পরদিন সকালবেলা কিরীটী, সুব্রত ও রাজু গতরাত্রের ঘটনা সম্পর্কেই আলোচনা করছিল।
কিরীটী বললে, যে কুৎসিত মুখটা স্কাইলাইটের ফাঁক দিয়ে দেখা দিয়েছিল সেটা মনে হয় একটা বাঁদরের মুখ।
সুব্রত বললে, আমারও তাই এখন মনে হচ্ছে। মুখখানা আমি ভাল করেই দেখেছি। সেটা বাঁদর-জাতীয় কোন প্রাণীর মুখ বলেই মনে হয়।
কিরীটী বললে, আরেকটা কথা সুব্রত—এই দলের যিনি নেতা, অর্থাৎ যিনি মহামান্য রক্তমুখী ড্রাগন নামে পরিচিত, তিনি আমার মনে হচ্ছে হয়ত একজন চায়নীজ–
চায়নীজ!
কিরীটী বললে, তোদের বলিনি-যে বাক্সটার মধ্যে ঐ পোকাটা ছিল—তার মধ্যে একটা কাগজ ছিল?
কাগজ?
হ্যাঁ, চীনা ভাষায় লেখা কাগজটা—তাই আমি ভেবেছি কাগজটার মধ্যে কি লেখা আছে জানতে হবে—আর তাই চীনা ভাষা পড়তে পারে এমন একজন লোকের কথা রামিয়াকে বলেছি–
তারপর একটু থেমে আবার কিরীটী বললে, ঐ রক্তমুখী ড্রাগন যেই হোক, যতই তার কথা ভাবছি মনে হচ্ছে, লোকটা রসায়নশাস্ত্রে পণ্ডিত, ইংরেজীতে পণ্ডিত, বাঁদর দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারে, বিশালকায় পিঁপড়ের মত জীবকে বিষাক্ত গন্ধে মাতোয়ারা করে মানুষের রক্তপানে লোলুপ করতে পারে। হয়ত কোন ক্ষুদ্র জীবকে ঘরের মধ্যে পাঠিয়ে তাকে বিষাক্ত গন্ধে উম্মত্ত করে ফেলে, এবং তারই কামড়ে নিদ্রিত মানুষকে অচৈতন্য করে দিতে পারে।
দুপুরের দিকে মিঃ রামিয়া এসে হাজির হলেন।
কিরীটী তাকে এনে ঘরে বসাল।
কিরীটী বললে, মিঃ রামিয়া, আমি যে একজন শিক্ষিত চীনা লোকের কথা বলেছিলাম, তিনি কোথায়?
তিনি এখুনি আসবেন। কিন্তু তিনি চীনা নন, তিনি একজন জাপানী। চীনা ভাষায়ও তার বেশ দখল আছে। আমাদের পুলিস-স্টাফেরই একজন অ্যাসিস্টান্ট কমিশনারের সঙ্গে তার বেশ হৃদ্যতা আছে।
কিরীটী বললে, ঠিক আছে। কিন্তু দেরি না হয়। আমি এর জন্য খুব বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। একটু অপেক্ষা করেও তাকে যদি সঙ্গে করে–
ঐ সময় মোটরের হর্ন শোনা গেল, সেই সঙ্গে কে একজন চেঁচিয়ে ডাকল, মিঃ রামিয়া। মিঃ রামিয়া এখানে আছেন?
হা হ্যাঁ, আসুন আসুন।
একটু পরেই জাপানী ভদ্রলোকটি এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।
কিরীটী কাগজটা ভদ্রলোককে দেখতে দিল।
তিনি কাগজটা পরীক্ষা করে বললেন, এর মধ্যে কয়েকটি নাম আছে-প্রথম দুটি কাটা ও নীচে লেখা ডাঃ ওয়াং।
কাটা নাম।
হ্যাঁ, প্রথমটি চিদাম্বরম্ ও দ্বিতীয়টী সুন্দর দাস—
আর তৃতীয়?
মিঃ ডিবরাজ।
ছাপা কাগজগুলি সাপ্তাহিকি ও মাসিক ইত্যাদি সাময়িক পত্রিকার অংশবিশেষ। এবং নানা ধরনের সংবাদ রয়েছে তার মধ্যে।
জাপানী ভদ্রলোকটি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে কতকটা আত্মগতভাবে বলতে লাগল, রক্তমুখী ড্রাগনের কাগজে ১নং হচ্ছে-মিঃ চিদাম্বরম; ২নং হচ্ছে-মিঃ সুন্দর দাস। তাদের কেউ আর এখন আমাদের মাঝে নেই—একজন হয়েছেন অপহৃত, অপরজন নিহত। আর ৩নং নাম হচ্ছে-মিঃ ডিবরাজ!
কে তিনি? তাকে জানেন নাকি? কি মিঃ রামিয়া, তিনি এখনও বেঁচে আছেন তো?
আজই সকালে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।
হঠাৎ কিরীটী বললে, তাহলে মিঃ রামিয়া, রক্তমুখী ড্রাগনের এই ৩ নং শিকার মিঃ ডিবরাজকে বাঁচাবার চেষ্টা আমাদের করতেই হবে।
মিঃ রামিয়া বললেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না মিঃ রায়, কি আপনার কথাটা।
বুঝতে পারছেন না? দেখছেন না, এই কাগজখানা হচ্ছে একটা নামের লিস্ট, যেসব হতভাগ্য রক্তমুখী ড্রাগনের শিকার হবে, এই কাগজখানায় তাদের নাম লেখা রয়েছে। নামের ক্রমিক নম্বর অনুসারে এদের সকলেই রক্তমুখী ড্রাগনের দ্বারা অপহৃত বা নিহত হবে।
এদের প্রথম দুটি তো চলেই গেছে, এখন যদি সম্ভব হয় এই ৩ নং ব্যক্তিটিকে রক্ষা করে, বাকী কটাকেও বাঁচানো হয়ত যেতে পারে।
সুব্রত ও রাজু মুগ্ধভাবে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে রইল, আর মিঃ রামিয়া বললেন, ঠিক বলেছেন।
আমার মনে হচ্ছে ঐ রক্তমুখী ড্রাগন নামধারী ব্যক্তিটি আর কেউ নয়—চীনের ডাঃ ওয়াং।
ডাঃ ওয়া?
হ্যাঁ, ডাঃ ওয়াং।
এই বলে কাগজের টুকরোটা রামিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে কিরীটী বললে, এই দেখুন মিঃ রামিয়া। প্রায় প্রত্যেকটা কাগজেই ডাঃ ওয়াং-এর স্বাক্ষর। সম্ভবত নিতান্ত অসতর্কভাবে তার চিন্তকুল মন এমন সাংঘাতিক ইঙ্গিতটা এই কাগজের বুকে লিখে রেখেছে। দেখুন লিস্টটার তলায়ও লেখা রয়েছে-ডাঃ ওয়াং। কলম্বোতে ডাঃ ওয়াং নামে বিখ্যাত কোন লোক আছে কি মিঃ রামিয়া? খোঁজ নেবেন তো, এ শহরে ডাঃ ওয়াং বলে কেউ আছে কিনা?
নিশ্চয়ই খবর নেবো।
আর একটা কথা—
কি?
চীন গভর্নমেন্টের কাছে জরুরী তার করতে হবে। জানতে হবে, এই ডাঃ ওয়াং লোকটির বর্তমান movement সম্পর্কে কিছু জানা আছে কিনা। এবং তার চেহারা, শিক্ষাদীক্ষা, ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদি সম্বন্ধে চীন গভর্নমেন্ট যদি কোন সংবাদ দিতে পারেন।
ইন্সপেক্টর রামিয়া একটু নীরব থেকে কি ভাবলেন; তারপর বললেন, তাহলে চলুন একবার আমাদের বড়কর্তার কাছে যাই। তাকে আপনিও সব কথা ভাল করে বুঝিয়ে বলতে পারবেন। তারপর মিঃ ডিবরাজকে পাহারা দেবার বন্দোবস্ত করে আপনাকে আবার এখানে পৌঁছে দিয়ে যাব।
বেশ, চলুন তাহলে।
অতঃপর ইন্সপেক্টর রামিয়ার মোটর-কার কিরীটীকে নিয়ে পুলিস-সাহেবের কুঠির দিকে বের হয়ে পড়ল।
সুব্রত ও রাজুকে কিরীটী বলে গেল, তোমরা খানিকক্ষণ এখানেই থাক। সব দিকে নজর রেখো ভাল করে। মনে রেখো, রক্তমুখী ড্রাগন বা ডাঃ ওয়াং হয়ত আমাদের খুব নিকটেই আশেপাশে কোথাও ওৎ পেতে লুকিয়ে রয়েছে।
পুলিসের চীফের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ওরা গেল ডিবরাজের বাড়ি। কিন্তু তিনি বাড়িতে নেই-বাইরে গিয়েছেন—পনের-কুড়ি দিনের মধ্যেই ফিরবেন তার লোকেরা বললে।