আরও প্রায় আধ ঘণ্টা পরে। ঘরের বন্ধ জানালাগুলো খুলে দিতেই প্রথম ভোরের স্নিগ্ধ আলো ঘরের মধ্যে এসে অবারিত প্রসন্নতায় যেন চারিদিক ভরিয়ে দেয়।
পুলিসের গাড়িতে করেই ইতিমধ্যে মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়ে গিয়েছে।
দুঃশাসন চৌধুরী, দালাল সাহেব, ডাঃ সানিয়াল ও ডাঃ সমর সেন ব্যতীত সকলকেই কিরীটী বিদায় দিয়েছে।
কিরীটী তার ঘরে বসে কথা বলছিল দুঃশাসন চৌধুরীর সঙ্গে।
রুচিরা দেবীকে তাহলে আপনিই রায়বাহাদুরের মৃত্যুসংবাদটা দিয়েছিলেন, মিঃ চৌধুরী?
নিশ্চয়ই না। সত্যি, আমি এখনও ভেবে পাচ্ছি না এত বড় ডাহা মিথ্যে কথাটা মেয়েটা বলে গেল কি করে!
দালাল সাহেব হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, রুচিরা দেবীর সঙ্গে আপনাদের কোন মনোমালিন্য নেই তো দুঃশাসনবাবু?
একটা পুঁচকে ফাজিল প্রকৃতির মেয়ের সঙ্গে আমার মনোমালিন্যের কি কারণ থাকতে পারে বলুন তো দালাল সাহেব! চিরটাকাল গান্ধারী আর তার স্বামী হৃষিকেশ দাদার ঘাড়ে বসে খেয়েছে। হৃষিকেশের সঙ্গে গান্ধারীর বিয়েতে মোটেই আমার মত ছিল না। এককালে ওরা ধনী ছিল কিন্তু হৃষিকেশের সঙ্গে যখন গান্ধারীর বিয়ে হয় তখন ওদের দুবেলা ভাল করে আহার জুটত না। থাকবার মধ্যে ছিল পৈতৃক আমলের একটা নড়বড়ে পুরনো বাড়ি আর দেহে ব্যাধি-দুষ্ট রূপ–
ব্যাধি-দুষ্ট রূপ!
তাছাড়া কি! ঐ রূপই ছিল, আর সেই সঙ্গে ছিল অতীত ধনদৌলতের মিথ্যে উগ্র একটা অহঙ্কার। এবারে এসে যখন দেখলাম এখনও ওরা দাদার ঘাড়েই চেপে বসে আছে, দাদাকে বলেছিলাম ওদের একটা ব্যবস্থা করে এখান থেকে অন্যত্র সরিয়ে দিতে। তা দাদা কি আমার কথা শুনলেন!
আচ্ছা এবারে আপনি তাহলে যেতে পারেন দুঃশাসনবাবু।
দুঃশাসন চৌধুরী ঘর থেকে চলে গেলেন কিরীটীর অনুমতি পেয়ে।
.
একটু চা পেলে মন্দ হত না—কিরীটী বলে ঐ সময়।
ডাঃ সানিয়াল বললেন, চলুন না আমার ঘরে।
তাই চলুন।
কিরীটী, দালাল সাহেব, ডাঃ সানিয়াল ও ডাঃ সেন অতঃপর সকলে ডাঃ সানিয়ালের ঘরে এসে প্রবেশ করে।
ডাঃ সানিয়াল ইলেকট্রিক স্টোভে কেতলীতে জল চাপিয়ে দিলেন।
হঠাৎ কিরীটী বলে, আপনারা বসুন, আমি দুমিনিটের মধ্যে আসছি। চা হতে হতেই আমি এসে পড়ব।
কিরীটী কথাটা বলে ডাঃ সানিয়ালের ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে কি ভেবে যেন ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল।
শকুনি ঘোষ!
একবার শকুনির খোঁজটা নেওয়া দরকার। শকুনির ঘরটা কিরীটীর চেনা।
দোতলারই শেষ প্রান্তের ঘরটায় শকুনি থাকে।
কিরীটী বারান্দা অতিক্রম করে শকুনির ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়।
ঘরের দরজা বন্ধ। কি ভেবে হাত দিয়ে ঈষৎ ধাক্কা দিতেই দুয়ার খুলে গেল—দরজা ভেজানো ছিল।
মাঝারি আকারের ঘরটি। খোলা জানালাপথে ভোরের পর্যাপ্ত আলো ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করেছে।
সেই আলোয় কিরীটী দেখল, অদূরে শয্যার ওপরে শকুনি অকাতরে তখনও ঘুমোচ্ছ।
সত্যিই শকুনি ঘুমোচ্ছিল। সমস্ত ঘরের মধ্যে একটা এলোমেলো বিশৃঙ্খলা। একটা ছন্নছাড়া শ্রীহীন বিপর্যয়ের মধ্যে যেন পরম নির্বিকার ভাবেই একান্ত নিশ্চিন্তে অঘোরে নিদ্রাভিভূত শকুনি ঘোষ। বাড়ির মধ্যে যে কিছুক্ষণ মাত্র পূর্বে একটা নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটে গিয়েছে—ওর নিদ্রায় তাতে কোন ব্যাঘাত ঘটেনি।
পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে শকুনি ঘোষ। গায়ের ওপরে একটা কম্বল চাপানো।
ঘরের একধারে একটা চেস্ট-ড্রয়ার, কপাট দুটো তার খোলা।
একরাশ জামাকাপড় এলোমেলো ভাবে সেই চেস্ট-ড্রয়ারটার মধ্যে স্তুপীকৃত করা আছে।
একটা বেহালা দেওয়ালের গায়ে পেরেকের সঙ্গে ঝুলছে।
ঘরের এক কোণে একটা জলের কুঁজো এবং তার আশপাশের মেঝে জলে যেন থৈ থৈ করছে।
কিরীটী তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখে।
হঠাৎ নজরে পড়ে, একটা ব্যবহৃত ধুতি ও একটা মলিন তোয়ালে ঘরের কোণে পড়ে আছে।
কিরীটী নিঃশব্দ পদসঞ্চারে নিদ্রিত শকুনির শয্যার একেবারে সামনেটিতে এসে দাঁড়ায়।
আবার কি ভেবে সেখান থেকে এগিয়ে গেল—যেখানে ক্ষণপূর্বে তার নজরে পড়েছিল একটা ব্যবহৃত ধুতি ও মলিন একখানা তোয়ালে।
ঈষৎ নিচু হয়ে কিরীটী মেঝে হতে প্রথমে তোয়ালেটা তুলে নিল হাতে।
স্থানে স্থানে তোয়ালেটা তখনও ভিজে বলে মনে হয় কিরীটীর। বুঝতে কষ্ট হয় না তার, রাতেই কোন একসময় ঐ তোয়ালেটা নিশ্চয়ই ব্যবহার করা হয়েছে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিঃশব্দে তোয়ালেটা কিরীটী চোখের সামনে মেলে ধরে পরীক্ষা করতে থাকে।
সহসা কিরীটীর দুচোখের দৃষ্টিতে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল চকিতে। তোয়লের সিক্ত অংশগুলিতে একটা মৃদু লালচে আভা যেন।
সিক্ত অংশের ঈষৎ লালচে আভা যেন কিসের এক ইঙ্গিত দেয়।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেই সিক্ত অংশগুলি পরীক্ষা করে একসময় আবার কিরীটী তোয়ালেটা ফেলে ধুতিটা হাতে তুলে নিল।
তোয়ালেটার মত অতঃপর ধুতিটাও ভাল করে পরীক্ষা করে দেখল।
ধুতিরও কোন কোন অংশ তখনও ঈষৎ সিক্ত বলেই মনে হয় এবং সেই সিক্ত অংশগুলিতে অস্পষ্ট একটা রক্তিমাভা যেন পরিষ্কার চোখের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে।
কিরীটী অতঃপর একটা দুঃসাহসিক কাজ করে, ধুতির ঈষৎ লালিমাযুক্ত ভিজে অংশ হতে একটা টুকরো ছিঁড়ে নিজের পকেটে রেখে দিল।
আর ঠিক ঐ সময় মৃদু একটা শব্দ ওর কানে প্রবেশ করতেই মুহূর্তে ও ফিরে তাকাল।
শকুনির ঘুম ভেঙেছে।
এবং নিদ্রাভঙ্গে শকুনি ইতিমধ্যে কখন যেন শয্যার ওপরে উঠে বসেছে।
এবং কেমন যেন বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে শকুনি।
প্রথমটায় কিরীটীও যে একটু বিব্রত হয়ে পড়েনি তা নয়, কিন্তু অসাধারণ প্রত্যুৎপন্নমতিত্বই তাকে যেন উপস্থিত পরিস্থিতিতে সজাগ ও সক্রিয় করে দেয়।
মৃদু হেসে যেন কিছুই হয়নি এইরকম একটা ভাব দেখিয়ে কিরীটী শয্যার ওপরে সদ্য নিদ্রাভঙ্গে উপবিষ্ট শকুনির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, ঘুম ভাঙল মিঃ ঘোষ?
শকুনি মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয়, হ্যাঁ। আপনি?
আপনার খোঁজেই এসেছিলাম আপনার ঘরে। দেখলাম আপনি ঘুমোচ্ছেন তাই—
আমার খোঁজে এসেছিলেন? কেন?
কয়েকটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করবার ছিল।
কথা? কি কথা?
গতকাল রাত্রে রায়বাহাদুরের ঘর থেকে হঠাৎ যে আপনি কোথায় উধাও হয়ে গেলেন আপনার আর দেখাই পেলাম না!
হ্যাঁ। বড্ড ঘুম পাচ্ছিল তাই ঘরে এসে শুয়ে পড়েছিলাম।
কখন শুতে এসেছিলেন? কিরীটী দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে।
তা রাত তখন গোটাতিনেক হবে বোধ করি। আগের রাত্রে মামার ঘরে জেগেছিলাম। মামার খবর কিছু জানেন–কেমন আছেন তিনি?
কিরীটী শকুনির প্রশ্নে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল শকুনির মুখের দিকে।
শকুনির মুখ একান্ত, নির্বিকার। দুচোখের দৃষ্টি একান্ত সহজ ও সরল।
কোন পাপ দুরভিসন্ধি বা দুস্কৃতির চিহ্নমাত্রও যেন তার চোখ-মুখের মধ্যে কোথাও নেই।
সহজ সরল নিস্পাপ দৃষ্টি।
মামার সেই দুঃস্বপ্নটা নিশ্চয়ই এখন আর অবশিষ্ট নেই—শকুনি বলে।
দুঃস্বপ্ন?
হ্যাঁ। শকুনি মৃদু হেসে বলে, তাঁর সেই দুঃস্বপ্নের কথা আপনি তো জানেন। কাল রাত্রে ঠিক চারটের সময় নাকি তিনি নিহত হবেন, তাঁর সেই ফোরকাস্ট—ভবিষ্যদ্বাণী নিজের মৃত্যু সম্পর্কে! আজ কয়েকদিন ধরে কি যে তাঁর মাথার মধ্যে চেপে বসেছিল আর সেজন্য কিই না এ কদিন ধরে তিনি করেছেন। এমন কি আপনাকে পর্যন্ত তিনি তাঁর পরিকল্পিত হত্যা-রহস্যের মীমাংসা করবার জন্য ডেকে এনেছেন। তা এখন তাঁর সে ভয় কেটেছে তো?
মৃদু কণ্ঠে কিরীটী জবাব দিল, হ্যাঁ।
ভেবে দেখুন একবার ব্যাপারটা মিঃ রায়, মামার মত একজন বুদ্ধিমান বিচক্ষণ ব্যক্তি, তাঁর মাথার মধ্যেও কি সব উদ্ভট কল্পনা!
উদ্ভট কল্পনা? কিরীটী শকুনির মুখের দিকে তাকায়।
তাছাড়া আর কি বলি বলুন! কোন সেই ম্যানের পক্ষে এটা চিন্তা করাও তো যায় না। এমন কথা কস্মিনকালেও শুনেছেন কখনও যে মানুষ তার হত্যার কথা পূর্বাহ্নেই জানতে পেরেছে!
হঠাৎ যেন কিরীটীর কণ্ঠস্বরে প্রত্যুত্তরটা বজ্রের মতই ঘোষিত হল, গম্ভীর কণ্ঠে কিরীটী বলে, শকুনিবাবু, দুঃস্বপ্নই হোক বা অন্য কিছুই হোক, নিষ্ঠুর নির্মম সত্য হয়েই ব্যাপারটা গতকাল রাত্রে কিন্তু প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে।
অ্যাঁ! কি বলছেন আপনি? কতকটা যেন একটা চাপা আর্ত কণ্ঠেই শকুনি ঘোষ কথা উচ্চারণ করে বিস্ময়-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সম্মুখে দণ্ডায়মান কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
হ্যাঁ, সত্যিসত্যিই গতকাল ঠিক রাত্রি চারটের সময়েই আপনার মামা রায়বাহাদুর নিহত হয়েছেন।
বলেন কি মিঃ রায়! সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি। তিনি নিহত হয়েছেন।
আমি—আমি যে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না মিঃ রায়। মামা নিহত হয়েছেন? কে-কে তাঁকে হত্যা করল?
নিহত যখন হয়েছেন নিশ্চয়ই তখন কেউ না কেউ তাঁকে হত্যা করেছে এ অবধারিত।
মামা নেই! সহসা শকুনি ঘোষের দুটি চোখ অশ্রুতে টলমল করে এবং কং ষরটা যেন বুজে আসে।
কিরীটী নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শকুনি ঘোষের মুখের দিকে, অশ্রুপ্লাবিত তার দুটি চোখের দিকে।
বেদনাক্লিষ্ট অশ্রুসিক্ত দুটি চোখের দৃষ্টি ও সমগ্র মুখখানি যেন সত্যিই বিষণ্ণ-কাতর একটি অনির্বচনীয় ভাবাবেগে নিবিড় হয়ে উঠেছে।
রায়বাহাদুরের হত্যাসংবাদটা যে একান্ত মর্মান্তিক ভাবেই শকুনি ঘোষকে একটা আঘাত দিয়েছে সে বিষয়ে যেন কোন সন্দেহ তার আর থাকে না।
সহসা শকুনি ঘোষ দুহাতে মুখটা ঢেকে বোধ হয় অদম্য ক্রন্দনের বেগকে বোধ করবার প্রয়াসে সচেষ্ট হয়ে ওঠে।
কিরীটী চেয়ে থাকে কেবল শকুনি ঘোষের মুখের দিকে।
অনেক প্রশ্নই তার মনের মধ্যে ঐ মুহূর্তে আনাগোনা করছিল।
কিন্তু সে নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে থাকে যেন।
কারণ কিরীটীর ইচ্ছে কিছু প্রশ্ন তার দিক থেকে উচ্চারিত না হয়ে শকুনির দিক থেকেই প্রথমে আসুক।
যা বলবার শকুনিই স্ব-ইচ্ছায় প্রথমে বলুক, তারপর যা বলবার সে বলবে।
ধীরে ধীরে শকুনি নিজেকে যেন কিছুটা সামলে নেয় এক সময়।
তারপর ধীরে ধীরে মুখ থেকে হাত সরিয়ে যখন কিরীটীর মুখের দিকে তাকায় তখনও তার অশ্রুসিক্ত চোখের দৃষ্টিতে যেন একটা মর্মঘাতী বেদনাই প্রকাশ পাচ্ছিল।
সত্যি মিঃ রায়, এখনও যেন আমি ভাবতেই পারছি না এত বড় একটা দুর্ঘটনা সত্যিসত্যিই ঘটে গেছে। উঃ, কি ভয়ানক! মামা নেই? মামাকে হত্যা করা হয়েছে, এ যেন এখনও। আমার কল্পনাতেও আসছে না।
কিন্তু যা হবার, যতই মর্মান্তিক বা দুঃখের হোক ঘটে গিয়েছে মিঃ ঘোষ। এখন যদি আমরা সেই হত্যাকারীকে ধরে আইনের হাতে তুলে দিতে পারি, তবেই না আমাদের দুঃখের কিছুটা সান্ত্বনা মিলবে!
হত্যাকারীকে?
হ্যাঁ। হত্যাকারীকে যেমন করে হোক আমাদের ধরতেই হবে।
কিন্তু–
এর মধ্যে কোন কিন্তু নেই মিঃ ঘোষ। হত্যাকারীকে আমরা ধরবই, তবে তাকে ধরতে হলে সর্বাগ্রে আমাদের যে বস্তুটির প্রয়োজন সেটা হচ্ছে আমাদের পরস্পরকে পরস্পরের সহযোগিতা করা। এক্ষেত্রে পরস্পর আমরা পরস্পরের সহযোগী না হলে আপনার মামা রায়বাহাদুরের নিষ্ঠুর মৃত্যুরহস্যের কোন কিনারাই করতে পারব না জানবেন।
কিরীটীর কথার শকুনি কোন জবাবই দেয় না, নিঃশব্দে বসে থাকে সামনের দিকে শূন্য
দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
আবার একসময় কিরীটীই কথা বলে, মিঃ ঘোষ?
অ্যাঁ! শকুনি যেন চমকে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
এ বাড়ির মৃত রায়বাহাদুরের সমস্ত আত্মীয়-পরিজন আপনাদের সকলের সাহায্যই আমি চাই শকুনিবাবু।
সাহায্য!
হ্যাঁ, সাহায্য। এ হত্যারহস্যের মীমাংসার ব্যাপারে আপনারা সকলেই যে যতটুকু জানেন সমস্ত কথা অকপটে বলে আমাকে যদি না সাহায্য করেন, বুঝতেই পারছেন আমার পক্ষে এ রহস্যের কিনারা করা কতখানি কষ্টকর হবে।
কিন্তু কি ভাবে আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারি মিঃ রায়? আমি তো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না?
একটা কথা আপনার জানা দরকার শকুনিবাবু, আপনার মামা রায়বাহাদুরকে বাইরে থেকে কেউ এসে হত্যা করেনি বলেই আমার ধারণা।
কিরীটীর কথায় শকুনি ঘোষ যেন দ্বিতীয়বার চমকে ওঠে।
এবং বিস্ফারিত দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, কি বলছেন আপনি মিঃ রায়!
ঠিকই বলছি। বাইরে থেকে কেউ এসে তাঁকে হত্যা করেনি।
তার মানে আপনি বলতে চান—
তাই বলতে চাই শকুনিবাবু, এ বাড়ির মধ্যেই কেউ-না-কেউ তাঁকে হত্যা করেছে।
সত্যিই আপনি একথা বিশ্বাস করেন মিঃ রায়?
করি। এবং আমার বিশ্বাস যে মিথ্যা নয় শীঘ্রই তা প্রমাণিতও হবে।
কেউ এ বাড়িরই বলতে ঠিক আপনি কাকে মীন করছেন মিঃ রায়, মানে কে ঐ নিষ্ঠুর হত্যার জন্য দায়ী?
বলতে দুঃখ ও লজ্জাই হচ্ছে আমার মিঃ ঘোষ। এই বাড়ির মধ্যে যাঁরা রায়বাহাদুরের আত্মীয় বলে পরিচিত তাঁদের মধ্যেই কেউ-না-কেউ সুনিশ্চিতভাবে এ কাজ করেছেন।
আমি! কথাটা যেন কতকটা অজ্ঞাতেই নিজের কণ্ঠ হতে শকুনির বের হয়ে আসে।
হ্যাঁ, আপনিও করতে পারেন বৈকি।
কি বলছেন আপনি মিঃ রায়! শকুনি যেন আর্তকণ্ঠে একটা চিৎকার করে ওঠে।
কিছুই অসম্ভব বলছি না মিঃ ঘোষ। আপনার পক্ষেও রায়বাহাদুরকে হত্যা করা এতটুকুও অসম্ভব বলে আমি মনে করি না। অত্যন্ত স্বাভাবিক।
এরপর শকুনি ঘোষ কিছুক্ষণ যেন ফ্যালফ্যাল করে একান্ত বোকার মতই কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
একটি কথাও যেন উচ্চারণ করতে পারে না।
একটি শব্দও কিছুক্ষণ যেন তার কণ্ঠ হতে বের হয় না।
কিরীটী বলে, মানুষ স্বার্থের খাতিরে কখন যে কি করতে পারে আর না পারে, সে মানুষও নিজে অনেক সময় বোধ হয় চিন্তাও করতে পারে না, স্বপ্নেও ভাবতে পারে না মিঃ ঘোষ। জানেন না তো আপনি, এ পৃথিবীটাই একটা বিচিত্র জায়গা! সময় সময় তুচ্ছ—অতি তুচ্ছ প্রয়োজনের তাগিদে আজও সভ্যজগতের মানুষ যে কি ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতারই পরিচয় দিতে পারে আমি বহুবার স্বচক্ষে দেখেছি। যাক সে কথা। এখন আপনি যদি আমার কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দেন তবে সুখী হব। ডাঃ সানিয়ালের ঘরে আমাকে এখুনি আবার যেতে হবে। তাঁরা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।
বলুন কি জানতে চান? নিস্তেজ নিম্নকণ্ঠে শকুনি ঘোষ প্রত্যুত্তর দিল।