এরপর তিনদিন কেটে গিয়েছে। কাকাবাবুদের এবার কলকাতায় ফিরতে হবে।
এর মধ্যে ছেলেটার অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। আরও দু-তিনবার পালাবার চেষ্টা করেছে বটে। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারেনি। এখন ওর একটা হাত দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা, সেই দড়ির আর-একটা দিক বাঁধা সন্তুর বাঁ হাতে। সেই দড়ির গিঁট খোলার ক্ষমতা ওর নেই। রাত্তিরেও ওই অবস্থায় শুয়ে থাকে সন্তুর পাশে। দড়িতে টান পড়লেই জেগে ওঠে সন্তু।
দ্বিতীয় দিনেই দু-তিনজন মিলে ওকে জোর করে চেপে ধরেছিল, সন্তু কেটে দিয়েছে ওর হাত-পায়ের লোম। মাথার চুলও হেঁটে দেওয়া হয়েছে। খানিকটা।
তারপর ওকে চান করানো হয়েছে।
আশ্চর্যের ব্যাপার, চান করাবার সময় কিন্তু ও মোটেই আপত্তি করেনি। শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে লাফালাফি করেছে অনেকক্ষণ। মনে হয়, আগে দুএকবার ও কোনও ঝরনার জলে মাথা ভিজিয়েছে।
ওর নিজের সাইজের দুসেট প্যান্ট-শার্ট কিনে আনা হয়েছে। সেই সব পরিয়ে, মাথার চুল আঁচড়ে দিলে ওকে ভালই দেখায়। মুখোনা সুন্দর।
কিন্তু এখনও কোনও কথা বলে না। মাঝে মাঝে বাঘের মতো গরগর শব্দ করে। সেরকম শব্দ করলেই জোজো ওকে কাতুকুতু দিয়ে হাসায়।
এদিককার অনেক কাগজে ওর খবর আর ফোটো ছাপা হয়েছে। কেউ ওর। নাম দিয়েছে টাইগার বয়, কেউ বলেছে নয়া মুগলি, কেউ বলেছে বাচ্চা টারজান। খবরের কাগজের লোকেরা বানিয়ে বানিয়ে অনেক গল্পও লিখেছে ওর নামে। ও নাকি এক গাছের ডগা থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে চলে যেতে পারে, জ্যান্ত ইঁদুর আর খরগোশ ধরে কামড়ে কামড়ে খায়, ওর সারা মুখ রক্তে মাখামাখি হয়ে থাকে। অবিকল বাঘের মতো ডাকতে পারে।
সেসব কিছু না।
সে মোটেই কঁচা মাংস খায় না। একদম ঝাল-মশলা না-দেওয়া রান্না করা মাংস খেতে শিখেছে। ভাত খায় না, কিন্তু রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে শুধু শুধু খায়। কলা খায়। তার সবচেয়ে প্রিয় খাবার আইসক্রিম। একটা আইসক্রিম খেয়েই আর-একটার জন্য হাত বাড়ায়।
এখনও কেউ তার বাবা কিংবা মা কিংবা আত্মীয় বলে দাবি করেনি।
বাঘিনিটাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ভোপালে। ঘুম ভাঙার পর সে কিছুক্ষণ খুব জোরে ডাকাডাকি করেছিল। নিশ্চয়ই খুঁজছিল ছেলেটাকে,
তারপর ঝিমিয়ে পড়েছে। সব সময় ঘুম ঘুম ভাব।
প্রথমে ঠিক হয়েছিল, বাঘিনিটাকে দূরের কোনও জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হবে। বনের প্রাণী বনেই থাকবে।
কিন্তু বনবিভাগের বড় বড় অফিসার ওকে পরীক্ষা করে দেখে বলেছেন যে, বাঘিনিটা এতই বুড়ি হয়ে গিয়েছে যে, জঙ্গলে গেলে আর বেশিদিন বাঁচবে না। অন্য প্রাণী শিকার করার ক্ষমতা নেই, তাই এখন মানুষ মারার চেষ্টা করবে। আদিবাসীদের সামনে পড়লে তারা ওকে মেরে ফেলতে পারে অনায়াসে। তার চেয়ে চিড়িয়াখানায় আদরযত্ন করলে ও আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারে।
ছেলেটা থাকবে কোথায়? কাকাবাবু ওকে অনাথআশ্রমে পাঠাবার ঘোর বিরোধী। এর মধ্যে দুটো অনাথআশ্রম জানিয়েও দিয়েছে যে, তারা জায়গা দিতে পারবে না।
কাকাবাবু ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু আইন-কানুনের কিছু ঝামেলা আছে।
সুলতান আলমের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হল। তিনি বললেন, আপনি ওর দায়িত্ব নিতে চান, সে তো খুব ভাল কথা। কিন্তু ওর কোনও আত্মীয় খোঁজখবর করে কি না, তার জন্য অন্তত দিনদশেক সময় দেওয়া দরকার।
কাকাবাবু বললেন, দশদিন ওকে কোথায় রাখবেন? আমাদের তো কাল ফিরতেই হবে। সন্তু আর জোজোর কলেজ খুলে যাচ্ছে।
সুলতান বললেন, তা হলে কয়েকটা দিন ওকে থানাতেই রেখে দিতে হবে। আর তো কোনও উপায় দেখছি না।
কাকাবাবু বললেন, ওইটুকু ছেলে, থানায় চোর-ডাকাতদের সঙ্গে থাকবে? তারাই তো ওকে নষ্ট করে দেবে।
সুলতান বললেন, না, ক্রিমিনালদের সঙ্গে অত কমবয়সি ছেলেকে রাখা যায় না। সেটা বেআইনি। অন্য কোথাও ব্যবস্থা করতেই হবে।
কাকাবাবু বললেন, যেখানেই রাখুন, সব সময় ওর দিকে মনোযোগ না দিলে ও তো আবার জঙ্গলে পালিয়ে যাবে। আপনার পুলিশ কি ওর খোঁজ করবে? তাদের কী দায় পড়েছে!
সুলতান বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন রায়চৌধুরীসাহেব। ও পালিয়ে গেলে পুলিশ আর ওকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না। তা হলে কী করা যায় বলুন তো?
কাকাবাবু বললেন, আমি বরং ওকে সঙ্গে নিয়ে যাই। সন্তু আর জোজোর সঙ্গে ওর অনেকটা ভাব হয়ে গিয়েছে। ওরা ছেলেটার দেখাশুনো করবে। এর মধ্যে কেউ যদি এসে ছেলেটাকে দাবি করে, ঠিক প্রমাণট্রমান দেখায়, আমি নিজের খরচে কলকাতা থেকে ওকে এখানে পৌঁছে দিয়ে যাব। আমার ঠিকানা রেখে যাচ্ছি। আপনি কলকাতার পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। সে আমাকে চেনে। তার কাছ থেকে আমার সম্পর্কে জানতে পারবেন।
সুলতান বললেন, কী বলছেন রায়চৌধুরীসাহেব, আমি এর মধ্যে সুপ্রভা রায়ের সঙ্গে দেখা করে আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছি। আপনি তো গ্রেট ম্যান। আপনি আন্দামানে সবুজ দ্বীপের রাজাকে আবিষ্কার করেছিলেন না? আপনি এ ছেলেটির ভার নিতে চাইছেন, এটাও তো একটা খুব বড় কথা। ঠিক আছে, আপনি ওকে নিয়ে যান। আমি লোকাল পুলিশকে বলে দিচ্ছি, কাল সকালেই আপনাদের ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করে দেবে। গাড়ির ব্যবস্থাও ওরাই করবে।
সন্তু আর জোজো পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিল। ওদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এর মধ্যেই ছেলেটার উপর ওদের মায়া পড়ে গিয়েছে। ওকে রেখে চলে যেতে হবে ভেবে ওদের মন খারাপ করছিল।
সন্ধেবেলা বুনোকে আইসক্রিম খাওয়াতে খাওয়াতে ওরা দুজন ওকে কথা বলাবার চেষ্টা করছে, বারান্দায় বসে। কাকাবাবু একটু দূরে একটা ইজিচেয়ারে বসে বই পড়ছেন।
এখনও পর্যন্ত বুনো একটাও কথা বলেনি। কিন্তু চোখ বড় বড় করে শোনে।
সন্তু নিজের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বলল, এটা আমি আর তুমি। তারপর ওর বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বলল, এটাও আমি। আর এদিকে তুমি।
জোজো বলল, ম্যায় আউর তুম!
সন্তু বলল, এটা বাড়ি। আর ওটা জঙ্গল।
জোজো বলল, ইয়ে কোঠি। আর উয়ো, জঙ্গল, জঙ্গল। অ্যাই সন্তু, জঙ্গলের হিন্দি কী রে?
সন্তু বলল, হিন্দিতেও জঙ্গল। ইংরেজিতেও তো জাঙ্গল!
জোজো বলল, এখন ইংরেজি শেখানোর দরকার নেই।
সন্তু বলল, আমি বাড়ি যাব। আমি জঙ্গলে যাব না।
জোজো বলল, আমি রুটি খাব। কাচা মাংস খাব না।
সন্তু বলল, আমি আইসক্রিম ভালবাসি।
জোজো বলল, অ্যাই সন্তু, আইসক্রিমের বাংলা কী?
সন্তু বলল, এই রে, আইসক্রিমের বাংলা তো জানি না। মালাই বরফ কি বলা যেতে পারে?
জোজো বলল, সেটা তো অন্যরকম।
সন্তু বলল, ওসব কথা এখন থাক। আইসক্রিমকে আইসক্রিম বললেই চলবে। বুনো, আমি মানুষ, তুমি মানুষ!
এইরকমভাবে চলল বেশ কিছুক্ষণ।
তারপর দেখা গেল, সিঁড়ি দিয়ে তিনজন লোক উঠে আসছে উপরের বারান্দায়।
তাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করল, মিস্টার রায়চৌধুরী হ্যায়?
সন্তু কাকাবাবুকে দেখিয়ে দিল।
সেই লোকটি হাতজোড় করে বলল, মিস্টার রায়চৌধুরী, আমার নাম মোহনকুমার, আমি এখানকার থানার ওসি। আর এঁরা দুজন সুরজ সিংহ আর তাঁর সেক্রেটারি বিলাস রাও।
কাকাবাবু বললেন, বসুন, বসুন।
মোহনকুমার বললেন, এঁরা দুজন জঙ্গলের ছেলেটিকে নিতে এসেছেন। সুরজ সিংহ এই ছেলেটির কাকা।
সুরজ সিংহ জোজোর দিকে তাকিয়ে গদগদভাবে বললেন, আও মেরে লাল, মেরে পাশ মে আও!
তিনি দুহাত বাড়িয়ে ধরতে গেলেন জোজোকে।
জোজো কুঁকড়ে গিয়ে বলল, আমি না, আমি না। এ।
সন্তু বলল, আগেই ওর গায়ে হাত দেবেন না। ও কিন্তু কামড়ে দিতে পারে।
এবার সুরজ সিংহই ঘাবড়ে গিয়ে দূরে সরে গেলেন। তার বিশাল চেহারা, ঝলমলে পোশাকপরা, মাথায় পাগড়ি। আর সেক্রেটারিটি সরু ও লম্বা, পায়জামা আর কুর্তা পরা।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ওর কাকা হন? ওর বাবা, মা?
সুরজ সিংহ বললেন, আমার বড় ভাই বেঁচে নেই। এই ছেলেটির মা, আমার ভাবী, বেঁচে আছেন। ছেলের শোক তিনি আজও ভুলতে পারেননি। কাগজে ওর ফোটো দেখেই চিনতে পেরেছেন। খুব কান্নাকাটি করছেন।
কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটি হারিয়ে গিয়েছিল কতদিন আগে?
সুরজ সিংহ বললেন, সাত বরষ আগে। তখন ওর বয়স ছিল তিন বছর। এই দেখুন, ফোটো।
তিনি লম্বা জামার পকেট থেকে একটা ফোটো বের করে দেখালেন। একটা বাচ্চার অস্পষ্ট ফোটো। তিন বছরের ছেলের সঙ্গে দশ বছরের ছেলের চেহারার মিল অনেক সময় বোঝাই যায় না। তখন ওর মাথায় চুলই ছিল না বলতে গেলে, এখন মাথা ভরতি চুল।
সুরজ সিংহ বললেন, ওর নাম ছিল বলবীর। বলবীর সিংহ।
তিনি ডাকলেন, বলবীর, বলবীর! ইধার দেখো!
বুনো তা গ্রাহ্যও করল না।
কাকাবাবু বললেন, এই সাত বছরে ও সব কিছু ভুলে গিয়েছে! ছেলেটি জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিল কী করে?
সুরজ সিংহ বললেন, আর বলবেন না, সে বড় লজ্জার কথা। আমাদের বাড়ি ইন্দৌর। জয়েন্ট ফ্যামিলি, বাপ-কাকা-জ্যাঠাদের ছেলেমেয়ে মিলিয়ে চোদ্দোজন। সে বছর ছেলেমেয়েরা সবাই গেল পিকনিক করতে। বলবীর তখন খুবই ছোট, কিন্তু আমার মেয়ে লছমি ওকে খুবই ভালবাসে। সে নিয়ে গেল জোর করে। গিয়েছিল এক জঙ্গলে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ইন্দৌর জঙ্গল আছে?
সুরজ সিংহ বললেন, শহর থেকে কিছুটা দূরে, ছোটখাটো জঙ্গল, সেখানে কোনও হিংস্র জন্তু থাকার কথা নয়, মাঝে মাঝে দু-একটা ভালুক দেখা যায়, তা অত মানুষ থাকলে ভালুক কী করবে? বাচ্চা ছেলে বলবীর ছিল খুব দুরন্ত, দৌড়োদৌড়ি করে চলে যেত এদিক-সেদিক। ওখানেও খেলা করছিল। আর সবাই ফুর্তি করছিল, হঠাৎ শোনা গেল এক বাঘের গর্জন। খুব কাছে। বাঘের ডাক শুনলে কী হয় জানেন তো? অন্যদের কথা মনে থাকে না, সবাই নিজের জান বাঁচাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ছেলেমেয়েরা সবাই দৌড় মেরে একটা মিনিবাস ছিল, তাতে উঠে পড়ল। ড্রাইভারও বাস চালিয়ে দিল জোরে। অনেকটা যাওয়ার পর খেয়াল হল, আর সবাই উঠেছে, শুধু বলবীর নেই। তখন আমার মেয়ে কাঁদতে লাগল।
কাকাবাবু বললেন, আপনার মেয়ের কত বয়স ছিল?
সুরজ সিংহ বললেন, চৌদ্দো বছর। এ জন্য আমার মেয়েকে অনেক মেরেছি। সে ভেবেছিল, রণবীর নামে একটা বড় ছেলে ছিল, সে নিশ্চয়ই ছোট্ট বলবীরকে তুলে নেবে। যাই হোক, সে ফিরে যাওয়ার জন্য বলতে লাগল। বাসের ড্রাইভারটি ছিল সাহসী, সে বলল, চলো ফিরে যাই! ফিরে গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি হল। বাঘের চিহ্ন নেই, বাচ্চাটাও নেই। পাশে একটা ছোট নদী ছিল, সেখানেও দেখা হল, কিন্তু বাচ্চাটার আর কোনও খোঁজ মিলল না। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, ছেলেটাকে বাঘেই মেরে ফেলেছে। এখন বুঝতে পারছি, বাঘে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মারেনি। এরকম অদ্ভুত ব্যাপারও ঘটে। তবে বাঘটাকে ধন্যবাদ। সে আমাদের বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আপনাকেও ধন্যবাদ।
কাকাবাবু বললেন, আমি বিশেষ কিছু করিনি। এখানে একজন কর্নেলসাহেব আছেন। তিনিই সার্চপার্টির ব্যবস্থা করেছেন। ঠিক সময়ে বাঘিনিটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন।
সুরজ সিংহ বললেন, আর দেরি করতে পারব না! বাচ্চাটাকে তা হলে নিয়ে যাই?
কাকাবাবু বললেন, আজই নিয়ে যাবেন?
সুরজ সিংহ বললেন, আমার ভাবী খুবই উতলা হয়ে আছেন আর কাঁদছেন। তিনি খুবই অসুস্থ, বেশিদিন বাঁচবেন না।
কাকাবাবু বললেন, ও তো আপনাদের কাউকে এখন চিনবে না। তাই বলছিলাম, দু-একদিন আপনি এখানে থাকুন, একটু ওর সঙ্গে ভাব করে নিন।
সুরজ সিংহ বললেন, আমার তো অত সময় নেই। নিজের ব্যাবসার কাজ ফেলে এসেছি। তা ছাড়া ও আমাকে চিনতে পারছে না, কিন্তু নিজের মাকে দেখে ঠিক চিনবে। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা মাকে কখনও ভোলে না।
কাকাবাবু চুপ করে গেলেন।
বুনো এতক্ষণ সন্তু আর জোজোর মাঝখানে বসে ছিল। এত কথা সে কিছুই বোঝেনি। এবার সে উঠে চলে যেতে লাগল ঘরের মধ্যে। সন্তুও উঠে দাঁড়াল।
সুরজ সিংহ বললেন, বলবীর, অন্দর মাত যাও। ইধার আও। মেরা পাস আও।
বুনো তবু তা শুনল না।
সুরজ সিংহের সেক্রেটারিটি এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিলেন, একটুও নড়াচড়া করেননি। এবার তিনি লাফিয়ে উঠে বুনোর ঘাড়টা চেপে ধরলেন।
বুনো সঙ্গে সঙ্গে কামড়ে দিল তার অন্য হাত। তিনি উঃ করে উঠলেন।
কাকাবাবু তাকালেন পুলিশ অফিসারের দিকে।
তিনি বললেন, স্যার, আমাদের উপর অর্ডার আছে, এর বাড়ির লোক নিতে চাইলে তাদের হাতে দিয়ে দিতে হবে। আমরা দায়িত্ব নিতে পারব না। এই লেড়কা, চল।
তিনি কাছে যেতেই বুনো তার দিকেও হিংস্রভাবে তাকাল।
মোহনকুমার ঠাস করে এক চড় কষালেন তার গালে। এবারে সেক্রেটারিটিও বুনোর অন্য গালে এক চড় কষিয়ে দিলেন।
কাকাবাবু বলে উঠলেন, এ কী, মারছেন কেন? মারছেন কেন?
মোহনকুমার বললেন, কামড়াতে আসছে, মারব না! দুষ্টু ছেলেদের না মারলে তারা কথা শোনে না।
কাকাবাবু বললেন, মোটেই তা নয়। ওর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে হবে। একটু একটু করে শেখাতে হবে।
সুরজ সিংহ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না রায়চৌধুরীসাহেব। আমরা ওর সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করব। এতদিন পর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরছে। ওর অত ভাইবোন ওকে এত আদর করবে, তাতেই ও ভুলে যাবে।
মোহনকুমার একটা হাতকড়া বের করে আটকে দিলেন বুনোর দুহাতে। সন্তু ওর দড়ির বাঁধনটা খুলে দিল।
মোহনকুমার ওর হাতকড়াটা ধরে টেনে বললেন, চল এবার!
বুনো শক্তভাবে দাঁড়িয়ে বিকটভাবে চেঁচিয়ে উঠল।
সেক্রেটারি তাকে ঠেলতে লাগলেন পিছন থেকে। বুনো কিছুতেই যাবে। পুলিশ অফিসারটি জোর করে টানতে টানতে নামাতে লাগলেন বারান্দা থেকে। ঠিক যেন একটা চোরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একটা বাচ্চা চোর।
বুনোর চিৎকার শুনে গেস্টহাউসের সব কর্মচারী আর অন্য ঘরের লোকরাও বেরিয়ে এসে উঁকি মেরে দেখছে।
বলির পাঁঠাকে দড়ি বেঁধে হাড়িকাঠের দিকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়ার সময় সে যেমন চাচায়, বুনোও সেরকম চ্যাঁচাচ্ছে।
গেটের বাইরে একটা বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে। তার মধ্যে বুনোকে তুলে অন্য সবাই উঠে পড়ল। শোনা গেল গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার শব্দ।
বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছেন কাকাবাবু আর জোজো-সন্তু। একটুক্ষণ তিনজনেই চুপ।
একটু পরে সন্তু বলল, কাকাবাবু, বুনোকে ওইভাবে জোর করে ধরে নিয়ে গেল…।
কাকাবাবু বললেন, কী আর করা যাবে, বল? ওর বাড়ির লোক যদি নিয়ে যেতে চায়? আমরা তো বাধা দিতে পারি না।
সন্তু বলল, লোকগুলো খুব নিষ্ঠুর। যদি ওকে আরও মারে?
কাকাবাবু বললেন, কিছু লোক আছে এরকম, ছোটদের গায়ে হাত তোলে। অন্যভাবেও যে শিক্ষা দেওয়া যায়, তা বোঝে না। তবে, ওর অনেক ভাইবোন, তাদের মাঝে গিয়ে পড়লে ওর নিশ্চয়ই ভালই হবে। আর জঙ্গলে পালাতে পারবে না।
সন্তু বলল, ইন্দৌর অনেক দূর। সেখান থেকে বাঘিনিটা এখানে এসেছে, মাঝখানে তো জঙ্গল নেই, তবু কারও চোখে পড়ল না?
কাকাবাবু বললেন, অনেক কিছুরই এখনও ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল। বাঘেরা এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। রাত্তিরের দিকে ফাঁকা মাঠঘাঠ, নদী, ফসলের খেত দিয়েও আসে। ছেলেটাকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে। তবু কারও চোখে পড়েনি। সেটা খুবই আশ্চর্য ব্যাপার! তবে, বাঘিনিটা যদি বুড়ি না হয়ে যেত, তা হলে এবারেও বোধ হয় অত সহজে ধরা দিত না।
একটুক্ষণ আবার সবাই চুপ।
এবারে জোজো বলল, আচ্ছা সন্তু, ওই বুনোর কাকাটা প্রথমে আমাকেই বুনো ভেবে জড়িয়ে ধরতে এসেছিল কেন বল তো? আমাকে কি দেখে মনে হয় জংলি ছেলে?
সন্তু বলল, শুধু তাই নয়। তোকে ভেবেছিল দশ বছরের বাচ্চা!
জোজো বলল, ধ্যাত!
কাকাবাবু বললেন,কালকের জন্য একটা গাড়ি ঠিক করতে হবে। আর তো আমাদের এখানে থাকার কোনও মানে হয় না। পুলিশও আমাদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করবে না। জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নাও।
কাকাবাবু মান্টো সিংহকে ডাকতে লাগলেন।
জোজো বলল, যাই বলুন আর তাই বলুন, ছেলেটার উপর বেশ মায়া পড়ে গিয়েছিল। প্রায় ভাব হয়ে গিয়েছিল আমাদের সঙ্গে। মনটা খুব খারাপ লাগছে।
সন্তু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।