অসাধারণ প্রসাধন-নৈপুণ্যে প্রথম দর্শনেই শ্রীমতী মিত্রা সেনকে দেখে চোখ ঝলসে গিয়েছিল সে-রাত্রে আমার। সত্যিই কালো জমিনের উপরে সাদা জরির পাড় দেওয়া বহুমূল্য ইটালীয়ান সিফন শাড়িটি যেন সে বরঅঙ্গে লেপ্টে ছিল। হাতে একগাছি হীরা-বসানো জড়োয়ার চুড়ি। কানে নীলার দুল। হীরা ও নীলার উপরে বিদ্যুতের আলো পড়ে যেন ঝিলিক দিচ্ছিল। আর অঙ্গে কোন অলঙ্কার ছিল না। কিন্তু ঐবেশভূষাতেই যেন মনে হচ্ছিল তাকে বিশ্ব-বিজয়িনী। লম্বায় পাঁচ ফুট দু-এক ইঞ্চির বেশী হবে না। রোগাটে গড়ন। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যাম। কিন্তু প্রসাধনের রঙে সেটা বোঝবার উপায় ছিল না।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই মিত্রা সেনকে সাদর আহ্বান জানালেও এবং সকলেইসোৎসুক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেও মিত্রা সেন কিন্তু সকলকেই উপেক্ষা করে তাকাল তরুণ ব্যারিস্টার অশোক রায়ের দিকে। মধুর হাসিতে দু-গালে তার টোল খেয়ে গেল। মৃদু কণ্ঠে অশোকের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সে বললে, অশোক, আমার আসতে আজ একটু দেরি হয়ে গেল!
দরদে ও আব্দারে মেশানো সে কণ্ঠের সুর।
অশোক রায়ের ওষ্ঠপ্রান্তে মৃদু একটুখানি হাসি জেগে ওঠে।
তারপরেই অশোকের কাছে আরও একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে এগিয়ে এসে বললে, পূবের চাইতে যেন আর একটু চাপা কণ্ঠেই, রাগ করনি তো?
অন্য কেউ না শুনলেও কথাটা আমি শুনতে পেলাম।
দেরি হল যে! মৃদু কণ্ঠে অশোক রায় এবার প্রশ্ন করে।
বল কেন, বৌদি কোথায় এক পার্টিতে যাবে শাড়ি পছন্দ করে দিতে দিতে—
তা তুমি যে গেলে না?
ভুলে গেলে নাকি, শনিবার আর বুধবার রাত্রে যেখানেই যাই না কেন, রাত দশটায় এখানে আসিই!
ঐ সময় ওয়েটার মীরজুমলা এসে হলঘরের মধ্যে ঢুকল সুদৃশ্য একটা প্লাসটিকের ট্রের উপরে পিপাসীদের বিভিন্ন সব পানীয় গ্লাসে গ্লাসে ভরে। প্রত্যেকের কাছে গিয়ে সে ট্রে-টা ধরতে লাগল। এক এক করে যে যার নির্দিষ্ট পানীয় মীরজুমলার ইঙ্গিতে তুলে নিতে লাগল ট্রে-র উপর থেকে। মিত্রা সেনকে লিমন-জুসের গ্লাসটা দিয়ে শূন্য ট্রে-টা হাতে এবার এগিয়ে এল মীরজুমলা আমার দিকে এবং আমার মুখের দিকে মুখ তুলে তাকাল।
আমিও তাকালাম লোকটার মুখের দিকে।
তারপরই সুস্পষ্টোচারিত নির্ভুল ইংরাজীতে প্রশ্ন করল, Any drink, Sir?
একজন ওয়েটারের মুখে অমন সুস্পষ্টোচ্চারিত নির্ভুল ইংরাজী শুনে আমিও নিজের অজ্ঞাতেই মীরজুমলার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সংবরণ করে বললাম, Yes, Gin and bitter please?
মীরজুমলা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে মাথা হেলিয়ে স্থানত্যাগ করল। এবারে স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম, চলার মধ্যে যেন একটা অদ্ভুত ক্ষিপ্রতা ও গতি আছে লোকটার।
আমি আবার হলের চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করলাম।
হঠাৎ ছোট একটা কথা কানে এল।
লাকি গ্যায়!
কথাটা বলেছিল বিখ্যাত আর্টিস্ট সোমেশ্বর রাহা তার সামনেই দণ্ডায়মান শ্ৰীমন্ত পালকে।
কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সোমেশ্বর একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল অল্প দূরেই ঘনিষ্ঠভাবে পাশাপাশি দণ্ডায়মান মিত্রা সেন ও অশোক রায়ের দিকে।
সোমেশ্বরের দু-চোখের তারায় মনে হচ্ছিল যেন একটা কুটিল হিংসা ও সঙ্গে আরও একটা কিছু মিশে আছে।
নিজের অজ্ঞাতেই যেন দৃষ্টিটা আমার সোমেশ্বরের মুখের উপর স্থির হয়ে ছিল। সোমেশ্বরকে ইতিপূর্বে চাক্ষুষ কখনও না দেখলেও ওর আঁকা ছবি দেখেছি। এবং বহু সাময়িক কাগজে ওর অনন্যসাধারণ প্রতিভার সমালোচনা পড়েছি। সেই থেকেই লোকটাকে না দেখলেও মনের মধ্যে ওর প্রতি আমার একটা প্রশংসা ও শ্রদ্ধার ভাব গড়ে উঠেছিল। কিন্তু কখনও ভাবতে পারিনি লোকটার চেহারা এত কুৎসিত। বেঁটে কালো দেখতে। ছোট কপাল, রোমশ জোড়া জ। নাকটা একটু চাপা। গোল গোল চোখ। একমাত্র হাতের মোটা মোটা কুৎসিত রোমশ আঙুলগুলি ছাড়া দেহের আর সমুদয় অংশ সযত্ন পরিধেয় পোশাকে আবৃত থাকলেও বুঝতে কষ্ট হয় না লোকটার শরীরে লোমের একটু আধিক্যই আছে।
ভাবছিলাম ঐ লোমশ কুৎসিতদর্শন মোটা মোটা আঙুলগুলো কি করে অমন সাদা কাগজের বুকে সূক্ষ্ম শিল্প রচনা করে! লোকটার চেহারা, চোখের দৃষ্টি ও হাতের আঙুল দেখলেই স্বতই মনে হয় লোকটা নিশ্চয় একটা নৃশংস খুনী। অতবড় উঁচুদরের একজন শিল্পী কোনমতেই নয়।
বিধাতার সৃষ্টি সত্যই আশ্চর্য। নইলে এমন চেহারা ও কাজে এমন বৈচিত্র্য আসে কোথা থেকে আর কোন যুক্তিতেই বা! নিজের চিন্তায় বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ দেখলাম চার নম্বর দরজা-পথে কেউ ক্ষণপূর্বে নিশ্চয়ই প্রস্থান করেছে, দরজার কবাটটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
তারপরেই এদিক-ওদিক তাকাতে নজরে পড়ল ঘরের মধ্যে দুটি প্রাণী নেই। অশোক রায় ও মিত্রা সেন। এবং নিজের অজ্ঞাতেই আবার আমার অনুসন্ধানী দৃষ্টিটা ঘুরে গিয়ে পড়ল আর্টিস্ট সোমেশ্বর রাহার মুখের উপরে। দেখলাম সোমেশ্বরের দু-চোখের স্থিরদৃষ্টি সেই চার নম্বরের বন্ধ কবাটের গায়ে যেন পিন দিয়ে কে এঁটে দিয়েছে।
ক্ষণকাল সেই বন্ধ কটের দিকে তাকিয়ে থেকে সোমেশ্বর ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে চার নম্বর দরজাটা খুলে প্রস্থান করল।
ঘড়িতে ঠিক তখন সাড়ে দশটা বাজতে কয়েক মিনিট বাক।
দুর্নিবার এক আকর্ষণে সেই চার নম্বর দরজাটা আমায় টানছিল এবং নিজের অজ্ঞাতেই একসময় পায়ে পায়ে সেদিকে যে এলিয়েও গিয়েছি টের পাইনি। দরজার কাছাকাছি প্রায় যখন গিয়েছি হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল, মীরজুমলা ট্রে-তে করে আমার পানীয় নিয়ে হলঘরে এসে প্রবেশ করল।
Your drink, Sir!
ট্রে থেকে গ্লাসটা তুলে নিতে নিতে আড়চোখে তাকালাম মীরজুমলার মুখের দিকে। মুখখানা যেন তার পাথরে কোঁদা, কিন্তু চোখের কোণে স্পষ্ট যেন মনে হল একটা চাপা হাসির বিদ্যুৎ-চমক।
মীরজুমলা তিন নম্বর দরজা-পথে বের হয়ে গেল ট্রে-টা হাতে নিয়ে। হলঘরের চারিদিকে আবার দৃষ্টিপাত করলাম। কেউ আমার দিকে চেয়ে আছে কি! কিন্তু না, সকলেই যেন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। আমার দিকে কারও যেন হৃক্ষেপও নেই। আমি যে একজন নবাগত তাদের সঙ্ঘে আজ রাত্রে, সে ব্যাপারে কারো মনেই যেন বিন্দুমাত্রও কৌতূহলের উদ্রেক করেনি।
কিন্তু নিজের কাছেই নিজের আমার যেন কেমন একটা অস্বস্তি লাগছিল। কেমন যেন একটু বিব্রত বোধ করছিলাম।
প্রেসিডেন্ট আমার সঙ্গে সকলের আলাপ করিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও কেউ আমার কাছে এগিয়ে এল না।
আর আলাপ করবার চেষ্টাও করল না।
এখানকার নিয়ম-কানুন রীতি-নীতিও আমার সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। গায়ে পড়ে এখানে হয়ত কেউ কারও সঙ্গে আলাপ করে না।
কিন্তু কিসের টানেই বা প্রতি রাত্রে এখানে এতগুলো বিভিন্ন চরিত্রের লোক এসে জড়ো হয়? সামান্য একটু তাস খেলা বিলিয়ার্ড খেলা বা সামান্য একটু ড্রিঙ্কের জন্যই কি? মন কিন্তু কথাটা মেনে নিতে চাইল না অত সহজে।
কিরীটী যে বলেছিল এবং সুধীরঞ্জনের কথাবার্তাতেও প্রকাশ পেয়েছিল,এ সঙ্ঘটা হচ্ছে আসলে নর-নারীদের একটা যৌন-সংক্রান্ত ব্যাপারে পরস্পরের একটা মিলনকেন্দ্র, কই সেরকমও তো এতক্ষণের মধ্যে তেমন কিছু আমার চোখে পড়ল না। বরং রুচি ও সংযমের পরিচ্ছন্নতাই সকলের মধ্যে লক্ষ্য করছি এযাবৎ।
তাছাড়া পুলিস বা তৎ-সংক্রান্ত লোকেদের এড়িয়ে চলবার মত কিছুও তো এখনও পর্যন্ত আমার নজরে পড়ল না।
ভুলেই গিয়েছিলাম যে গ্লাসটা হাতে করেই তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি, একটি সিপ-ও দিইনি পানীয়ে।
হঠাৎ পাশ থেকে একটি মিষ্ট মৃদু-উচ্চারিত নারীকণ্ঠে চমকে ফিরে তাকালাম।
কি নাম আপনার?
সুবেশা মধ্যবয়সী এক নারী ইতিমধ্যে কখন আমার পশ্চাতে এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছেন টেরই পাইনি। আমি যখন এ ঘরে প্রবেশ করি তখন ওঁকে দেখিনি। নিশ্চয়ই পরে কোন এক সময় এসেছেন।
আগন্তুক মহিলা খুব সুন্দরী না হলেও প্রসাধন-নৈপুণ্যে সুন্দরীই মনে হচ্ছিল। মৃদুকণ্ঠে আমার ছদ্মনামটা উচ্চারণ করলাম, সত্যসিন্ধু রায়।
আমার নাম বিশাখা চৌধুরী। আপনাকে আগে কখনও দেখিনি তো বৈকালী সঙ্ঘে?
না। আজই প্রথম এসেছি।
কারও সঙ্গে বুঝি এখনও আলাপ হয়নি?
নামেমাত্র কারও কারও সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হয়েছে, তার বেশি হয়নি।
তা এখানে এই ঘরের মধ্যে রয়েছেন কেন? আমার তো বদ্ধ ঘরে প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে।
উপায় কি? কোথায় আর যাব?
কেন, গার্ডেনে চলুন না! Its a lovely place!
গার্ডেন!
হ্যাঁ। ও, আপনি তো নতুন! এ বাড়ির কিছুই জানেন না! চলুন গার্ডেনে যাওয়া যাক।
বেশ তো, চলুন।
বিশাখা চৌধুরীকে অনুসরণ করে তিন নম্বর দরজার দিকে এগিয়ে চললাম। দরজা ঠেলে প্রথমে তিনি বের হলেন, তাঁর পিছনে আমিও হলঘর থেকে বের হলাম। সরু একটা প্যাসেজ। স্বল্পশক্তির একটামাত্র বিদ্যুৎবাতির আলো প্যাসেজে। এবং সেই স্বল্পালোকে নির্জন প্যাসেজটা যেন কেমন থমথমে মনে হয়। প্যাসেজের দু-পাশে গোটা দুই বন্ধ দরজা আর একটা জানলা পার হয়ে দ্বিতীয় জানলার পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ চমকে উঠলাম। খোলা জানলার পথে স্বল্প আলো-আঁধারিতে মনে হল যেন একখানা মুখ চট করে সরে গেল। এবং শুধু মুখই নয়, একজোড়া চোখের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি।
যে মুখখানা ক্ষণেকের জন্য আমার দৃষ্টিপথে পড়েছিল, পলকমাত্রেই সে মুখখানা কিন্তু চিনতে আমার কষ্ট হয়নি। ওয়েটার মীরজুমলার মুখ।
চোখের তারায় সেই সরীসৃপ চাউনি। বুঝলাম নতুন আগন্তুক আমি এ গৃহে এবং আমাকে তিনজন মেম্বারের সুপারিশে এখানে প্রবেশাধিকার দিলেও প্রখর দৃষ্টিই আছে আমার উপরে।
এমনি নিছক কৌতূহলেই সেই প্রখর দৃষ্টি আমার উপর পতিত হয়েছে, না আমাকে সন্দেহ করেই এরা আমার প্রতি দৃষ্টি রেখেছে সেটাই বুঝতে পারলাম না। সে যাই হোক, বুঝলাম সাবধানের মার নেই, আমাকে এখানে সতর্ক ও সজাগ হয়ে চলতে হবে।
প্যাসেজটা শেষ হয়েছে একটা দরজায়। সে দরজাটা খুলতেই বিদ্যুতালোকে আমার চোখে পড়ল একটা লোহার ঘোরানো সিঁড়ি ধাপে ধাপে নীচে নেমে গিয়েছে।
আসুন! বিশাখা সিঁড়ির ধাপে পা দিলেন।
আমিও তাঁকে অনুসরণ করলাম।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই চোখে পড়ল একটি উদ্যান। নানা আকারের গাছপালাই নজরে পড়ল। আরও নজরে পড়ল উদ্যানের মধ্যে স্বল্পশক্তির নীল বিদ্যুবাতি জ্বলছে মধ্যে মধ্যে। এদিকে-ওদিকে ছড়ানো ছোট ছোট ঝোপের মতও আছে। আর আছে একটা ঘর উদ্যানের দক্ষিণ প্রান্তে। লোহার ঘোরানো সিঁড়িটা দিয়ে নেমে বিশাখার সঙ্গে উদ্যানে এসে দাঁড়ালাম।
ঝিরঝিরে একটা ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা চোখেমুখে যেন একটা ঠাণ্ডা স্পর্শ দিয়ে গেল। সরু সরু সিমেন্ট-বাঁধানো রাস্তা উদ্যানের মধ্যস্থলে একটি গোলাকার বাঁধানো জায়গা থেকে যেন চারিদিকে হাত বাড়িয়েছে। বাঁধানো রাস্তার পরেই ঘাসের কোমল সবুজ কার্পেট যেন চারিদিকে বিছানো। তার মধ্যে মধ্যে সযত্ন-বর্ধিত নানা আকারের গাছপালা ও ঝোপ। সব কিছুর ভিতরেই যেন একটা সুপরিকল্পিত প্ল্যানের নির্দেশ আছে বলে মনে হয়।
উদ্যানটি যে কতখানি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত সঠিক বোঝবার উপায় নেই। কারণ সীমানা সেই স্বল্প নীলাভ আলোয় রাত্রে চোখে পড়ল না।
আবছা আলো-ছায়ার মধ্যে দিয়ে সরু বাঁধানো পথ ছেড়ে ঘাসের উপর দিয়েই ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছিলাম। আমার সঙ্গিনীর মনে তখন কি চিন্তা ছিল জানি না, কিন্তু আমার মনের সবটা জুড়েই সরু প্যাসেজ দিয়ে আসবার সময় ক্ষণেকের জন্য দেখা জানলা-পথে মীরজুমলার সেই পাথরে-খোদাইকরা মুখ ও সরীসৃপের মত দুটি চোখের দৃষ্টিভেসে বেড়াচ্ছিল। আমার সমস্ত চিন্তা যেন তাতেই নিবদ্ধ ছিল।
হঠাৎ বিশাখার কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম, কেমন লাগছে এ জায়গাটা, সত্যসিন্ধুবাবু?
অ্যাঁ!
কি ভাবছিলেন বলুন তো?
কই, কিছু না।
একটা কথা বলব, মিঃ রায়?
বলুন না।
সত্যসিন্ধু! আপনার নামটা যেন কেমন!
কেন বলুন তো?
সে জানি না, তবে ও নামে আমি কিন্তু আপনাকে ডাকতে পারব না।
সে কি! তবে কি নামে ডাকবেন?
কেন? ঐ পোশাকী নামটা ছাড়া আপনার কি আর অন্য কোন নাম নেই? মানুষের তো কত সময় ডাকনামও দু-একটা থাকে!
ডাকনাম?
হ্যাঁ। এই ধরুন না, যেমন আমার ডাকনাম শিলু। এখন অবিশ্যি ও নামে ডাকবার আর কেউ নেই। তবে ছোটবেলায় ঐ নামটা ধরেই সকলে আমাকে ডাকত। বলুন না, আপনার ডাকনামটা কি?
ঐ নামটি ছাড়া তো আমার আর দ্বিতীয় কোন নাম নেই বিশাখা দেবী। তবে ইচ্ছে করলে আপনি আমাকে সত্যবাবু বলেও ডাকতে পারেন।
কারা যেন এদিকে আসছে!
সত্যিই চেয়ে দেখি একটি পুরুষ ও একটি নারী-মূর্তি পরস্পর গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে মন্থর পদে হাঁটতে হাঁটতে এই দিকেই আসছে।
অস্পষ্ট আলোয় তাদের মুখ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।
চলুন ঐ ঝোপের ধারে একটা বেঞ্চ আছে, সেখানে গিয়ে আমরা বসি।
রেডিয়াম ডায়েল দেওয়া হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত প্রায় এগারোটা বাজতে চলেছে। বললাম, এবারে যাব ভাবছি!
কোথায়?
বাড়িতে।
বাড়িতে বুঝি রাত জেগে বসে আছেন মিসেস?
মৃদু হাসলাম বিশাখার কথায়।
হাসলেন যে? প্রশ্ন করলেন বিশাখা।
আপনার কথায়।
কেন?
তার কারণ বিয়েই করিনি তো মিসেসের ভাগ্য আসবে কোথা থেকে?
সে কি! বাঙালীর ছেলে, এত উপার্জন, এখনও বিয়ে করেননি?
না।
আশ্চর্য! কেন বলুন তো?
কেন আর কি! সুযোগ হয়ে ওঠেনি।
বিয়ে করার সুযোগ হয়ে ওঠে নি?
না। তাছাড়া শুধু সুযোগই তো নয়, মনের একটা তাগিদও তত থাকা দরকার বিয়ের ব্যাপারে।
ইতিমধ্যে কথা বলতে বলতে আমরা দুজনে এসে বিশাখা-বর্ণিত ঝোপের ধারে একটা বেঞ্চের উপরে পাশাপাশি বসেছিলাম।
বাড়িতে মিসেসের তাগিদই যখন নেই তখন বাড়ি ফেরবার জন্য এত তাড়াই বা কিসের?
রাত হল।
নিজের ছোট্ট হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে নিয়ে বিশাখা এবারে বললেন, মাত্র তো এগারটা! রাতের তো এখনও সবটাই বাকি!
হঠাৎ এমন সময় কানে এল মৃদু ভায়োলিন বাজনার শব্দ।
আশেপাশে কে যেন ভায়োলিন বাজাচ্ছে মনে হচ্ছে? প্রশ্ন করলাম।
হ্যাঁ।
কে বাজাচ্ছে বলুন তো?
সুধী বাজাচ্ছে।
সুধী!
মানে সুধীরঞ্জন?
হ্যাঁ। চেনে নাকি তাকে?
হ্যাঁ। আপনাদের এখানকার সভ্য-সভ্যাদের মধ্যে ঐ একজনের সঙ্গেই যা একটু-আধটু পূর্ব-পরিচয় আছে।
সিনিক!
কে?
কে আবার, আপনার ঐ সুধীরঞ্জন!
কেন?
কিন্তু আমার কেনর জবাব দিলেন না বিশাখা। চুপ করে রইলেন। সেরাত্রে বুঝতে পারলেও পরে বুঝছিলাম সুধীরঞ্জনকে কেন বিশাখা চৌধুরী সেরাত্রে সিনিক বলেছিলেন! যাহোক বিশাখার আমার প্রশ্নের জবাব দেবার অনিচ্ছাটা বুঝতে পেরে আমিও অন্য প্রশ্ন তুললাম। বললাম, এখানে এসে সুধী কারও সঙ্গে বুঝি মেশে না? আপনার মনে একা একা বেহালা বাজায়? তা বেহালা বাজাবার জন্য এখানেই বা ওকে আসতে হবে কেন তাও তো বুঝতে পারছি না!
কে বললে সুধী এখানে বেহালা বাজাতে আসে? ও বেহালা বাজানো শেখাচ্ছে!
বেহালা বাজানো শেখাচ্ছে? এই অন্ধকার বাগানের মধ্যে?
মনের মানুষকে বেহালা বাজানো শেখাবার জন্যে আলো বা আঁধারের ঘর বা বাগানের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে নাকি?
মনের মানুষ!
হ্যাঁ। শনিবার রাত্রে ও আসে মৃদুলোকে বেহালা শেখাবার জন্যে।
আর কৌতূহল প্রকাশ করা হয়ত উচিত হবে না। তাই চুপ করে গেলাম। মৃদু শব্দে বেহালা বাজালেও এমন চমৎকার সুরের একটা আকৃতি সে বাজনার মধ্যে ছিল যা আমার শ্রবণেন্দ্রিয়কে স্বভাবতই সেইদিন আকর্ষণ করছিল।
রাত হয়ে যাচ্ছে, তবু যাবার কথাও যেন ভুলে গেলাম।
সুধী এত চমৎকার বেহালা বাজায়, কই আগে তো কখনও জানতে পারিনি!
হঠাৎ আবার চমক ভাঙল বিশাখার কণ্ঠস্বর, চলুন সত্যসিন্ধুবাবু, উঠুন।
উঠব?
হ্যাঁ। এই যে বলছিলেন রাত হয়ে যাচ্ছে, বাড়ি যাবেন? যাবেন না?
হ্যাঁ চলুন।
উঠে দাঁড়ালাম।
.
আরও তিন রাত্রি বৈকালী সঙ্ঘে যাতায়াত করবার পর বিশাখা চৌধুরীর পরিচয় আর একটু পেলাম।
ফিলসফির বিখ্যাত প্রফেসর স্বর্গীয় ডক্টর প্রতুল চৌধুরীর বিধবা স্ত্রী হচ্ছেন বিশাখা চৌধুরী। বয়স পঁয়তাল্লিশোত্তীর্ণ।
দুটি মেয়ে, তাদের দুজনেরই বিবাহ হয়ে গিয়েছে। তারা শশুর-গৃহে। ডক্টর চৌধুরী নেহাত কিছু কম রেখে যাননি তাঁর বিধবা স্ত্রীর জন্য। কলকাতার উপর একখানা বাড়ি ও মোটামুটি কিছু ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স ও শেয়ারের কাগজ।
ইচ্ছা করলে বিশাখা চৌধুরী তাঁর বাকি জীবনটা আরামেই কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু গত-যৌবনা, দুটি সন্তানের জননী বিশাখার মনে কামনার আগুন তখনও নিঃশেষে নির্বাপিত হয়নি। তাই তাঁকে ছুটে আসতে হয়েছিল ঘরের বাইরে, বৈকালী সঙ্ঘের রাতের আসরে। প্রতি রাতে বৈকালী সঙ্ঘে তিনি আসতেন সেই অতৃপ্ত কামনার তাগিদেই। এবং সামনে যাকে পেতেন তাকেই আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করতেন। তিন রাত্রের আলাপেই সেটা আমার আর জানতে বাকি ছিল না। কিন্তু সে কথা জানতে পারা সত্ত্বেও আমি তাঁকে নিরুৎসাহ করিনি, কারণ তখন তাঁকে ঘিরে অন্য একটা চিন্তা আমার মনের মধ্যে উদয় হয়েছে। ওঁকে হাতে রাখতে পারলে এখানে আমি কতকটা নিশ্চিন্তে এবং নির্ভয়েই আসা-যাওয়া করতে যে পারব তা বুঝেছিলাম।
পঞ্চম রাত্রে হঠাৎ চমকে উঠলাম আর এক নবাগতার মুখের দিকে তাকিয়ে। পঞ্চম রাত্রি অবিশ্যি আমার পর পর আসা নয়। বৈকালী সঙ্ঘে আমার পঞ্চম রাত্রি আসা গত কুড়িদিনে। আজ আবার দ্বিতীয়বার রাজেশ্বর চক্রবর্তীকে দেখলাম বৈকালী সঙ্ঘে।
ইতিমধ্যে আর তাঁকে দেখতে পাইনি।
নিয়মানুযায়ী আজও প্রেসিডেন্ট রাজেশ্বর চক্রবর্তীই এক নবাগতাকে সঙ্ঘের অন্যান্য মেম্বারদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন।
কুমারী মীনা রায়।
আমি চমকে উঠেছিলাম কুমারী মীনা রায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এইজন্য যে প্রথম দৃষ্টিতেই একটু ভাল করে লক্ষ্য করতেই তাকে চিনতে কষ্ট হয়নি।
কৃষ্ণা বৌদি। কিরীটী-মহিষী।
এমনিতেই চোখ-ঝলসানো রূপ আর চেহারা কৃষ্ণার। তার উপরে আজ তার বেশ ও প্রসাধনে একটা অভূতপূর্ব চাকচিক্য ছিল, যাতে করে পুরুষ তো ছার মেয়েদেরও মনে আকর্ষণ জাগায়। এবং সেই কারণেই বোধ হয় সেরাত্রে আমার আবির্ভাবে কেউ আমার দিকে ফিরে না তাকালেও, আজ ঘরের মধ্যে উপস্থিত পনেরজন বিভিন্ন বয়েসী নরনারীর ত্রিশজোড়া কৌতূহলী চোখের দৃষ্টি যেন একঝাঁক ধারালো তীরের মতই কৃষ্ণাকে গিয়ে তার সর্বাঙ্গে বিদ্ধ করল। এবং তাকিয়েই রইল সকলে।
মনে হচ্ছিল আজ রাত্রে বৈকালী সঙ্ঘের মক্ষীরানী শ্রীমতী মিত্রা সেন এসে তার পাশে দাঁড়ালেও বুঝি ম্লান হয়ে যেতেন। কিন্তু মিত্রা সেন সে-সময়ে এসে তখনও পৌঁছাননি। যদিও সেটা শনিবারই ছিল।
প্রেসিডেন্ট রাজেশ্বর চক্রবর্তীতাঁর কর্তব্য-কাজটুকু সম্পাদন করে ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
এবং নীলাম্বর মিত্র ও মনোজ দত্ত কৃষ্ণার সঙ্গে আলাপ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন।