ক্লোস্টার শহরটা বেশ ছোট, কিন্তু ছবির মতো সুন্দর।
অঞ্জনাদির বাড়ির সামনে যে পরিষ্কার নির্জন রাস্তা, সেটা গাড়ি-চলাচলের জন্যে। মানুষ সেই রাস্তায় হাঁটে না। রাস্তার পাশে অনেকটা ঘাসজমি এবং সেই ঘাসের ঠিক মাঝখানে হেঁটে যাওয়ার জন্যে সরু বাঁধানো পথ রয়েছে। আমেরিকায় গাড়ি রাস্তার ডান দিক ঘেঁষে যায় বলে অর্জুনের একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি দুর্ঘটনা ঘটল। মোড়েই একটা গির্জা। খুব শান্ত চেহারা। এখন সেখানে মানুষজন নেই। অর্জুন বাঁ দিকে ঘুরল। গতকাল অঞ্জনাদি ওই পথেই তাদের নিয়ে এসেছিলেন। মিনিট তিনেক হাঁটতেই দোকানপাট শুরু হল। এখন বেশ হাওয়া বইছে। একটু শীতশীত ভাব। দোকানগুলো গায়ে-গায়ে ঠাসা নয়। বাড়িগুলোও একতলা। প্রথমে একটা সেলুন চোখে পড়ল। তারপরই কেক-পাউরুটির দোকান। পরেরটি পাব। পোশাকের দোকানটিতে ঢোকার ইচ্ছে হলেও অর্জুন ঠিক করল, এখন সময় নষ্ট করবে না। বাসস্টপ লেখা থামটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। তারপরেই খেয়াল হল পুরনো অভ্যাসে সে বাঁ দিক দিয়ে হাঁটছে। রাস্তার ডান দিকে না গেলে সে নিউ ইয়র্কের বাস পাবে না। গতকাল তারা তো নিউ ইয়র্ক থেকে বাঁ দিক দিয়ে এসেছিল। সে রাস্তা পার হয়ে বাসস্টপে গিয়ে দাঁড়াতে লক্ষ করল, এতক্ষণ যেটাকে বাঁ দিক মনে হচ্ছিল সেটা এখন ডান দিক হয়ে গিয়েছে। আসলে তুমি যেদিকে মুখ করে দাঁড়াচ্ছ দিকটা সেইমতো নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে।
বাস এল। ড্রাইভারের পাশের দরজা বোধ হয় বোতাম টিপতেই খুলে গেল। অর্জুন সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, এটা কি নিউ ইয়র্ক যাবে?
ড্রাইভার মাথা নাড়ল, না। জর্জ ওয়াশিংটন পর্যন্ত যাবে। ওখান থেকে তুমি টিউব পেয়ে যাবে। এক ভলারকুড়ি সেন্ট দাও।
গতকাল অনেক পঞ্চাশ সেন্টের কয়েন পেয়েছিল ট্রলি নিতে গিয়ে। অর্জুন তার তিনটে দিতে ড্রাইভার ব্যালান্স এবং টিকিট দিয়ে বোতাম টিপতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। অর্জুন দেখল বাসটা বেশ বড় কিন্তু মাত্র গোটা চারেক লোক বসে আছে। জানলার ধারের সিটে বসে বাইরে তাকাতেই বাস চলতে শুরু করল। খুব আরামদায়ক সিট। এক ডলার কুড়ি সেন্ট মানে ভারতবর্ষের টাকায় অনেক। লোকাল বাসে চল্লিশ টাকার ওপরে ভাড়ার কথা কেউ চিন্তা করতে পারে? অবশ্য এদের কাছে এক টাকা কুড়ি পয়সা মাত্র। ডলার সেন্টকে টাকা এবং পয়সায় ভাবতে পারলে কোনও সমস্যা থাকে না। একশো পয়সায় এক টাকা আর একশো সেন্টে এক ডলার। সুধামাসির টাকায় ডলার কেনা হলেও ওটা যে কিছুতেই ভাবা যাচ্ছে না।
বাস বেশ জোরেই ছুটছে। মাঝে-মাঝে সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে, ড্রাগ-ফ্রি জোন। অর্থাৎ এই এলাকায় কেউ ড্রাগ নেয় না। এ থেকে বোঝা যায় অনেক এলাকা আছে যেখানে ড্রাগের চল রয়েছে। আমেরিকান সরকার চেষ্টা করেও বন্ধ করতে পারছে না? পরপর দুটো স্কুল চোখে পড়ল। ছেলেরা বাস্কেটবল খেলছে। কোনও কোনও বাড়ির সামনে বাস্কেটবলের স্ট্যান্ড দেখা যাচ্ছে। একটা নির্জন মাঠের মধ্যে বিশাল সাজানো বাড়ির ওপর লেখা রয়েছে কে মার্ট। সামনের পার্কিং লটে প্রচুর গাড়ি। এতবড় বাড়িটা দোকান?
শেষপর্যন্ত জর্জ ওয়াশিংটনে বাস পৌঁছে গেল। বাস থেকে নেমে জিজ্ঞেস করতেই টিউব স্টেশনের হদিস পেয়ে গেল অর্জুন। সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে টানেল দিয়ে সে যখন স্টেশনের দিকে হাঁটছে তখন অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল। দশ হাত দূরে-দূরে বিশাল চেহারার নিগ্রো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের প্রত্যেকের পরনে জিন্স এবং জ্যাকেট। দাঁড়িয়ে আছে ঠিক স্ট্যাচুর ভঙ্গিতে, সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় গম্ভীর এবং জড়ানো গলায় বলছে, হে ম্যান, গিমি এ ডলার! শুনলেই বুকটা কীরকম করে ওঠে। দিনদুপুরেই যদি এই অবস্থা হয়, সন্ধের পরে যে কী হবে কে জানে! কিন্তু লোকগুলো নড়ছে না। পাশে হেঁটে বিরক্তও করছে না।
টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে ট্রেনে উঠতে কোনও অসুবিধে হল না। কিন্তু ট্রেনটায় বেজায় ভিড়। যারা বসে আছে তারা ভাগ্যবান, অর্জুন কয়েকজন সাদার পাশে হাতল ধরে দাঁড়িয়ে পড়তেই নজরে এল। প্রায় সাত ফুট লম্বা এবং তেমনই মোটা একটি কালো যুবক পা ছড়িয়ে সিটের ওপর ঘুমোচ্ছে। তার মাথা এবং পায়ের কাছে খানিকটা জায়গা ছেড়ে যাত্রীরা বসে আছে। যারা দাঁড়িয়ে তারা লোকটাকে কিছু বলছে না। এত লোক যখন কষ্ট করে যাচ্ছে, তখন নিগ্রো ছেলেটা ওভাবে সিট দখল করে ঘুমোচ্ছে কেন এই প্রশ্ন কেউ করছে না। মুখ দেখে অসুস্থ বলে মনেও হচ্ছে না। অর্জুন সহযাত্রীদের দিকে তাকাল। এরা সবাই সাদা। সাদা বলে যে আমেরিকান তা নাও হতে পারে। অর্জুন তার পাশে দাঁড়ানো মধ্যবয়সী ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করল কারণটা। লোকটি ইশারা করল চুপ করতে। তারপর নিচু গলায় বলল, তুমি কি নতুন?
অর্জুন মাথা নাড়তেই লোকটি বলল, আমি এসেছি পাঁচ মাস হল। আমার বাড়ি বেলগ্রেডে। এখন এখানে ধাতস্থ হয়ে গেছি। খবরদার এই কালো মানুষগুলোকে চটিও না। এরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে।
পরের স্টেশনে ট্রেন থামতে কিছু লোক যেমন নামল, অনেক বেশি উঠল। চাপ বাড়ছে। হঠাৎ এক্সকিউজ মি, এক্সকিউজ মি বলে এক বৃদ্ধা ভিড় কাটিয়ে অর্জুনের সামনে এসে কোনওমতে দাঁড়ালেন। মহিলাটি কালো এবং রোগা। পাঁচ ফুটের বেশি লম্বা নন। তাঁর এক হাতে একটা চামড়ার হাতব্যাগ, অন্য হাতে ভাঁজ করা খবরের কাগজ সামনে শায়িত যুবককে দেখে তিনি বলে উঠলেন, এ কী! এ এখানে শুয়ে আছে কেন? দেখে তো অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে না। অ্যাই ছোকরা, ওঠো, উঠে বোসো। ভদ্রতাবোধগুলো কি বাড়িতে রেখে এসেছ?
যুবকটি কোনও কথা বলা দূরে থাক, চোখও খুলল না।
বৃদ্ধা বললেন, আচ্ছা তাদড় তো। কালা নাকি? বলে লম্বা করে ভাঁজ করা কাগজটাকে লাঠির মতো করে মারতে লাগলেন যুবকের শরীরে। শব্দ হচ্ছিল। এবার যুবক চোখ খুলল। অত্যন্ত বিরক্ত সে। বৃদ্ধা বললেন, অ্যাই, ওঠ! এটা তোর বাড়ি পেয়েছিস? মেরে হাড় গুঁড়িয়ে দিতে হয় তোর মতো হতচ্ছাড়াদের। ওঠ বলছি।
পাশের যুগোস্লাভ লোকটি নিচু গলায় বলল, এইবার বুড়ি মরল।
লোকটা উঠল। উঠতেই বৃদ্ধা বসে পড়লেন সিটে, বসুন আপনারা, আরাম করে বসুন। শেষের কথাগুলো অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি। তৎক্ষণাৎ সিটটা ভরে গেল। যুবক দরজার দিকে এগোল। পরের স্টেশনে ট্রেন থামতেই নেমে গেল সে নিঃসাড়ে। সিটে বসে পাশের বৃদ্ধার দিকে তাকাল অর্জুন। যে কাজটা করতে কোনও সাদা সাহস পাচ্ছিল না, সেই কাজ ইনি অবলীলায় করলেন কোন সাহসে? ভদ্রমহিলা এত রোগা যে, যুবক একটা আঙুলের চাপেই ওঁকে কাহিল করে দিতে পারত। সিটে বসে মহিলা তখন কাগজ খুলে সামনে ধরেছেন। অর্জুন না জিজ্ঞেস করে পারল না, আচ্ছা, কিছু মনে করবেন না, আপনি এমন সাহসী কী করে হলেন?
সাহসী? আমি? দুর, আমি মোটেই সাহসী নই। আমাকে প্যারাসুট নিয়ে প্লেন থেকে নামতে বললে আমি ভয়েই মরে যাব। একটা আরশোলা দেখলে আমি তো প্রায় ভিরমি খাই।
তা হলে ওই বিশাল চেহারার লোকটাকে মারলেন কী করে?
ও, এর কথা বলছ? ও তো অন্যায় করেছিল। কেউ অন্যায় করলে সে মনে-মনে দুর্বল হয়ে যাবে। আর অন্যায় দেখলেই আমার খুব রাগ হয়ে যায়। তোমাদের উচিত ছিল অনেক আগে ওকে উঠিয়ে দেওয়া। বৃদ্ধা আবার খবরের কাগজে মন দিলেন।
পোর্ট অথরিটি স্টেশনে নেমে ফোনের বুথ খুঁজছিল অর্জুন। হঠাৎ একটা রোগা ঢ্যাঙা নিগ্রো এগিয়ে এল সামনে, তুমি কোনও হেলপ চাও?
হ্যাঁ। টেলিফোন বুথ–!
এসো দেখিয়ে দিচ্ছি। বলেই ছেলেটা হাঁটতে লাগল। ওকে অনুসরণ করতে না করতেই দেওয়ালে সার-সার টেলিফোন দেখতে পেল অর্জুন। সে ছেলেটাকে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে দেখল ও হাত বাড়িয়ে রেখেছে।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?
আমার পারিশ্রমিক। আমি তোমার জন্যে পরিশ্রম করেছি।
সে কী! আঁতকে উঠল অর্জুন। এমন ভাব করছ যেন তুমি আমাকে টেলিফোনের কথা বলেনি। ওসব কায়দা ছেড়ে আমাকে একটা ডলার দাও। নইলে আমি সবাইকে ডেকে বলব তুমি কাজ করিয়ে আমাকে ডলার দিচ্ছ না। দাও।
অর্জুন বাধ্য হল লোকটাকে দুটো পঞ্চাশ সেন্টের কয়েন দিতে। লোকটা যেন কাজ করে পয়সা পেল এমন ভঙ্গিতে চলে গেল। অর্জুন কিছুক্ষণ ওর যাওয়া দেখল। পোর্ট অথরিটি স্টেশন এবং বাস টার্মিনাস বিশাল এলাকা জুড়ে একটি বাড়িই বলা যায়। যে বাড়ির মাটির নীচে এবং ওপরে অনেক তলা আছে। প্রতিটি তলায় বিভিন্ন গেট থেকে লোকাল এবং দূরগামী বাস ছাড়ছে। টিউবরেলও এর নীচ দিয়ে চলে গিয়েছে। এই সময় যাত্রীরা ব্যস্ত পায়ে যে যার কাজে গেলেও বহু নিগ্রো ছেলে ছড়িয়ে আছে এখানে-ওখানে, অলস ভঙ্গিতে। বোঝাই যাচ্ছে এদের কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই। ওয়াশিংটন স্টেশনে এদের রূপ দেখেছে সে, এখানে অন্য রূপ।
টেলিফোন করতেই মেজর রিসিভার তুললেন, কে? অর্জুন? কোত্থেকে বলছ?
পোর্ট অথরিটি থেকে।
বাঃ। এসে গেছ। আমি যাচ্ছি।
কিন্তু এটা তো বিশাল জায়গা, আমাকে খুঁজে পাবেন কী করে?
দ্যাটস ট্র। তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছ তার সামনে কিছু আছে?
অর্জুন তাকাল। উলটোদিকেই একটা রেস্টুরেন্ট, যার ওপরে লেখা রয়েছে পিজা।
অর্জুন বলল, পিজা বিক্রি হয় এমন রেস্টুরেন্টের উলটোদিকে টেলিফোনের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। কতক্ষণ লাগবে আপনার?
দশ মিনিট।
কয়েক পা সরে এসে অর্জুন অপেক্ষা করতে লাগল। যে ছেলেটি তার কাছে ডলার চেয়েছিল তাকে দেখতে পেল এক এশীয় ভদ্রলোকের পাশাপাশি কথা বলতে বলতে হেঁটে যেতে। ভদ্রলোকের আঙুলে সিগারেট ছিল। যেই তিনি হাত তুলেছেন ওই সিগারেটে টান দিতে, অমনই ছেলেটি ঝট করে তাঁর কবজিতে আঘাত করল। সঙ্গে-সঙ্গে সিগারেটটা ছিটকে ওপরে উঠে গেল। ছেলেটি অত্যন্ত দক্ষ ফিল্ডারের মতো সেটা লুফে নিয়ে টানতে-টানতে অন্যদিকে চলে গেল। ভদ্রলোক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওর যাওয়া দেখলেন, তারপর দ্রুত নিজের পথে চলতে লাগলেন।
বোঝাই যাচ্ছে এই কালো ছেলেগুলো খুব গরিব। চাকরি পায়নি। কোথায় যেন পড়েছিল এরা পড়াশুনা করতে তেমন আগ্রহী নয়। গরিব মানুষ আমাদের দেশেও আছেন। কিন্তু তাঁরা পরিশ্রম না করে এইভাবে নিজের প্রয়োজন মেটান না। অথচ ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় অর্জুন আঙ্কল টমস কেবিন পড়েছিল। পড়তে-পড়তে সে কেঁদেছিল। আঙ্কল টম তার বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। সেই কালো মানুষটির ওপর যেসব সাদা অত্যাচার করেছিল তাদের জন্যে ঘৃণা তৈরি হয়েছিল। আফ্রিকা থেকে কালো মানুষের দলকে ক্রীতদাস করে নিয়ে এসে সাদারা কী ভয়াবহ অত্যাচার করে গিয়েছে বছরের পর বছর। ফলে কালো মানুষদের প্রতি সহানুভূতি এবং ভালবাসা তৈরি হয়েছিল অর্জুনের মনে। অথচ আজ এদের আচরণ দেখে আতঙ্ক হচ্ছে। ওই বিশাল চেহারা। নিয়ে তারা তো যে-কোনও কাজ করতে পারত। তা না করে এভাবে ঠকাচ্ছে অথবা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ভিক্ষে চাইছে? সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল অর্জুনের।
হাই! হেঁড়ে গলায় চিৎকারটা ভেসে আসতেই অর্জুন মুখ ফিরিয়ে দেখল মেজর দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছেন। আর একটু মোটা হয়েছেন ভদ্রলোক। প্যান্টের ওপর টাইট গেঞ্জিশার্ট পরায় ভুড়ি আরও প্রকট হয়েছে। মুখ ঢাকা জসুলে দাড়িতে সাদা ছোপ ছড়িয়ে পড়েছে। কাছে এসে দুহাতে তিনি এত জোরে জড়িয়ে ধরলেন যে, হাঁসফাস করতে লাগল অর্জুন। প্রাথমিক উচ্ছাস কমে গেলে মেজর বললেন, ব্যাপার কী হে? পাচার মতো অন্ধকারে আমেরিকায় উড়ে এলে? আগাম একটা খবরও দাওনি?
হঠাৎই আসতে হল। পরিচিত এক বয়স্কা মহিলার মেয়ে এখানে থাকেন। তাঁর স্বামী দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে আছেন। ভদ্রমহিলাকে নিয়ে আসতে হল।
অ। এসকর্ট। তিনি এখন কেমন আছেন?
আগের থেকে ভাল।
তা হলে এবার কোনও রহস্য সমাধানের দায়িত্ব নেই? অর্জুন হাসল, না। আপনি কেমন আছেন?
ভাল। খুব ভাল। মাস তিনেক আগে প্রশান্ত মহাসাগরের নীচে গিয়েছিলাম নতুন ধরনের শ্যাওলা খুঁজতে। আবার দুমাস বাদে যাচ্ছি উত্তরমেরুতে।
তাই?
ইয়েস ব্রাদার। তোমার মিস্টার সোম কেমন আছেন?
আছেন। একটু সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী ভাব এসে গেছে।
তাই নাকি! এ আবার কী কথা। চলো আমার ওখানে চলো। একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। মেজর হাঁটা শুরু করতেই অর্জুন তাঁকে অনুসরণ করল। পোর্ট অথরিটির বাইরেই ম্যানহাটান। সেই বিখ্যাত ম্যানহাটান, যার নাম সিনেমা এবং বইয়ের কল্যাণে অনেক বাঙালির জানা। ফুটপাথ ধরে হাঁটতে গিয়ে সেই দৃশ্য আবার দেখতে পেল অর্জুন। বিশাল বিশাল চেহারার নিগ্রো হয় দেওয়ালে ঠেস দিয়ে, নয় ফুটপাথে পা ছড়িয়ে বসে আছে। সামনে দিয়ে কেউ গেলেই পয়সা চাইছে। এদের কারও চেহারা দেখে মনে হয় না অনাহারে আছে। অর্জুন কথাটা বলতেই মেজর খেপে গেলেন, এই পাজি শয়তান আহাম্মক হিপোদের কথা আমাকে বোলো না তো! আমেরিকার কলঙ্ক এরা। প্রত্যেকে বেকার ভাতা পায়। সেটা পেয়েই ড্রাগ কেনে আর উড়িয়ে দেয়। দশদিন বাদে হাত খালি হতেই সারাদিন এখানে দাঁড়িয়ে থাকে নবাবপুকুরের মতো। ভিক্ষে হল তো ভাল, নইলে সন্ধে নামলেই ছিনতাই শুরু করে।
পুলিশ কিছু বলে না?
নিশ্চয়ই বলে। কিন্তু মুশকিল হল এরা জেলে যেতে ভালবাসে।
সে কী! অর্জুন অবাক!
এখানকার জেলে কয়েদিরা জামাই আদরে থাকে হে। রীতিমতো ভাল খাবার, টিভি, ব্যায়াম, কী নেই! ভেতরে ঢুকে ওখানকার কয়েদি-নেতাকে সেলাম করলে একদম নিশ্চিন্ত। শুনেছি জেলে বসে ড্রাগও পেয়ে যায় ওরা।
পার্কিংলটের দিকে এগিয়ে গেলেন মেজর। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কিন্তু এভাবে চললে কালোদের প্রজন্ম শেষ হয়ে যাবে না?
খুব স্বাভাবিক। তবে এরাই সব নয়। প্রচুর কালো মানুষ আছেন যাঁরা পড়াশুনা করে ভাল চাকরি বা ব্যবসা করছেন। এই নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র একজন কালো মানুষ ছিলেন। এঁদের মধ্যে থেকে খেলোয়াড়, অ্যাথলেট, ক্সার, অভিনেতা এবং কবি উঠে এসেছেন। তাঁরা না থাকলে আমেরিকার গৌরব বাড়ত না। অতএব এই যাদের দেখলে, তারাই সব নয়। মেজর গাড়ির দরজা খুললেন।
গাড়িতে বসে অর্জুনের মনে হল, কথাটা ঠিক। জনসন নামেই দুজন বিখ্যাত অ্যাথলেট আছেন, একজন পৃথিবীবিখ্যাত বাস্কেটবলার। আমেরিকার যে দলটা ওলিম্পিক বা ওয়ার্ল্ড কাপে অংশ নেয় তার অধিকাংশই কালো মানুষ। পৃথিবীর অন্যতম শ্রদ্ধেয় মানুষ মার্টিন লুথার কিং অথবা গায়ক পল রবসন কালো মানুষ। তা হলে?
মেজর থাকেন যে বাড়িতে সেটি পনেরো তলা। গাড়ি পার্ক করে ওরা লটের দিকে এগোচ্ছিল। হঠাৎ অর্জুনের মনে পড়ল লকেটটার কথা। সে জিজ্ঞেস করল, মেজর, আপনি তো পৃথিবীর অনেক দেশ, বিশেষ করে আফ্রিকায় অনেকবার গিয়েছেন। সেখানে এমন কোনও লকেটের কথা শুনেছেন যেটা সাপের আকৃতি নিয়ে আছে এবং যার চোখের পাথরের নীচে মারাত্মক বিষ রাখা ছিল।
নো। নেভার। শুনিনি তো। তুমি দেখেছ?
অর্জুন জামার ভেতর থেকে লকেট বের করে মেজরকে দেখাল। মেজর কুঁকে ওটা দেখতে-দেখতে বললেন, ফ্যান্টাস্টিক। কী দিয়ে তৈরি এটা?
বলতে পারব না।
ঠিক আছে। এবাড়িতে একজন আফ্রিকান-আমেরিকান থাকেন। খুব পণ্ডিত মানুষ। আফ্রিকার আদিবাসীদের ওপর অনেক কথা জানেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো কিছু জানা যাবে। ঘড়ি দেখলেন মেজর, মিস্টার আলাম্বাকে বোধ হয় এখন ওঁর ফ্ল্যাটেই পেয়ে যেতে পারি।
লিফটের পাশে ঝোলানো টেলিফোনে কথা বললেন মেজর। তারপর রিসিভার রেখে বললেন, চলো, আমি দশতলায় আর উনি আটতলায়।
আটতলায় লিফট থামতেই মেজর বেরিয়ে একটা দরজার কাছে পৌঁছতেই সেটা খুলে গেল। অর্জুন দেখল বেশ বৃদ্ধ একজন মানুষ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। মেজর মুখ খোলার আগেই তিনি বললেন, ওয়েলকাম। ভারতীয় ভদ্রলোকদের জন্যে যদি কিছু করতে পারি তা হলে গৌরবান্বিত বোধ করব।