কাকাবাবু অনেকক্ষণ ধরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে হিসেবের খাতাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।
তারপর ঘুমিয়ে পড়লেন একসময়।
বিকেলের দিকে তার ঘুম ভাঙল। জানলার বাইরে ঝকঝক করছে রোদ। সন্তু আর জোজো ফেরেনি। তিনি ভাবলেন, এই রোদ্দুরে কোথায় ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছে কে জানে!
তিনি খাট থেকে নেমে দরজাটা খুলে বাইরে মুখ বাড়ালেন।
বারান্দার এক কোণে দেখা গেল কমলিকাকে।
সে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, কফি?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, কফির তেষ্টা পেয়েছে। তুমি ঠিক বুঝেছ তো!
একটু পরেই কমলিকা ট্রে-তে করে কফির পট, কাপ আর বিস্কুট নিয়ে এল।
কাকাবাবু কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, বাঃ, বেশ ভাল বানিয়েছ।
কমলিকা বলল, বিস্কুট নিন।
কাকাবাবু বললেন, দুপুরে এত খাইয়েছ, এখন আর কিছু খেতে পারব। আজ বোধহয় আর বৃষ্টি হবে না।
কমলিকা বলল, আকাশে একটুও মেঘ নেই। তবে, এখানে মেঘ না থাকলেও হঠাৎ ঝড় আসে। জঙ্গলের দিক থেকে। একবার ঝড়ের সময় তিনটে হরিণ চলে এসেছিল এ-বাড়ির সামনে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কী হল? হরিণগুলোকে কেউ মারেনি তো?
কমলিকা বলল, না, না, আমার বাবা কোনও জীবজন্তু মারতে দেন না। কেউ গাছ কাটলেও রেগে যান খুব। বাবা যদি এখানে না থাকতেন, তা হলে ছোটকাকা অন্তত একটা হরিণ মারতই ঠিক। মাংস খাওয়ার জন্য। ছোটটাকা তো শিকারি। একবার নাকি একটা জিরাফ মেরেছিল সিমপলিপাল জঙ্গলে।
কাকাবাবু চমকে উঠে বললেন, জিরাফ! এই জঙ্গলে জিরাফ আসবে কোথা থেকে?
কমলিকা বলল, তা হলে বোধহয় জেব্রা।
কাকাবাবু বললেন, আমাদের দেশে জেব্রাও নেই। বুনো গাধা আছে। কোথাও কোথাও!
কমলিকা বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, গাধা। না, না, গাধাও নয়, কুকুর।
কাকাবাবু বললেন, হঠাৎ কুকুর মারতে যাবেন কেন?
কমলিকা বলল, এমনি কুকুর নয়, জঙ্গলের কুকুর!
কাকাবাবু বললেন, জংলি কুকুর খুব হিংস্র হয় বটে, ইংরেজিতে যাদের বলে ওয়াল্ড ডগস! তাদের মারা তো খুবই শক্ত। তোমার কাকা তা হলে খুব ভাল শিকারি।
কমলিকা বলল, ছোটকাকা একবার সাপের মাংস খেয়েছিল। মস্তবড় একটা কেউটে সাপকে আগে পিটিয়ে মারল। তারপর বলল, এটাকে রান্না করে খাব। আমাদের রান্নার মাসি রান্না করতে রাজি হল না, কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। ছোটকাকা তখন নিজেই রান্না করল। আর কেউ যায়নি অবশ্য।
কাকাবাবু বললেন, চিন দেশের লোকেরাও তো সাপ খায়। সাপের মাথাটা কেটে ফেললে, সারা গায়ে তো বিষ থাকে না, বিষ থাকে শুধু দাতে।
হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটে কমলিকা বলল, আচ্ছা কাকাবাবু, সন্তু আর জোজো তো অনেকবার অনেকরকম বিপদে পড়েছে, তাই না? ওরা নিজে নিজেই উদ্ধার পেয়েছে, না আপনি সবসময় সাহায্য করেন?
কাকাবাবু বললেন, নিজে নিজেই অনেকবার বিপদ থেকে বেরিয়ে এসেছে। আমার সাহায্যের দরকারই হয়নি। বরং আমাকেই ওরা সাহায্য করে।
কমলিকা বলল, যদি একটা নদীর মধ্যে পড়ে যায়? খুব স্রোত?
কাকাবাবু বললেন, সন্তু খুব ভাল সাঁতার জানে। জোজো জানে না বটে, সন্তু ওকে পিঠে নিয়ে চলে আসতে পারে। সন্তু ভাল ক্যারাটে জানে। গাছে উঠতে পারে। আর জোজো ওর মুখের কথা দিয়ে অন্যদের মাত করে দেয়।
কমলিকা বলল, যদি মরুভূমিতে হারিয়ে যায়?
কাকাবাবু বললেন, সেরকম কখনও হয়নি বটে। কিন্তু একবার আমরা ইজিপ্টে উটের পিঠে চেপে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে একটা পিরামিড দেখতে গিয়েছিলাম।
কমলিকা আবার বলল, যদি কোনও গর্তে পড়ে যায়?
কাকাবাবু বললেন, সেরকম তো কতবার হয়েছে। একবার একটা বিরাট সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে গেছি, সেখানে একটা সাপ ছিল, সেটা বিজয়নগরের বিখ্যাত হিরেটা উদ্ধার করার সময়।
কমলিকা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মুখ তুলে খুব সরলভাবে বলল, তা হলে আমি যে ওদের বাঘের ফাঁদে ফেলে দিলাম, সেখান থেকে এখনও উঠতে আসতে পারল না কেন?
কাকাবাবু আঁতকে উঠে বললেন, কোথায় ফেলে দিয়ে এলে?
কমলিকা বলল, বাঘের ফঁদে।
কাকাবাবু বললেন, সেটা আবার কী?
কমলিকা বলল, সেটা দুৰ্গটার কাছেই। একটা গর্ত। উপরে চাটাই চাপা দেওয়া থাকে, কেউ বুঝতে পারে না। ওটা বাঘ ধরার জন্য।
কাবাবু বললেন, সেখানে তুমি ওদের ইচ্ছে করে ফেলে দিলে?
কমলিকা বলল, না, না, ওর মধ্যে বাঘ নেই কিন্তু। এমনি গর্ত। সন্তু আর জোজো ওখান থেকে উঠে আসতে পারে কি না দেখছিলাম। কিন্তু এখনও তো এল না। ভেবেছিলাম এই কথাটা আপনাকে বলব না। কিন্তু আমি তো মিথ্যে কথা বেশিক্ষণ চেপে রাখতে পারি না। মজা করছিলাম ওদের নিয়ে। আমি আর দাদা আরও কয়েকজন ওখানে কতবার লুকিয়েছি। ভিতরে খাঁজ কাটা আছে, মানুষ উঠে আসতে পারে, বাঘ পারে না!
কাকাবাবু বললেন, তুমি ওদের ফেলে দেওয়ার আগে দেখেছিলে, গর্তটার মধ্যে কিছু আছে কি না?
কমলিকা বলল, তা কী করে দেখব? আমি তো কাছে যাইনি।
কাকাবাবু ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে ক্রাচ দুটি বগলে নিলেন।
তারপর বললেন, শিগগির চলো তো, কোথায় তুমি ওদের ফাঁদে ফেলেছ, আমাকে দেখিয়ে দাও!
কমলিকা ঠোঁট উলটে বলল, এমা, ছি, ছি, ওরা বুঝি নিজেরা উদ্ধার হতে পারে না? সব সময় আপনার সাহায্য লাগে?
কাকাবাবু বললেন, আর দেরি না করে, চলো এক্ষুনি সেখানে যেতে হবে! কত দূরে?
কমলিকা বলল, খুব কাছে। গাড়িও লাগবে না।
কাকাবাবু সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নামতে গিয়ে ক্রাচ পিছলে পড়ে যাচ্ছিলেন প্রায়। কোনওরকমে দেওয়াল ধরে সামলে নিলেন।
বাড়ির বাইরে আসার পর কমলিকা বলল, আপনি আমাকে একবার গর্তটার মধ্যে ফেলে দিন। দেখবেন, আমি নিজে নিজে কী করে ঠিক উঠে আসব।
জোরে জোরে হাঁটতে হাঁটতে কাকাবাবু বললেন, ওই গর্তে কখনও বাঘ পড়েছিল?
কমলিকা বলল, বাবা বলেন, অনেকদিন আগে এদিকে বাঘ আসত। এখন আর আসে না। তবে, আমরা যখন কলকাতায় ছিলাম, দুমাস আগে একটা বাঘ এসে ওই ফাঁদে পড়েছিল, ছোটকাকা বলেছে। সে বাঘটাকে কিন্তু আর কেউ দেখেনি। ছোটকাকা নিজেই বাঘটাকে উদ্ধার করে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু জগোদাদা আমাদের চুপিচুপি বলেছে, মোটেই বাঘ ধরা পড়েনি, ওটা ছোটকাকা আমাদের বলেছে ভয় দেখানোর জন্য। জানেন, চোটকাকা বাঘের ডাক ডাকতে পারে?
কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি?
কমলিকা বলল, হ্যাঁ। একটা মাটির হাঁড়ির মধ্যে মুখ দিয়ে উম উম শব্দ করলে ঠিক বাঘের ডাকের মতন শোনায়। একবার ওইরকম ডেকে সবাইকে ভয় দেখিয়ে দিল।
কাকাবাবু বললেন, বাঃ, তোমার ছোটকাকার তো অনেক গুণ! ভাল থিয়েটারও করেন শুনেছি।
বাগানের দিকটা পার হয়ে বাঁ দিকে বেঁকবার সময় কমলিকা হঠাৎ থমকে দাড়াল।
তারপর মুখটা অন্ধকার করে বলল, সন্তু আর জোজোর সত্যি যদি কোনও বিপদ হয়, তা হলে আমাকে বকবেন না তো? আমি কিন্তু মজা করার জন্যই ওদের ফেলে দিয়েছিলাম।
কাকাবাবু বললন, না রাজকুমারী, তোমাকে বকব না। তবে, এরকম মজা করা উচিত নয়। আচমকা গর্তের মধ্যে পড়ে গেলে হাত-পা-ও ভাঙতে পারে।
কমলিকা বলল, না। তলাটা নরম। খুব নরম মাটি। আমি কতবার পড়েছি। আপনি ইচ্ছে করলে আমাকে ঠেলে ফেলে দিতে পারেন।
কাকাবাবু বললেন, না, আমি তোমাকে ঠেলে ফেলে দেব না। বিকেল প্রায় শেষ হয়ে আসছে। আকাশে জমেছে কালো মেঘ। আজ আবার বৃষ্টি হতে পারে। তাই এখন অসহ্য গুমোট। গাছের একটি পাতাও নড়ছে না।
রাজবাড়ির পিছন দিকে আসার পর আঙুল দেখিয়ে কমলিকা বলল, ওই দেখুন। সেই দুর্গ।
গাছের ফাঁক দিয়ে ভাঙা বাড়িটা দেখতে পেয়ে কাকাবাবু বললেন, এত কাছে?
তার কপাল কুঁচকে গেল। আপনমনে বললেন, এখানে বাঘ ধরার ফাঁদ?
কমলিকা বলল, আর-একটু কাছে চলুন দেখতে পাবেন।
আগের রাত্তিরের অত বৃষ্টির জন্য এখানকার মাটি কাদা কাদা হয়ে আছে, কাকাবাবুর ক্রাচ বসে যাচ্ছে।
ভাঙা দুৰ্গটা ঘুরে সেই বড় বড় গাছপালায় ঘেরা জায়গাটায় এসে পৌঁছোলেন ওঁরা। সেই গোল চাটাইটা একইভাবে পাতা আছে।
কমলিকা বলল, আমি সন্তু আর জোজোকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ওখানে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওই চাটাইটার উপর দাড়ালেই, ভুস! একেবারে নীচে চলে যাবে।
কাকাবাবু বললেন, চাটাইটা সুদ্ধ নীচে চলে যায়?
কমলিকা বলল, না, না, চাটাইটা একপাশে হেলে পড়ে যায়। তখন গড়িয়ে পড়ে যেতে হয়।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তারপর চাটাইটা কি একপাশে হেলেই থাকে? না কাউকে ঠিক করে দিতে হয়?
কমলিকা বলল, তা আমি জানি না। আগে তো গর্তটা এরকম ঢাকা থাকত না। গাছের ডালটাল থাকত। এখন যাতে কেউ ওখানে না পড়ে যায়, সেইজন্য ঢাকা দেওয়া থাকে।
কাকাবাবু আর-একটু এগোতেই কমলিকা বলল, সাবধান, সাবধান!
কাকাবাবু সেকথা না শুনে কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে এক টানে চাটাইটা সরিয়ে দিলেন।
গর্তের মুখটা চৌকো ধরনের।
ভিতরটা আবছা মতন, তলা পর্যন্ত দেখা যায় না।
কাকাবাবু বললেন, টর্চটা আনলে ভাল হত।
তারপর তিনি জোরে ডাকলেন, জোজো, সন্তু?
কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।
কমলিকা কিছু না বলে দৌড়ে এসে ঝাপ দিল গর্তটার মধ্যে।
তারপর তলা থেকে হাসতে হাসতে বলল, এই দেখুন কাকাবাবু, আমার পা ভাঙেনি, কিছুই হয়নি। সন্তু আর জোজো কিন্তু এখানে নেই।
কাকাবাবু বললেন, ওখানে কোনও দরজা কিংবা গর্তটর্ত আছে।
অন্যদিকে যাওয়ার জন্য?
কমলিকা বলল, না তো! কোনওদিনও ছিল না।
কাকাবাবু বললেন, তবু, ভাল করে হাত বুলিয়ে দ্যাখো তো?
কমলিকা বলল, এই তো দেখছি। না, আর কিছু নেই।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, তুমি এখন উঠবে কী করে? আমার একটা ক্রাচ ঝুলিয়ে দিচ্ছি, তাই ধরে ধরে উঠতে পারবে?
কমলিকা বলল, তার দরকার হবে না। দেখুন না!
একটু পরেই গর্তটার গা বেয়ে বেয়ে উঠে এল কমলিকা। প্রথমে দেখা গেল তার সুন্দর মুখোনি। খুশিতে ঝলমল করছে সেই মুখ।
বলল, সন্তু আর জোজো ওখানে নেই। তার মানে, ওদের কোনও বিপদ হয়নি! আমার কোনও দোষ নেই, দোষ নেই।
কাকাবাবু বললেন, তুমি এত সহজে উঠে এলে, ওরা তো পারবেই!
কমলিকা বলল, ছোট ছোট খাঁজ কাটা আছে। মানুষ উঠতে পারে, কোনও জন্তু-জানোয়ার পারবে না। অবশ্য বাবা বলেছেন, মানুষও একটা জন্তু, কিন্তু মানুষ দুটো হাত ব্যবহার করতে পারে। অন্য কোনও জন্তু তা পারে না।
কমলিকার সাদা শাড়িতে বেশ খানিকটা কাদা লেগে গেছে।
কাকাবাবু বললেন, এখান থেকে উঠে সন্তু-জোজোরা বাড়ি না ফিরে কোথায় গেল? নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে আছে।
কমলিকা বলল, কতক্ষণ আর লুকিয়ে থাকবে? খিদে পেলেই ফিরে আসবে সুড়সুড় করে।
কাকাবাবু বললেন, তুমি ওদের সঙ্গে মজা করার জন্য গর্তে ফেলে দিয়েছিলে, এবার ওরাও তোমার সঙ্গে মজা করার জন্য প্রতিশোধ নেবে। কী করবে কে জানে। তুমি সাবধানে থেকো।
কমলিকা অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, ওরা আমার কচু করবে! আমাকে বিপদে ফেলা অত সোজা নয়!