গল্পগ্রন্থ
উপন্যাস
অগ্রন্থিত
নাটক
ছড়া

০৬. ঘনাদা একটু থামতেই

ঘনাদা একটু থামতেই পল্টুবাবু প্রথম গদগদ হলেন। তা হলে ভাগ্যিস আমি গাড়িটা নিয়ে আজ অমন সময়ে এসে পড়েছিলাম!

আমাদের ক-জনের গলায় খুকখুকে কাশিটা তখন প্রায় ছোঁয়াচে হয়ে উঠেছে। ঘনাদা সেটা অগ্রাহ্য করেই উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, নিশ্চয়ই। ওই গাড়িটা না থাকলে বোরোত্রার হদিস কখনও পেতাম! রাসবিহারীর মোড়ে ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়েছি, বোরোত্ৰা তখন তার বন্ধ গাড়ির ভেতরে মনের সুখে পিঁপিঁর সঙ্গে বাস্ক-এ আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। সেই আলাপ শোনবার পর আর তার পেছন ছাড়ি! তার দামি বিদেশি গাড়ির সঙ্গে লেগে থাকতে অবশ্য আমাদের জিভ বেরিয়ে গেছে।

তবু শহর ছাড়িয়ে দমদমের রাস্তায় শেষ পর্যন্ত তার গাড়িটাকে এয়ারপোর্ট হোটেলের দিকে যেতে দেখেই তার পিছু ছেড়ে সোজা এয়ারপোর্টে গিয়ে, ইস্টার্ন ফ্লাইটস-এর ওয়েটিং হএ গিয়ে হাজির হয়েছি। অনুমানে আমার ভুল হয়নি, ভাগ্যটাও ভাল, দ্যুব্যারি তার সেই মাকামারা আখখুটে হাঘরে চেহারা পোশাকে একটু আগে আগেই এসে তার মাল ওজন করাতে দাঁড়িয়েছে।

আমাকে দেখে সে তো যেমন অবাক তেমনই আহ্লাদে আটখানা। গলগল করে কী যে জিজ্ঞাসা করবে, আর কোন কথা যে আগে বলবে, তাই ঠিক করতে পারছে না।

গম্ভীর মুখে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছি, ওজন করাতে হবে না, মাল নিয়ে শিগগির ওদিকে চলো।

এ কথায় একেবারে হতভম্ব হলেও দুব্যারি প্রতিবাদ কিছু করেনি। তাকে নিয়ে তারপর একদিকের নির্জন একটা কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলেছি, এ ফ্লাইটে যাওয়া তোমার হবে না। তোমায় অন্য প্লেনে কোথাও যেতে হবে।

কোথায়? দুব্যারি এই প্রশ্নটুকু শুধু করে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছে।

কোথায় তা জানি না। তাকে আরও বিমূঢ় করে বলেছি, এখন অন্য যে কোনও ফ্লাইটে একটানা-একটা সিট খালি পাওয়া যাবে, তাতেই।

আর-কোনও প্রতিবাদ বা প্রশ্ন না করে দুব্যারি এবার বলেছে, এখনও সময় আছে, আমার যাওয়াটা তা হলে বাতিল করিয়ে আসি।

বাতিল করিয়ে আসবে! একটু থেমে ভেবে নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছি, সঙ্গে তোমার পুঁজির অবস্থা কী রকম? এ টিকিট ক্যানসেল না করলেও প্রথমে কাছাকাছি। কোথাও, আর তারপর সেখান থেকে আবার ফিরে তোমার নিজের জায়গায় যাবার নতুন টিকিট করার মতো খরচে কুলোবে?

একটু ভেবে নিয়ে দুব্যারি বলেছে, ক-টা জিনিস এখানে কিনতে পারিনি। তাই সঙ্গে যা আছে তাতে একরকম কুলিয়ে যাবে।

তা হলে টিকিট ক্যানসেল করতে হবে না। তাকে বুঝিয়ে বলেছি, তুমি যেন এই ফ্লাইটেই যাচ্ছ, এইটেই সবাই জানুক। না এসে পৌঁছনো প্যাসেঞ্জার হিসেবে তোমার নাম শেষ পর্যন্ত মাইকে ডেকে যাবে। তাই যাক। শেষ মুহূর্তেও তুমি এসে পড়তে পারো, এইরকম একটা ধারণা ভাঙবার কোনও কারণ যেন না থাকে।

দ্যুব্যারির মালপত্র নিয়ে তাকে ঘরোয়া বিমানযাত্রীদের ঘাঁটিতে রওনা করিয়ে দেবার সময়ে সে হঠাৎ আমার হাতটা ধরে ফেলে বললে, তুমি যা করছ তা অনেক ভেবেচিন্তে বুঝেসুঝেই করছ, এ বিশ্বাস আছে বলে কোনও প্রশ্ন তোমাকে করব না। একটা কথা শুধু তোমায় বলে যাই, দাস। তোমার সঙ্গে দেখা আমার শিগগিরই আবার হবে। আর তা লুকিয়ে চুরিয়ে নয়, দুনিয়ার সকলকে সগৌরবে জানিয়ে। কারণ আমার সাধনা আমি প্রায় ষোলো আনাই সফল করে এনেছি।

এরপর পকেট থেকে একটা নোটবইয়ের মতো খাতা বার করে আমার হাতে দিয়ে আবার বললে, এই খাতাটা সেইজন্যেই তোমায় দিয়ে যাচ্ছি। এতে সব পাতায় আমার সই আছে। তা থাক বা না থাক, শুধু তোমার সই থাকলেই এ খাতার পাতা কিংবা যে কোনও সাদা কাগজ এখন থেকে লক্ষ টাকার চেয়েও দামি। কারণ সবচেয়ে যা দুষ্প্রাপ্য আর মূল্যবান, সেই এনার্জি তুমি যাকে যত খুশি দেবার হ্যান্ডনোট লিখে দিতে পারো। পৃথিবীর সব এনার্জির চাহিদা চিরকালের মতো মেটাবার মতো মহাশূন্যের কালো ফুটো আমি পেয়েছি।

কথাগুলো বলে নিজের আবেগেই দ্যুব্যারি আর আমার দিকে না-ফিরে হন হন করে তার মালের ঠেলার সঙ্গে এগিয়ে চলে গেল।

একটু দাঁড়িয়ে আমি আবার আগের ওয়েটিং হএই ফিরে এলাম। আমার একটু দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু তাতে কিছু ক্ষতি হয়নি। বোরোত্রাও এয়ারপোর্ট হোটেলে বেশ ভালরকম সেঁটেই নিশ্চয় সবে তখন তার মালপত্র ওজন করাচ্ছে।

সঙ্গে তার পিঁপিঁ আছে ঠিকই। ওজন করাতে করাতেও তাদের আলাপের বিরাম নেই।

ভাষাটা তাদের অবোধ্য হলেও কাছাকাছি সবাই পুতুল-পিঁপিঁ আর বোরোত্রার আলাপের ধরনে হেসে কুটোপাটি হচ্ছে তখন। বিশুদ্ধ বাঙ্ক-এ সেই আলাপের মর্ম বুঝলে তাদের মুখে কী ধরনের হাসি ফুটত তাই ভাবলাম।

ওজন করাতে করাতে বোরোত্রার বাঁ বগলের পিঁপিঁ তখন বলেছে, খুব যে খুশি, না? প্লেনে গিয়ে ওঠার আর তর সইছে না! বোরোত্রা যেন তাকে ধমক দিয়ে বলেছে, চুপ কর। তর সইছে না-সইছে, তাতে তোর কী?

আমার কী! খ্যানখেনে হাসির সঙ্গে বলেছে, পিঁপিঁ আরে আমারই তো সব। আমি ছাড়া তুই তো ঠুটো!

ঠিক আছে, ঠিক আছে। বোরোত্রা যেন পিঁপিঁকে ঠাণ্ডা করবার চেষ্টা করেছে, সত্যিই তো, সব তো তোরই কেরামতি। আমি তো এর পরের ঘাঁটিতেই নেমে যাব। তারপর তো তোরই খেল।

আমায় ফেলে তুই নেমে যাবি! পিঁপিঁ একটু কাঁদুনে সুর ধরেই আবার তা ভুলে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছে, কোথায় রেখে যাবি আমায়?

সে যেখানেই রেখে যাই না, বলে একটু গরম হতে গিয়েই বোরোত্রা যেন ভয়ে ভয়ে নরম হয়ে বলেছে, রাখব, রাখব, ভাল জায়গাতেই রাখব। তুই তো ওই একরত্তি পুঁচকে একটা পুঁটলি, ওপরের তাকের লাইফবেল্টের ভেতরেই গোঁজা থাকলে কে খেয়াল করবে।

কেউ না! কেউ না! পিঁপিঁ যেন খুশিতে ডগমগ হয়ে বলেছে, ওইখান থেকেই এমন খেল শুরু করব, একেবারে ফটকাবাজি। ফট ফট।

থাম থাম, আহাম্মক কোথাকার। বোরোত্রা তাকে আবার ধমক দিয়েছে, আর ফটকাবাজি দেখাতে হবে না। এদিকে দেরি হয়ে গেছে। পাখি ডালে গিয়ে বসেছে। কিনা দেখা হয়নি।

বসেছে! বসেছে! পিঁপিঁ প্রায় যেন নাচতে নাচতে বলেছে, আমরা আসবার আগেই গিয়ে বসেছে নিশ্চয়! চল! চল!

ওজন-টোজনের ঝামেলা চুকিয়ে এক হাতে ঝোলানো একটা ব্যাগ আর-এক হাতে পিঁপিঁকে নিয়ে কাউন্টারের সকলের হাসির মধ্যে বোরোত্রা এবার তার প্লেনে গিয়ে ওঠবার পথে রওনা হয়েছে। কিন্তু দু-পা গিয়েই তাকে থামতে হয়েছে চমকে হতভম্ব হয়ে।

অন্য সবাই যখন এটাও তার ভেনট্রিলোকুইজমের একটা প্যাঁচ মনে করে হেসে খুন, তখন বোরোত্রা নিজে বেশ দিশাহারা।

তা দিশাহারা হওয়া আশ্চর্য কী? কাউন্টার ছেড়ে দু-পা না যেতে যেতেই তার পিঁপিঁই যেন ছুঁচলো গলায় তাকে সাবধান করে দিয়ে স্প্যানিশে বলেছে, আপ,ি কী হারাইতেছেন, আপনি জানেন না।

বলে কী পিঁপিঁ! আর বলছে কেমন করে? বেশ হতভম্ব হয়েও বোরোত্রা আবার তার ব্যাগ তুলে রওনা হওয়া মাত্র আবার পিঁপিঁ যেন ফরাসি ভাষায় সেই একই কথা তাকে শুনিয়েছে।

বোরোত্রার সত্যিই তখন বেসামাল অবস্থা। মাথাটাই তার হঠাৎ বিগড়ে-টিগড়ে গেছে বলে তার সন্দেহ হচ্ছে।

মাথাতেই কিছু গণ্ডগোল না হলে এমন অদ্ভুত কাণ্ড হয় কী করে। তাও একবার আধবার কী! স্প্যানিশ আর ফরাসির পর জোর করে ব্যাগ তুলে নিয়ে পা বাড়াবামাত্র পিঁপিঁ খাস বাক-এই সেই একই কথা তাকে শুনিয়েছে, আপনি কী হারাইতেছেন আপনি জানেন না।

বোরোত্রার কাণ্ড দেখে তখন মনে হয়েছে, সে যেন পাগলের অভিনয় করছে। আশপাশের লোকে যত এটা তার মজার খেলা মনে করে হেসেছে, সে তত চিড়বিড়িয়ে উঠে, আর-কিছু না পেরে, এক দফা চুটিয়ে গালাগাল দিয়ে পিঁপিঁকেই ছুড়ে ফেলে দিয়েছে সেখানকার মেঝের ওপর।

ছুড়ে ফেলে দিয়েই যেন তার হুশ হয়েছে। তারপর যে রকম অস্থির হয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সে পুতুলটা তুলে নিয়েছে, তা দেখবার মতো। সেইটুকু দেখেই হিসেবের ভুল কিছু যে আমার হয়নি তা বুঝে বোরাত্রার প্লেন ছাড়া পর্যন্ত বেয়াড়া কিছু ঘটে কিনা, তা একটু দেখে যাবার জন্য এয়ারপোর্ট হোটেলেই গিয়ে একটু বসেছি।

এয়ারপোর্ট হোটেলের একটা নিরিবিলি টেবিলে একলাই বসে বসে প্লেনের ভেতর বোরোত্রার অবস্থাটা যেন আমি প্রত্যক্ষ দেখতে পেয়েছি।

কী অস্বস্তি নিয়েই সে যে তার সিটে বসে আছে, তা তার মুখের চেহারাতেও এখন আর লুকোনো নেই নিশ্চয়ই। সিটটা এখন যেন তার কাছে কন্টকাসন।

কোনওরকমে নিজের সিটটায় বসে আছে বটে, কিন্তু নজর তার প্লেনের ভেতরে ঢোকবার দরজাটার দিকে যেন আঠা দিয়ে আটকানো। নীচের ঢাকা-দেওয়া সিঁড়িটা সেইখানেই লাগানো। সেই সিঁড়িই বেয়েই এক-এক করে যাত্রীরা উঠে আসছে ভেতরে।

কিন্তু যাত্রীরাও তো যা আসবার প্রায় সবাই এসে গিয়েছে। এখন যা আসছে তা তো বেশ একটু ফাঁক দিয়ে দিয়ে দু-একজন মাত্র। তার মধ্যে দুব্যারি কই? হাত ঘড়িটার দিকে চেয়ে অস্থির হয়ে উঠছে এবার বোরোত্রা, আর সময়ই তো নেই।

মাত্র এক মিনিট, পঞ্চাশ সেকেন্ড, পঁয়তাল্লিশ।

প্লেনের দরজা ওরা বন্ধ করতে যাচ্ছে যে।

নীচে দরজার গায়ে লাগানো সিঁড়িটা সরিয়ে ফেলেছে নাকি।

বোরোত্রার মনের মধ্যে কী হচ্ছে, তা আমি বেশ বুঝতে পারছি তখন।

একটু দেরি হলেও দুব্যারি শেষ মুহূর্তে ঠিক এসে পড়বে এই ছিল তার বিশ্বাস।

সত্যি না এসে দুব্যারি যাবে কোথায়?

কিন্তু এখন কী করবে বোরোত্রা?

নেমে যাবে প্লেন থেকে?

সিট থেকে উঠে পড়তে গিয়ে তার পিঁপিঁর কাছেই সে পরামর্শ চাইছে নিশ্চয়।

কী পরামর্শ দেয় পিঁপিঁ?

পিঁপিঁ এখন চিচি হয়ে গিয়েছে নিশ্চয়। চিঁচি করেই জানায়, কোথায় যাবি? এখন কি আর নামতে দেবে?

দেবে দেবে, কেন দেবে না! ধমক দিয়ে আবার উঠতে চেষ্টা করে বোরোত্রা।

পিঁপিঁর চিচি আবার শোনা যায় নিশ্চয়, নামতে পারলেও যাবি কোথায়? কোথায় এখন পাবি সে-হতভাগাকে? তার চেয়ে চেপে বসে থেকে এরপর কী করবি ভেবেই নে না।

বোরোত্রা আবার বসে পড়েছে দোনামোনা মুখে।

পিঁপিঁর সঙ্গে কথাগুলো বাস্ক-এই হয়েছে সন্দেহ নেই।

আশপাশের লোকেরা কিছু বুঝতে না পেরে ভেন্ট্রিলোকুইজমের মজা পেয়েই তখন হাসছে।

সে হাসিতে গা জ্বলে গেলেও বোরোত্রাকে বোকা-বোকা ভালমানুষের মুখ করে থাকতে হচ্ছে জাদুকরের ভোল নিয়ে।

মনের ভেতর এখন তার ভাবনার তুফান চলছে।

সে যা ভাবছে আমি সব টের পাচ্ছি।

ভাবছে, দুবারি তো শেষ মুহূর্তেও প্লেনে এসে উঠতে পারল না। কেন পারল না?

ইচ্ছে করে দ্যুব্যারি যে এ প্লেনটায় ওঠেনি, তা অবশ্য বোরোত্রার মাথাতেই আসছে না।

দুব্যারি নিশ্চয়ই কোনও কিছুতে আটকে গেছে এই সন্দেহই বোরোত্রার হচ্ছে। কিন্তু কীসে আটকাতে পারে?

কোনওরকম আকস্মিক দুর্ঘটনা? হঠাৎ অসুখ-বিসুখ?

তেমন কোনও দারুণ দুর্ঘটনা কি হঠাৎ অসুখে একেবারে ভেঁসে গেলে তার কাজ তো হাসিল হয়ে যায়।

কিন্তু অত ভাগ্য কি তার হবে? তা ছাড়া অমন দৈব দুর্ঘটনায় কিছু হলে তার বাহাদুরির দাম সে কি পাবে?

না, ওরকম কিছু হয়ে কাজ নেই। আর যাই হোক, পরের ঘাঁটিতে নেমে তাকে ভাল করে খোঁজ নিতে হবে। দরকার হলে আবার ফিরেও যেতে হবে কলকাতায়।

কিন্তু এদিকে পিঁপিঁর বুকের ভেতর প্রায় নিঃশব্দ ধুকধুকুনি যে সমানে চলেছে।

ওই ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে জুড়ে যে শয়তানির প্যাঁচটি আছে, তা নির্ভুল ঘণ্টা মিনিট সেকেন্ডের হিসেব ধরে ঠিক সময়টিতে প্রলয়কাণ্ড বাধাবে।

সেই ব্যবস্থা করেই পিঁপিঁর ভেতর টাইম-বোমাটি লুকিয়ে দুব্যারির প্লেনেই বোরোত্ৰা টিকিট কেটে উঠেছে।

সে মাঝপথে নেমে যাবার সময় টাইম-বোমা-লুকোনো পুতুলটা ওপরের তাকের মধ্যে লুকিয়ে রেখে যাবে। আর সেটা প্লেন আবার ছাড়বার পর সমস্ত প্লেনটাকেই চৌচির করে ফাটাবে। এমন পাকা প্ল্যান যে কোনওভাবে ভেস্তে যেতে পারে, তা সে ভাবতেই পারেনি।

এখন এই পিঁপিঁ পুতুলটার সর্বনাশা শয়তানি প্যাঁচটা কাটিয়ে ভণ্ডুল না করে দিলেই নয়।

বোরোত্ৰা কেমন করে বিপর্যয় ঘটাবে, তাও আমি ভাল করেই বুঝতে পেরেছি।

একটু বাদেই পিঁপিঁকে নিয়ে সে বাথরুমে গিয়ে ঢুকবে। তারপর সেখানে গিয়ে পিঁপিঁর ছালচামড়া ছাড়িয়ে তার ভেতরের ঘড়িটা দেবে বন্ধ করে।

পিঁপিঁকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে তাকে না-নিয়েই আবার ফিরে এলে তার যে সব সহযাত্রী এতক্ষণ তার ভেনট্রিলোকুইজমে মজা পেয়েছে তারা একটু অবাক হয়ে পিঁপিঁর খোঁজ হয়তো নিতে পারে।

তখন কী জবাব বোরোত্রা দেবে, সেটা তার দায়। আমার তা নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার কী!

বোরোত্রার প্লেনটা ছেড়ে যাবার বেশ খানিকটা পরে তাই আমি ফিরে আসবার জন্য উঠেছি।

তা এয়ারপোর্ট হোটেলে তো আর এমনি এমনি বসে থাকা যায় না। তাই একটু খাবার দাবার অর্ডার দিতে হয়েছিল। তা এত দিল যে, ওখানে শেষ করা যাবে না বলে কিছু প্যাক করিয়ে সঙ্গেও আনতে হয়েছে। সে বাক্সটা—

ঘনাদার মুখের কথা পড়তে-না-পড়তে পল্টুবাবু প্রায় জোড়হস্ত হয়ে বললেন, সে খাবারের প্যাকেট আমি আপনার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি এই এদের বনোয়ারিকে দিয়ে।

ও, দিয়েছ! ঘনাদা একটু প্রসন্ন হাসি দিয়ে পল্টুবাবুকে ধন্য করে কেদারা থেকে উঠে পড়ে পা বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ একটা কথা যেন মনে পড়ায় থেমে গিয়ে বললেন, কিন্তু আর-একটা মুশকিল হয়েছে। সঙ্গে তেমন কিছু নিয়ে তো বেরোইনি। ওই হোটেলে যাবার সময় ড্রাইভারের কাছে গোটা চল্লিশই যেন ধার করতে হয়েছিল। সেটা–

সে আপনি কিছু ভাববেন না। পল্টুবাবু কৃতার্থ গলায় বললেন, ও সব কিছুর যা করবার আমি করব। আপনি এখন বিশ্রাম করুন গিয়ে একটু।

হ্যাঁ, তাই করি। বলে টঙের ঘরে যেতে যেতে ঘনাদা আমাদের জন্য একটু সহানুভূতি খরচ করে গেলেন, তোমাদের বড্ড দেরি হয়ে গেল আজ।

আমাদের মুখগুলোর দিকে একবার চেয়ে দেখলে ঘনাদা আমাদের কৃতজ্ঞতার পরিমাণটা বুঝতে পারতেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়া পর্যন্ত কেন যে ঘনাদা আজ অমন অকাতরে আমাদের সঙ্গে খিদেতেষ্টা অগ্রাহ্য করেছেন, তা বুঝে আমরা আমও অভিভূত।

ঘনাদাকে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে নতুন ভক্ত পল্টুবাবুর ফিরে আসার পর তাঁকেই একটু নিশানা না বানিয়ে তাই পারলাম না।

বললাম, বেরাল তো মিলেছে, কিন্তু তার গলায় ঘন্টাটা বাঁধা হবে কী করে?

বেরাল! পল্টুবাবু অবাক হয়ে বললেন, ঘনাদা বেরালের কথা তো কিছু বলেননি

সোজা করেই তাই বলতে হল, আকাশের ঘেঁদা, ওই সর্বার্থসাধিকা কালো ফটো, ও তো শুনলাম দেড় দুই আলোকবর্ষ দূরে। তা ফুটোর গলায় উপগ্রহের বিদ্যুৎবানানো যন্ত্র বসানো হাঁসুলি পরানো হবে কী করে?

প্রায় ঘনাদার মতোই নাসিকাধ্বনি করে নিজের পকেটের ঘনাদার-দেওয়া এনার্জির দানপত্র একটু নেড়ে নিয়ে পল্টুবাবু বললেন, ওসব তোমাদের বোঝবার নয়।

পল্টুবাবুর অন্ধ ভক্তির ছোঁয়াচ লেগেও আর একটা রহস্য হঠাৎ যেন পরিষ্কার হয়ে গেল।

ঘনাদার অনেক রকম বেয়াড়া আবদার অত্যাচারই আমরা অম্লানবদনে সহ্য করে থাকি। কিন্তু আজকের এই অন্যের আনা গাড়ি নিয়ে এমন বেপরোয়া উধাও হয়ে যাওয়াটা তাঁর পক্ষেও যেন বেশ একটু বাড়াবাড়ি। এটা যেন তাঁর গুলসম্রাট চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না।

হঠাৎ এমন অস্বাভাবিক চরিত্রস্থলনের কারণ কী?

কারণটা গৌরের মাথাতেই প্রথম ঝিলিক দিল।

ঘনাদা আজ কীসের শোধ নিলেন বুঝতে পারছিস?

গৌর বুঝিয়ে বলবার আগেই ব্যাপারটা আমাদের ভাল করেই মনে পড়ল। মাসখানেক আগেই আমাদের একটা ছোটখাটো বেয়াদপি হয়ে গেছে। বিকেলবেলা সেদিন ঘনাদাকে নিয়ে এক নামকরা হোটেলে যাবার কথা দিয়েছিলাম। কিন্তু খেলার মাঠে সর্ব ভারত-প্রতিযোগিতায় বাংলা-দলের অপ্রত্যাশিত হারে এমন মুষড়ে পড়েছিলাম সবাই যে মেসে ফিরে যাবার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম একরকম।

ঘনাদা সেজেগুঁজে রাত প্রায় ন-টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে রামভুজের রান্নাতেই ডিনার সারলেও, পরের দিন এ ব্যাপার যেন বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন।

মোটেই যে তিনি ভোলেননি, আজকের এই প্রতিশোধই তার প্রমাণ।