০৬. আকাশে চাঁদের আলো নেই

মনসুর সাহেব বাসার দিকে রওনা হলেন সন্ধ্যা মেলাবার পর। পথ অন্ধকার। আকাশে চাঁদের আলো নেই শুধু নক্ষত্রের আলো। নক্ষত্রের আলোয় পথ চলতে তাঁর ভালোই লাগছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শারীরবৃত্তির নিয়মে পরিবর্তন হয়—আলোর চেয়ে অন্ধকার বেশি ভালো লাগে।

বাঁধের উপর যে জায়গায় বজ্ৰপাত হয়েছিল মনসুর সাহেব ঐ জায়গাটা খুঁজতে শুরু করলেন। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছেন যেখানে বজ্ৰপাত হয়। সেখানে গর্ত হয়ে থাকে। গর্ত খুঁড়লে লৌহ জাতীয় কিছু পাওয়া যায়। বাঁধের উপর তিনি এমন কোনো গর্ত খুঁজে পেলেন না, যাকে বজ্ৰপাতজনিত গর্ত বলে ভাবা যায়। গরুর গাড়ির চাকায় তৈরি গর্ত, মাটি ডেবে যাবার গর্ত প্রচুর আছে; কিন্তু বজ্রপাতের গর্ত কই? তাঁর হাত থেকে কাগজের প্যাকেট পড়ে গিয়েছিল—সেই প্যাকেটটাই বা কোথায়?

স্যার কী খুঁজছেন?

মনসুর সাহেব চমকে উঠলেন। এতটা চমকানোর কোনো কারণ ছিল না। প্ৰশ্নকর্তা তাঁর অপরিচিত কেউ নয়। ফিবোনাক্কি। তিনি শুকনো গলায় বললেন, ও।

আমাকে চিনতে পেরেছেন তো স্যার আমি ফিবোনাক্কি।

হুঁ।

বজ্ৰপাতের জায়গাটা খুঁজছেন?

হুঁ।

ঐ রাতে বজ্ৰপাত হয়েছিল আপনার শরীরে। আপনার গা বেয়ে বিদ্যুৎ নিচে নেমে যায়।

আমার গায়ে বজ্ৰ পড়ল আর আমার কিছু হল না? তালগাছে বজ্ৰপাত হলে তালগাছ জ্বলে যায়।

স্যার আপনিতো আর তালগাছ না।

ফিবোনাক্কিও রসিকতা করছে। আশ্চর্য।

স্যার চলুন হাঁটা শুরু করি। গল্প করতে করতে আপনার সঙ্গে যাই। যদি আপনার আপত্তি না থাকে।

মনসুর সাহেব জবাব দিলেন না। হটাও শুরু করলেন না। ফিবোনাক্কির সঙ্গে হাঁটতে শুরু করা মানে তাকে শুধু যে স্বীকার করে নেয়া তাই না তাকে প্রশ্রয় দেয়া। স্বীকার করা বা প্রশ্রয় দেয়া কিছুতেই উচিত হবে না। মনের ভ্ৰান্তি মনেই থাকুক। তাঁর প্রেসার নিশ্চয়ই অনেক বেশি। ডাক্তার বজলুর রহমানের নষ্ট যন্ত্রে ধরা পড়ে নি। প্রেসার বেশি না হলে ফিবোনাক্কি নামক ব্যাপার স্যাপার চোখের সামনে উপস্থিত হত না।

স্যার ঐ রাতেতত এক ম্যারাথন ঘুম দিলেন। আমি হিসেব করে দেখেছি আপনি সর্বমোট ২৩ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট ১১ সেকেন্ড ঘুমিয়েছেন। আপনি কি স্যার লক্ষ করেছেন—২৩, ৩৭, ১১ তিনটাই প্রাইম নাম্বার। আবার এদের যোগফলও প্রাইম নাম্বার। এদের যোগফল হল ৭১, ইন্টারেস্টিং না?

হ্যাঁ ইন্টারেস্টিং। বেশ ইন্টারেস্টিং।

ফিবোনাক্কি লজ্জিত গলায় বলল, আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন স্যার। আসলে আপনি ঘুমিয়েছেন ২৫ ঘন্টা ২০ মিনিট চল্লিশ সেকেন্ড। কোনোটাই প্রাইম নাম্বার না। আপনাকে মিথ্যা করে প্রাইম নাম্বারের কথা বলেছি যাতে আপনি আগ্রহী হয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেন। প্রাইম নাম্বারের প্রতি আপনার এই আগ্রহের কারণ কি?

মনসুর সাহেব বললেন, একটা সংখ্যাকে উৎপাদকে বিশ্লেষণ করা যাচ্ছে না। অখণ্ড অবস্থায় থাকছে এই জন্যেই ভালো লাগে।

এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যত গণিতবিদ জন্মেছেন সবারই প্রাইম নাম্বার সম্পর্কে কৌতূহল। ভারতের মাদ্রাজের এক গণিতবিদ ছিলেন—আপনি তাঁর নাম শুনেছেন রামানুজন?

হ্যাঁ শুনেছি।

প্রাইম নাম্বার সম্পর্কে উনার আগ্রহ ছিল সীমাহীন। উনার সেই বিখ্যাত গল্পটা কি স্যার জানেন?

কোন গল্প?

ঐ যে নিদারুণ অসুস্থ হয়ে তিনি শুয়ে আছেন। শরীরের এমন অবস্থা যে, যে কোনো মুহূর্তে তিনি মারা যাবেন। এই সময় তাঁকে এক ভদ্রলোক দেখতে এলেন। রামানুজন বললেন—তুমি যে গাড়িতে করে এসেছ তার নাম্বারটা কত। ভদ্রলোক নাম্বার বললেন। রামানুজন আনন্দিত ভঙ্গিতে বললেন-আরে প্রাইম নাম্বার! তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কি কৌতূহল।

মনসুর সাহেব রাগী গলায় বললেন, প্রাইম নাম্বার তুচ্ছ বিষয়?

অবশ্যই তুচ্ছ বিষয়। মৌলিক সংখ্যায় এমন কি বিশেষত্ব আছে যে একে মাথায় নিয়ে নাচতে হবে? পৃথিবীর রহস্যের সবটাই শূন্যের ভেতর। যে কোনো রাশিকে শূন্য দিয়ে গুণ দিলে উত্তর হবে ০, আবার সেই রাশিকে শূন্য দিয়ে ভাগ দিন হয়ে যাবে অসীম।

তুমি আমাকে এইসব শেখাতে এসো না। এসব আমার অজানা নয়।

স্যার আমরা হাঁটতে হাঁটতে গল্প করি?

চল।

আপনার কাগজের প্যাকেটটা আমার হাতে দিন।

তোমার হাতে দিতে হবে না—তুমি হাঁট। এটা এমন কিছু ভারি নয়।

ফিবোনাক্কি পাশপাশি হাঁটছে। নিজের উপর রাগে মনসুর সাহেবের গা জ্বলে যাচ্ছে। ফিবোনাক্কিকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটার মানে তাকে স্বীকার করে নেয়া।

ফিবোনাক্কি তুমি কি ধূমপান কর?

জ্বি না স্যার। তবে আপনি যদি দেন একটা সিগারেট টেনে দেখতে পারি।

আমার কাছে সিগারেট নেই, আমি ধূমপান করি না।

না করাই ভালো হার্টের বারোটা বাজিয়ে দেয়।

ফিবোনাক্কি।

জ্বি স্যার?

ব্যাঙের পেটে মণি থাকে তুমি জান?

আমি শুনেছি। ব্যাঙের পেটের মণিকে বলে–লাল। ভাদ্ৰ আশ্বিন মাসে ব্যাঙ এই লাল উগরে মাটিতে ফেলে। এতে জায়গাটা আলো হয়ে যায়। আলো দেখে পোকা মাকড় আসে। ব্যাঙ তখন এইসব পোকামাকড় ধরে ধরে খায়। এইসব কেন জিজ্ঞেস করছেন?

তোমার জ্ঞান কতটুকু তা জানার চেষ্টা করছি।

কি জানলেন?

জানলাম যে আমার যে জ্ঞান এবং তোমার যে জ্ঞান তা একই। তুমি আমার চেয়ে বেশি কিছু জান না। অর্থাৎ তুমি ফিবোনাকি নাও-কিছুই নও তুমি আমার কল্পনা। এবং এই সত্য আমি খুব সহজে প্রমাণ করতে পারি।

কীভাবে করবেন?

কাউকে না কাউকে আমি পাব যে নেত্রকোনার দিকে যাচ্ছে। তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করব সে তোমাকে দেখতে পাচ্ছে কি না। সে যদি তোমাকে দেখতে না পায় তাহলে তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই। তুমি আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের সৃষ্টি।

ফিবোনাক্কি চুপ করে রইল। মনসুর সাহেব বললেন আমার এই ক্ষুদ্র পরীক্ষা তোমার কাছে কেমন মনে হচ্ছে?

খুব ভালো পরীক্ষা স্যার!

তুমি কি এই পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে চাও?

অবশ্যই যেতে চাই। কেন যেতে চাইব না। পরীক্ষাটা হলে আমারই লাভ।

কি লাভ?

আপনি বুঝবেন যে আমি কল্পনা নই। আমার অস্তিত্ব আছে। এবং আমার কথা আপনার মন দিয়ে শোনা উচিত। আমি আপনাকে বিপদে ফেলার জন্যে বা বিভ্রান্ত করার জন্যে আসিনি। আমি আপনাকে সাহায্য করার জন্যে এসেছি।

মনসুর সাহেব কথা বললেন না। নিঃশব্দে হাঁটতে লাগলেন। এই মুহূর্তে একজন কাউকে তার প্রয়োজন যে নেত্রকোনা যাচ্ছে, বা নেত্রকোনা থেকে ফেরত আসছে।

কাকে যেন আসতে দেখা যাচ্ছে। বাঁধের উপর উঠে এল। সিগারেট বা বিড়ি টানছে। আগুনের ফুলকি উঠানামা করছে। মনসুর সাহেব দাঁড়িয়ে পড়লেন। আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

ফিবোনাক্কির গলাতেও আগ্রহ ঝরে পড়ল, স্যার কেউ একজন আসছে।

মনসুর সাহেব এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করলেন। এই বয়সে উত্তেজনা ভালো না। তাছাড়া ডাক্তার বলে দিয়েছে তার প্রেসারের সমস্যা আছে নরম্যালের চেয়ে বেশি। প্রেসারের মানুষদের জন্যে উত্তেজনা-শুভ না।

সিগারেট টানতে টানতে যে আসছিল সে মনসুর সাহেবের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। সিগারেট ফেলে দিয়ে চুপ করে বসে মনসুর সাহেবের পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলল। মনসুর সাহেব চিনতে পারলেন না। অন্ধকারে চেনার কথাও না। তার পুরানো ছাত্রদের কেউ হবে। মনসুর সাহেব বললেন, থাক থাক সালাম লাগবে না। বলেই বিরক্ত হলেন—এই বাক্যটা সব সময় সালাম শেষ হবার পর বলা হয়। কাজেই এটা অর্থহীন বাক্য।

স্যার কেমন আছেন?

ভালো।

অনেকদিন পর আপনাকে দেখলাম। রোগা হয়ে গেছেন।

শরীর তেমন ভালো যাচ্ছে না।

কি স্যার।

চোখে সমস্যা, তারপর তোমার ইদানিং প্রেসারও সম্ভবত বেড়েছে। নরম্যালের চেয়ে বেশি।

খুব হাঁটাহাঁটি করবেন। প্রেসার আর ডায়াবেটিস এই দুইয়ের একটাই ওষুধ-হন্টন।

ফিবোনাক্কি হঠাৎ কথা বলল, ভাই আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। আমার নাম ফিবোনাক্কি।

কি নাক্কি।

ফিবোনাক্কি। একটু অদ্ভুত নাম।

আপনি কে?

আমিও আপনার মতোই আপনার স্যারের ছাত্র।

ও।

ফিবোনাক্কি হাসতে হাসতে বলল, ছাত্রে ছাত্রে ধুল পরিমাণ। ছাত্রে ছাত্রে ধুল পরিমাণ, মানে কি?

কথার কথা বললাম। সব কথাকে গুরুত্ব দিতে নেই। ভাই আপনি এখন চলে যান। আমরা হাঁটা শুরু করি। স্যারের সঙ্গে খুব জরুরি কিছু কথা আছে।

আপনার নামটা কি যেন বললেন–?

ফিবোনাক্কি।

আপনি কি বাঙালি।

এই মুহূর্তে ১০০ ভাগ বাঙালি। জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইনও জানি। শুনবেন?

জি না।

শুনুন না। ভালো লাগবে–।

জ্বি না কবিতা শুনব না।

তাহলে আপনি আর আপনার স্যারকে আটকে রাখবেন না। ছেড়ে দিন। উনার সঙ্গে আমার ভয়াবহ ধরনের জরুরি কিছু কথা আছে।

 

মনসুর সাহেব নিঃশব্দে হাঁটছেন। ফিবোনাক্কি হাঁটছে তার পাশে পাশে। ফিবোনাক্কি বলল, স্যার আপনার পরীক্ষার ফলাফল তো মনে হয় পজেটিভ। আপনার ঐ ছাত্রতো আমাকে দেখতে পেল এবং কথাবার্তাও বলল।

হু।

এখন কি আপনি মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন যে আমার একটা অস্তিত্ব আছে। আমি কল্পনার কেউ না।

মনসুর সাহেব কিছু বললেন না।

স্যার বাঁধের নিচে নৌকা বাঁধা আছে। খালি নৌকা। ঐখানে একটু বসবেন? জরুরি কথা দ্রুত সেরে ফেলতাম।

ঢালু বাঁধ। নামতে কষ্ট। ফিবোনাক্কি মনসুর সাহেবের হাত থেকে কাগজের প্যাকেট নিয়ে নিল। মনসুর সাহেবকে হাত ধরে সাবধানে নামাল।

দুজন চুপচাপ নৌকার গলুইয়ে মুখোমুখি বসে আছে। প্রথম কথা বললেন। মনসুর সাহেব বল কি বলবে?

স্যার আপনি খুব বড় একটা কাজ করছেন। কত বড় কাজ যে করছেন সেই সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই। আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি।

তুমি কে?

আমি এসেছি শূন্য জগত থেকে।

মনসুর সাহেব দীৰ্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। সবই কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। ফিবোনাক্কি বলল, আমার জগতটা কি আমি ব্যাখ্যা করব?

করতে পার।

আপনার ভেতর কোনো আগ্রহ দেখছি না। আপনি যদি কোনো আগ্রহ না দেখান তাহলে আমি কথা বলে আরাম পাব না।

আগ্রহ বোধ করছি না বলেই তুমি আগ্রহ দেখছ না।

আগ্রহ না দেখালেন-কি বলছি মন দিয়ে শুনুন।

শুনছি।

স্যার এই পৃথিবীর বস্তু জগৎ হচ্ছে ত্রিমাত্রিক। পৃথিবীর বস্তু জগতের প্রতিটি বস্তুর আছে তিনটি মাত্রা–দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা। ঠিক না স্যার।

হ্যাঁ।

আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি থেকে সময় নিয়ে এসে, সময়কে একটা মাত্রা ধরে পৃথিবীর বস্তুজগতকে কেউ কেউ চার মাত্রার জগতও বলেন, তবে আমাদের বোঝার জন্যে পৃথিবীর জগতটাকে তিন মাত্রার জগত বলা চলে। ঠিক আছে স্যার?

হুঁ।

তিন মাত্রার জগতের মতো দুই মাত্রার জগততো হতে পারে। পারে না স্যার?

যে জগতে শুধু দৈৰ্ঘ্য আছে, প্রস্থ আছে। উচ্চতা বলে কিছু নেই।

থিওরিটেক্যালি থাকতে পারে।

দুই মাত্রার জগতের মতো একমাত্রার জগতও থাকতে পারে যে জগতের সব বস্তুর শুধু দৈৰ্ঘ্য আছে আর কিছু নেই। থাকতে পারে না স্যার?

হুঁ।

এখন তাহলে সবচে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে চলে আসুন। শূন্য মাত্রার জগত। তো থাকতে পারে। যে জগতে কোনো মাত্রা নেই। মাত্রা নেই বলে মাত্রার বন্ধনও নেই। শূন্য মাত্রার জগত এবং অসীম মাত্রার জগত কি একই নয়?

মনসুর সাহেব তাকিয়ে আছেন।

ফিবোনাক্কি বলল, শূন্য এবং অসীম এই দুটি সংখ্যার ধর্ম এক রকম। যে কোনো সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে গুণ করলে উত্তর হয় শূন্য। আবার যে কোনো সংখ্যাকে অসীম দিয়ে গুণ করলে উত্তর হয় অসীম। এখন স্যার আপনিই বলুন শূন্যকে অসীম দিয়ে গুণ করলে কি হবে?

মনসুর সাহেব ছোট্ট নিশ্বাস ফেললেন।

ফিবোনাক্কি বলল— আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি। আপনার সমাধান মানব জাতির জন্যে বিরাট ব্যাপার হবে। এই সমাধানের জন্যে মানুষ শূন্যের প্রবেশ…

মনসুর সাহেব তার কথা থামিয়ে মেঘস্বরে ধমকে উঠলেন–স্টপ।

ফিবোনাক্কি থমতো খেয়ে চুপ করে গেল। মনসুর সাহেব বললেন, তুমি কোনো কথা বলবে না। তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই। তুমি আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা…এর বেশি কিছু না।

একটু আগেই কিন্তু তৃতীয় এক ব্যক্তি—আপনার ছাত্র আমাকে দেখতে পেরেছে। আমার সঙ্গে কথা বলেছে।

আমার ঐ ছাত্রও আমার মনের কল্পনা। তুমি যেমন আমার কল্পনা থেকে এসেছ—সেও এসেছে। সে যে আচরণ আমার সঙ্গে করেছে কোনো ছাত্র আমার সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করবে না। আমাকে উপদেশ দিচ্ছে। বলছে হন্টন করবেন। হন্টন আবার কি?

সামান্য রসিকতাও আপনার ছাত্র আপনার সঙ্গে করতে পারবে না?

পারা উচিত কিন্তু পারে না। আমার বত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে কোনো ছাত্র আমার সঙ্গে রসিকতা করেনি। তারচেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল ঘুঘুটে অন্ধকারে আমার সঙ্গে তার দেখা। সে অন্ধকারে আমাকে চিনে ফেলল?

কেমন করে চিনল?

মনসুর সাহেব উঠে পড়লেন। ফিবোনাক্কি বলল, স্যার চলে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ চলে যাচ্ছি। আর শোন খবৰ্দার আমার পেছনে পেছনে আসবে না।

বাঁধে তুলে দেই। খাড়া বাঁধ। একা উঠতে পারবেন না।

খুব পারব। তুমি আসবে না। বললাম…

মনসুর সাহেব দেখলেন তারপরেও ফিবোনাক্কি তাঁকে অনুসরণ করছে। মনসুর সাহেব বাসার কাছাকাছি এসে আবারো কড়া করে ধমক দিলেন। ফিবোনাক্কি বলল, ঠিক আছে স্যার আমি চলে যাচ্ছি। তবে কাছাকাছিই থাকব। যদি প্রয়োজন হয়…

ফিবোনাক্কি ক্লান্ত ভঙ্গিতে চলে যাচ্ছে। গেট খুলে কম্পাউন্ডের ভেতর মনসুর সাহেব বললেন-হরমুজ ফিরে এসেছে। একদিন থাকার কথা বলে দুদিন কাটিয়ে এসেছে। মেয়ের বাড়ি থেকে আসার পর প্রথম কয়েকদিন হরমুজের মেজাজ খুব ভালো থাকে। আজ তার মেজাজ অত্যন্ত ভালো। কথা বলার জন্যে সে ছটফট করছে, বলার লোক পাচ্ছে না।

মনসুর সাহেবকে দেখে তার আনন্দ তীব্র হল। সে গ্যারাজের বারান্দায় কেরোসিনের চুলায় ভাত চড়িয়েছে। ডাল ইতিমধ্যে নেমে গেছে। ইচ্ছা করলে কয়েক টুকরা বেগুন ভেঙ্গে ফেলা যায়। ঘরে বেগুন আছে। তবে না ভাজলেও ক্ষতি নেই–ডাল ভাত দিলেই স্যারের চলবে। বেগুন ভাজা দেখলে উনি বিরক্ত হতে পারেন।

হরমুজ একগাল হেসে বলল, স্যার কেমন আছেন?

ভালো।

আপনারে নিয়া খুব চিন্তায় ছিলাম।

কেন?

আপনার খাওয়া দাওয়ার কি ব্যবস্থাকি খাইলেন, না খাইলেন।

কোনো অসুবিধা হয় নি। তোমার মেয়ে ভালো?

আপনের দোয়া স্যার। মেয়ে ভালো আছে। তবে স্যার শরীর দুর্বল। ডাক্তার ওষুধ একটা দিয়েছে সত্তুর টাকা দাম। চিন্তা করেন—নয় আঙ্গুলের এক বোল তার দাম সত্তুর টাকা।

মনসুর সাহেব প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়ে বললেন, একটা কাজ করে দিতে পারবে হরমুজ।

অবশ্যই পারব।

গেটের বাইরে গিয়ে দেখতে কোনো ছেলে আছে কি-না।

কি ছেলে?

যুবক এক ছেলে। আমার কাগজগুলি ছিল তার হাতে। পাঁচ দিস্তা কাগজ।

হরমুজ তৎক্ষণাৎ বের হয়ে গেল। লোকটাকে সে পেল না।

কেউ ছিল না?

জ্বি না কেউ ছিল না।

ভালো করে দেখেছ?

খুব ভালো করে দেখেছি।

স্যার খানা হয়ে গেছে দিয়ে দেব?

না। খিদে নেই। আজ কিছু খাব না।

মনসুর সাহেব রাত নটা বাজার আগেই ঘুমুতে গেলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙল রাত দুটায়। আকাশে চাঁদ উঠেছে। চাদের ক্ষীণ আলোয় সব কেমন ভৌতিক লাগছে। দীর্ঘকাল পর তার একটু ভয় ভয় করতে লাগল।

তিনি হারিকেন জ্বালালেন। ঘুম যখন ভেঙেছে তখন একটু কাজ করা যাক। ফাইলপত্র নিয়ে বসা যাক। অনেকদিন কিছু লেখা হয় নি। অবহেলা করা হচ্ছে। বয়স হচ্ছে—বয়সের প্রধান ধর্ম আলস্য। কাজ এড়ানোর অজুহাত খোজা। অথচ উল্টোটাই হওয়া উচিত ছিল। অল্প বয়স্করা আলস্য দেখাতে পারে তাদের হাতে সময় আছে। তাঁর হাতে সময় কই? বৃদ্ধরা কাজ করবে যন্ত্রের মতো কোননাদিকে তারা তাকাবে না। কারণ তাদের ঘণ্টা বেজে গেছে। ঢং টং টং ঘণ্টা বেজেই যাচ্ছে। একদিন শেষ ঘণ্টা বাজবে তখন…

আচ্ছা শূন্য জগতের ব্যাপারগুলি কেমন? ফিবোনাকি কথাটা মন্দ বলে নিমাত্রাহীন জগত হল—অসীম মাত্রার জগত। তাঁর পিপাসা বোধ হচ্ছে। লেবুর সরবত খেয়ে ঘুমতে যান নি। পিপাসা হবারই কথা। চিনি লেবু কিছুই কেনা হয়নি। আজও ছোটবাজারে গিয়ে শুধু কাগজ কিনে ফিরেছেন।

তাঁর একজন এ্যাসিসটেন্ট থাকলে মন্দ হত না। হরমুজের মতো এ্যাসিসটেন্ট না—ফিবোনাক্কির মতো এ্যাসিসটেন্ট। যার সঙ্গে কথা বলে আরাম পাওয়া যায়। যে যুক্তি নির্ভর কথা বলবে প্রয়োজনে ছোটখাটো কাজও করে দেবে। যেমন চট করে গ্লাস ভর্তি লেবুর সরবত নিয়ে এল। কাগজপত্র গুছিয়ে রাখল।

ভালো কথা, তিনি যে পাঁচ দিস্তা কাগজ কিনেছিলেন—সেই কাগজতো রয়ে গেছে ফিবোনাক্কির কাছে। স্পষ্ট মনে আছে—দুজন নৌকোয় বসে কথা বলছেন। কাগজের প্যাকেটটা ফিবোনাক্কির হাতে। নৌকা থেকে তিনি রাগ করে উঠে এলেন। প্যাকেট নেয়া হল না। বাসার কাছাকাছি এসে ফিবোনাক্কিকে ধমকে বিয়ে করলেন। প্যাকেট ফেরত নিতে ভুলে গেলেন।

কাগজ ছাড়া তিনি হারিকেন জ্বালিয়ে করবেন কি? মনসুর সাহেব বিরক্ত মুখে ঘর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। এখান থেকে দেয়ালের বাইরের খানিকটা অংশ দেখা যায়। ফিবোনাক্কি কি আছে সেখানে?

আচ্ছা তিনি হাস্যকর চিন্তা করছেন কেন? কল্পনার মানুষকেই বাস্তব মানুষ হিসেবে ভাবতে শুরু করছেন। তাঁর কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মাথা খারাপ রোগ তাঁদের বংশে আছে। তাঁর দাদাজান চল্লিশ বছরে হঠাৎ একদিন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেলেন। রাতে ঘুমুচ্ছিলেন ঘুম ভেঙে স্ত্রীকে ডেকে তুলে বললেন, ওগো ওই। আমার মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে। আমার মাথায় পানি ঢাল। দাদিজান ভয়ে অস্থির হয়ে পানি আনতে গেলেন। দাদাজান বললেন—বউ শোন পানি আনতে যাবার আগে দড়ি এনে আমাকে খাটের সঙ্গে বেঁধে রাখ, নয়ত দেখবে আমি ঝাপ দিয়ে দোতলা থেকে নিচে পড়ে গেছি। পাগল মানুষতো কিছুই বলা যায় না।

মনসুর সাহেবের দাদিজান দড়ি আনার আগে বালতি ভর্তি পানি এনে দেখেন মানুষটা বিছানায় নেই। ছাদ থেকে লাফিয়ে নিচে পড়েছে। তখনো জ্ঞান আছে। কথা বলতে পারছে। মৃত্যুর আগে মানুষটা বিড়বিড় করে বলল তোমার মনে কোনো কষ্ট রাখবে না। এটা আত্মহত্যা না। আমি আত্মহত্যার মানুষ না। মাথা খারাপ হয়ে গেছে বলে এই কাজ করেছি। মাথাটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। বড় আফসোস।

তার মাথাটাও কি হঠাৎ খারাপ হয়ে গেছে? তিনি নিশিরাতে বারান্দায় দাড়িয়ে ফিবোনাক্কি নামক কল্পনার এক যুবককে ভাবতে শুরু করেছেন।

মনসুর সাহেব ডাকলেন, ফিবোনাক্কি।

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল, জ্বি স্যার আমি আছি।

হ্যাঁ সে আছে তো বটেই। ঐতো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চাদের মরা আলোয় সুদর্শন এক তরুণ দাঁড়িয়ে। তার দিকে তাকিয়ে আছে।

ফিবোনাক্কি।

জ্বি স্যার।

আমার কাগজের প্যাকেটতো তোমার কাছে ছিল।

জ্বি!

কোথায় সেগুলি?

নষ্ট করে ফেলেছি।

নষ্ট করে ফেলেছি মানে?

আপনি আমার উপর রাগ করলেন। আমার মনটা হল খারাপ। আমি মন খারাপটা ঝাড়লাম কাগজের উপর।

তুমি কি করলে—এতগুলি কাগজ কুচি কুচি করে ছিড়ে ফেললে?

জ্বি না। কাগজগুলি দিয়ে নৌকো বানিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছি।

কি বললে?

কাগজের নৌকা বানিয়ে নদীতে ভাসিয়েছি। অনেকগুলি নৌকা হয়েছে। দেখতে খুব ভালো লাগে। সকালে মর্নিং ওয়াক করার জন্যে যদি নদীর পাড়ে আসেন তাহলে দেখবেন। একটা নৌকাও নষ্ট হয়নি।

আচ্ছা।

নৌকাগুলি ছেড়েছিও আপনার প্রিয় রাশিমালা অনুযায়ী প্রথম ছাড়লাম একটা, তারপর একটা, তারপর একসঙ্গে দুটা। তারপর একসঙ্গে তিনটা, তারপর পাঁচটা।…

চুপ কর।

জ্বি আচ্ছা স্যার।

ফিবোনাক্কি।

জ্বি স্যার।

সত্যি করে বলতে আমার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? মাথা খারাপের ব্যাপারটা আমাদের পরিবারে আছে। আমার দাদাজানের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

আমি জানি।

তুমি জান?

আমি শূন্য জগতের একজন, সবকিছুই আমার জানা থাকার কথা। আপনার দাদাজানের হঠাৎ পাগল হয়ে যাবার ব্যাপারটা আমি জানি…একদিন তিনি ছাদে পাটি পেতে ঘুমুচ্ছিলেন—হঠাৎ তাঁর স্ত্রীকে ডেকে বললেন, ওগো ওঠ। আমার মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে…

মনসুর সাহেব ফিবোনাক্কিতে থামিয়ে দিয়ে বললেন—তুমি এসব জান কারণ তুমি এসেছ আমার কল্পনা থেকে। সঙ্গত কারণেই আমি যা তুমি তাই জানবে।

আপনার দাদাজানও আপনার মতো অঙ্ক করতে ভালোবাসতেন। তাই না স্যার।

হুঁ।

তার ট্রাংক ভর্তি ছিল গুটি গুটি হাতে লেখা কাগজ।

হুঁ।

স্যার আপনি কি সেইসব দেখেছেন?

দেখেছি। বেশির ভাগই উইপোকায় কেটে ফেলেছিল।

অল্প যা রক্ষা পেয়েছিল আপনি তা আপনার ফাইলে যত্ন করে রেখেছেন।

আমি রাখিনি। আমার বাবা রেখেছিলেন। বাবার কাছ থেকেই আমি পেয়েছি।

আপনার বাবাওতো স্যার অঙ্কের ছাত্র ছিলেন?

হুঁ। কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অঙ্কে এম. এ ডিগ্রি নেন। গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন।

আপনারা তাহলে তিনপুরুষের গণিতজ্ঞ।

হুঁ।

অঙ্কে তো আপনারও এম. এ ডিগ্রি আছে। আপনি নিজেও তো কালি নারায়ণ স্কলার।

হুঁ।

ইউনিভার্সিটি বা কলেজে ইচ্ছা করলেই আপনি ভালো চাকরি পেতে পারতেন, তা না করে স্কুলে চাকরি নিলেন–কেন?

চট করে পেয়ে গেলাম। ঝামেলা কম, নিরিবিলি–।

আপনার বাবাও ঝামেলা পছন্দ করতেন না। নিরিবিলি কাজ করতে চাইতেন। তিনিও তো অতি অল্প বয়সে মারা গেছেন।

হু।

তাঁর মৃত্যু কি স্বাভাবিক মৃত্যু, না অস্বাভাবিক মৃত্যু?

মনসুর সাহেব জবাব দিলেন না। তাঁর কপালে ঘাম জমছে। শরীর কঁপছে। ফিবোনাক্কি বলল-স্যার একটা জটিল রাশিমালার সমাধান আপনারা তিন পুরুষ ধরে চেষ্টা করছেন। চতুর্থ পুরুষ বলে আপনাদের কিছু নেই। কিছু করার হলে আপনাকেই করতে হবে। যদি কিছু করতে না পারেন তাহলে আপনাতেই সব শেষ। স্যার আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি।

তুমি কেউ না। তুমি আমার অবচেতন মনের কল্পনা।

যদি কল্পনাও হয়ে থাকি তাতেও তো ক্ষতি নেই। কাজ হওয়া নিয়ে কথা।

তুমি কী ভাবে সাহায্য করতে চাও?

আপনি অনেক রাশিমালা নিয়ে কাজ করছেন—একটি রাশিমালা আছে যার যোগফল শূন্য।

অনেকগুলি রাশিমালার যোগফলই শূন্য।

ফিবোনাক্কি রাশিমালার একটি আছে যার ফলাফল শূন্য।

মনে পড়ছে না।

খুঁজে বের করুন।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মনসুর সাহেব বললেন, তোমাদের শূন্য জগতটা কেমন?

অন্য রকম। সে জগতে সবই শূন্য। সেখানে আনন্দ, দুঃখ, বেদনা কিছুই নেই।

আনন্দ, দুঃখ, বেদনা নেই। শূন্য জগত তো ভয়াবহ জগত।

স্যার আপনি ভুলে যাচ্ছেন-শূন্যের সঙ্গে অসীম সম্পর্কিত। আনন্দ, দুঃখ, বেদনা যেমন শূন্য—তেমনি একই সঙ্গে অসীম। আপনি রহস্যের খুব কাছাকাছি আছেন। খুব কাছাকাছি। আপনি নিজেও তা জানেন। জানেন না?

হ্যাঁ জানি।

স্যার আপনি খুব কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। রহস্যের খুব কাছাকাছি এসে মানুষ ভেঙে পড়ে। আপনার দাদাজান ভেঙে পড়েছিলেন। আপনার বাবার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে।

মনসুর সাহেবের শীত করতে লাগল। চৈত্র মাসের রাতে এরকম শীত লাগার কথা নয়।

স্যার আমি এসেছি আপনাকে সাহস এবং শক্তি জোগানোর জন্যে। তুমি আমার অবচেতন মনের ছায়া।

তাতে কোনো ক্ষতি নেই। আপনি কাজ শুরু করুন যে ভাবে বলছি সেই ভাবে…

থ্যাংক য়্যু।

স্যার আমি আপনাকে কি পরিমাণ ভালোবাসি তা আপনি জানেন না।

তুমি তো ভালোবাসবেই। তুমি আমারই অংশ।

সব সময় মানুষের নিজের অংশই যে মানুষকে ভালোবাসে তাতো নয়। কিন্তু কিছু মানুষ আছে যারা নিজেদের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করে বেঁচে থাকে।

তোমাকে ধন্যবাদ। আচ্ছা শোন–আমি কি স্বপ্ন দেখছি?

আমি যে জগতে বাস করি সে জগতে স্বপ্ন ও বাস্তবের কোনো সীমারেখা নেই। স্বপ্ন যা বাস্তবও তা।

ফিবোনাক্কি!

জ্বি স্যার। তুমি কি চা বানাতে পার?

কেন বলুনতো?

তাহলে চা বানাতে বলতাম। চা খেয়ে অঙ্ক শুরু করতাম।

ফিবোনাক্কি হেসে ফেলল।

হাসছ কেন?

এমি হাসছি স্যার। আপনি চা খেতে পারবেন না। ঘরে চিনি নেই। আপনি চিনি ছাড়া চা খেতে পারেন না। তাছাড়া রাত প্রায় শেষ হতে চলল—কিছুটা হলেও বিশ্রাম আপনার দরকার।

শুয়ে পড়তে বলছ?

হ্যাঁ।

একটা কথা ফিবোনাক্কি, শূন্য জগতে মানুষের আয়ু কি? মানুষ সে জগতে কতদিন বাঁচে?

সেই জগতে মানুষের আয়ু একই সঙ্গে শূন্য এই সঙ্গে অসীম?

বুঝতে পারছি না।

সেটা হচ্ছে অস্তিত্ব এবং অস্তিত্বহীনতার জগত।

বুঝতে পারছি না।

স্যার আপনি বিশ্রাম করুন। ঘুমুতে যান।

আমার ঘুমুতে ভয় লাগছে।

কেন?

হঠাৎ হয়তো ঘুম ভেঙে আমার দাদাজানের মতো…

উনার সমস্যা আপনার হবে না।

কেন?

উনার পাশে সেই দুঃসময়ে কেউ ছিল না। আপনার পাশে আমি আছি।

তুমি কি সত্যি সত্যি আমার কল্পনা, নাকি তুমি শূন্যের জগত থেকে উড়ে এসেছ?

আমি আপনার কল্পনা কিন্তু আমার বাস শূন্য জগতে।

কিছুই বুঝতে পারছি না।

বুঝতে পারবেন। খুব শিগগিরই বুঝতে পারবেন। আপনার কাজ শেষ করুন।

কাগজ তো নেই। কীভাবে কাজ করব?

মনসুর সাহেব ঘরে ফিরে এলেন। হারিকেন নিভিয়ে বিছানায় গেলেন। ভয়াবহ ক্লান্তি তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। আকাশে মরা চাদ, সেই আলো এসে পড়েছে তাঁর বিছানার এক অংশে।

শূন্য জগতে কি চন্দ্ৰলোক আছে? সেই জগতে কি জোছনার ফুল ফুটে। পাখি গান গায়?

Everything was once created from nothing.

শূন্য থেকে সব সৃষ্টি হয়েছে। শূন্যতেই সব ফিরে যাবে।

মনসুর সাহেবের মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। ভোতা যন্ত্ৰণা। মানুষের প্রধান অংশ কি?

মানুষের প্রধান অংশ তার চেতনা। এই চেতনাকে ধারণ করছে শরীর। শরীরকে বাদ দিয়ে চেতনার যে অস্তিত্ব সেই অস্তিত্বের জগতই কি শূন্যের জগত, না-কি এর বাইরেও কিছু।

খাটের নিচে ইদুর খচখচ করছে। এই অতি ক্ষুদ্র প্রাণীর চেতনা কি আদি চেতনারই অংশ? বিরাট এক রাশিমালা? যে রাশিমালার যোগফল শূন্য।

শরীরে এত ক্লান্তি অথচ ঘুম আসছে না। ঘুম আনতে হলে কি করতে হয় মেষ গুণতে হয়।

মনসুর সাহেব মেষের বিশাল পাল কল্পনা করতে লাগলেন। একটি মেষ আসছে। আবার একটি। এখন একটির সঙ্গে আসছে দুটি। এইবার তিনটি…মেষ পাল আসছে ফিবোনাক্কি রাশিমালায়–

১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩…

আচ্ছা এখন এই মেষের পালে কয়েকটা নেকড়ে ঢুকিয়ে দেয়া যাক। নেকড়েগুলি মেষ খেতে শুরু করবে। ব্যাপারটা এমনভাবে ঘটবে যে মেষ এবং নেকড়ের সংখ্যা শুরুতে সমান থাকলেও সময়ের সঙ্গে কমতে শুরু করবে। নেকড়ে যেমন মেঘ মারবে তেমনি মেষরা নেকড়ে মারবে…কাজেই নেকড়ের জন্যে একটি রাশিমালা প্রয়োজন…

মনসুর সাহেব উঠে বসলেন পাওয়া যাচ্ছে। কিছু একটা পাওয়া যাচ্ছে। কাগজ ঘরে নেই। কাগজের খুব প্রয়োজন ছিল।