মন একাগ্র করিবার ক্ষমতার তারতম্যই মানুষ ও পশুর মধ্যে প্রধান পার্থক্য। যে-কোন কাজে সাফল্যের মূলে আছে এই একাগ্রতা। একাগ্রতার সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচয় আমাদের সকলেরই আছে। ইহার ফল প্রতিদিনই আমাদের চোখে পড়ে। সঙ্গীত, কলাবিদ্যা প্রভৃতিতে আমাদের যে উচ্চাঙ্গের কৃতিত্ব, তাহা এই একাগ্রতা-প্রসূত। একাগ্রতার ক্ষমতা পশুদের একরকম নাই বলিলেই চলে। যাঁহারা পশুদের শিক্ষা দিয়া থাকেন, তাঁহাদিগকে এই কারণে বিশেষ বেগ পাইতে হয়। পশুকে যাহা শেখান হয়, তাহা সে ক্রমাগত ভুলিয়া যায়; কোন বিষয়ে একসঙ্গে অধিকক্ষণ মন দিবার ক্ষমতা তাহার নাই। পশুর সঙ্গে মানুষের পার্থক্য এখানেই—মন একাগ্র করার ক্ষমতা পশুর চেয়ে মানুষের অনেক বেশী। মানুষে মানুষে পার্থক্যের কারণও আবার এই একাগ্রতার তারতম্য। সর্বনিম্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে সর্বোচ্চ স্তরের মানুষের তুলনা করিয়া দেখ, দেখিবে একাগ্রতার মাত্রার বিভিন্নতাই এই পার্থক্য সৃষ্টি করিয়াছে। পার্থক্য শুধু এইখানেই। সকলেরই মন সময়ে সময়ে একাগ্র হইয়া যায়। যাহা আমাদের প্রিয়, তাহারই উপর আমরা সকলে মনোনিবেশ করি; আবার যে বিষয়ে মনোনিবেশ করি, তাহাই প্রিয় হইয়া উঠে। এমন মা কি কেহ আছেন, নিজের ছেলের অতিসাধারণ মুখখানিও যিনি ভালবাসেন না? মায়ের কাছে সেই মুখখানিই জগতের সুন্দরতম মুখ। মন সেখানে নিবিষ্ট করিয়াছেন বলিয়াই মুখখানি তাঁহার প্রিয় হইয়াছে। সকলেই যদি ঠিক সেই মুখখানির উপর মন বসাইতে পারিত, তাহা হইলে তাহার উপর সকলেরই ভালবাসা জন্মিত; সকলেই ভাবিত, এমন সুন্দর মুখ আর হয় না। যাহা ভালবাসি, তাহারই উপর আমরা মনোনিবেশ করি। সুললিত সঙ্গীত-শ্রবণকালে আমাদের মন সেই সঙ্গীতেই আবদ্ধ হইয়া থাকে, তাহা হইতে আমরা মন সরাইয়া লইতে পারি না। উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত বলিয়া যাহা পরিচিত, তাহাতে যাহাদের মন একাগ্র হয়, সাধারণ পর্যায়ের সঙ্গীত তাহাদের ভাল লাগে না। ইহার বিপরীতটিও সত্য। দ্রুত-লয়ের সঙ্গীত-শ্রবণমাত্র মন তাহাতে আকৃষ্ট হয়। ছেলেরা হালকা সঙ্গীত পছন্দ করে, কারণ তাহাতে লয়ের দ্রুততা মনকে বিষয়ান্তরে চলিয়া যাইবার কোন অবকাশই দেয় না। উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত জটিলতর, এবং তাহা অনুধাবন করিতে হইলে অধিকতর মানসিক একাগ্রতার প্রয়োজন; সেইজন্যই সাধারণ সঙ্গীত যাহারা ভালবাসে, উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত তাহাদের ভাল লাগে না।
এই ধরনের একাগ্রতার সব চেয়ে বড় দোষ হইতেছে এই যে, মন আমাদের আয়ত্তে থাকে না, বরং মনই আমাদের চালিত করে। যেন সম্পূর্ণ বাহিরের কোন বস্তু আমাদের মনটিকে টানিয়া লইয়া যতক্ষণ খুশী নিজের কাছে ধরিয়া রাখে। সুমধুর সঙ্গীত-শ্রবণকালে অথবা মনোরম চিত্রদর্শনকালে আমাদের মন উহাতে দৃঢ়ভাবে লগ্ন হইয়া যায়; মনকে আমরা সেখান হইতে তুলিয়া আনিতে পারি না।
আমি যখন তোমাদের মনোমত কোন বিষয়ে ভাল বক্তৃতা দিই, তখন আমার কথায় তোমাদের মন একাগ্র হয়। তোমাদের নিকট হইতে তোমাদের মনকে কাড়িয়া আনিয়া আমি তোমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও উহাকে ঐ প্রসঙ্গের মধ্যে ধরিয়া রাখি। এভাবে আমাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বহু বিষয়ে মন আকৃষ্ট হইয়া একাগ্র হয়। আমরা তাহাতে বাধা দিতে পারি না।
এখন প্রশ্ন হইতেছে, চেষ্টা করিয়া এই একাগ্রতা বাড়াইয়া তোলা ও ইচ্ছামত তাহাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কিনা। যোগীরা বলেন, হাঁ, তাহা সম্ভব; তাঁহারা বলেন, আমরা মনকে সম্পূর্ণ বশে আনিতে পারি। নৈতিক দিক্ হইতে একাগ্রতার ক্ষমতা বাড়াইয়া তোলায় বিপদও আছে; কোন বিষয়ে মন একাগ্র করিবার পর ইচ্ছামাত্র সেখান হইতে সে-মন তুলিয়া লইতে না পারিলেই বিপদ। এরূপ পরিস্থিতি বড়ই যন্ত্রণাদায়ক। মন তুলিয়া লইবার অক্ষমতাই আমাদের প্রায় সকল দুঃখের কারণ। কাজেই একাগ্রতার শক্তি বাড়াইবার সঙ্গে সঙ্গে মন তুলিয়া লইবার শক্তিও বাড়াইয়া তুলিতে হইবে। বস্তুবিশেষে মনোনিবেশ করিতে শিখিলেই চলিবে না। প্রয়োজন হইলে মুহূর্তের মধ্যে সেখান হইতে মন সরাইয়া লইয়া বিষয়ান্তরে তাহাকে নিবিষ্ট করিতে পারা চাই। এই উভয় ক্ষমতা সমভাবে অর্জন করিয়া চলিলে বিপদের কোন সম্ভাবনা থাকে না।
ইহাই মনের প্রণালীবদ্ধ ক্রমোন্নতি। আমার মতে মনের একাগ্রতা-সাধনই শিক্ষার প্রাণ, শুধু তথ্য সংগ্রহ করা নহে। আবার যদি আমাকে নতুন করিয়া শিক্ষালাভ করিতে হইত, এবং নিজের ইচ্ছামত আমি যদি তাহা করিতে পারিতাম, তাহা হইলে আমি শিক্ষণীয় বিষয় লইয়া মোটেই মাথা ঘামাইতাম না। আমি আমার মনের একাগ্রতা ও নির্লিপ্ততার ক্ষমতাকেই ক্রমে ক্রমে বাড়াইয়া তুলিতাম; তারপর ওভাবে গঠিত নিখুঁত যন্ত্রসহায়ে খুশীমত তথ্য সংগ্রহ করিতে পারিতাম। মনকে একাগ্র ও নির্লিপ্ত করিবার ক্ষমতাবর্ধনের শিক্ষা শিশুদের একসঙ্গেই দেওয়া উচিত।
আমার সাধনা বরাবর একমুখী ছিল। ইচ্ছামত মন তুলিয়া লইবার ক্ষমতা অর্জন না করিয়াই আমি একাগ্রতার শক্তি বাড়াইয়া তুলিয়াছিলাম; ইহাই হইয়াছে আমার জীবনে গভীরতম দুঃখভোগের কারণ। এখন আমি খুশীমত মন তুলিয়া লইতে পারি; তবে ইহা শিখিতে হইয়াছে অনেক পরে।
কোন বিষয়ে ইচ্ছামত আমরা নিজেরাই যেন মনোনিবেশ করিতে পারি; বিষয় যেন আমাদের মনকে টানিয়া না লয়। সাধারণতঃ বাধ্য হইয়াই আমরা মনোনিবেশ করি; বিভিন্ন বিষয়ের আকর্ষণের প্রভাবে আমাদের মন সেখানে সংলগ্ন হইয়া থাকিতে বাধ্য হয়, আমরা তাহাকে বাধা দিতে পারি না। মনকে সংযত করিতে হইলে—যেখানে ইচ্ছা করিব ঠিক সেখানেই তাহাকে নিবিষ্ট করিতে হইলে—বিশেষ শিক্ষার প্রয়োজন; অন্য কোন উপায়ে তাহা হইবার নয়। ধর্মের অনুশীলনে মনঃসংযম একান্ত প্রয়োজন। এ অনুশীলনে মনকে ঘুরাইয়া মনেরই উপর নিবিষ্ট করিতে হয়।
মনের নিয়ন্ত্রণ আরম্ভ করিতে হয় প্রাণায়াম হইতে। নিয়মিত শ্বাস-ক্রিয়ার ফলে দেহে সমতা আসে; তখন মনকে ধরা সহজ হয়। প্রাণায়াম অভ্যাস করিতে হইলে প্রথমেই আসন বা দেহসংস্থানের কথা ভাবিতে হয়। যে-কোন ভঙ্গিতে অনায়াসে বসিয়া থাকা যায়, তাহাই উপযুক্ত আসন। মেরুদণ্ড যেন ভারমুক্ত থাকে, দেহের ভার যেন বক্ষ-পঞ্জরের উপর রাখা হয়। কোন স্বকপোলকল্পিত কৌশল অবলম্বনে মন-নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করিও না, একমাত্র সহজ, সরল শ্বাস-প্রশ্বাসক্রিয়াই এ-পথে যথেষ্ট। বিবিধ কঠোর সাধন-সহায়ে মনকে একাগ্র করিতে প্রয়াসী হইলে ভুল করা হইবে। সে-সব করিতে যাইও না।
মন শরীরের উপর কার্য করে, আবার শরীরও মনের উপর ক্রিয়াশীল। উভয়েই পরস্পরের উপর ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া করিয়া থাকে। প্রত্যেক মানসিক অবস্থার অনুরূপ অবস্থা শরীরে ফুটিয়া উঠে, আবার শরীরের প্রতিটি ক্রিয়ার অনুরূপ ফল প্রকটিত হয় মনের ক্ষেত্রে। শরীর ও মনকে দুটি আলাদা বস্তু বলিয়া ভাবিলেও কোন ক্ষতি নাই, আবার দুটি মিলিয়া একটি-ই শরীর—স্থূল দেহ তাহার স্থূল অংশ, আর মন তাহার সূক্ষ্ম অংশ—এরূপ ভাবিলেও কিছু আসে যায় না। ইহারা পরস্পর পরস্পরের উপর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াশীল। মন প্রতিনিয়ত শরীরে রূপায়িত হইতেছে। মনকে সংযত করিতে হইলে প্রথমে শরীরের দিক্ হইতে আরম্ভ করা বেশী সহজ। মন অপেক্ষা শরীরের সঙ্গে সংগ্রাম করা অনেক সহজ কাজ।
যে যন্ত্র যত বেশী সূক্ষ্ম, তাহার শক্তিও তত বেশী। মন শরীরের চেয়ে অনেক বেশী সূক্ষ্ম, এবং অধিকতর শক্তিসম্পন্ন। এজন্য শরীর হইতে আরম্ভ করিলে কাজ সহজ হয়।
প্রাণায়াম হইতেছে এমন একটি বিজ্ঞান, যাহার সাহায্যে শরীর-অবলম্বনে অগ্রসর হইয়া মনের কাছে পৌঁছান চলে। এভাবে চলিতে চলিতে শরীরের উপর আধিপত্য আসে, তারপর শরীরের সূক্ষ্ম ক্রিয়াগুলি আমরা অনুভব করিতে আরম্ভ করি; ক্রমে সূক্ষ্মতর ও গভীরতর প্রদেশে প্রবেশ করি, অবশেষে মনের কাছে গিয়াই পৌঁছাই। শরীরের সূক্ষ্ম ক্রিয়াগুলি অনুভূতিতে আসামাত্র সেগুলি আয়ত্তে আসে। কিছুকাল পরে শরীরের উপর মনের কার্যগুলিও অনুভব করিতে পারিবে। মনের একাংশ যে অপরাংশের উপর কাজ করিতেছে, তাহাও বুঝিতে পারিবে; এবং মন যে স্নায়ুকেন্দ্রগুলিকে কাজে লাগাইতেছে, তাহাও অনুভব করিবে; কারণ মনই স্নায়ুমণ্ডলীর নিয়ন্তা ও অধীশ্বর। বিভিন্ন স্নায়ুস্পন্দন অবলম্বনে মনই ক্রিয়া করিতেছে, ইহাও টের পাইবে।
নিয়মিত প্রাণায়ামের ফলে—প্রথমে স্থূল শরীরের উপর ও পরে সূক্ষ্মশরীরের উপর আধিপত্য বিস্তারের ফলে মনকে আয়ত্তে আনা যায়।
প্রাণায়ামে প্রথম ক্রিয়াটি সম্পূর্ণ নিরাপদ ও খুবই স্বাস্থ্যকর। ইহার অভ্যাসে আর কিছু না হউক স্বাস্থ্যলাভ ও শরীরের সাধারণ অবস্থার উন্নতি হইবেই। বাকী প্রক্রিয়াগুলি ধীরে ধীরে ও সাবধানে করিতে হয়।