ্ট্য ক্রমশ লুপ্ত হওয়ায় তাকে অধিকতর ছায়াবৃত মূর্তিতে শুধু আধ্যাত্মিক সত্তাতেই দেখা যায়। ইন্দ্ৰজাল বা অলৌকিক ক্ষমতাযুক্ত শব্দ অর্থে ‘ব্ৰহ্ম’-এর পুরাতন প্রয়োগ যদিও অক্ষুন্ন ছিল, তবুও তাৎপর্যের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের লক্ষণও কতকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যেহেতু ধর্মতত্ত্ববিষয়ক আলোচনার অন্তর্বস্তুরূপেই এই শব্দটি আরণ্যকে ব্যবহৃত নিয়েছে। ব্ৰহ্মবাদী শব্দে ব্রহ্মের মৌল তাৎপর্য অর্থাৎ অনুপ্রাণিত বাক নিহিত রয়েছে; বৈদিক সমাজের আধ্যাত্মিক সম্পদের অভিভাবকরূপে পরিচিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীরই শুধু ব্ৰহ্মবাদীর বিরল সম্মান লাভ করার অধিকার ছিল। যজ্ঞের প্রতীকী বিশ্লেষণ করা ছিল তাদের দায়িত্ব। আরণ্যকে ব্ৰহ্মবাদীরা যজ্ঞের নিয়মাবলী প্ৰণয়ন করতেন; অনুষ্ঠানসম্পর্কিত সমস্যা ও সংশয় নিরসনের বিশেষজ্ঞরূপে তারা উদ্ধৃত হতেন।
তবু, অন্তত দেবকাহিনীর দৃষ্টিকোণ থেকে, ব্রহ্মের প্রকৃতরােপ অস্পষ্টই থেকে গিয়েছিল। ব্ৰহ্মাকে সত্য, জ্ঞান ও অনন্তরূপে অভিহিত করা হয়েছে; তার অনিৰ্দেশ্য বিমূর্ত সত্তার বৈশিষ্ট্য সন্ধানের প্রবণতা ক্রমাগত প্ৰবল হয়ে উঠেছে। সমস্ত সমুন্নত দেবকাহিনী ও অধ্যাত্মবাদ-সঞ্জাত ধ্যানধারণা ক্রমশ ব্রহ্মের একক অস্তিত্বে এসে আশ্রয় পেয়েছে।
অন্যদিক থেকে এ সময় আত্মার দার্শনিক ভাবমূর্তি নির্মাণের প্রয়াসও শুরু হয়েছে; যা পরবর্তী স্তরে অর্থাৎ উপনিষদে দৃঢ় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। অবশ্য উপনিষদের বিশেষ তাৎপৰ্যপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে জীবনের মৰ্মসন্ধানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা যে আরণ্যকে প্রতিফলিত হয়েছে, তাতে কোনো সংশয় নেই। তখন পুরাতন মূল্যবোধ সম্পর্কে নানাবিধ প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ায় তা অপর্যাপ্ত বলে বিবেচিত হচ্ছিল; ফলে, জীবনের পুনর্মূল্যায়নের প্রেরণা অনিবাৰ্য হয়ে উঠলো। প্ৰথম স্তরে প্রশ্নগুলি ছিল মূলত প্ৰকৃতি, কাল ও বিশ্বজগতের সমর্থন সম্পর্কিত; ঐ সময় আর্যদের মধ্যে মৃৎকুটির নির্মাণের প্রাথমিক জ্ঞান পরিণততর হওয়ায় পরবর্তী পর্যায়ে দন্ধ ইষ্টক (বা পকেষ্টক) নির্মিত জটিলতর গৃহনির্মাণ পদ্ধতির সূচনা হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা ও স্থাপত্য-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অনুপুঙ্খ সম্পর্কে আগ্রহ। এ যুগের বিশিষ্ট লক্ষণ। দ্বিতীয় স্তরের প্রশ্নগুলো ছিল মূলত নৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং প্রেততত্ত্ব বিষয়ক। অনেক ক্ষেত্রে অভিব্যক্তিতে স্পষ্টতার ও সামঞ্জস্যবোধের অভাব পরিলক্ষিত হয়; বহু বিবৃতি ও সিন্ধান্ত পরস্পরবিরোধী। সম্ভবত তৎকালে প্রচলিত লোকায়ত আরণ্যক সংস্কৃতির রহস্যবাদী প্রবণতার প্রভাবেই জ্ঞানচর্চা সর্বসাধারণের পক্ষে প্ৰতিবিদ্ধ হতে শুরু করে।
যুগসন্ধিক্ষণের সাহিত্য বলেই আরণ্যকের তাৎপৰ্য সম্পূর্ণ পৃথক, যদিও আয়তনের দিক থেকে বৈদিক সাহিত্যে এটি ক্ষুদ্রতম। ব্রাহ্মণে যজ্ঞানুষ্ঠানগুলির প্রতীকী ব্যাখ্যা ছিল; কিন্তু পরবর্তী আরণ্যক সাহিত্যেই প্ৰথম যজ্ঞাপরায়ণ-জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত আদর্শ থেকে বিচ্ছেদের সূত্রপাত হ’ল। যজ্ঞানুষ্ঠানের সীমাবদ্ধ গণ্ডী অতিক্রম করে অতিপ্রাকৃত বা অধ্যাত্মবাদী প্ৰতীকায়ণের প্রতি রচয়িতারদের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিবন্ধ হতে শুরু করল। তৎকালীন পরিপ্রেক্ষিতে আরণ্যকে একটি দুঃসাহসিক পদক্ষেপ; কারণ পাঁচ শতাব্দীরও বেশি সময় ধীরে জনগোষ্ঠীর শ্রদ্ধা ও সমর্থনধন্য দেবকাহিনী ও অনুষ্ঠানমূলক ধর্মবোধের বৃত্ত-বহির্ভূত ক্ষেত্রে তার বিচরণের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। লঘু ঐতিহ্য ও লোকায়াত ধর্মের বিভিন্ন উপাদানের নিঃসংকোচে আত্মস্থ করে আরণ্যক শুধু বিশিষ্টই হয়ে ওঠেনি, পরবর্তী স্তরের বহুবিধ প্রবণতার প্রাথমিক উন্মেষের ক্ষেত্রও প্ৰস্তুত করেছে।