পরদিন প্রভাতেতে যত বীরগণ।
সসৈন্য চলিল সবে করিবারে রণ।।
যোদ্ধাগণ চলিল চড়িয়া দিব্যরথে।
গজবাজী পদাতিক চলে যূথে যূথে।।
হস্তী হ্স্তী মল্লে মল্লে মহাযুদ্ধ করে।
অশ্বে আসোয়ার যুঝে নানা অস্ত্র ধরে।।
হেনকালে ধনঞ্জয় কৃষ্ণে আগে করি।
রণস্থলে আইলেন হাতে ধনু ধরি।।
গগন ছাইয়া বীর এড়িলেন বাণ।
কোটি কোটি সেনাপতি ত্যজিলেক প্রাণ।।
ক্রোধেতে অর্জ্জুন যেন দীপ্ত হুতাশন।
প্রাণ লয়ে পলাইয়া যায় সেনাগণ।।
সৈন্যভঙ্গ দেখি তবে রাজা দুর্য্যোধন।
কোপমনে রথে চড়ি করিল গমন।।
অর্জ্জুন উপরে মারে পূরিয়া সন্ধান।
একেবারে প্রহারিল দশ গোটা বাণ।।
অর্দ্ধপথে ধনঞ্জয় করে খান খান।
ছয় বাণ মারিলেন পূরিয়া সন্ধান।।
দুই বাণে কাটিলেন ধ্বজ মনোহর।
চারি বাণে অশ্বগণ গেল যমঘর।।
দুই বাণ এড়িলেন যেন যমদণ্ড।
সারথির মাথা কাটি কৈল খণ্ড খণ্ড।।
নিরখিয়া দুর্য্যোধন কম্পিত অন্তর।
রথ এড়ি গদা লয়ে ধাইল সত্বর।।
গদা ফেলি মারিলেক অর্জ্জুনের রথে।
দারুণ প্রহারে রথ লাগিল কাঁপিতে।।
কোপেতে অর্জ্জুন যেন অনল সমান।
দুর্য্যোধনে প্রহার করিল শত বাণ।।
বাণাঘাতে দুর্য্যোধন মহাকম্পবান।
বেগে পলাইয়া যায় লইয়া পরাণ।।
বাণাঘাতে ব্যথিত হইল দুর্য্যোধন।
রথ লয়ে সারথি যোগায় সেইক্ষণ।।
রথে চড়ি পলাইয়া যায় দুর্য্যোধন।
দেখি ক্রোধে অগ্রসর দ্রোণের নন্দন।।
ধনঞ্জয় অশ্বথামা হয় মহারণ।
বিস্ময় মানিয়া চায় যত যোদ্ধাগণ।।
সন্ধান পূরিয়া অশ্বথামা মারে বাণ।
অর্দ্ধপথে পার্থ করিলেন খান খান।।
তবে ধনঞ্জয় বীর ক্রোধে হুতাশন।
দ্রৌণীর উপরে করে বাণ বরিষণ।।
বৃষ্টিধারাবৎ বাণ করেন ক্ষেপণ।
নিমিষেকে নিবারিল দ্রোণের নন্দন।।
বাণব্যর্থ দেখি তবে বীর ধনঞ্জয়।
মহাকোপে পুনশ্চ করেন অস্ত্রময়।।
বাণাঘাতে অশ্বথামা ব্যথিত হইল।
মূর্চ্ছিত হইয়া বীর রথেতে পড়িল।।
মূর্চ্ছিত হইলে রথ ফিরায় সারথি।
পলাইয়া গেল অশ্বথামা যোদ্ধাপতি।।
তবে দুঃশাসন বীর দেখি বৃকোদরে।
হস্তীর উপরে চড়ি চলিল সত্বরে।।
দুঃশাসনে দেখি কোপে বলে ভীমবীর।
গদাঘাতে আজি তোর লোটাব শরীর।।
দ্রৌপদীর মানস করিব আজি পূর্ণ।
এত বলি গদা লয়ে ধায় অতি তূর্ণ।।
হস্তীর উপরে গদা করিল ক্ষেপণ।
পৃথিবীতে দন্ত দিয়া পড়িল বারণ।।
হস্তী যদি পড়িল পলায় দুঃশাসন।
সৈন্যের মধ্যেতে পশি রাখিল জীবন।।
তবে বৃকোদর বীর ক্রোধে হুতাশন।
গদার প্রহারে মারে রথ রথিগণ।।
তবে অশ্বথামা বীর ধায় শীঘ্রগতি।
যুদ্ধ করিবারে বাঞ্ছা ভীমের সংহতি।।
অশ্বথামা দেখি বীর চাপে নিজ রথে।
ভয়ঙ্কর ধনুক তুলিয়া নিল হাতে।।
বাণ বৃষ্টি করে দোঁহে দোঁহার উপর।
দোঁহাকার বাণে দোঁহে হইল জর্জ্জর।।
কোপে অশ্বথামা বীর পরিঘ লইয়া।
মারিলেন বৃকোদরে ক্রোধিত হইয়া।।
অচেতন হৈল বীর পরিঘের ঘায়।
রথের উপরে বীর পড়ি গেল ঠায়।।
কতক্ষণে চেতন পাইয়া বৃকোদর।
মহাকোপে উঠিলেন কম্পিত অধর।।
গদা ফেলি মারিলেন রথের উপর।
চূর্ণ হৈল রথখান দেখি লাগে ডর।।
সেইক্ষণে আর রথ যোগায় সারথি।
তাহাতে চড়িয়া অশ্বথামা মহামতি।।
ভীমের উপরে বীর এড়ে যত বাণ।
কাটি পাড়ে ভীম তাহা করি খান খান।।
অতি ক্রোধে বৃকোদর জ্বলন্ত অনল।
রথ এড়ি গদা লয়ে ধায় মহাবল।।
রথের উপরে মারে দোহাতিয়া বাড়ি।
চূর্ণ হৈল রথখান যায় গড়াগড়ি।।
লাফ দিয়া অশ্বথামা পলাইয়া যায়।
দেখি বৃকোদর বীর পাছে পাছে ধায়।।
হেনকালে কর্ণ বীর হৈল আগুয়ান।
ভীমের উপরে মারে চোক্ চোক্ বাণ।।
বাণাঘাতে বৃকোদর হইল বিবর্ণ ।
কর্ণেরে এড়েন বাণ পূরিয়া আকর্ণ।।
যত বাণ এড়ে ভীম কর্ণ ফেলে কাটি।
রথ এড়ি ধায় বীর মহাক্রোধে ফাটি।।
গদা হাতে করি ক্রোধে ধায় মহাসুর।
গদা মারি অশ্ব রথ করিলেন চুর।।
লাফ দিয়া কর্ণ বীর যায় পলাইয়া।
শীঘ্রগতি আর রথে চড়িলেন গিয়া।।
কর্ণ পলাইয়া গেল দেখি বৃকোদর।
আপনার রথে গিয়া চড়িল সত্বর।।
বাণ বৃষ্টি করে বীর সৈন্যের উপর।
বাণেতে সকল সৈন্য করিল জর্জ্জর।।
হেথায় সংগ্রাম করি পার্থ ধনুর্দ্ধর।
কোটি কোটি কাটিলেন সৈন্য নিরন্তর।।
অর্জ্জুনের বাণে স্থির নহে সেনাগণ।
দেখিয়া ব্যাকুল তাহে রাজা দুর্য্যোদন।।
দ্রোণেরে ডাকিয়া তবে বলিল বচন।
দেখ গুরু সৈন্য সব হইল নিধন।।
সেনাপতি তোমা করি করিলাম আশ।
যুধিষ্ঠিরে ধরি দিবা করিলে আশ্বাস।।
আজিকার যুদ্ধে গুরু না দেখি নিস্তার।
ভীম ধনঞ্জয় করে সকল সংহার।।
সেনাপতি করিতাম যদ্যপি কর্ণেরে।
এত দিনে কর্ণ ধরি দিত যুধিষ্ঠিরে।।
মহারথী দেখি তোমা কৈনু সেনাপতি।
উপরোধে না যুঝহ বুঝি তব মতি।।
তোমার শিক্ষিত অস্ত্র অর্জ্জুন পাইয়া।
তব অস্ত্রে মারে সেনা দেখ দাণ্ডাইয়া।।
এতেক শুনিয়া গুরু ক্রোধে হুতাশন।
ডাকিয়া বলিল তবে শুন দুর্য্যোধন।।
পূর্ব্বেতে তোমায় আমি কহিনু আপনে।
ভিক্ষুক ব্রাহ্মণ আমি কিবা কার্য্য রণে।।
সেনাপতি যোগ্য আমি না হই কখন।
আমার এ সব কার্য্য নহে প্রয়োজন।।
এত বলি ডাকিলেন আপন নন্দন।
ক্রোধ করি যায় দ্রোণ উপেক্ষিয়া রণ।।
তবে দুর্য্যোধন কর্ণ শকুনি লইয়া।
আগে হৈতে গুরুপদে পড়িল আসিয়া।।
শকুনি বলিল গুরু কর অবধান।
প্রীতিভাবে দুর্য্যোধন করে অভিযান।।
তুমি যদি উপেক্ষিয়া চলিলা ভবনে।
আজ্ঞা কর রাজা দুর্য্যোদন যাক বনে।।
এত শুনি গুরু হাসি হইল সদয়।
দুর্য্যোধন দুঃখ দেখি ব্যথিত হৃদয়।।
দ্রোণ বলে কহিলাম পূর্ব্বেতে তোমারে।
অর্জ্জুন না থাকিলে ধরিব যুধিষ্ঠিরে।।
অর্জ্জুন সম্মূখে যুঝে নাহি হেন বীর।
যার বাণে যোদ্ধাগণ কেহ নহে স্থির।।
এক যুক্তি ভাবিয়াছি শুন দুর্য্যোধন।
তবে সে ধরিতে পারি ধর্ম্মের নন্দন।।
না থাকিবে ধনঞ্জয় সমর পাইয়া।
তবে ধরে দিতে পারি রাজাকে বান্ধিয়া।।
এতেক কহিতে হয় সন্ধ্যার সময়।
কৌরব পাণ্ডব গেল আপন আলয়।।
মহাভারতের কথা অমৃত-আখ্যান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পূণ্যবান।।