অবন্তীর বিশাল রাজপুরী; প্রাকার-বেষ্টিত একটি নগর বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। বিস্তৃত বিহার ভূমির উপর কুঞ্জবাটিকা উপবন, মধ্যে মধ্যে এক একটি অট্টালিকা। কোনোটি মন্ত্রগৃহ, কোনোটি শস্ত্রাগার, কোনোটি যন্ত্রভবন— এইরূপ আরও অনেক।
পুরভূমির সর্ব পশ্চাতে মহাদেবী ভানুমতীর অবরোধ— নগরের মধ্যে ক্ষুদ্র নগরী। অবরোধের ভূভাগ উচ্চ প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত, প্রাচীরের কোল ঘেঁষিয়া সঙ্কীর্ণ পরিখা। এখানে প্রবেশের একটি মাত্র পথ; তাহাও এত সঙ্কীর্ণ যে দুইজন পাশাপাশি প্রবেশ করিতে পারে না।
যে-সময়ের কাহিনী সে-সময়ে রাজপুরীর পুরন্ধ্রীদের প্রাকার পরিখার অন্তরালে অবরুদ্ধ করিয়া রাখিবার প্রথা প্রচলিত ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি কয়েক বৎসর পূর্বে হূণ বর্বরদের উৎপাত হইয়াছিল; সেই সময় পুরনারীদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য মহারাজ বিক্রমাদিত্য এই অবরোধ নির্মাণ করাইয়াছিলেন। তারপর হূণ উৎপাত দূর হইয়াছিল; কিন্তু প্রথা একবার গড়িয়া উঠিলে সহজে ভাঙ্গা যায় না। অবরোধ এবং তৎ-সংক্রান্ত বিধি-বিধান রহিয়া গিয়াছিল।
সেদিন একজন সশস্ত্র প্রহরী অবরোধের অপ্রসর প্রবেশ-পথের সম্মুখে পাহারায় নিযুক্ত ছিল। রক্ষীর বয়স কম, মাত্র উনিশ কুড়ি; কিন্তু ভারি জোয়ান। হাতের লৌহশূল অবহেলাভরে ঘুরাইতে ঘুরাইতে সে দ্বার সম্মুখে পদচারণ করিতেছিল। কেহ কোথাও নাই। দ্বারপথে অবরোধের প্রাসাদ প্রাঙ্গণ কিয়দংশ দেখা যাইতেছে; বাহিরে বকুল তমাল পিয়াল শোভিত মুক্ত ভূমি জনশূন্য। সন্ধ্যা সমাগত।
দূরে মালিনীকে আসিতে দেখিয়া রক্ষী থমকিয়া দাঁড়াইয়া সেইদিকে তাকাইয়া রহিল। তারপর একটু গদ্গদ হাসি তাহার মুখে দেখা দিল। মালিনীর প্রতি তাহার মনে যে বেশ প্রীতির ভাব আছে তাহা সহজেই অনুমান করা যায়।
মালিনী তাহার প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করিয়া তাড়াতাড়ি অবরোধে প্রবেশের উদ্যোগ করিল। রক্ষী এজন্য প্রস্তুত ছিল, মালিনীর অবজ্ঞা তাহার কাছে নূতন নয়; তাহার বল্লম অর্গলের মত পড়িয়া মালিনীর পথ রোধ করিয়া দিল। চমকিয়া মালিনী অধীর রুষ্ট মুখে রক্ষীর পানে তাকাইল; বলিল— ‘কি হচ্ছে! পথ ছেড়ে দাও।’
মালিনীর ভ্রূকুটি দেখিয়া রক্ষী ঘাবড়াইয়া গেল। সে নূতন প্রেম করিতে শিখিতেছে, এখনো আনাড়ী; অথচ একটু রসিকতা না করিয়াও মালিনীকে ছাড়িয়া দেওয়া যায় না। তাই সে বোকার মত হাসিয়া বলিল— ‘বিনা প্রশ্নে তোমাকে রানীর মহলে ঢুকতে দিই কি করে? কঞ্চুকী মশায়ের হুকুম—’
মালিনী বলিল— ‘ঢের হয়েছে, এবার বল্লম নামাও। এম্নিতেই আমার দেরি হয়ে গেছে—’
রক্ষী বলিল— ‘কঞ্চুকী মশায়ের হুকুম, পুরুষ ঢুকতে দেবে না। এখন তুমি যে মেয়ের ছদ্মবেশে পুরুষ নও—’
মালিনী ধমক দিয়া বলিল— ‘আবার! আচ্ছা বেশ, রঙ্গই কর তাহলে—’
মালিনী অদূরস্থ বেদীর মত ক্ষুদ্র শিলাখণ্ডের উপর সাজি কোলে লইয়া বসিল, আকাশের দিকে চোখ তুলিয়া নীরসকণ্ঠে বলিল— ‘আমার কি! রানীমার এতক্ষণ চুল বাঁধা গা ধোয়া হয়ে গেছে, ফুল আর মালার জন্যে হা-পিত্যেশ করে বসে আছেন। বেশ তো, বসে থাকুন। যত দেরি হবে ততই তাঁর রাগ বাড়বে। তা আমি কি করব! আমাকে যখন তলব হবে আমি বলব—’
রক্ষী এবার রীতিমত ভয় পাইয়া গেল, ত্বরিতে দ্বার হইতে বল্লম সরাইয়া মিনতির সুরে বলিল— ‘না না মালিনী, আমি কি তোমাকে আটকেছি! আমি একটু— ইয়ে— রস করছিলাম। নাও— তুমি ভিতরে যাও।’
মালিনী উঠিল না, মুখ কঠিন করিয়া বলিল— ‘আগে নিজের হাতে কান মলো।’
রক্ষীর বয়স অল্প, তাহার কর্ণ দু’টি রক্তিম হইয়া উঠিল। কিন্তু উপায় কি? সে হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল— ‘আচ্ছা, এই নাও মলছি। কিন্তু এ শুধু তোমাকে— ইয়ে— ভালবাসি বলে।’
মালিনী ফিক্ করিয়া হাসিল। উঠিয়া দাঁড়াইয়া গ্রীবার একটি লীলায়িত ভঙ্গি করিয়া বলিল— ‘ইঃ, ভালবাসা!’ সহসা গম্ভীর হইয়া মালিনী প্রশ্ন করিল— ‘জানো, নারীই গৃহকে গৃহের রূপ দিতে পারে? সে গৃহদেবতা— জানো?’
রক্ষী অবোধের মত ক্ষণকাল তাকাইয়া থাকিয়া বলিল— ‘কৈ, না তো।’
‘তবে তুমি কিছু জান না।’ মালিনী সদর্পে দ্বারপথে প্রবেশ করিয়া অন্তর্হিত হইয়া গেল।
মহাদেবী ভানুমতীর প্রসাধন কক্ষে একটি শিঙার-বেদিকার উপর অপরূপ রূপবতী প্রগাঢ়যৌবনা রানী অর্ধশয়ানভাবে অবস্থান করিতেছেন। চার পাঁচটি কিঙ্করী তাঁহাকে ঘিরিয়া আছে; একজন ভানুমতীর আলুলায়িত কুন্তল দুই হাতে তুলিয়া ধরিয়া ধূপের ধোঁয়ায় সুরভিত করিতেছে, দ্বিতীয়া কিঙ্করী পদপ্রান্তে নতজানু হইয়া লাক্ষারসে চরণপ্রান্ত রঞ্জিত করিতেছে। অবশিষ্ট কিঙ্করীরা প্রসাধন দ্রব্য হাতে লইয়া সাহায্য করিতেছে।
দ্রুত ব্যস্তপদে মালিনী প্রবেশ করিল; বাক্যব্যয় না করিয়া ভানুমতীর দেহ পুষ্পাভরণে সাজাইতে লাগিয়া গেল। রানী মদালস নেত্র মালিনীর দিকে ফিরাইয়া একটু হাসিলেন, বলিলেন— ‘আমার মালিনী মেয়ের আজ এত দেরি যে!’
মালিনী ক্ষিপ্রহস্তে ভানুমতীর মৃণালভুজে ফুলের অঙ্গদ পরাইতে পরাইতে হ্রস্বস্বরে বলিল— ‘কার মুখ দেখে যে আজ উঠেছিলুম, দেরি হয়ে গেল রানিমা। ফুল নিয়ে নদীর ধার দিয়ে আসছি, চোখ তুলে দেখি— ওমা, এক কবি! বল তো রানিমা, অবাক কাণ্ড না?’
রানী অধর প্রান্ত একটু কুঞ্চিত করিলেন— ‘এ আর অবাক কাণ্ড কী! মহারাজের কৃপায় উজ্জয়িনীতে এত কবি জুটেছে যে, বর্ষাকালে ইন্দ্রগোপ কীটও এত জন্মায় না।’
মালিনী মাথা নাড়িয়া বলিল— ‘ওমা না গো না, এ তোমার ন্যাড়ামাথা নাকলম্বা চিমসে কবি নয়। কি বলব তোমায় রানিমা, চেহারা যেন ঠিক— কুমার কার্তিক! গায়ের রঙ ডালিম ফেটে পড়ছে— কী নাক, কী চোখ! বয়স কতই বা হবে, বড় জোর চব্বিশ পঁচিশ।’
ঈষৎ ভ্রূভঙ্গ করিয়া ভানুমতী মালিনীকে নিরীক্ষণ করিলেন— ‘হুঁ?’
মালিনী উৎসাহভরে বলিয়া চলিল— ‘হ্যাঁ গো রানিমা। বললে বিশ্বাস করবে না, এত সুন্দর কবি আমি জন্মে দেখিনি। — নদীর পাড়ে কুঁড়ে ঘর তৈরি করেছে, সেখানেই থাকবে!’ মালিনী হঠাৎ হাসিয়া উঠিল— ‘দরজায় আল্পনা দিচ্ছিল— কিবা আল্পনার ছিরি! হাত থেকে পিটুলির ভাঁড় কেড়ে নিয়ে আমি আল্পনা এঁকে দিলুম। তাই না এত দেরি হল। কবির নাম— কালিদাস। বেশ মিষ্টি নাম, না? আর তেমনি কি মিষ্টি কথা— কথা শুনলে কান জুড়িয়ে যায়।’
ভানুমতী মন দিয়া শুনিতেছিলেন, তাঁহার মুখের গূঢ় হাসি গভীর হইতেছিল; মালিনী থামিতেই তিনি ভ্রূভঙ্গি করিয়া বলিলেন— ‘সত্যি!— নদীর ধারে খাসা কবি কুড়িয়ে পেয়েছিস তো! তা— কি বল্ল তোর কবিটি? কানের কাছে ভোমরার মত গুনগুন করে গান শুনিয়েছে বুঝি?’
মালিনী রানীর কথার ব্যঙ্গার্থ বুঝিল না; সে এখনো অতশত বুঝিতে শেখে নাই, সরলভাবে বলিল— ‘না রানিমা, গান করেনি, শুধু কথা বলেছে। কিন্তু কী মিষ্টি কথা, ঠিক যেন মধু ঢেলে দিচ্ছে।’
ভানুমতী ফিক্ করিয়া হাসিয়া কিঙ্করীদের পানে চাহিলেন; তাহারাও মুখ টিপিয়া হাসিতে লাগিল। রানী অলসহস্তে মালিনীর চিবুক তুলিয়া ধরিয়া তাহার কচি মুখখানি দেখিলেন, তরল কৌতুকের সুরে বলিলেন— ‘আমার মালিনী-কুঁড়িটি এতদিনে সত্যিই ফুটবে ফুটবে করছে, ভোমরাও ঠিক এসে জুটেছে। দেখিস মালিনী, তুই যেমন ভালমানুষ, তোর কবি-ভোমরা সব মধুটুকু শুষে নিয়ে উড়ে না পালায়।’
কিঙ্করীরা হাসিতে লাগিল। মালিনী ব্যাপার বুঝিতে না পারিয়া অবাক হইয়া সকলের মুখের পানে তাকাইতে লাগিল। রানী হাসিতে হাসিতে উঠিয়া মালিনীর দুই স্কন্ধের উপর হাত রাখিলেন, স্নেহ-কোমল কণ্ঠে বলিলেন— ‘বোকা মেয়ে। এখনো ঘুম ভাঙেনি। — ভয় নেই, একদিন ঘুম ভাঙবে, হঠাৎ সব বুঝতে পারবি। তোর কবি বুঝি ঘুম ভাঙাতেই এসেছে।’
কিছুদিন কাটিয়াছে।
একদা প্রভাতকালে কালিদাস নিজ কুটির প্রাঙ্গণে বেদীর উপর বসিয়া আছেন। সম্মুখে মৃত্তিকার মসীপাত্র, খাগের কলম ও একতাড়া তালপত্র। কবি রচনায় নিমগ্ন, কিন্তু যত না রচনা করিতেছেন চিন্তা করিতেছেন তাহার দশগুণ। ললাট চিন্তা-চিহ্নিত, কোথাও যেন আটকাইয়া গিয়াছে। কবি কয়েকবার মুখে বিড়্বিড়্ করিতে করিতে করাগ্রে গণনা করিলেন, তারপর অন্যমনস্কভাবে লেখনী মসীপাত্রে ডুবাইলেন। কিন্তু মনে মনে যাহা গড়িয়াছিলেন তাহা মনঃপূত হইল না, তিনি আবার কলম রাখিয়া দিলেন। তালপত্রে একটি অসমাপ্ত শ্লোক লেখা ছিল, তালপত্রটি তুলিয়া জানুর উপর রাখিয়া মৃদুকণ্ঠে শ্লোকটি আবৃত্তি করিলেন, যেন উহার ধ্বনি হইতে পরবর্তী অলিখিত পংক্তির ইঙ্গিত ধরিবার চেষ্টা করিতেছেন—
অবচিত বলিপুষ্পা বেদি সম্মার্গদক্ষা
নিয়মবিধি জলানাং বর্হিষাঞ্চোপনেত্রী
গিরিশমুপচচার প্রত্যহং সা— ভবানী!
শেষ শব্দটি তিনি সংশয়সঙ্কুল কণ্ঠে উচ্চারণ করিলেন। ‘ভবানী’ শব্দটি পত্রে লেখা ছিল না, কবি পাদপূরণের জন্য উচ্চারণ করিয়াছিলেন। ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া তিনি মাথা নাড়িলেন— ‘উহুঁ, ভবানী চলবে না! এখনো তো দেবী ভবানী হননি। কৃশাঙ্গী—? উঁহু— মৃগাক্ষী?— উঁহু উঁহু—’
কবির ভাবাবিষ্ট চক্ষু এদিক ওদিক ঘুরিতে ঘুরিতে দ্বারের কাছে গিয়া সহসা রুদ্ধ হইল; কবি ভাবতন্দ্রা হইতে জাগিয়া উঠিলেন। প্রাঙ্গণের দ্বারপথে মালিনী হাসিতে হাসিতে প্রবেশ করিতেছে। সদ্যঃস্নাতা; হাতে তাম্রের থালিতে একরাশ ফুল, মাথার সিক্ত চুলগুলি বুকে কাঁধে ছড়াইয়া পড়িয়াছে; প্রভাতের শিশির বিন্দুর মত চৌদিকে আনন্দের রশ্মি বিকীর্ণ করিতে করিতে মালিনী কালিদাসের দিকে অগ্রসর হইল। কালিদাস চকিত বিস্ফারিত নেত্রে ক্ষণকাল চাহিয়া রহিলেন— এ কি! এ যে গিরিকন্যারই মর্ত্য প্রতিমূর্তি! যে শব্দটির অভাবে তাঁহার শ্লোক এবং কাব্যের প্রথম সর্গ সমাপ্ত হইতেছে না সেই শব্দটি বিদ্যুৎস্ফুরণের মত তাঁহার মস্তিষ্কে জ্বলিয়া উঠিল। ত্বরিতে লেখনী ধরিয়া কবি লিখিতে আরম্ভ করিয়া দিলেন, খস্খস্ শব্দে তালপত্রের উপর লেখনী চলিতে লাগিল।
ফুলের থালি হাতে মালিনী বেদীর পাশে আসিয়া দাঁড়াইল; কবি কিন্তু তাহাকে অন্য দিনের মত সম্ভাষণ করিলেন না, মুখ তুলিয়া দেখিলেন না। মালিনীর হাসিভরা মুখখানি ম্লান হইয়া গেল, অভিমানে চক্ষু ছলছল করিয়া উঠিল। কবি ব্যগ্রভাবে লিখিয়া চলিয়াছেন, যেন মুহূর্তের জন্য অন্য দিকে মন দিলেই শব্দগুলি মস্তিষ্কের পিঞ্জর খুলিয়া উড়িয়া যাইবে। মালিনী ক্ষণেক চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর ভারী গলায় বলিল— ‘এত কাজ— আমার পানে চোখ তুলে চাইবারও সময় নেই! বেশ!—’
কালিদাস মুখ না তুলিয়াই চাপা সুরে বলিলেন— ‘স্স্স্— একটু দেরি কর— এটা শেষ করে ফেলি—। নি-য়-মি-ত প-রি-খে-দা—’
মুখে অসমাপ্ত বাক্য মিলাইয়া গেল, কালিদাস লিখিয়া চলিলেন। অবশেষে লেখা সমাপ্ত হইল। লেখার নীচে কলমের একটি সাড়ম্বর আঁচড় টানিয়া তিনি মালিনীর পানে হাস্যোজ্জ্বল মুখ তুলিলেন— ‘ব্যস— ইতি প্রথম সর্গঃ।’
মালিনী মুখ ভার করিয়া রহিল, কালিদাস সোৎসাহে বলিয়া চলিলেন— ‘একটা শব্দ কিছুতেই মাথায় আসছিল না, তোমাকে দেখেই মনে পড়ে গেল— তোমার ওই কালো কালো কোঁকড়া চুল দেখে—’
মালিনীর পক্ষে আর অভিমান করিয়া থাকা সম্ভব হইল না, কৌতূহল-দীপ্ত চোখে সে কালিদাসের পানে চাহিয়া প্রশ্ন করিল— ‘কি কথা— বল না।’
কালিদাস বলিলেন— ‘কথাটি হচ্ছে— সুকেশী। তোমার সুন্দর ভিজে চুলগুলি দেখে মনে পড়ে গেল।’
মালিনী বেদীর একপাশে বসিয়া পড়িল। কৌতূহলের সীমা নাই; ফুলের থালিটি নামাইয়া রাখিয়া সে এক অঞ্জলি ফুল কবির কোলের উপর ফেলিয়া দিল, তারপর লেখনী মসীপাত্র তালপত্রের উপর দুই চারিটি ফুল ছড়াইয়া দিতে দিতে বলিল— ‘কিসের গল্প লিখছ? শিবের গীত বুঝি?’
কালিদাস বলিলেন— ‘হ্যাঁ। শিব আর পার্বতীর গল্প। শিবের সঙ্গে পার্বতীর তখনো বিয়ে হয়নি। শিব তপস্যা করছেন— কঠিন তপস্যা, আর গিরিরাজ-কন্যা উমা রোজ এসে তাঁর সেবা করেন, ফুল সমিধ আহরণ করে আনেন, পূজার জন্যে বেদী-মার্জন করে দেন। তারপর এইসব কাজ ক’রে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েন তখন শিবের ললাট-চন্দ্রের কিরণের তলায় বসে ক্লান্তি দূর করেন। — শুনবে শেষ শ্লোকটা?’
মালিনী অবহিত চিত্তে শুনিতেছিল, সে কেবল সাগ্রহে ঘাড় নাড়িল। কালিদাস তালপত্র তুলিয়া পড়িলেন—
‘অবচিত বলিপুষ্পা বেদি সম্মার্গদক্ষা
নিয়মবিধি জলানাং বর্হিষাঞ্চোপনেত্রী
গিরিশমুপচচার প্রত্যহং সা সুকেশী
নিয়মিত পরিখেদা তচ্ছিরশ্চন্দ্রপাদৈঃ।’
কিছুক্ষণ দুইজনে নীরব। কালিদাস ধীরে ধীরে তালপত্র নামাইয়া রাখিলেন, মালিনীর দিকে মৃদু সস্নেহ হাসিয়া বলিলেন— ‘এ ছন্দের নাম জানো?’
মালিনী বলিল— ‘না— কী?’
কালিদাস বলিলেন— ‘মালিনী ছন্দ— তোমার নামের ছন্দ। প্রত্যেক সর্গের শেষে তোমার নামের ছন্দে শ্লোক লিখব ইচ্ছা আছে। আমার কাব্য যদি বেঁচে থাকে মালিনীর নামও কেউ ভুলবে না, আমার কাব্যে তোমার নাম গাঁথা থাকবে।’
মালিনীর মুখ আনন্দে গৌরবে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। কালিদাস হাসিতে হাসিতে বেদীর উপর উঠিয়া দাঁড়াইলেন। পরম বিলাসভারে আলস্য ত্যাগ করিতে করিতে অঙ্গন-বেষ্টনীর বাহিরে শিপ্রার তীরে তাঁহার দৃষ্টি পড়িল। তাঁহার হাস্য-আলস্য ভরা মুখে সহসা ভাবান্তর দেখা গেল।
শিপ্রার তীররেখা ধরিয়া এক শ্রেণী উট চলিয়াছে। আর একদিনের কথা কালিদাসের মনে পড়িয়া গেল— পূর্ণিমার নিথর রাত্রি, জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাজোদ্যান, প্রাকার-বেষ্টনীর পরপারে উটের সারি চলিয়াছে— তারপর—
স্মৃতির বেদনা কালিদাসের মুখে করুণ ছায়াপাত করিল। মালিনী ঊর্ধ্বমুখী হইয়া কবির পানে চাহিয়া ছিল, সে তাঁহার মুখের ভাবান্তর লক্ষ্য করিল। ঈষৎ বিস্ময়ে উঠিয়া দাঁড়াইয়া সে প্রাঙ্গণ-বেষ্টনীর ওপারে দেখিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু দেখিতে পাইল না; তখন সেও বেদীর উপর উঠিতে উঠিতে বলিল— ‘কী দেখছ?’
কালিদাস উত্তর দিলেন না, চাহিয়া রহিলেন। মালিনী তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া ডিঙি মারিয়া দেখিল উটের সারি। সে ঠোঁট উল্টাইয়া বলিল— ‘আ কপাল— উট! আমি বলি না জানি কী! তো হ্যাঁ কবি, উট দেখে তোমার ভয় হল নাকি?’
কালিদাস ম্লান হাসিলেন— ‘ভয় নয় মালিনী, দুঃখ হল। ঐ উটের সঙ্গে একটা বড় দুঃখের স্মৃতি জড়িয়ে আছে।’
কালিদাস দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন। মালিনী সপ্রশ্ন নেত্রে তাঁহার মুখের পানে চাহিয়া রহিল, কিন্তু তিনি আর কিছু বলিলেন না।