॥ ৬ ॥
ইন্সপেক্টর ভৌমিকের সঙ্গে কথা বলে ফেলুদা জানল যে পুলিশ একটা গুণ্ডার দলকে সন্দেহ করছে। নেপালবাবুর নাকি একটা সোনার ঘড়ি ছিল সেটা খুনের পর পাওয়া যায়নি। খুবই দামী ঘড়ি, এবং সেটাই হয়ত খুনের কারণ হতে পারে। ফেলুদা বলল, ‘তাহলে থিয়েটারের সঙ্গে এ খুনের কোনো সম্পর্ক নেই বলছেন।’ তাতে ভৌমিক বললেন ওঁর তাই ধারণা। একটা গুণ্ডার দল কিছুদিন থেকেই নাকি ওই অঞ্চলে উৎপাত করছে। তারা প্রায় সকলেই দাগী আসামী। ছুরিটা নেপালবাবুর গায়েই বিঁধে ছিল, কিন্তু তাতে কোনো আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া যায়নি। সব শেষে ভৌমিক বললেন, তিনি আশা করছেন দিন তিনেকের মধ্যেই কেসটার নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। ‘এবার আর আপনাকে কোনো ভূমিকা নিতে হবে না,’ বললেন ভদ্রলোক।
ফেলুদা টেলিফোনটা রেখে বলল, ‘ম্যানেজারকে ওই ফোনটা করে নে। অভিনেতাদের একবার জেরা করা দরকার।’
আমি তখনই অপ্সরা থিয়েটারে ফোন করলাম। বার তিনেক ডায়াল করবার পর লাইন পেলাম। ম্যানেজার বললেন, ‘পুলিশ এক দফা জেরা করে গেছে সকলকে। তবে আপনারা যদি আবার করতে চান তা হলে বিষ্যুদবার সকাল সাড়ে দশটায় আসুন। সেদিন এগারোটায় রিহার্সাল আছে; আপনাদের আধ ঘণ্টায় কাজ শেষ করতে হবে।’
আমি ফোনটা নামিয়ে রাখার পর ফেলুদা বলল, ‘টপ তিনজন আর ওই নতুন অ্যাকটরটিকে জেরা করলেই হবে।’
বিষ্যুদবার সাড়ে দশটার পাঁচ মিনিট আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম অপ্সরা থিয়েটারে। ফেলুদাকে দেখে এসেছি তার আজও পায়ে ব্যথা রয়েছে। লালমোহনবাবু আজ আরো স্মার্ট; তার হাঁটা চলা এবং কথা বলার ঢংই বদলে গেছে।
আমরা প্রথমে ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে বললাম যে আমরা তিনজন টপ অভিনেতা আর নতুন অভিনেতাটিকে প্রশ্ন করতে চাই।
‘তাহলে ধরণীকে দিয়ে শুরু করুন। ধরণী সান্যাল। সে এখানের সিনিয়ারমোস্ট আর্টিস্ট; ছাব্বিশ বছর হল কাজ করছে।’
আমাদের জেরার জন্য ম্যানেজারের পাশের ঘরটা খালি করে দেওয়া হল। ঘরে একটা সোফা আর তিনটে চেয়ার রয়েছে।
একজন বছর পঞ্চাশের ভদ্রলোক এসে ঢুকলেন। সিংহের কেশরের মতো চুল—তার বেশির ভাগই সাদা—ঢুলুঢুলু চোখ, গায়ের রং মাঝারি।
‘আমার নাম ধরণী সান্যাল,’ বললেন ভদ্রলোক, ‘আপনারা গোয়েন্দা?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, সোজাসুজি বললেন লালমোহনবাবু। ‘আমরা নেপাল লহিড়ীর ব্যাপারে তদন্ত করছি।’
‘নেপাল হুম্কি চিঠি পাচ্ছিল,’ বললেন ধরণীবাবু। ‘তাকে বললুম সাবধান হতে, সে কথা কানেই তুললে না। এর মধ্যে গেছে মতি মিস্ত্রি লেনে। আরে বাবা, বন্ধুর সঙ্গে কদিন না হয় নাই দেখা করলে। আমি ত ওকে পুলিশে খবর দিতে বলেছিলাম, কিন্তু ও গা-ই করেনি। ঠিক এরকম হয়েছিল আমাদের আরেক অভিনেতার—মহীতোষ রায়। অবিশ্যি মহীতোষের মৃত্যুটা থিয়েটারের পক্ষে তত বড় লস্ নয়।’
‘নেপালবাবুর কোনো শত্রু ছিল বলে জানেন?’
‘থিয়েটারের টপ পোজিশনে বসে থাকলে তার শত্রু থাকবেই। মানুষের ছয় রিপুর মধ্যে একটি হল মাৎসর্য। নেপালের শত্রু থাকবে না? তবে যদি জিগ্যেস করেন কোন্ শত্রু এই কুকীর্তি করেছে, বা শত্রু ছাড়া অন্য কেউ করেছে কিনা, তা বলতে পারব না।’
‘আপনার বাড়িতে তাঁর যাতায়াত ছিল?’
‘আজ্ঞে না। এমনিই থিয়েটারে হপ্তায় তিন দিন দেখা হচ্ছে, তার উপর সে আমার এমন বন্ধু ছিল না যে অন্যদিনও দেখা করব।’
‘যেদিন খুন হয় সেদিন সন্ধ্যাবেলা আপনি কী করছিলেন?’
‘কালিকিঙ্কর ঘোষের বাড়ি কেত্তন শুনছিলুম। ইচ্ছে করলে যাচাই করে নিতে পারেন।’
‘ঠিক আছে; আপনাকে আর কোনো প্রশ্ন করার নেই।’
এবার এলেন দীপেন বোস। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স, মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল, ঠোঁটের কোণে একটা সিগারেট, দাড়ি-গোঁফ নেই।
ভদ্রলোক প্রথমেই বললেন, ‘আমি আর নেপাল প্রায় এক সঙ্গেই অপ্সরা থিয়েটারে জয়েন করি। সে ছিল জাত অভিনেতা। আমারও অ্যাম্বিশন ছিল, কিন্তু দেখলাম নেপালের সঙ্গে পেরে উঠব না।’
‘তাতে আপনার মনে ঈর্ষা জাগেনি?’
‘তা জেগেছে বৈ কি। বিলক্ষণ জেগেছে। অনেকদিন মনে মনে ভেবেছি—এই লোকটা আমার পথে কাঁটা হয়ে রয়েছে—এটাকে সরানো যায় না?’
‘এই চিন্তাকে কার্যে পরিণত করার ইচ্ছা হয়নি কোনোদিন?’
‘পাগল! আমরা ছাপোষা লোক। আমাদের দিয়ে কি খুনখারাপি হয়? নাটক করি, তাই নানারকম নাটকীয় চিন্তা মাথায় আসে—ব্যস্, ওই পর্যন্ত।’
‘যেদিন খুনটা হয় সেদিন সন্ধ্যাবেলা আপনি কী করছিলেন?’
‘বায়স্কোপ দেখছিলাম। তবে প্রমাণ দিতে পারব না। টিকিটের অর্ধাংশ আমি কখনো রাখি না।’
‘কী ছবি দেখলেন?’
‘মনের মানুষ।’
‘কেমন লাগল?’
‘থার্ড ক্লাস।’
‘ঠিক আছে, আপনি আসতে পারেন।’
তৃতীয় অভিনেতার নাম ভুজঙ্গ রায়। এঁর বয়স পঞ্চাশের উপর, চোখা নাক, চোখ কোটরে বসা, গাল তোবড়ানো, মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে।
‘আপনার সঙ্গে নেপালবাবুর সদ্ভাব ছিল?’
‘এই থিয়েটারে নেপালই ছিল আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু।’
‘তাঁর মৃত্যু সম্বন্ধে আপনার কিছু বলার আছে?’
‘এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি থিয়েটার-মহলে অনেকদিন হয়নি। নেপাল ছিল আশ্চর্য অভিনেতা। আমার সঙ্গে কোনোদিন ক্ল্যাশ হয়নি, কারণ ও করত নায়কের রোল আর আমি করতুম ক্যারেকটার পার্ট।’
‘উনি হুম্কি চিঠি পাচ্ছিলেন সেটা আপনাকে বলেছিলেন?’
‘প্রথম দিনই। আমি ওকে ওয়ার্নিং দিই—এসব চিঠি উড়িয়ে দিও না, আর বিশেষ করে মতি মিস্ত্রি লেনে কিছুদিন যাওয়া বন্ধ কর। ও পাড়াটা নটোরিয়াস। কে কার কথা শোনে? নেপালের বিশ্বাস ছিল তার আয়ু বিরাশি বছর—সেটা কেউ খণ্ডাতে পারবে না।’
‘তাহলে আপনার ধারণা গুণ্ডার হাতেই তাঁর মৃত্যু হয়?’
‘তাই ত মনে হয়, কারণ তার দামী ঘড়িটাও ত পাওয়া যায়নি। সোনার ওমেগা ঘড়ি, দাম ছিল সাত হাজার টাকা।’
ভুজঙ্গবাবুকে ছেড়ে দিলাম। উনি আমাদের ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলেন।
এবার এলেন নতুন অভিনেতা, নাম সুধেন্দু চক্রবর্তী। প্রথম দেখে একটু হকচকিয়ে যেতে হয়, কারণ মোগলাই দাড়ি আর গোঁফ দেখে মনে হয় উনি মেক-আপ নিয়ে রয়েছেন। বললেন, অপ্সরা থিয়েটারে আলমগীর হচ্ছে শুনেই তিনি দাড়ি রাখতে আরম্ভ করেন। আগে শুধু গোঁফ ছিল।
‘আপনি এর আগে কোথায় অভিনয় করতেন?’ লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন।
‘কোথাও না। দু-একটা আপিস ক্লাবে করেছি। আমার প্লাইউডের ব্যবসা ছিল। তবে অভিনয় আমার নেশা। আর কিছু না করার থাকলে আমি নাটকের বই খুলে পার্ট মুখস্থ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় করতাম। এখন অবশ্য তার আর দরকার হবে না।’
‘আপনি কি আলমগীরে পার্ট পেয়ে গেছেন?’
‘সে বিষয় সন্দেহ নেই, তবে কোন্ পার্ট সেটা এখনো স্থির হয়নি। মেন পার্টও হতে পারে।’
‘আপনি থাকেন কোথায়?’
‘অ্যামহার্স্ট রো।’
‘ব্যবসা কি এখন ছেড়ে দেবেন?’
‘হ্যাঁ। অ্যাকটিংই আমার ধ্যান ছিল; সুযোগ পাইনি বলে ব্যবসা চালাচ্ছিলাম।’
ফেলুদাকে যাতে ঠিকভাবে রিপোর্ট দিতে পারি তাই আমি কথোপকথনটা টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করে নিচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম লালমোহনবাবু প্রশ্নগুলো করছিলেন নিজেকে ফেলুদা হিসেবে কল্পনা করেই। এটা আমাদের কাছে একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা।
সুধেন্দুবাবুকে আর একটাই প্রশ্ন করার ছিল।
‘আপনার সঙ্গে নেপালবাবুর আলাপ হয়েছিল?’
‘সামান্যই। তবে ওঁর অভিনয় আমি আগে অনেক দেখেছি। খুব ভালো লাগত।’