ইন্দ্ৰজাল বা জাদু
সারা পৃথিবীর সব প্রাচীন ধর্মেই ইন্দ্ৰজালের বিপুল ভূমিকা ছিল। ভারতবর্ষেও তাই ছিল। ধর্মচৰ্যার কোনো অংশকে ইন্দ্ৰজালরূপে পৃথক করে নেওয়ার প্রবণতা স্পষ্টতই অযৌক্তিক, কেননা দেবকাহিনী ও যজ্ঞানুষ্ঠানের সম্পর্ক নিতান্তই ছদ্ম-যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। একটি বিশেষ অর্থে সমস্ত অনুষ্ঠানই মূলত ইন্দ্ৰজাল-নির্ভর; যজ্ঞে আচরণীয় ক্রিয়াকাণ্ড মূলত ও আদিতে স্বতন্ত্রই ছিল, কেবলমাত্র কোনো ভঙ্গুর ও অর্ধবিস্মৃত যোগসূত্র তাদের দেবকাহিনীর সঙ্গে সম্পূক্ত করে তোলে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে কল্যাণপ্ৰসূ ইন্দ্ৰজালের সঙ্গে অভিচার বা নেতিবাচক ও ক্ষতিকারক ইন্দ্ৰজাল খোলাখুলিভাবেই বর্ণিত হয়েছে। বহু আনুষ্ঠানিক ক্রিয়ার অনুপুঙ্খকে অবচেতনভাবে ঐন্দ্ৰজালিক শক্তিতে মণ্ডিত করা হয়েছে। যজ্ঞাগ্নির অন্যতম মৌলিক বৃত্তি হ’ল দানব, ভূতপ্রেত ও পিশাচ জাতীয় অন্ধকারের অপশক্তিগুলির বিতাড়ন। যজ্ঞের কিছু কিছু উপাদানও ঐন্দ্ৰজালিক শক্তিসম্পন্ন বলে বিবেচিত হতে; বিশেষ স্তোত্র অনুষ্ঠানের ব্যবহৃত হত। তবে, কোনো অনুষ্ঠান প্রচলিত যজ্ঞের ক্রমের বিপরীতক্রমে প্ৰযুক্ত হলে তা শক্রকে ধবংস করে, এই ছিল সাধারণ বিশ্বাস। সমগ্ৰ জনগোষ্ঠী যেসব ভাবী অমঙ্গল চিহ্ন বা সংস্কারে বিশ্বাসী ছিল, গৃঢ় আনুষ্ঠানিক শক্তিতে অম্বিত হয়ে সেসব ব্রাহ্মণ সাহিত্যের অঙ্গীভূত; অনুপুঙ্খের ব্যাখ্যায়। এই প্রবণতা স্পষ্ট। ঐতরেয়, শতপথ ও তৈত্তিরীয়ে এর বেশ কিছু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। অক্ষরের ঐন্দ্ৰজালিক শক্তি সম্পর্কে বিশ্বাসও ব্রাহ্মণ সাহিত্যে বহুক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। অপেক্ষাকৃত বিলম্বে আবিষ্কৃত সৌত্ৰিমণী যাগ যেহেতু বহু জনগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণের ফল, তাই তাতে বিচিত্র ধরনের লোকায়ত ঐন্দ্ৰজালিক বিশ্বাস অভিব্যক্তি হয়েছে, যেমন শতপথে (১৩ : ৯ : ৩) কথিত হয়েছে যে, সৌত্রিমণীতে নেকড়েবাঘ, বাঘ ও সিংহের লোম সুরায় নিক্ষিপ্ত হয় – সেইসঙ্গে মিশ্রিত হয় নেকড়ে বাঘের মূত্র (ওজঃ বা বীরত্বের জন্য), বাঘের অন্ত্র (জুতি বা গতির জন্যে), সিংহের রক্ত (মৃত্যুর জন্যে)। আর্যরা যে অঞ্চলে থেকে এসেছিলেন সেখানে বাঘের বসতি ছিল না; তারা পরিক্রমার পথে মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা ভারতবর্ষে উপনীত হয়ে বাঘের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। স্পষ্টই বলা হয়েছে যে, সৌত্ৰিমণী যাগটি আদিতে অসুরদের কাছে ছিল, পরে তা দেবতাদের কাছে উপস্থিত হয়। বলাই বাহুল্য, প্ৰাগাৰ্য জাতিদেরই ‘অসুর’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।
সৌত্ৰিমণী যাগের দক্ষিণারূপে নিম্নোক্ত দ্রব্যগুলি নির্দেশিত হয়েছে : নতুন বস্ত্ৰ, কাজল, পায়ের মলম, পুরাতন যব, পুরাতন আসন ও বালিশ। এখানে স্পষ্টতই আমরা সাধারণ জনতার মধ্যে প্রচলিত–সম্ভবত, অসুর বা প্ৰাগাৰ্য জাতির ব্যবহার্য বিভিন্ন উপাদানের দেখা পাচ্ছি, কেননা কেবলমাত্র এখানেই পুরাতন দ্রব্য দীর্ঘায়ুকে সুনিশ্চিত করে এমন বিশ্বাসের কথা পাই। অন্যত্র কোথাও যজ্ঞ দক্ষিণারূপে পুরাতন দ্রব্য প্রদত্ত হয়নি। সম্ভবত প্ৰাগাৰ্য উপাদানই ‘পুরাতন’ রূপে তখন গণ্য হতে পারত।
মারুতিহােমের সপ্তম আহুতি, শতরুদ্রীয় হােম, অগ্ন্যান্ধান, প্রবর্গ্য যাগ প্রভৃতির বিভিন্ন অনুপুদ্ধে ইন্দ্ৰজালের বহু বিচিত্র লোকায়ত বিশ্বাস অভিব্যক্ত হয়েছে। ঐ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী প্রেত্যাবিষ্ট মানুষই উন্মত্তার শিকার এবং কেবলমাত্র উপযুক্ত ঐন্দ্ৰজালিক ক্রিয়ার মাধ্যমেই এর নিরাময় সম্ভব। শক্রকে পর্যুদন্ত করার প্রয়োজনে ইন্দ্ৰজাল বারবার প্রযুক্ত হয়েছে। শতপথ ব্ৰাহ্মণে যজ্ঞাগ্নি সম্পর্কিত বক্তব্যে (১১ : ৫ : ৩, ৮-১২) ভাবী অমঙ্গলের আশঙ্কা ব্যক্ত হয়েছে; এতে বোঝা যাচ্ছে, সমাজ ক্রমশ ভাবী অমঙ্গল গণনা ও ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণের বিধিবদ্ধ পদ্ধতি নির্মাণের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। শেষ পর্যায়ের সামবেদীয় ব্রাহ্মণগুলি বিশেষত ষড়বিংশ ও সামবিধান, গাৰ্হস্থ্য ও গোতীজীবনের যাবতীয় সম্ভাব্য ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; এ অংশগুলি ভবিষ্যদ্বাণী, ভাবী অমঙ্গল আশঙ্কা ও দুর্ঘটনার ইঙ্গিতে পরিপূর্ণ। কখনো কখনো কুসংস্কারপূর্ণ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও দেখা দিয়েছে, যেমন শতপথে রয়েছেঃ ‘একজন নায়ী, একজন শূদ্র, একটি কুকুর ও একটি কালো পাখি-এ সমস্তই মিথ্যা, এদের দেখা উচিত নয়, যাতে সমৃদ্ধি ও অমঙ্গল, আলো ও অন্ধকার, সত্য ও অসত্য পরস্পর মিশ্রিত হতে না পারে।’ (১৪ : ১ : ১ : ৩১)। এই তালিকায় নারী ও শূদ্রের অন্তর্ভুক্তি তাদের সামাজিক অবস্থানের নির্মম সত্যই উদঘাটিত করেছে।