একটা ইজি-চেয়ারে শুয়ে কাকাবাবু ঠিক চল্লিশ মিনিট ঘুমোলেন। তারপর উঠে পড়ে সন্তুকে বললেন, এবার লোকটিকে এ-ঘরে নিয়ে আয়।
অলিকে বললেন, তুমি একটা প্লেটে ওর জন্য রুটি আর আলুর দম এনে টেবিলের ওপর রাখো।
এখানে শনশন করে হাওয়া দিচ্ছে অনবরত। বেশ শীত শীত ভাব। কাকাবাবু কোট পরে আছেন। কিন্তু টাকমাথা লোকটার গায়ে শুধু পাতলা একটা সুতির জামা। সেটা এখন শুকিয়ে গেছে। তার হাত ও পা শক্ত নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা, সে এল লাফাতে লাফাতে, সন্তু তাকে পেছন থেকে ঠেলছে।
কাকাবাবু বললেন, ওহে, তোমার নামটা আগে বলল, না হলে তোমাকে ডাকব কী করে? কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া যেমন বলতে নেই, তেমনই ন্যাড়া-মাথা লোককে নেড় কিংবা টাকমাথা লোককে টাকলু বলতে আমার খারাপ লাগে। কী নাম তোমার?
লোকটি উত্তর তো দিলই না, এমন ভাব দেখাল যেন শুনতেই পায়নি।
কাকাবাবু আবার বললেন, খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই? আমরা পেটপুরে খেলাম, আর তোমাকে খেতে দিইনি, এটা খুব খারাপ ব্যাপার। এক্ষুনি খাবার পাবে। তার আগে কয়েকটা কথার উত্তর দাও তো চটপট। সন্তু, ওর পা আর হাতের বাঁধন খুলে দে। দেখতে খারাপ লাগছে। হাত বাঁধা থাকলে খাবে কী। করে?
সন্তু ওর দড়ির বাঁধন খুলে দিল।
কাকাবাবু বললেন, এবারে লক্ষ্মী ছেলের মতন টেবিলের উলটো দিকের ওই চেয়ারটায় বোসো।
কোটের পকেট থেকে রিভলভারটা বার করে বললেন, এটা দেখেছ তো? পালাবার চেষ্টা করলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব। সারাজীবন খোঁড়া থাকার যে কী কষ্ট, তা তো আমি জানি, তুমিও হাড়ে-হাড়ে টের পাবে। এবারে বলো তো, ম্যাজিশিয়ান মিস্টার এক্স কোথায়?
লোকটি চেয়ারে বসল, কিন্তু কোনও কথা বলল না। কাকাবাবু বললেন, কেন সময় নষ্ট করছ? তোমা, কোনও ভয় নেই, কেউ মারধর করবে না। সত্যি কথা বলো, একটু বাদেই ছাড়া পাবে। আমাদের সঙ্গে জোজো বলে যে ছেলেটি ছিল, তার কী হয়েছে? কে তাকে আটকে রেখেছে?
লোকটি মুখ বুজে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কাকাবাবুর চোখের দিকে।
সন্তু বলল, কাকাবাবু, লোকটি বোধ হয় বোবা। সেই যে টুল থেকে পড়ে গেল, আঃ উঃ কোনও শব্দ করেনি। ম্যাজিশিয়ানটা ওকে চড় মারল, তাও কিছু বলেনি।
কাকাবাবু বললেন, সত্যিকারের বোবা না হয়েও বোবা সেজে থাকতে পারে। বোবারা সাধারণত কানেও শোনে না। এর মুখ দেখে মনে হচ্ছে, আমার সব কথা শুনতে পাচ্ছে, বুঝতেও পারছে। মুখটা ফাঁক করে দ্যাখ তো, জিভটা কাটা কি না।
সন্তু ওর মুখোনা ধরে ঠোঁট ফাঁক করে দিল, তাতে ও আপত্তি জানাল না। কটমট করে চেয়ে আছে কাকাবাবুর দিকে।
জিভ কাটা নয়, ঠিকই আছে।
অলি খাবারের প্লেটটা রাখল টেবিলের ওপর। সে সেদিকে চেয়েও দেখল না।
কাকাবাবু বললেন, কথা বলতে জানোনা? লেখাপড়া জানো?
তিনি কোটের পকেট থেকে নোটবই আর কলম বার করে লিখলেন, ম্যাজিশিয়ান কোথায়?
লেখাটা লোকটিকে দেখিয়ে নোটবই আর কলম এগিয়ে দিলেন। সে ওসব ল না।
সন্তু বলল, এমন হতে পারে, বাংলা জানে না। ম্যাজিশিয়ানটা ইংরিজি বলছিল।
কাকাবাবু বললেন, ম্যাজিশিয়ানের মুখ আমরা দেখিনি। কিন্তু এর মুখ দেখে বোঝা যায় না যে, পুরো বাঙালি? এ লোকটি আলবাত বাঙালি। ইচ্ছে করে কথা বলছে না।
হঠাৎ লোকটি মুখ দিয়ে গোঁ-গোঁ শব্দ করতে লাগল। অদ্ভুত শব্দ। ক্রমে শব্দটা জোর হতে লাগল আর সে দোলাতে লাগল মাথাটা।
কাকাবাবু বললেন, এ আবার কী ব্যাপার?
অলি দেওয়ালের এক কোণে কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, ভয় করছে, আমার ভয় করছে।
লোকটি এবার সামনের দিকে ঝুঁকে চট করে একটা আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিল কাকাবাবুর কপাল।
সঙ্গে সঙ্গে কাকাবাবুর মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। তিনি চোখে অন্ধকার দেখলেন। তাঁর মাথাটা ঢলে পড়ল টেবিলের ওপর।
লোকটি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। এক ঝটকায় সন্তুকে ঠেলে ফেলে দিল মাটিতে। তারপর দৌড়ে বেড়িয়ে গেল দরজা দিয়ে।
কিন্তু সে পালাতে পারল না। তার দুর্ভাগ্য, ঠিক তখনই অর্ক ফিরে এল গাড়ি নিয়ে। লোকটিকে পালাতে দেখে অর্ক লাফিয়ে গাড়ি থেকে নেমে তাড়া করল তাকে। ধরেও ফেলল। জড়াজড়ি করে দুজনে পড়ে গেল মাটিতে। টাক-মাথা লোকটির গায়ের জোর বেশি, তবু নিজেকে ছাড়াবার অনেক চেষ্টা করেও পারল না, অর্ক নানারকম কায়দা জানে, সে লোকটির একটা হাত পেছন দিকে নিয়ে গিয়ে মোচড়াতে লাগল। গাড়ি থেকে কনস্টেবলটিও লাঠি নিয়ে পৌঁছে গেল সেখানে।
এর মধ্যে কাকাবাবুর জ্ঞান ফিরে এসেছে। তিনি হাহা করে হেসে উঠলেন। অর্ক যখন পলাতকটিকে ঠেলতে-ঠেলতে ঘরের মধ্যে নিয়ে এল তখনও কাকাবাবু হাসছেন আর আপন মনে বলছেন, ব্যাটা হিপনোটাইজ করল আমাকে! অ্যাঁ? এটা হাসির কথা নয়। রাজা রায়চৌধুরীকেও কেউ হিপনোটাইজ করার সাহস পায়?
অর্ক বলল, এ কী কাকাবাবু, আপনি ওর হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিলেন? আর একটু হলে পালাচ্ছিল!
কাকাবাবু সে কথা গ্রাহ্য না করে হাসিমুখে বললেন, আমাকে হিপনোটাইজ করল? ঘুমিয়ে ছিলাম তো, ঘুম ভাঙার পরেও কিছুক্ষণ মাথার জড়তা কাটে না, তাই ও পেরেছে! এবার তো ওকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। ওকে আবার চেয়ারে এনে বসাও!
অর্ক সন্তুকে জিজ্ঞেস করল, ও কিছু স্বীকার করেছে?
সন্তু বলল, একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি।
অর্ক লোকটির গালে সপাটে এক চড় কষিয়ে বলল, ফের পালাবার চেষ্টা করবি?
কাকাবাবু বললেন, মেরো না, মেরো না। মারধর আমার পছন্দ হয় না। তবে ও যদি খোঁড়া হতে চায়, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। আবার পালাবার চেষ্টা করলেই খোঁড়া হবে। আমার সামনে ওকে বসাও।
অর্ক ওকে বসাল, হাত দুটো পেছনে মুড়ে বেঁধে দিল। কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, ওর নামও বলেনি? ব্যাটার মাথায় একটাও চুল নেই, দাড়ি গোঁফ নেই। ওর নাম দেওয়া হোক মাকুন্দ।
কাকাবাবু বললেন, মাকুন্দ শব্দটা শুনতে ভাল নয়। বরং বলা যাক তুবক। ভীমের দাড়ি-গোঁফ ছিল না, তাই তার এক নাম ছিল তুক। ওহে তুবরক, তুমি তো আমাকে সম্মোহিত করে ফেলেছিলে। আর-একবার করো দেখি! আমার নাম রাজা রায়চৌধুরী, আমাকে তুমি চেনো না।
অর্ককে বললেন, তুমি পেছন থেকে সরে যাও। আমার ধারণা, ও-বিদ্যেটা সারা দেশে আমার চেয়ে ভাল কেউ জানে না। শিখেছিলাম লাদাখের এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কাছে। ও-বিদ্যে যখন-তখন ব্যবহার করতে গুরুর নিষেধ আছে। কিন্তু কেউ আমার ওপর ওটা চালাতে গেলে তাকে আমি ছাড়ি না।
লোকটি এখনও কটমট করে তাকিয়ে আছে। কাকাবাবু তার মুখের সামনে একটা হাত ঘোরাতে লাগলেন, আর আস্তে-আস্তে বলতে লাগলেন, তাকিয়ে থাকো, তাকিয়ে থাকো, আমি যা বলব তা শুনবে, আমি যা জিজ্ঞেস করব, তার উত্তর দেবে, তাকিয়ে থাকো, তাকাও আমার দিকে।
লোকটির চোখ এবার একটু-একটু করে বুজে আসতে লাগল, তারপর পুরোটা বুজে গেল।
কাকাবাবু হুকুম দিলেন, চোখ খোলো! লোকটি চোখ খুলল, কিন্তু চোখের তারা দুটি একেবারে স্থির। পলক পড়ছে।।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? লোকটি ধীরে ধীরে দুদিকে মাথা নাড়ল।
কাকাবাবু বললেন, তুমি কেউ না? সে আবার কী? ম্যাজিশিয়ান এখন কোথায়?
আবার সে মাথা নাড়ল দুদিকে।
কাকাবাবু বললেন, আমার সঙ্গে চালাকি কোরো না। ম্যাজিশিয়ানটি কোথায় লুকিয়েছে, নিশ্চয়ই তুমি জানো, বলো সে কোথায়?
লোকটি আবার দুদিকে মাথা নাড়ল, তার মুখে ফুটে উঠল যন্ত্রণার রেখা।
কাকাবাবু এবার অন্যদের দিকে ফিরে বললেন, এ-লোকটা বোবা নয়। কিন্তু কোনও কারণে ওর কথা বলার ক্ষমতাটা বন্ধ হয়ে গেছে। আমি ওর মনের মধ্যে ঢুকতে পারছি না। খানিক বাদে ঠিক পারব, আচ্ছা দেখা যাক, মুখে বলতে না পারলেও ও লিখতে পারে কি না!
কাগজ-কলম এগিয়ে দিয়ে কাকাবাবু লোকটিকে বললেন, ওহে তুবরক, জোজো কোথায় আছে, এখানে লিখে দাও!
অর্ক ওর হাতের বাঁধন খুলে দিল। লোকটি কলমটি তুলে নিয়েও থেমে রইল।
কাকাবাবু ধমক দিয়ে বললেন, লেখো!
লোকটি এবার লিখতে শুরু করল। আঁকাবাঁকা অক্ষর। সবাই হুমড়ি খেয়ে দেখতে লাগল সে কী লেখে।
লোকটি একটু লিখেই কলম তুলে নিল। সে লিখেছে, মহিষ কালী।
কাকাবাবু বললেন, এ আবার কী? এর কী মানে হয়? মহিষ কালী? ইয়ার্কি হচ্ছে আমার সঙ্গে? ঠিক করে লেখো, জোজো কোথায় আছে?
লোকটি আবার গোটা-গোটা করে লিখল, কক শেস বা জাড়।
কাকাবাবু আবার বিরক্তভাবে বললেন, এ কী অদ্ভুত কথা? কোনও মানেই হয় না। বাংলা অক্ষরেই তো লিখেছ, এটা কী ভাষা?
লোকটির হাত থেকে কলমটা খসে গেল, মাথাটা নিচু হতে হতে ঢুকে গেল টেবিলে। সে ঘুমিয়ে পড়েছে বা অজ্ঞান হয়ে গেছে!
কাকাবাবু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, এখন আর কিছু করা যাবে না। ওকে পাশের ঘরে শুইয়ে দাও!
অর্ক দারুণ অবাক হয়ে বলল, ওরকম একটা তেজি লোককে আপনি ঘুম পাড়িয়ে দিলেন? এরকমভাবে হিপনোটাইজ করা যায়?
কাকাবাবু বললেন, দেখলেই তো যে যায়! একটা হাতিকেও আমি ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি। বাঘকে পারব না। বাঘ আগেই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে!
অর্ক জিজ্ঞেস করল, আমাকে পারবেন? করুন তো!
কাকাবাবু বললেন, ওই ক্ষমতাটা নিয়ে ছেলেখেলা করতে নেই। একটু ভুল হলে আমি নিজেই মারা পড়ব!
অর্ক মনের ভুলে পকেট থেকে সিগারেট-দেশলাই বার করে ধরাতে গিয়ে কাকাবাবুকে দেখে লজ্জা পেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি আবার পকেটে ভরে ফেলল।
কাকাবাবু বললেন, তোমার সিগারেট খাওয়ার অভ্যেস থাকলে খেতে পারো। আমার সামনে লজ্জার কিছু নেই। তবে, একটু দূরে বসে খেয়ো, ধোঁয়ার গন্ধটা আমার এখন খারাপ লাগে। এককালে নিজে খুব চুরুট খেতাম।
অর্ক বলল, না, এখন খাব না। জানেন কাকাবাবু, আমি এখানে খোঁজখবর নিয়ে বেশ কিছু অদ্ভুত খবর পেলাম। সেই মুখোশধারী ম্যাজিশিয়ানকে মেলার সময় কয়েকজন দেখেছিল, তারপর আর কেউ দেখেনি। আপনি ঠিকই শুনেছেন, সে একটা লঞ্চে থাকত। এখানে নাকি বাংলাদেশ, বার্মা থেকে কিছু-কিছু লঞ্চ সমুদ্রের ধার দিয়ে দিয়ে প্রায়ই আসে। এখান থেকেও কিছু লঞ্চ ওইসব দেশে যায়। ভিসা, পাসপোর্টের কোনও ব্যাপার নেই। নানারকম জিনিসের চোরাচালান হয়। এদিকটায় পুলিশের তেমন নজর নেই।
কাকাবাবু বললেন, এইদিক দিয়েই তো বড় বড় বিদেশি জাহাজ কলকাতা আর হলদিয়া বন্দরে যায়?
অর্ক বলল, যা, সেইসব জাহাজ থেকেও অনেক চোরাই জিনিসপত্র নামিয়ে দেয় এখানে। এই ব্যাপারে একটা রিপোর্ট করতে হবে।
কাকাবাবু বললেন, ঘরে বসে থেকে কী হবে, চলো সবাই মিলে সমুদ্রের ধারটা একবার ঘুরে আসি।
টাক-মাথা লোকটাকে ধরাধরি করে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে পাশের ঘরে। প্রফুল্ল নামে একটা লোক বাংলোটা দেখাশুনো করে, তাকে ডেকে বলা হল, দরজা বন্ধ করে রাখো। ওই লোকটার ওপর নজর রাখবে।
টেবিলের ওপর থেকে কাগজটা তুলে নিয়ে কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, কী হিজিবিজি লিখেছে, মাথামুণ্ডু নেই! মহিষ কালী! মহিষের সঙ্গে কালীর কী সম্পর্ক? তারপর কক শেস বা জাড়, এটা তো মনে হচ্ছে বাংলাই নয়!
কাগজটা কাকাবাবু পকেটে পুরে নিলেন।
অর্ক সন্তুর কাঁধে চাপড় মেরে বলল, জোজোর অভাবে সন্তু একেবারে মুষড়ে পড়েছে। কোনও কথাই বলছে না!
সন্তু ফ্যাকাসে ভাবে একটু হাসল।
কাকাবাবু বললেন, সামনাসামনি যদি কোনও শত্রু আসে, তা হলে সন্তু জানে কী করে লড়াই করতে হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তো কে যে শত্রু তা বোঝাই যাচ্ছে না। জোজোর বদলে যদি সম্ভকে অদৃশ্য করে দিত, তা হলে আমার এত চিন্তা হত না। সন্তু ঠিক বেরিয়ে আসত।
সমুদ্র এখান থেকে বেশি দূর নয়। গাড়িতে গিয়ে লাভ নেই, বালিতে চাকা বসে যাবে। সবাই হাঁটতে-হাঁটতে চলে এল। ভাটার সময় সমুদ্রের জল অনেকটা সরে যায়। তখন কাদা থিকথিক করে। এখন জল বেশ কাছে। বালির ওপর দৌড়োদৌড়ি করছে অসংখ্য লালরঙের কাঁকড়া। সেগুলো এত ছোট যে, খাওয়া যায় না। এদের ধরাও বেশ শক্ত। একটু দূর থেকে মনে হয় যেন হাজার হাজার কাঁকড়া একটা কার্পেটের মতন বিছিয়ে আছে, কাছে গেলেই সব গর্তের মধ্যে ঢুকে যায়। অলি দৌড়োদৌড়ি করে ধরবার চেষ্টা করল, একটাও পারল না।
তারপর সে এক জায়গায় বসে পড়ে বালি দিয়ে দুর্গ বানাতে লাগল।
কাকাবাবুও ক্রাচ দুটো নামিয়ে রেখে, রুমাল পেতে বসে পড়লেন এক জায়গায়। বললেন, একটু পরেই সূর্যাস্ত হবে। সেটা দেখে যাব।
সন্তু বলল, একটা লঞ্চ দেখা যাচ্ছে ওই যে!
অর্ক বলল, ওটা মাছ ধরার ট্রলার। সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। দূরের দিকে চেয়ে দ্যাখো, আরও দু-তিনটে লঞ্চ রয়েছে। ওগুলো কাদের কে জানে! এবার এদিকটায় টহল দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
কিছু কিছু জেলেদের নৌকোও রয়েছে। এক-একজন জেলে জাল কাঁধে নিয়ে ফিরছে। এক জায়গায় বালির ওপর কয়েকজন কাঠকুটো জ্বেলে গোল হয়ে বসে আছে। সন্তু সেইদিকে হেঁটে গেল।
অলি বেশ বড় একটা দুর্গ বানিয়েছে। তারপর আর-একটা কিছু বানাতে গিয়ে থেমে গিয়ে বিভোর হয়ে চেয়ে আছে সমুদ্রের দিকে। একসময় সে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, অককাকু, এই সমুদ্রে দ্বীপ আছে?
অর্ক বলল, হ্যাঁ। সুন্দরবনের দিকে অনেক দ্বীপ আছে। তারপর যদি আন্দামান-নিকোবরের দিকে যাও, সেখানে কয়েক শো দ্বীপ!
অলি বলল, আমি একটা দ্বীপ দেখতে পাচ্ছি।
অর্ক বলল, কই? আমরা তো পাচ্ছি না!
অলি বলল, আমি মাঝে-মাঝে দেখছি, আবার দেখছি না। কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
অর্ক কাকাবাবুর দিকে ফিরে বলল, এখান থেকে তো কোনও দ্বীপ দেখা যায় না? ও দেখছে কী করে?
কাকাবাবু বললেন, ও-মেয়েটা ওরকমই। আমরা যা দেখি, তার চেয়ে ও কিছুটা বেশি দ্যাখে। তাই নিয়ে ও নিজের মনে থাকে।
পশ্চিম আকাশ লাল হয়ে গেছে, সূর্য নেমে গেছে অনেক নীচে। সমুদ্রের জলেও লাল আভা। একটা বড় জাহাজ এগিয়ে আসছে গভীর সমুদ্রের দিক থেকে, সেটাকে মনে হচ্ছে ছবিতে আঁকা জাহাজ। ঝাঁক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে।
অর্ক বলল, কাকাবাবু, একবার ওই কাগজটা আমাকে দিন তো!
কাগজটা নিয়ে একদৃষ্টিতে সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে সে কী যেন বিড়বিড় করতে লাগল।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কিছু অর্থ উদ্ধার করতে পারলে নাকি?
অর্ক বলল, মহিষ কালী মানে কী তা আমি ধরতে পারছি না। কিন্তু অন্য লেখাটা যতবার উচ্চারণ করছি, একটা জায়গার নাম আমার মনে আসছে।
কাকাবাবু কৌতূহলী হয়ে বললেন, তাই নাকি? কী নাম বলো তো?
অর্ক বলল, ধরা যাক লোকটা লেখাপড়া প্রায় কিছুই শেখেনি। যুক্তাক্ষর লিখতে জানে না। আপনি হিপনোটাইজ করেছিলেন, সেই ঘোরের মধ্যে অনেক বানান ভুল করেছে। এই সব ধরে নিলে অক্ষরগুলো নিয়ে একটা নাম তৈরি হয়। কক্সেসবাজার!
কাকাবাবু বললেন, কক্সেসবাজার? সে তো বাংলাদেশের প্রায় শেষ প্রান্তে সমুদ্রের ধারে একটা ছোট শহর।
অর্ক বলল, কক্স সাহেবের নামে বাজার, তাই কক্সেসবাজার। কেউ-কেউ শুধু কক্সবাজারও বলে। যেমন আমাদের ফ্রেজারগঞ্জ।
কাকাবাবু বললেন, ওই তুবরক কি বলতে চায় যে জোজোকে কক্সেসবাজারে কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে?
অর্ক বলল, তাই তো বোঝায়?
কাকাবাবু বললেন, বাংলাদেশে কি মানুষ কম পড়েছে? সেখানে শুধু-শুধু একটা সতেরো বছরের ছেলেকে নিয়ে যাবে কেন? উদ্দেশ্যটা কী?
অর্ক বলল, ঠিক বলেছেন, উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারলে অন্য সব কিছু সহজ হয়ে যায়। উদ্দেশ্যটি বোঝা যাচ্ছে না।
কাকাবাবু ভুরু কুঁচকিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করতে লাগলেন। তারপর বললেন, দ্বিতীয় লেখাটা যদি কক্সেসবাজার হয়, তা হলে প্রথম লেখাটারও একটা মানে বার করা যায়। মহিষ কালী নয়, মহেশখালি! কক্সেসবাজারের কাছে মহেশখালি নামে একটা বড় দ্বীপ আছে আমি জানি। সেখানে একটা পুরনো মন্দির আছে। অনেকদিন আগে আমি গিয়েছিলাম। ওই অঞ্চলের লোকেরা খ-কে ক-এর মতন উচ্চারণ করে। মহেশ হয়ে গেছে মহিষ। মহেশখালি!
অর্ক বলল, তা হলে দুটোরই মানে হয়।
কাকাবাবু উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, শিগগির চলো, ডাকবাংলোতে ফিরতে হবে। ওই লোকটাকে আরও জেরা করে কথা বার করতে হবে। সন্তু কোথায় গেল!
অর্ক সন্তুর নাম ধরে জোরে-জোরে ডাকতে লাগল।
কাকাবাবু বললেন, অলি, উঠে এসো, এবার আমাদের ফিরতে হবে।
অলি বলল, না, আমি এখন যাব না। আর একটু থাকব।
কাকাবাবু বললেন, না, আর থাকা যাবে না। বাংলোতে যাওয়া খুব দরকার।
অলি বলল, তোমরা যাও, আমার এখানে খুব ভাল লাগছে।
কাকাবাবু বললেন, তোমাকে একলা রেখে যেতে পারি নাকি? লক্ষ্মী সোনা, চলো, আমরা কাল সকালে আবার আসব!
অলি বলল, এখনও অন্ধকার হয়নি, কত রং দেখা যাচ্ছে। সকালটা তো অন্যরকম!
কাকাবাবু বাংলোয় ফেরার জন্য ছটফট করছেন। অলিকে বোেঝানো যাচ্ছে। কিছুতেই। সন্তু কাছে এলে কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তুই অলির কাছে থাক। একটু পরেই চলে আসিস। বেশি দেরি করিস না।
ক্রাচ বগলে নিয়ে কাকাবাবু জোরে-জোরে হাঁটতে লাগলেন বাংলোর দিকে। গাড়িটা রয়েছে বাংলোর সামনে, ড্রাইভার আর কনস্টেবলটি ঘুমোচ্ছে তার মধ্যে।
বসবার ঘরে ঢুকেই অর্ক বলে উঠল, এ কী!
মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে প্রফুল্ল, তার মাথায় থকথকে রক্ত। অর্ক তার পাশে বসে পড়ে আস্তে-আস্তে তার শরীরটা উলটে দিল।
কাকাবাবু পাশের ঘরটার দিকে তাকিয়ে বললেন, পাখি উড়ে গেছে।
সে-ঘরের দরজা খোলা। টাকমাথা লোকটা নেই। পড়ে আছে তার হাত বাঁধা দড়িটা।
অর্ক প্রফুল্লর বুকে হাত দিয়ে বলল, বেঁচে আছে। অজ্ঞান হয়ে গেছে, কেউ ওর মাথায় ভারী কিছু জিনিস দিয়ে মেরেছে।
কাকাবাবু বললেন, ছি ছি, আমাদের আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল।
অর্ক বলল, টাকলুটাকে আমি নিজে হাত বেঁধেছি। সেবাঁধন সে খুলবে কী করে? নিশ্চয়ই আর একজন কেউ এসেছিল ওকে সাহায্য করতে।
কাকাবাবু হঠাৎ অস্থিরভাবে বললেন, অলি! অলিকে রেখে এসেছি, ওর যদি কোনও বিপদ হয়? এক্ষুনি যেতে হবে।
অর্ক ড্রাইভার আর কনস্টেবলটিকে ডেকে তুলল। তাদের ধমকে বলল, তোমরা এই সন্ধেবেলা পড়ে-পড়ে ঘুমোচ্ছিলে, ভেতরে কী কাণ্ড হয়ে গেল জানো না!
তারা কাঁচুমাচু মুখে চুপ করে রইল। কনস্টেবলটিকে রেখে যাওয়া হল প্রফুল্লকে দেখাশুনো করার জন্য। কাকাবাবু গাড়িতে উঠে বসলেন।
সূর্য ড়ুবে গেছে, কিন্তু এখনও পুরোপুরি অন্ধকার হয়নি। অলি ঠিক তার আগের জায়গাটাতেই বসে আছে। সেখানে সন্তু নেই।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, অলি, অলি, সন্তু কোথায়?
অলি আঙুল তুলে একটা দিকে দেখিয়ে বলল, সন্তুকে ধরে নিয়ে যাবে।
ডান দিকে, অনেকটা দূরে দুটি ছায়ামূর্তি দৌড়োদৌড়ি করছে। তাদের মধ্যে একজন সন্তু, অন্যজন বেশ লম্বা। ঠিক যেন চোর-চোর খেলছে। লম্বা মূর্তিটা একবার সন্তুকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলছে, সন্তু পেছনে সরে যাচ্ছে।
অলি বলল, ওরা সন্তুকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
কাকাবাবু অলিকে দেখেই নিশ্চিত হলেন, তার পাশে গিয়ে হাতটা ধরলেন। সন্তুর জন্য তাঁর চিন্তা নেই। ওইরকম ভাবে কেউ সন্তুকে ধরতে পারবে না। অন্য লোকটির গায়ে যতই জোর থাকুক, সন্তু দারুণ ক্ষিপ্র।
ক্রাচ নিয়ে কাকাবাবু বালির ওপর দিয়ে তাড়াতাড়ি যেতেও পারবেন না, অর্ক ছুটে গেল সেদিকে। কিন্তু বেশি ব্যস্ত হয়ে সে ভুল করে ফেলল। কাছে গিয়ে লোকটিকে ধরে ফেলা উচিত ছিল। একবার সেই লম্বা ছায়ামূর্তিটা সন্তুকে জাপটে ধরে মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে দেখে অর্ক তার রিভলভার ওপরের দিকে তুলে গুলি ছুড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে সেই মূর্তিটা সন্তুকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে গেল জলের দিকে, সেখানে কয়েকটা মাছ-ধরা নৌকোর আড়ালে আর তাকে দেখা গেল না।
রিভলভার উঁচিয়ে অর্ক সেদিকে গিয়ে লোকটাকে খুঁজল। কিন্তু তাকে আর পাওয়া গেল না কিছুতেই। সে কি জলে নেমে গেছে? ওদের কাছে টর্চ নেই, এর মধ্যে আরও অন্ধকার হয়ে গেল।
কাকাবাবু দাঁড়িয়ে রইলেন অলির হাত ধরে। ওই লোকটা যে-ই হোক, সে অলিকে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। অথচ সেটাই সহজ ছিল। সন্তুকে ধরার চেষ্টা করছিল কেন?
লোকটিকে খুঁজে না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে অর্ক আর সন্তু ফিরে আসবার পর অলি খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, সন্তু, তুমি ইচ্ছে করে ধরা দিলে না কেন? তা হলে বেশ ভাল হত! জোজো যেখানে আছে, তোমাকেও সেখানে নিয়ে যেত। তোমরা দুজনে বেশ একসঙ্গে থাকতে!