ছাদের উপর সেই শব্দ হতেই কয়েক মুহূর্ত এরা সকলে চুপ করে রইল।
তৃতীয়বারও সেই শব্দ হওয়ার পর বাদশা পাংশু মুখে বলল, এটা কীসের আওয়াজ আমি বুঝতেই পারছি না। কাকাবাবু, বিশ্বাস করুন, ছাদে আমি কোনওরকম ভয় দেখাবার ব্যবস্থা করিনি।
সন্তু বলল, কোনও চোরটোর এলেও শুধু শুধু শব্দ করবে কেন? জন্তুজানোয়ার হতে পারে। বাঁদর আসে?
কাকাবাবু বললেন, কোনও বাঁদর এত জোরে শব্দ করতে পারে নাকি?
জোজো বলল, একমাত্র গন্ডার হওয়া সম্ভব!
কাকাবাবু বললেন, ছাদের উপর গন্ডার! চমৎকার আইডিয়া! আবার সেই শব্দ। বাদশা রীতিমতো ভয় পেয়ে বলল, এ যে মনে হচ্ছে ছাদটা ভেঙে ফেলবে! এখন আমরা কী করব?
কাকাবাবু বললেন, ছাদে কেন এত শব্দ হচ্ছে, তা জানার একমাত্র উপায় ছাদে গিয়ে দেখে আসা। সিঁড়ি আছে?
বাদশা বলল, হ্যাঁ আছে। চলুন, আমরা সকলে মিলে দেখে আসি।
কাকাবাবু বললেন, সকলে মিলে কেন? তা হলে মনে হবে, আমরা ভয় পেয়েছি। ভয়টাকে মানলেই ভয় আরও বেড়ে যায়। তোমরা বসো, আমি দেখে আসছি।
সন্তু বলল, কাকাবাবু, তুমি যাবে কেন? সিঁড়ি দিয়ে উঠতে তোমার অসুবিধে হবে, আমি যাচ্ছি।
বাদশা বলল, না, না, সন্তু। আমিই যাচ্ছি। আমি দেখে আসছি। সন্তু তবু বলল, আমি যাব।
বাদশা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তা কখনও হয়! আমার বাড়ি, দায়িত্ব আমার। সঙ্গে তো রাইফেল থাকছেই। চোর-ডাকাত যদি হয়, গুলি করে মাথা উড়িয়ে দেব।
সে আর দেরি না করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
অন্য তিনজন বসে রইল উৎকর্ণ হয়ে।
একসময় জোজো ফিসফিস করে বলল, কাকাবাবু তো বলে দিয়েছেন ভূত নেই। তাই শুনে আসল ভূতরা রেগে গিয়েছে। নিজেদের জানান দিচ্ছে।
সন্তু বলল, ভূতেরা বুঝি দুমদুম শব্দ করে?
জোজো বলল, ব্রহ্মদৈত্য হতে পারে। বাদশা ফিরে এল একটু পরেই। ফ্যাকাশে মুখে বলল, কেউ নেই, কিছু নেই উপরে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কিছুই দেখতে পেলে না?
বাদশা বলল, আমি ছাদের চারপাশটা দেখে এলাম। কোনও কিছুর চিহ্নই নেই। তারপর কাকাবাবুর দিকে ফিরে হাত জোড় করে বলল, আপনি বিশ্বাস করুন কাকাবাবু, আমি মিথ্যে কথা বলছি না। আমি নিজেই কিছু বুঝতে পারছি না।
কাকাবাবু বললেন, পুরনো বাড়ির ছাদ, নানারকম শব্দ হতেই পারে। গরমকালে বোধহয় খানিকটা এক্সপ্যানশন হয়, তাতে অনেকটা গু-ড়ু-র গু-ড়ু-র শব্দ হয়। কিন্তু এরকম তো…
আবার দুমদুম শব্দ! কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে ছাদটা ভাঙার চেষ্টা করছে।
সন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি একবার দেখে আসবই আসব।
বাদশা বলল, আমার রাইফেলটা নিয়ে যাও!
সন্তু বলল, আমি রাইফেল চালাতে জানি না। কাকাবাবু, তোমার রিভলভারটা দাও!
সেটা নিয়ে সন্তু দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
রেলিং নেই বটে, কিন্তু সিঁড়িটা ভাঙা নয়। উপরের দরজাটা হাট করে খোলা।
ছাদে এসে সন্তুও প্রথমটা কিছুই দেখতে পেল না। ফাঁকা ছাদ, একটা-দুটো ঝাকড়া গাছ দেখা যায়, উঠেছে পাশ দিয়ে। ছাদটা দুভাগে ভাগ করা। অন্য দিকটাই একেবারে ভেঙে পড়েছে। সেদিকে তাকিয়েও কিছু দেখা গেল না। তারপর একটা গাছে বেশ জোরে শব্দ হতেই সন্তু সেদিকে ফিরে তাকাল।
সেই গাছ থেকে একজন কেউ হাত বাড়িয়ে ধরল ছাদের কার্নিশ। মনে হল, একটা গোরিলা। যতই অবিশ্বাসী হোক, রাত্তিরবেলা নির্জন ছাদে এরকম অদ্ভুত কিছু দেখলে বুকটা কেঁপে উঠবেই। বুক কাপলেও সন্তু শক্ত করে রিভলভারটা চেপে ধরে রইল। গোরিলা যদি হয়, তা হলে তো রিভলভার থেকেও কোনও লাভ নেই। গুলি করলে আরও বিপদ হবে।
গোরিলা নয়, মানুষ!
কার্নিশ পেরিয়ে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। বিশাল লম্বা-চওড়া পুরুষ, প্যান্টকোট পরা, মাথায় একটা টুপি। মুখটা ঠিক দেখা যাচ্ছে না। অনেক গল্পের বইয়ে সাহেব-ভূতদের এরকম ছবি থাকে।
তাড়াতাড়িতে সন্তু টর্চটা আনতে ভুলে গিয়েছে। ভূতের ভয় তার একেবারেই নেই। মানুষ যখন, তখন আর ভয় পাওয়ার কী আছে? বুকের কাপুনিটা থেমে গেল।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কে? কে ওখানে?
ছায়ামূর্তি ইংরেজিতে বলল, ইউ গো ব্যাক। কল মিস্টার রায়চৌধুরী।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, হু আর ইউ?
সে এবার বাংলায় গম্ভীরভাবে বলল, তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই না। যাও, তোমার আঙ্কলকে ডাকো।
সন্তু বলল, আমার আঙ্কল যার-তার সঙ্গে দেখা করেন না। আপনি কে আগে বলুন!
সে এবার বিচ্ছিরি কর্কশভাবে বলল, এ যে দেখছি একটা নেংটি ইঁদুর। যা যা, নীচে যা। তোর আঙ্কলকে গিয়ে বল, আমি ভূত!
সন্তু বলল, আপনার পরিচয় না দিলে আমি গুলি চালাব। সত্যি ভূত কিনা দেখব।
সে এবার বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে বলল, তুই আবার গুলি চালাতেও শিখেছিস নাকি? চালা তো দেখি।
সন্তু ট্রিগার টিপল। লোকটাকে ঠিক মারার জন্য নয়, ভয় দেখানোর জন্য। মাথার উপর দিয়ে গেল গুলিটা।
সঙ্গে সঙ্গে সে-ও গুলি চালাল দুবার। সন্তুর বুকে। সন্তু পড়ে গেল মাটিতে।
লোকটি আবার ছাদের পাঁচিল টপকে নেমে গেল গাছ বেয়ে।
নীচের ঘরে কাকাবাবুরা পরপর তিনবার গুলির শব্দ শুনতে পেলেন। বাদশা লাফিয়ে উঠে বলল, অ্যাঁ গুলি!
সে ছুটে যেতেই জোজোও গেল তার পিছনে পিছনে।
কাকাবাবুর ক্রাচ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে একটু দেরি হল।
তিনি দরজার কাছে আসতেই জোজো ড়ুকরে উঠে বলল, কাকাবাবু, কাকাবাবু, সন্তু মরে গিয়েছে!
কাকাবাবু কেঁপে উঠে বললেন, অ্যাঁ কী বলছ জোজো? না, না, এ হতেই পারে না!
কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে দেখলেন, উপুড় হয়ে পড়ে আছে সন্তু। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ।
বাদশা তার শরীরটা উলটে দিল। সন্তুর বুক থেকে এখনও গলগল করে বেরিয়ে আসছে রক্ত।
বাদশা সন্তুর নাড়ি ধরে বসে রইল।
কাকাবাবু পাগলের মতো বলতে লাগলেন, কী, বাদশা? কী? শুনতে পাচ্ছ কিছু? বাদশা!
বাদশা হতাশভাবে বলল, সাড়া নেই। নিশ্বাসও টের পাচ্ছি না। কাকাবাবু হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ভাঙা গলায় বললেন, সন্তু, সন্তু নেই? অ্যাঁ অ্যাঁ কী বলছ বাদশা। মিথ্যে কথা। সন্তু নেই
বাদশা বলল, কাকাবাবু, এখন ভেঙে পড়ার সময় নয়। এখনই ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। যদি কিছু আশা থাকে। তারপর জোজোকে বলল, তোমাকেও শক্ত থাকতে হবে। পা দুটো ধরো ওর। গেটের সামনে গাড়ি আছে। কাকাবাবু, আপনি আস্তে আস্তে নামুন। তাড়াহুড়ো করে হোঁচট খাবেন না, তাতে আরও বিপদ হবে।
বাদশা আর জোজো সন্তুকে বয়ে নিয়ে গেল নীচে।
কাকাবাবু সাবধানে সিঁড়িতে পা ফেলতে লাগলেন। তাঁর দুচোখ ঠেলে আসছে কান্না। এক জায়গায় তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ভূত কখনও মানুষকে গুলি করে না। সাধারণ চোর-ডাকাত কিংবা পার্টির ছেলেরাই বা শুধু শুধু সন্তুকে মারতে যাবে কেন? এ নিশ্চয়ই সেই কর্নেল ধ্যানচাঁদের কাজ। ওরা এমনই নিষ্ঠুর! বাদশা যখন ছাদে উঠল, তখন তো তাকে গুলি করেনি। ওরা নিশ্চয়ই সন্তুকে চিনতে পেরেই মেরেছে।
ইস, কেন তিনি সন্তুকে কর্নেল ধ্যানচাঁদের হুমকির কথা বলে দেননি। তা হলে সন্তু সাবধান হয়ে থাকতে পারত। কিন্তু এইরকম ভূতের বাড়িতে ওরা আক্রমণ করতে আসবে, তা কাকাবাবু ভাবতেই পারেননি। এটা তাঁরই ভুল। ধ্যানচাঁদ লোকটা হঠাৎ-হঠাৎই আসবে বলেছিল। সন্তুকে তিনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসেন। সন্তু না থাকলে তাঁরও আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করবে না। ধ্যানচাঁদই জিতে গেল।
বাদশা আবার উঠে এসে কাকাবাবুর হাত ধরে বলল, নামুন, আমার কাঁধে ভর দিন।
কাকাবাবু চোখ মুছে ফেললেন। তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। মনে মনে কিছু একটা প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি।
শিমুলতলায় একজন ডাক্তার বাদশার বন্ধু। প্রথমে তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হল।
তিনি দেখে বললেন, বাঁচবার আশা খুব কম। তবে এখনও প্রাণ আছে। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চেষ্টা করা যেতে পারে। কয়েক বোতল রক্ত দিতে হবে।
কাকাবাবু বললেন, সন্তু আর আমার ব্লাড গ্রুপ একই। আমার শরীর থেকে যত ইচ্ছে রক্ত নিন।
ডাক্তারটি বললেন, সেসব ব্যবস্থা তো এখানে নেই। জসিডি নিয়ে যেতে হবে। কিংবা দেওঘর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
কাকাবাবু কাতরভাবে বললেন, আপনি দয়া করে আমাদের সঙ্গে চলুন।
ডাক্তার ভার্গব বললেন, নিশ্চয়ই যাব।
অন্ধকার রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটল জসিডির দিকে। গাড়ি চালাচ্ছে বাদশা নিজে, দারুণ স্পিডে। সন্তুকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। কাকাবাবুর কোলে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে জোজো।
ডাক্তার ভার্গব বললেন, বাদশা, অত জোরে চালাচ্ছ, অ্যাকসিডেন্ট হলে তো সকলকে মরতে হবে। তাতে কী লাভ হবে!
বাদশা বলল, আমি ঠিক দেখে চালাচ্ছি।
এখন অনেক রাত, জসিডি হাসপাতালে কয়েকজন নার্স শুধু ডিউটি দিচ্ছেন। কোনও ডাক্তার নেই।
সন্তুকে ভরতি করানো হল এমার্জেন্সিতে। এখনই অপারেশন করা দরকার। কিন্তু ভার্গব অপারেশন করেন না, তিনি পেটের রোগের চিকিৎসা করেন।
ডাক্তার ভার্গবকে সন্তুর পাশে বসিয়ে রেখে আবার ছুটে বেরিয়ে গেল বাদশা। এই হাসপাতালের ডাক্তার জয়ন্ত দাসকে সে চেনে। তাঁর বাড়ি কোথায় তাও জানে।
কাকাবাবু চেয়ে রইলেন সন্তুর দিকে। রক্তমাখা শরীর, চোখ দুটো বোজা। বেঁচে থাকার কোনও চিহ্নই নেই। জোজো দুহাতে মুখ ঢেকে বসে আছে।
দুজন নার্স এলেন সন্তুর গায়ের রক্তক্ত পরিষ্কার করতে।
একজন বললেন, আহা গো, এই বয়সের ছেলেকে কে এমন করে মারলে?
অন্যজন বললেন, আজকাল তো এই রকমই হয়েছে। কারও দয়ামায়া নেই।
প্রথমজন ডাক্তার ভার্গবকে জিজ্ঞেস করলেন, স্যার, একে বাঁচানো যাবে?
ডাক্তার ভার্গব বললেন, আশা তো করতেই হবে।
মিনিট দশেকের মধ্যেই বাদশা টানতে টানতে নিয়ে এল অন্য একজন ডাক্তারকে। তাঁর মাথার চুল উসকোখুসকো, পাজামা আর গেঞ্জি পরা।
বাদশা বোধহয় ওঁকে বিছানা থেকে টেনে তুলে এনেছে, জামাও পরতে দেয়নি, চুল আঁচড়াবার তো প্রশ্নই ওঠে না।
তিনি সন্তুর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন ঘরের অন্যদের। মুখোনা গম্ভীর।
ডাক্তার ভার্গব বললেন, খুব মৃদু পাল্স পাওয়া যাচ্ছে এখনও।
বাদশা বলল, কাকাবাবু, ডাক্তার জয়ন্ত দাস খুব নামী সার্জন।
ডাক্তার দাস বললেন, আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব। কী হবে জানি না। আপনারা সকলে বাইরে অপেক্ষা করুন, এখানে ভিড় করে থেকে লাভ নেই।