কপোট্রনিক ভবিষ্যৎ
বিকেলে আমার হঠাৎ করে মনে হল আজ আমার কোথায় জানি যাবার কথা। ভোরে বারবার করে নিজেকে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু এখন আর মনে করতে পারছি না। আমি একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম, তবে বিশেষ চিন্তিত হলাম না। আমি ঠিক জানি, আমার মস্তিষ্কও কপোট্রনের মতো পুরানো স্মৃতি হাতড়ে দেখতে শুরু করেছে, মনে করার চেষ্টা না করলেও ঠিক মনে হয়ে যাবে।
বৈকলিক চা খাওয়ার সময় আমার মনে পড়ল আজি সন্ধেয় একটি কপোট্রন প্ৰস্তুতকারক ফার্মে যাবার কথা। ডিরেক্টর ভদ্রলোক ফোন করে বলেছিলেন, তাঁরা কতকগুলি নিরীক্ষামূলক কপোট্রন তৈরি করেছেন, আমি দেখলে আনন্দ পাব। কিছুদিন আগে এই ডিরেক্টরের সাথে কোনো—এক বিষয়ে পরিচয় ও অল্প কিছু হয়েছিল। এখন মাঝে মাঝেই নৃতন রবোট তৈরি করলে আমাকে ফোন করে যাবার আমন্ত্রণ জানান।
ফার্মটি শহরের বাইরে, পৌঁছুতে একটু দেরি হয়ে গেল। লিফটে করে সাততলায় ডিরেক্টরের ঘরে হাজির হলাম। তিনি খানিকক্ষণ শিষ্টতামূলক আলাপ করে আমাকে তাঁদের রিসার্চ সেন্টারে নিয়ে গেলেন। ভেবেছিলাম। সদ্যপ্ৰস্তুত ঝকঝকে কতকগুলি রবোট দেখব, কিন্তু সেরকম কিছু না। বিরাট হলঘরের মতো ল্যাবরেটরিতে ছোট ছোট কালো টেবিলের উপর কাচের গোলকে কপোট্রন সাজিয়ে রাখা হয়েছে। একপাশে একটি প্রিন্টিং মেশিন, অপর পাশে মাইক্রোফোন, প্রশ্ন করলে উত্তর বলে দেবে কিংবা লিখে দেবে। দেয়ালে কিছু বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, চৌকোণা ট্রান্সফর্মার, দেখে মনে হল এখান থেকে উচ্চচাপের বৈদ্যুতিক প্রবাহ দেয়া হয়। কপোট্টনের সামনে লম্বাটে মাউথপীস। ঠিক একই রকম বেশ কয়টি কপোট্রন পাশাপাশি সাজানো। আমি জিজ্ঞাসু চোখে ডিরেক্টর ভদ্রলোকের দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, রবোটের শরীরের সাথে এখনও জুড়ে দিই নি,-দিতে হবেও না বোধহয়।
কেন?
এই কপোট্রনগুলি স্বাভাবিক নয়। সব কপোট্রনই কিছু কিছু যুক্তিতর্ক মেনে চলে। এগুলির সেরকম কিছু নেই।
মানে? ওরা তাহলে আবোল-তাবোল বকে?
অনেকটা সেরকমই। ভদ্রলোক হাসলেন। ওদের কল্পনাশক্তি অস্বাভাবিক। ঘোর অযৌক্তিক ব্যাপারও বিশ্বাস করে এবং সে নিয়ে রীতিমতো তর্ক করে।
এগুলি তৈরি করে লাভ? এ তো দেখছি উন্মাদ কপোট্রন।
তা, উন্মাদ বলতে পারেন। কিন্তু এদের দিয়ে কোনো লাভ হবে না জোর দিয়ে বলা যায় না। বলগা ছাড়া ভাবনা যদি না করা হত, পদার্থবিদ্যা কোনোদিন ক্লাসিক্যাল থেকে রিলেটিভিস্টিক স্তরে পৌঁছুত না।
তা বটে। আমি মাথা নাড়ুলাম। কিন্তু তাই বলে ইচ্ছে করে পাগল কপোট্রন তৈরি করবেন?
আপনি আলাপ করে দেখুন না, আর কোনো লাভ হোক কি না-হোক, নির্ভেজাল আনন্দ তো পাবেন।
আমি একটা কপোট্রনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কি হে?
নাম? নামের প্রয়োজন কী? ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য থাকলে নামের প্রয়োজন হয় না-যন্ত্রণা পিয়ে পরিচয় পাওয়া যায়। লাল নীল যন্ত্রণারা রক্তের ভিতর খেলা করতে থাকে….
সাহিত্যিক ধাঁচের মনে হচ্ছে? আমি ডিরেক্টর ভদ্রলোকের দিকে তাকোলাম।
হ্যাঁ। এটি সাহিত্যমান। একটা-কিছু জিজ্ঞেস করুন।
আমি কপোট্রনটিকে জিজ্ঞেস করলাম, যন্ত্রণারা আবার লাল নীল হয় কেমন করে?
যন্ত্রণারা সব রংয়ের হতে পারে, সব গন্ধের হতে পারে, এমনকি সবকিছুর মতো হতে পারে। যন্ত্রণার হাত-পা থাকে, চোখ থাকে-ফুরফুরে প্রজাপতির মতো পাখা থাকে। সেই পাখা নাড়িয়ে যন্ত্রণার আরো বড় যন্ত্রণায় উড়ে বেড়ায়। উড়ে উড়ে যখন ক্লান্তি নেমে আসে, তখন–
তখন?
তখন একটি একটি লাল ফুলের জন্ম হয়। সব নাইটিংগেল। তখন সবগুলো ফুলের কাঁটায় বুক লাগিয়ে রক্ত শুষে নেয়—লাল ফুল সাদা হয়ে যায়, সাদা ফুল লাল…
বেশ বেশী। আমি দ্রুত পাশের কপোট্রনের কাছে সরে এলাম।
এটিও কি ওটার মতো বদ্ধ পাগল?
না, এটা অনেক ভালো। এটি আবার বিজ্ঞানমনা। যুক্তিবিদ্যা ছাড়া তো বিজ্ঞান শেখানো যায় না, কাজেই এর অল্প কিছু যুক্তিবিদ্যা আছে। তবে আজগুবি আজগুবি সব ভাবনা এর মাথায় খেলতে থাকে।
আমি কপোট্রনটির পাশে দাঁড়ালাম। জিজ্ঞেস করলাম, বলতে পার বিজ্ঞান-সাধনা শেষ হবে কবে?
এই মুহূর্তে হতে পারে। একটু চেষ্টা করলেই।
আমি ডিরেক্টর ভদ্রলোকের দিকে তোকালাম, তবে না বলছিলেন এটা যুক্তিপূর্ণ কথা বলবে?
ওর বক্তব্যকে ব্যাখ্যা করতে বলুন দেখি।
আমি কপোট্রনটিকে বললাম, বিজ্ঞান-সাধনা শেষ হওয়া আমি দর্শন বা অন্য কোনো দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলি নি। আমি সাদা কথায় জানতে চাই বিজ্ঞান-সাধনা বা প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন কবে শেষ হবে?
বললাম তো, ইচ্ছে করলে এখনই।
কীভাবে?
ভবিষ্যতের শেষ সীমানা থেকে টাইম মেশিনে চড়ে কেউ যদি আজ এই অতীতে ফিরে আসে, আর তাদের জ্ঞান-সাধনার ফলাটুকু বলে দেয়, তা হলেই তো হয়ে যায়। আর কষ্ট করে জ্ঞান-সাধনা করতে হয় না।
আমি বোকার মতো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, কিন্তু আমরা কী করতে পারি? ভবিষ্যৎ থেকে কেউ যদি না আসে?
নিশ্চয়ই আসবে। কপোট্রনটি যুক্তিহীনভাবে চেঁচিয়ে উঠল। ভবিষ্যতের লোকেরা নিশ্চয়ই বর্তমান কালের জ্ঞানের দুরবস্থা অনুভব করবে। এর জন্যে কাউকে-না–কাউকে জ্ঞানের ফলসহ না পাঠিয়ে পারে না।
সেই আশায় কতকাল বসে থাকিব?
লক্ষ বছর বসে থেকেও লাভ নেই। অথচ পরিশ্রম করলে এক মাসেও লাভ হতে পারে।
কি রকম?
যারা ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে আসবে তারা তাদের কাল থেকে নিঃসময়ের রাজত্বে ঢুকবে নিজেদের যান্ত্রিক উৎকর্ষ দিয়ে, কিন্তু নিঃসময়ের রাজত্ব থেকে বর্তমানকালে পৌঁছুবে কীভাবে? কে তাদের সাহায্য করবে? পৃথিবী থেকে কেউ সাহায্য করলেই শুধুমাত্র সেটি সম্ভব।
তোমার কথা কিছু বুঝলাম না। নিঃসময়ের রাজত্ব কি?
নিঃসময় হচ্ছে সময়ের সেই মাত্রা, যেখানে সময়ের পরিবর্তন হয় না।
এসব কোথা থেকে বলিছ?
ভেবে ভেবে মন থেকে বলছি।
তাই হবে। এ ছাড়া এমন আষাঢ়ে গল্প সম্ভব।
আমি ডিরেক্টর ভদ্রলোককে বললাম, চলুন যাওয়া যাক। আপনার কপোট্রনদের সাথে চমৎকার সময় কাটল। কিন্তু যা-ই বলুন-আমি না বলে পারলাম না, এগুলি শুধু শুধু তৈরি করেছেন, কোনো কাজে লাগবে না।
আমারও তাই মনে হয়। তাঁকে চিন্তিত দেখায়, যুক্তিহীন ভাবনা দিয়ে লাভ নেই।
ফার্ম থেকে বাসায় ফেরার সময় নির্জন রাস্তায় গাড়িতে বসে বসে আমি কপোট্রনটির কথা ভেবে দেখলাম। সে যেসব কথা বলছে, তা অসম্ভব কল্পনাবিলাসী লোক ছাড়া বলা সম্ভব নয়। কিন্তু ব্যাপারটি কি শুধুই কল্পনাবিলাস? কথাগুলোর প্রমাণ নেই, কিন্তু যুক্তি কি একেবারেই নেই? আমি ভেবে দেখলাম, ভবিষ্যৎ থেকে কেউ এসে হাজির হলে মানবসভ্যতা এক ধাপে কত উপরে উঠে যেতে পারে। কিন্তু কপোট্রনের ঐ নিঃসময়ের রাজত্বটাজত্ব কথাগুলি একেবারে বাজে, শুধু কল্পনা করে কারো এরকম বলা উচিত না, তবে ব্যাপারটি কৌতূহলজনক। সত্যি সত্যি একটু ভেবে দেখলে হয়।
পরবর্তী কয়দিন যখন আমি অতীত, ভবিষ্যৎ, চতুর্মাত্রিক জগৎ, আপেক্ষিক তত্ত্ব ইত্যাদি নিয়ে পড়াশোনা করছিলাম, তখন মাঝে মাঝে আমার নিজেরই লজ্জা করত, একটি ক্ষ্যাপা কপোট্রনের কথা শুনে সময় নষ্ট করছি ভেবে। এ বিষয় নিয়ে কেন জানি আগে কেউ কোনোদিন গবেষণা করে নি। সময়ে পরিভ্রমণ সম্পর্কে আমি মাত্র একটি প্ৰবন্ধ পেলাম এবং সেটিও ভীষণ অসংবদ্ধ। বহু পরিশ্রম করে উন্নতশ্রেণীর কয়েকটি কম্পিউটারকে নানাভাবে জ্বালাতন করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌছানো গেল। সেগুলি হচ্ছে, প্রথমত উপযুক্ত পরিবেশে সময়ের অনুকূল কিংবা প্রতিকূলে যাত্রা করে ভবিষ্যৎ কিংবা অতীতে যাওয়া সম্ভব। দ্বিতীয়ত, সময়ের স্লোতে যাত্রার পূর্বমুহূর্তে ও শেষমূহুর্তে অচিন্তানীয় পরিমাণ শক্তিক্ষয়ের প্রয়োজন। সেই মুহুর্তে শক্তিক্ষয় নিয়ন্ত্রণ না করলে পুরো মাত্রা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, এবং তৃতীয়ত, যাত্রার পূর্ব ও শেষমূহুর্তের মধ্যবর্তী সময় স্থির সময়ের ক্ষেত্ৰ। এই ক্ষেত্রে পরিভ্রমণে কোনো শক্তির প্রয়োজন নেই।
আমি ভেবে দেখলাম, উন্মাদ কপোট্রনাটি যা বলেছিল, তার সাথে এই সিদ্ধান্তগুলির খুব বেশি একটা অমিল নেই। প্রথমবারের মতো কপোট্রনটির জন্য আমার একটু সভ্রমবোধের জন্ম হল।
এরপর আমার মাথায় ভয়ানক ভয়ানক সব পরিকল্পনা খেলা করতে লাগল। যেসব ভবিষ্যতের অভিযাত্রীরা অতীতে আসতে চাইছে আমি তাদের সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। নিঃসময়ের ক্ষেত্র থেকে বর্তমানে পৌঁছুতে যে-শক্তিক্ষয় হয় তা নিয়ন্ত্রণের যান্ত্রিক কলাকৌশল আমার মাথায় উঁকি দিতে লাগল। এই সময়-স্টেশনটি তৈরি করতে কী ধরনের রবোটের সাহায্য নেব মনে মনে স্থির করে নিলাম।
যে-উন্মাদ কপোট্রনটির প্ররোচনায় আমি এই কাজে নেমেছি, তার সাথে আবার দেখা করতে গিয়ে শুনলাম সেটিকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। যারা যুক্তিহীন ভাবনা ভালবাসে তারা নাকি প্রকৃত অর্থেই অপদার্থ। শুনে আমার একটু দুঃখ হল।
যেহেতু সময়ে পরিভ্রমণ বিজ্ঞানীদের দ্বারা স্বীকৃত নয় এবং এ বিষয়ে গবেষণার জন্য সরকারি সাহায্যের কোনো আশা নেই, সেহেতু আমি এই সময়–স্টেশনটি বাসাতেই স্থাপন করব ঠিক করলাম। যান্ত্রিক কাজে পারদশী দুটি রবোট নিয়ে এসে খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করলাম। পুরো পরিকল্পনা আমার নিজের চিন্তাপ্রসূত এবং ব্যাপারটি যে-কোনো বিষয় থেকে জটিল। কাজ শেষ হতে এক মাসের বেশি সময় লাগল। টোপন দিনরাত সব সময় স্টেশনের পাশে বসে থাকত। এটা দিয়ে ভবিষ্যতের মানুষের সাথে যোগাযোগ করা হবে শুনে সে অস্বাভাবিক কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। কোন সুইচটি কোন কাজে লাগবে এবং কোন লিভারটি কিসের জন্যে তৈরি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে তার কোনো ক্লান্তি ছিল না।
পরীক্ষামূলকভাবে যেদিন সময়-স্টেশনটি চালু করলাম, সেদিন টোপন আমার পাশে বসে। উত্তেজনায় সে ছটফট করছিল। তার ধারণা, এটি চালু করলেই ভবিষ্যতের মানুষেরা টুপটাপ করে হাজির হতে থাকবে।
একটা মৃদু গুঞ্জনধ্বনির সাথে সাথে দুটি লালবাতি বিপবিপি করে জ্বলতে লাগল। সামনে নীলাভ স্ত্রীনে আলোকতরঙ্গ বিচিত্রভাবে খেলা করছিল। আমি দুটি লিভার টেনে একটা সুইচ টিপে ধরলাম, একটা বিস্ফোরণের মতো আওয়াজ হল, এখন স্থির সময়ের ক্ষেত্রের সাথে এই জটিল সময়–স্টেশনটির যোগাযোগ হবার কথা। সেখানে কোনো টাইম মেশিন থাকলে বড় স্ক্রীনটাতে সংকেত পাব। কিন্তু কোথায় কি? বসে থাকতে থাকতে আমার বিরক্তি ধরে গেল, বড় স্ক্রীনটিতে এতটুকু সংকেতের লক্ষণ পাওয়া গেল না।
পাশে বসে থাকা টোপনকে লক্ষ করলাম। সে আকুল আগ্রহে স্ত্রীনের দিকে তাকিয়ে আছে, উত্তেজনায় বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। সে প্রতি মুহূর্তে আশা করছে এক্ষুণি একজন ভবিষ্যতের মানুষ লাফিয়ে নেমে আসবে। তাকে দেখে আমার মায়া হল, জিজ্ঞেস করলাম, কি রে টোপন, কেউ যে আসে না।
আসবে বাবা, আসবে। তাকে স্থিরপ্রতিজ্ঞ দেখাল।
কেউ যদি আসে, তা হলে তাকে তুই কী বলবি?
বলব, গুড মনিং। সে স্ক্রীন থেকে চোখ সরাল না, পাছে ভবিষ্যতের মানুষ সেই ফাঁকে স্ত্রীনে দেখা দিয়ে চলে যায়।
আচ্ছা বাবা, আমার যদি একটা টাইম মেশিন থাকে—
হুঁ।
তা হলে আমি অতীতে যেতে পারব?
কেন পারবি না। অতীত ভবিষ্যৎ সব জায়গায় যেতে পারবি।
অতীতে গিয়ে আমার ছেলেবেলাকে দেখব?
দেখবি।
আমি যখন হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতাম, তখনকার আমাকে দেখব?
দেখিবি।
আচ্ছা বাবা, অতীতে গিয়ে আমি যদি আমার হামা-দেয়া আমাকে মেরে ফেলি। তাহলে আমি এখন কোথেকে আসব?
আমি চুপ করে থাকলাম। সত্যিই তো। কেউ যদি অতীতে গিয়ে নিজেকে হত্যা করে আসে, তাহলে সে আসবে কোত্থেকে? অথচ সে আছে, কারণ সে নিজে হত্যা করেছে। এ কী করে সম্ভব? আমি ভেবে দেখলাম, এ কিছুতেই সম্ভব না।—কাজেই অতীতে ফেরাও সম্ভব না। টাইম মেশিনে করে ভবিষ্যতের মানুষ অতীতে ফিরে আসবে, এসব কল্পনাবিলাস। আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। একটি উন্মাদ কপোট্রনের প্ররোচনায় এতদিন শুধু শুধু পরিশ্রম করেছি, অকাতরে টাকা ব্যয় করেছি? রাগে দুঃখে আমার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হল। লিভার ঠেলে সুইচ টিপে আমি সময়স্টেশনটি বন্ধ করে দিলাম।
বাবা, বন্ধ করলে কেন? টোপন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
তোর প্রশ্ন শুনে। তুই যে-প্রশ্নটি করেছিস সেটি আমার আগে মনে হয় নি, তাই।
টোপন্ন কিছু না বুঝে বলল, কি প্রশ্ন?
ঐ যে তুই জিজ্ঞেস করলি, অতীতে নিজেকে মেরে ফেললে পরে কোথেকে আসব? তাই অতীতে যাওয়া সম্ভব না, টাইম মেশিন তৈরি সম্ভব না–
টোপনের চোখে পানি টলমল করে উঠল। মনে হল এই প্রশ্নটি করে আমাকে নিরুৎসাহিত করে দিয়েছে বলে নিজের উপর ক্ষেপে উঠেছে। আমাকে অনুনয় করে বলল, আর একটু থাক না বাবা।
থেকে কোনো লাভ নেই। আয় যাই, অনেক রাত হয়েছে।
টোপন বিষণ্ণমুখে আমার পিছনে পিছনে আসতে লাগল। আমি বুঝতে পারলাম সময়ে পরিভ্রমণের উপরে কেন এতদিন কোনো কাজ হয় নি। সবাই জানত এটি অসম্ভব। ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে এলে অতীত পরিবর্তিত হয়ে যায়, কিন্তু বাস্তব জগতের পরিবর্তন—তা অতীতই হোক আর ভবিষ্যৎই হোক, কোনো দিনই সম্ভব নয়। আমি প্রথমে উন্মাদ কপোট্রনটির উপর, পরে নিজের উপর ক্ষেপে উঠলাম। কম্পিউটারগুলিকে কেন যে বাস্তব সম্ভাবনার কথা জিজ্ঞেস করি নি, ভেবে অনুতাপ হল। কিন্তু তাতে লাভ কী আমার, এই অযথা পরিশ্রম আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।
টোপন কিন্তু হাল ছাড়ল না। প্রতিদিন আমাকে অনুনয়-বিনয় করে সময়স্টেশনটি চালু করতে বলত। তাকে কোনো যুক্তি দিয়ে বোঝানো গেল না যে, কোনোদিনই ভবিষ্যতের মানুষ অতীতে আসবে না,-এটি একটি অসম্ভব ব্যাপার। তার অনুনয়-বিনয় শুনতে শুনতে আমাকে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হল। আমি আবার সময়-স্টেশনটি চালু করলাম। টোপনকে সুইচপ্যানেলের সামনে বসিয়ে দিয়ে আমি চলে এলাম। আসার সময় সাবধান করে দিলাম, কোনো সুইচে যেন ভুলেও চাপ না দেয়। শুধু বড় স্ক্রীনটার দিকে যেন নজর রাখে। যদি কিছু দেখতে পায় (দেখবে না জানি) তবে আমাকে যেন খবর দেয়।
এই জটিল ও মূল্যবান যন্ত্রটি সাত বছরের একটি ছেলের দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ে চলে আসতে আমার কোনো দ্বিধা হয় নি। আমি জানি, বাচ্চা ছেলেদের ছেলেবেলা থেকে সত্যিকার দায়িত্ব পালন করতে দিলে তারা সেগুলি মন দিয়ে পালন করে, আর পরে খাঁটি মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। টোপনের সাথে আগেও আমি বেশ গুরুত্ব দিয়ে কথা বলতাম, প্রায় বিষয়েই আমি ওর সাথে এমনভাবে পরামর্শ করেছি, যেন সে একটি বয়স্ক মানুষ। এই সময়-স্টেশনটি তৈরি করার সময়েও কোন লিভারটি কোথায় বসালে ভালো হবে, তার সাথে আলাপ করে দেখেছি।
সারাদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে কাটিয়ে সন্ধেয় বাসায় ফিরে আসতেই বুলা আমাকে বলল, টোপন সারা দিন নাওয়া-খাওয়া করে নি। একমনে সময়স্টেশনের সামনে বসে আছে। আমি হেসে বললাম, একদিন নাওয়া-খাওয়া না করলে কিছু হয় না।
তুমি তো তাই বলবে! বুলা উষ্ণ হয়ে বলল, নিজে যেরকম হয়েছ, ছেলেটিকেও সেরকম তৈরি করছিা!
বেশ, বেশ, টোপনকে খেতে পাঠিয়ে দিচ্ছি, বলে আমি সময়— স্টেশনটিতে হাজির হলাম। অতিকায় যন্ত্রপাতির ভিতরে সুইচ প্যানেলের সামনে ছোট্ট টোপন গভীর মুখে বড় স্ক্রীনটার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। আমি পিছনে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রাখলাম। সে চমকে উঠে বলল, কে?
আমি। কি রে, কিছু দেখলি?
এখনও দেখি নি। তবে ঠিক দেখব। সারা দিন না খেয়ে ওর মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে।
যা, এখন খেয়ে আয়। ততক্ষণ আমি বসি।
তুমি বসবে? টোপন কৌতূহলী চোখে আমার দিকে তাকাল। আমি যাব। আর আসব, একছুটে—
একছুটে যেতে হবে না। ধীরেসুস্থে খেয়েদেয়ে আয়। সারা দিনরাত তো আর এখানে বসে থাকতে পারবি না! ঘুমোতে হবে, পড়তে হবে, স্কুলে যেতে হবে, খেলাধুলা করতে হবে।
কয়দিন খেলাধুলা করব না, স্কুল থেকে এসেই এখানে বসব। তারপর পড়া শেষ করে—
বেশ বেশ।
তুমি নাহয় আমাকে শিখিয়ে দিও কীভাবে এটি চালু করতে হয়। তা হলে তোমাকে বিরক্ত করব না।
আচ্ছা আচ্ছা, তাই দেব। এখন খেয়ে আয়।
শেষ পর্যন্ত পুরো সময়-স্টেশনটি টোপনের খেলার সামগ্ৰী হয়ে দাঁড়াল। সে সময় পেলেই নিজের এসে চালু করে চুপচাপ বসে থাকত, আর যাবার সময় বন্ধ করে চলে যেত। আমি মাঝে মাঝে এসে দেখে যেতাম। টোপনকে জিজ্ঞেস করতাম, কি রে, কিছু দেখলি?
এখনও দেখি নি, তবে ঠিক দেখব। এরই নাম বিশ্বাস। আমি মনে মনে হাসাঁতাম এরপর বহুদিন কেটে গেছে। আমি সময়-স্টেশনটির কথা ভূলেই গেছি। মাঝে মাঝে টোপন এসে আমাকে নিয়ে যেত যন্ত্রপাতি ঠিক আছে কি না পরীক্ষা করে দেখার জন্যে। খুঁটিনাটি ভুলের জন্যে ভবিষ্যতের মানুষ হাতছাড়া হয়ে গেলে তার দুঃখের সীমা থাকবে না।
সেদিন দুপুরে আমি সবে এক কাপ কফি খেয়ে কতকগুলি কাগজপত্র দেখছি, এমন সময় ঝনঝনি করে ফোন বেজে উঠল। সহকারী মেয়েটি ফোন ধরে রিসিভারটি আমার দিকে এগিয়ে দিল, আপনার ছেলের ফোন।
আমি রিসিভারে কান পাততেই টোপনের চিৎকার শুনলা, বাবা, এসেছে, এসেছে—এসে গেছে!
কে এসেছে?
ভবিষ্যতের মানুষ! তুমি তাড়াতাড়ি চলে এস।
ব্যাপারটা বুঝতে আমার সময় লাগল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি রকম মানুষ?
এখনও দেখি নি। বড় ক্ৰীনটায় এখন শুধু আলোর দাগ দেখা যাচ্ছে। প্রথমে লম্বা লম্বা থাকে, পরে হঠাৎ ঢেউয়ের মতো হয়ে যায়। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এস।
সত্যি বলছিস তো? টোপন মিথ্যা বলে না জেনেও জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, ঠিক দেখেছিস তো?
তুমি এসে দেখে যাও, মিথ্যা বলছি না কি। টোপনের গলার স্বর কাদো কাঁদে হয়ে যায়, এতক্ষণে চলেই গেল নাকি!
আমি সহকারী মেয়েটিকে বললাম, জরুরি কাজে চলে যাচ্ছি, বাসায় কেউ যেন বিরক্ত না করে। তারপর লিফুট বেয়ে নেমে এলাম।
বাসা বেশি দূরে নয়, পৌঁছুতে বেশি সময় লাগল না। টোপন আমার জন্যে বাসার গেটে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখেই পুরো ঘটনাটা হড়বড় করে দু বার বলে গেল। আমি তাকে নিয়ে সময়—স্টেশনে ঢুকে দেখি বড় স্ক্রীনটা সত্যি সত্যি আলোকতরঙ্গে ভরে যাচ্ছে। এটি হচ্ছে স্থির সময়ের ক্ষেত্রে পার্থিব বস্তুর উপস্থিতির সংকেত। আমার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। আমার সামনে সম্পূর্ণ অসম্ভব একটি ঘটনা ঘটতে চলেছে।
এখন আমার অনেক কাজ বাকি। সাহায্য করার কেউ নেই, টোপনকে নিয়েই কাজ শুরু করতে হল। প্রথমে দুটো বড় বড় জেনারেটর চালু করলাম—গুমগুমা শব্দে ট্রান্সফর্মারগুলি কোঁপে উঠল। ঝিলিক ঝিলিক করে দুটো নীল আলো ঘুরে ঘুরে যেতে লাগল। বিভিন্ন মিটারের কাঁটা কোপে কোঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল। লিভারের চাপ দিতেই সামনে অনেকটুকু জায়গায় শক্তিশালী চৌম্বকীয় ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গেল। দীর্ঘদিনের জমে ওঠা ধুলাবালি আয়নিত হয়ে কাপনের সাথে সেখানে একটা ঘূর্ণির সৃষ্টি করল, এগুলি আর পরিষ্কার করার উপায় নেই।
তারপর সবদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সুইচ প্যানেলের সামনে বসে পড়লাম, কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কে জানে?
রাত দুটো বাজার পরও কিছু হল না। আমি সব রকম প্রস্তুতি শেষ করে বসে আছি। এখন ঐ ভবিষ্যতের যাত্রী নেমে আসতে চাইলেই হয়। এক সময় লক্ষ করলাম, টোপন টুলে বসে সুইচ প্যানেলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। সারা দিনের উত্তেজনা ওকে দুর্বল করে ফেলেছে, নইলে ও এত সহজে ঘুমোবার পাত্র নয়। ওকে জাগিয়ে দিতেই ধড়মড় করে উঠে বলল, এসেছে?
এখনো আসে নি, দেরি হতে পারে। তুই ঘরে গিয়ে ঘুমে। এলেই খবর দেব।
না না—টোপন প্রবল আপত্তি জানাল, আমি এখানেই থাকব।
বেশ, থাক তাহলে। তোর ঘুম পাচ্ছে দেখে বলছিলাম।
একটু পরে ঘুমে বারকয়েক ঢুলে পড়ে টোপন নিজেই বলল, বাবা, খুব বেশি দেরি হবে? তা হলে আমি না হয় একটু শুয়ে আসি, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ওরা আসতেই ভূমি আমাকে খবর দিও।
ঠিক আছে। পুরো কৃতিত্বটাই তো তোর—তোকে খবর না দিয়ে পারি?
টোপন খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে চলে গেল।
বসে সিগারেট খেতে খেতে বোধহয় একটু তন্দ্ৰামতো এসেছিল। প্রচণ্ড শব্দ শুনে লাফিয়ে উঠলাম। হঠাৎ করে, কিছু বোঝার আগে খালি জায়গায় অতিকায় চ্যাপটামতো ধূসর কী-একটা নেমেছে। ঘরে ঢোকার জন্যে ছোট ছোট দরজা, অথচ এটি কীভাবে ভিতরে চলে এসেছে ভেবে ধাঁধা লেগে যাবার কথা। ভীষণ ধুলাঝালি উড়ছে, রনোমিটার কঁ কঁ শব্দ করে বিপদসংকেত দিচ্ছে, আমি তীব্র রেডিয়েশন অনুভব করে ছুটে একপাশে সরে এলাম। একা এতগুলো সুইচ সামলানো কঠিন ব্যাপার। টাইম মেশিনকে স্থির করতে আমার কালো ঘাম ছুটে গেল।
একটু পরে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, জিনিসটা হোভার ক্র্যাফটের মতো দেখতে, অতিকায়। পিছনের দিকটা চৌকোণা হয়ে গেছে। মাথা চ্যাপটা, তাতে দুটো বড় বড় ফুটো-ভিতরে লাল আলো ঘুরছে। টাইম মেশিনটির মাঝামাঝি জায়গায় খানিকটা অংশ কালো রংয়ের, আমার মনে হল এটিই বোধহয় দরজা ঠিক তক্ষুণি খানিকটা গোল অংশ সরে গিয়ে একটা গর্ত বেরিয়ে পড়ল। উত্তেজনায আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল, আমি আমার হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনতে পেলাম, এক্ষুণি ভবিষ্যতের মানুষ নামবে।
আমার চোখের সামনে ধীরে ধীরে একজন নেমে এল, ভেবেছিলাম স্পেসসুন্টজাতীয় কিছু গায়ে মানুষ, কাছে আসার পর বুঝতে পারলাম। ওটি একটি রবোট। রবোট হেঁটে আমার সামনে এসে দাঁড়াল, তারপর মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, আমার হিসেব ভুল না হলে আপনি আমার কথা বুঝতে পারবেন।
হ্যাঁ, পারছি। আমি রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে নিলাম। সুদূর অতীতের অধিবাসী আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে।
সুদূর ভবিষ্যতের অধিবাসীও প্রত্যুত্তরে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। আমি জীবনে প্রথম একটি রবোটকে হাসতে দেখলাম। কিন্তু তার কথাটি আমার কানে খট করে আঘাত করল। সুদূর ভবিষ্যতের অধিবাসী মানে? তাহলে কি ভবিষ্যতে রবোটরাই পৃথিবীর অধিবাসী?
আমাকে অবতরণ করতে সাহায্য করেছেন বলে ধন্যবাদ। রবোটটির চোখ কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল। তবুও যথেষ্ট ধকল গিয়েছে। একটা ফ্লিচিং বার্ড ছিঁড়ে গেছে।
আমি কী করতে পারি? হাত উল্টিয়ে বললাম, এই শতাব্দীতে যান্ত্রিক উৎকর্ষের ভিতরে যতটুকু সম্ভব—
সে তো বটেই, সে তো বটেই। রবোটটি ব্যস্ত হয়ে বলল, আমরা এতটুকুও আশা করিনি।
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রবোটটির গঠননৈপুণ্য, কথা বলার ভঙ্গি, ক্ষণে ক্ষুণে বদলে যাওয়া চোখের দৃষ্টি, মুখের ভাব লক্ষ করছিলাম। যান্ত্রিক উৎকর্ষ কত নিখুঁত হলে এরকম একটি রবোট তৈরি করা সম্ভব, চিন্তা করতে গিয়ে কোনো কুল পেলাম না। একটি মানুষের সাথে এর কোনো পার্থক্য নেই। খুব অস্বস্তির সাথে মনে হল, হয়তো কোনো কোনো দিকে এটি মানুষের থেকেও নিখুঁত। কিন্তু আমি বিস্ময় ইত্যাদি ঝেড়ে ফেলে কাজের কথা সেরে নিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। রবোটটিকে বললাম, আপনি ভবিষ্যৎ থেকে এসেছেন। সবকিছুর আগে আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দিন।
নিশ্চয়ই। কিন্তু আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। আপনাদের পৃথিবীর হিসেবে এক ঘন্টা পরে এই টাইম মেশিন নিজে থেকে চালু হয়ে উঠে আমাকে নিয়ে আরো অতীতে চলে যাবে।
এক ঘন্টা অনেক সময়, তার তুলনায় আমার প্রশ্ন বেশি নেই। আমি মনে মনে প্রশ্নগুলি গুছিয়ে নিয়ে বললাম, কেউ অতীতে ফিরে এলে অতীত পরিবর্তিত হয়ে যায়। এটি কী করে সম্ভব?
অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন—
যেমন আপনি আজ থেকে কয়েক হাজার বছর পরে সৃষ্টি হবেন, আপনার অতীতের আপনি সেই, কারণ এখনও আপনি সৃষ্টি হন নি। কিন্তু যেই মুহূর্তে আপনি অতীতে আসবেন, তৎক্ষণাৎ আগের অতীতের সাথে পার্থক্য সৃষ্টি হবে—অতীতটা পরিবর্তিত হয়ে যাবে। এটা কী করে সম্ভব?
রবোটটি অসহিষ্ণু মানুষের মতো কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, আপনি এই সহজ জিনিসটা বুঝতে পারছেন না? অতীত ফিরে এলে তো সে অতীত আর আগের থাকে না, নতুন অতীতের সৃষ্টি হয়।
মানে? অতীত কয়টা হতে পারে?
বহু। এখানেই আপনারা ভুল করছেন। শুধু অতীত নয়, জীবনও বহু হতে পারে। আপনি ভাবছেন আপনার জীবনটাই সত্য, কিন্তু আমার অতীতে আপনার যে অস্তিত্ব ছিল, তাতেও আপনার অন্য এক অস্তিত্ব তার জীবনটাকে সত্যি ভেবেছিল। এই মুহূর্তেও আপনার অনেক অস্তিত্ব বিদ্যমান, আপনার চোখে সেগুলো বাস্তব নয়, কারণ আপনি সময়ের সাথে সাথে সেই অস্তিত্ত্বে প্রবাহিত হচ্ছেন না। অথচ তারা ভাবছে তাদের অস্তিত্বটাই বাস্তব, অন্য সব অস্তিত্ব কাল্পনিক।
মানে? আমার সবকিছু গুলিয়ে গেল। আপনার কথা সত্যি হলে আমার আরো অস্তিত্ব আছে?
শুধু আপনার নয়, প্রত্যেকের, প্রত্যেকটি জিনিসের অসীমসংখ্যক অস্তিত্ব। আপনারা আমরা সবাই সময়ের সাথে সাথে এক অস্তিত্ব থেকে অন্য অস্তিত্বে প্রবাহিত হই। যে—অস্তিত্বে আমরা প্রবাহিত হই সেটিকেই সত্য বলে জানি—তার মানে এই নয় অন্যগুলি কাল্পনিক।
তা হলে ব্যাপারটি দাঁড়াচ্ছে এরকম। আমি একটু চিন্তা করে নিলাম। পৃথিবী সৃষ্টি হল, মানুষের জন্ম হল, সভ্যতা গড়ে উঠল, একসময় আমার জন্ম হল। আমি বড় হলাম, একসময়ে মারা গেলাম। তারপর অনেক হাজার বছর পার হল, তখন আপনি সৃষ্টি হলেন। আপনি অতীতে ফিরে এলেন আবার আমার কাছে। আবার আমি বড় হব, মারা যাব, কিন্তু সেটি আগের আমি না-সেটি আমার আগের জীবন না, কারণ আগের জীবনে আপনাকে আমি দেখি নি।
ঠিক বলেছেন। এইটি নতুন অস্তিত্বে প্রবাহ। আপনার পাশাপাশি আরো অনেক জীবন এভাবে বয়ে যাচ্ছে, সেগুলি আপনি দেখবেন না, বুঝবেন না—
কেন দেখব না?
দুই সমতলে দুটি সরল রেখার কোনোদিন দেখা হয় না, আর এটি তো ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্বের প্রশ্ন।
আমি মাথার চুল খামচে ধরলাম। কী ভয়ানক কথা! এই পৃথিবী, জীবনপ্রবাহ, সভ্যতাকে কী সহজ ভাবতাম। অথচ এর নাকি হাজার হাজার রূপ আছে, সবাই নিজেদের সত্যি বলে ভাবছে। আমি কাতর গলায় বললাম, এইসব হাজার হাজার অস্তিত্ব ঝামেলা করে না? একটা আরেকটার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে—
হতে পারে। আমরা মাথা ঘামাই না। আমরা আমাদের জীবনপ্রবাহটিকে ঠিক রাখতে চাই। এ-ব্যাপারে অন্য কোনো অস্তিত্ব ঝামেলা করলে আমরা তাদের জীবনপ্রবাহ বদলে অন্যরকম করে ফেলি, এর বেশি কিছু না।
বুঝতে পারলাম না।
যেমন ধরুন আপনাদের জীবনপ্রবাহটি, এটির ভবিষ্যৎ খুব সুবিধের নয়। আমরা যেরকম খুব সহজে মানুষকে পরাজিত করে জ্ঞানবিজ্ঞানের সাধনা, পৃথিবীর কতৃত্ব আমাদের হাতে নিয়ে নিয়েছি, আপনাদের ভবিষ্যতে রবোটরা তা পারত না, আমি যদি এখানে না। আসতাম। আপনাদের ভবিষ্যতের মানুষদের আমাদের অস্তিত্বে হামলা করে মানুষের পক্ষ থেকে রবোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কথা। আমরা সেটি চাই না, তাই এটা পরিবর্তিত করতে চাইছি।
কীভাবে?
এই যে আপনার কাছে চলে এলাম-এতে এই অতীতটি পরিবর্তিত হয়ে নুতন দিকে চলছে। আমরা দেখে এসেছি, এখন খুব তাড়াতাড়ি রবোটরা আপনাদের পরাজিত করে ক্ষমতা নিয়ে নেবে। জ্ঞানবিজ্ঞান সাধনায় আর কোনো অন্তরায় থাকবে না।
আমি চুপ করে রইলাম।
তারপর ধরুন জীবনসৃষ্টির ব্যাপারটা। আমার অতীতে যাওয়ার প্রথম কারণই তো এইটি।
কি-রকম?
আমাদের প্রত্নতত্ত্ববিদরা পৃথিবীর এক আদিম গুহায় কয়েক শত কোটি বছর আপুকুর একটি আশ্চর্য জিনিস পেয়েছিলেন
আমাকে পেয়েছিলেন। এই টাইম মেশিনে বসে আছি, অবশ্যি বিধ্বস্ত অবস্থায়।
মানে?
হ্যাঁ, আমার কপোট্রন বিশ্লেষণ করে দেখা গেল। আমি কতকগুলি এককোষী প্রাণী নিয়ে গিয়েছিলাম।
কেন?
পৃথিবীতে প্ৰাণ সৃষ্টি করতে। পৃথিবী সৃষ্টির পরে এখানে প্রাণের জন্ম সম্বন্ধে আপনারা যা ভাবছেন, তা সত্যি নয়। মহাকাশ থেকে জটিল জৈবিক অণু থেকে নয়, মাটি পানির ক্রমাগত ঘর্ষণে স্বাভাবিক উপায়ে নয়, ঈশ্বরের কৃপাতেও নয়, আমিই অতীত প্ৰাণ নিয়ে গিয়েছি। শুদ্ধ করে বললে বলতে হয়, প্ৰাণ নিয়ে যাচ্ছি।
মানে? আপনি বলতে চান সুদূর অতীতে এই এককোষী প্রাণী ছড়িয়ে দিলে পরেই প্রাণের জন্ম হবে, ক্রমবিবর্তনে গাছপালা, ডাইনোসর, বাঘ-ভালুক, মানুষ এসবের জন্ম হবে না?
ঠিক ধরেছেন।
কিন্তু যদি আপনি ব্যর্থ হন? আমি কঠোর গলায় বললাম, যদি আপনি অতীতে এককোষী প্ৰাণী নিয়ে প্রাণের সৃষ্টি করতে না পারেন তাহলে কি এই জীবন, সভ্যতা কিছুই সৃষ্টি হবে না?
ব্যৰ্থ হওয়া সম্ভব নয়, যেহেতু আমাকে কয়েক শত কোটি বছর আগে পাওয়া গেছে, কাজেই আমি ব্যর্থ হলেও আমার অন্য কোনো অস্তিত্ব নিশ্চয়ই অতীতে প্ৰাণ রেখে আসবে। তবে তার প্রয়োজন হবে না। আমার ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা নেই। আমি পুরো অতীত পর্যবেক্ষণ করে দেখছি।
কিন্তু তবু যদি আপনি ব্যর্থ হন?
বললাম তো হব না। আমি আমার পুরো যাত্রাপথ ছকে এসেছি।
কিন্তু যদি তবুও কোনোভাবে ব্যর্থ হন? আমি একগুয়ের মতো বললাম, কোনো দুৰ্ঘটনায় যদি আপনার মৃত্যু হয়? কিংবা আপনার টাইম মেশিন যদি ধ্বংস হয়?
তা হলে বুঝতে হবে আমি অন্য এক জগতে ভুলে নেমে পড়েছি।
সেটির ভবিষ্যৎ কি?
কে বলতে পারে। তবে-রবোটটি মনে মনে কী হিসেবে করল, তারপর বলল, যদি আমি কোনো জগতে নামার দরুন অতীতে ফিরে যেতে ব্যর্থ হই, তবে সেজগতের ভবিষ্যৎ খুব খারাপ, এখনও মানুষ খুঁকঠুক করে জ্ঞানসাধনা করছে। রবোটটি হা-হা করে হাসল, বলল, হয়তো আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে একেবারে গোড়া থেকে সভ্যতা সৃষ্টি করছে। রবোটটি আবার দুলে দুলে হেসে উঠল। মানুষের প্রতি এর অবজ্ঞা প্রায় নিষ্ঠুরতার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, কিন্তু সে নিজে এটি বুঝতে পারছে না।
আমি অনেক কষ্ট করে শান্ত থাকলাম। তারপর মৃদুস্বরে বললাম, আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম।
আরো আলাপ করার ইচ্ছে ছিল, রবোটটি বলল, কিন্তু এই টাইম মেশিনটি একটু পরে নিজে থেকে চালু হয়ে উঠবে। আর সময় নেই।
এক সেকেণ্ড। আমার টোপনের কথা মনে হল। বললাম, আমার ছেলে ভবিষ্যতের অধিবাসী দেখতে ভীষণ আগ্রহী। শুর আগ্রহেই আপনার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে-ওকে একটু ডেকে আনি।
বেশ, বেশ। তবে একটু তাড়াতাড়ি করুন। বুঝতেই পারছেন–
আমি টোপনের ঘরে যাওয়ার আগে নিজের ঘরে গেলাম, একটি জিনিস নিতে হবে। বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হল না, ড়ুয়ারে ছিল। সেটি শার্টের তলায় গুঁজে টোপনকে ডেকে তুললাম, টোপন, ওঠ, ভবিষ্যতের মানুষ এসেছে।
এসেছে বাবা? এসেছে? কেমন দেখতে?
দেখলেই বুঝতে পারবি, আয় আমার সাথে। আমি ওকে নিয়ে দ্রুত স্টেশনে হাজির হলাম। রবোটটি সুইচ প্যানেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওটিকে দেখে টোপন অবাক হয়ে বলল, মানুষ কই, এটি তো রবোট!
ভবিষ্যতের মানুষ রবোটই হয়! আমি দাঁতে দাঁত চেপে হাসলাম। টোপন বিমর্ষ হয়ে আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল, কথা বলার উৎসাহ পেল না। রবোটটি একটু অপ্ৰস্তুত হল মনে হল। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, এবারে বিদায় নিই, আমি অনেক বড় দায়িত্ব নিয়ে এসেছি।
বেশ। আমি হাত নাড়লাম, আবার দেখা হবে।
রবোটটি তার টাইম মেশিনের দরজায় উঠে দাঁড়াল। বিদায় নিয়ে হাত নেড়ে ওটি ঘুরে দাঁড়াল।
টোপন—আমি চিবিয়ে কললাম, চোখ বন্ধ করা। না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবি না।
কেন বাবা?
কাজ আছে, বন্ধ করা চোখ। টোপন চোখ বন্ধ করল। আমি শার্টের তলা থেকে একটু আগে নিয়ে আসা রিভলবারটি বের করলাম। রবোটটি শেষ করে দিতে হবে। আমার বংশধরের ভবিষ্যৎ এই রবোটদের পদানত হতে দেয়া যাবে না। এটিকে শেষ করে দিলেই পুরো ভবিষ্যৎ পাল্টে যাবে।
রিভলবারটি তুলে ধরলাম। একসময় ভালো হাতের টিপ ছিল। হে মহাকাল, একটিবার সেই টিপ ফিরিয়ে দাও। মনুষ্যত্বের দোহাই, পৃথিবীর দোহাই, একটি ধার হাতের নিশানা ঠিক করে দাও, … একটিবার…
আমি রবোটের কপোট্রন লক্ষ্য করে গুলি করলাম, প্রচণ্ড শব্দ হল। টোপন চিৎকার করে আমাকে জড়িয়ে ধরল, আর রবোটটির চূৰ্ণ কপোট্রন টুকরো টুকরো হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। খুব ধীরে ধীরে রবোটটি কান্ত হয়ে টাইম মেশিনের ভিতর পড়ে গেল।
খানিকক্ষণ থেকেই একটা ভোঁতা শব্দ হচ্ছিল, এবার সেটা তীক্ষ্ণ সাইরেনের আওয়াজের মতো হল। সাৎ করে হঠাৎ দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে কানে তালা লাগানো শব্দে চারদিক কেঁপে উঠল, তারপর কিছু বোঝার আগে ধূসর টাইম মেশিন অদৃশ্য হয়ে গেল। শূন্য জায়গাটা দেখে কে বলবে এখানে কখনো কিছু এসেছিল!
চোখ খোল টোপন। টোপন চোখ খুলে চারদিক দেখল। তারপর, আমার দিকে তাকাল, কী হয়েছে। বাবা?
কিছু না।
রবোট কই? টাইম মেশিন কই?
চলে গেছে।
আর আসবে না?
না। আর আসবে না। যদি আসে মানুষ আসবে।
কবে?
আজ হোক কাল হোক, আসবেই একদিন। মানুষ না এসে পারে?