রাজা বলিলেন, মুনি কর অবধান।
কার পুত্র দ্রোণাচার্য্য, কোথা অবস্থান।।
ধনুর্ব্বেদ শিখাইল তাঁরে কোন্ জন।
কুরু-দেশে গুরু হইলেন কি কারণ।।
ব্যাস-শিষ্য মুনিবর সর্ব্ব-শাস্ত্র-জ্ঞানী।
কহিতে লাগিল দ্রোণাচার্য্যের কাহিনী।।
ভরদ্বাজ মহামুনি খ্যাত ভূমণ্ডলে।
একদিন স্নানার্থ গেলেন গঙ্গাজলে।।
অন্তরীক্ষে চ’লি যায় ঘৃতাচী অপ্সরা।
পরমা সুন্দরী হয় অপ্সরাতে বরা।।
দক্ষিণ-পবনে তার উড়িল বসন।
মুনি তার অঙ্গ করিলেন দরশন।।
দেখিয়া তাঁহার চিত্তে জন্মিল উদ্বেগ।
পঞ্চশর-শরের অধিকতর বেগ।।
নাহি হেন জন, যারে না মোহে কামিনী।
স্খলিত হইল রেত, চিন্তাম্বিত মুনি।।
সম্মুখে দেখিয়া দ্রোণী রাখিলেন তায়।
দ্রোণী-মধ্যে পুত্র জন্ম হইল ত্বরায়।।
পুত্র দেখি ভরদ্বাজ হরিষ-অন্তর।
পুত্র লৈয়া গেলেন সে আপনার ঘর।।
দ্রোণীতে জন্মিল পুত্র তেঁই দ্রোণ আখ্যা।
বেদ-বিদ্যা সর্ব্ব-শাস্ত্র করালেন শিক্ষা।।
ছিলেন পৃষত-নামে পাঞ্চাল রাজন।
দ্রুপদ বলিয়া নাম তাঁহার নন্দন।।
ভরদ্বাজ-মুনির আশ্রমে সদা যায়।
সমান-বয়স দ্রোণ সহিত খেলায়।।
এক ঠাঞি দুই জন করে অধ্যয়ন।
ক্রীড়া করে এক ঠাঁই ভোজন-শয়ন।।
তিলেক না রহে দোঁহে না হইলে দেখা।
পরস্পর হইলে দোঁহার দোঁহে সখা।
তবে কত দিনে রাজা পৃষত মরিল।
পাঞ্চাল-দেশেতে রাজা দ্রুপদ হইল।।
স্বর্গেতে গেলেন ভরদ্বাজ তপোধন।
তপস্যা করিতে দ্রোণ যান তপোবন।।
কতদিনে দ্রোণাচার্য্য পিতৃ-আজ্ঞা মানি।
বিবাহ করেন কৃপাচার্য্যের ভগিনী।।
পরমা-সুন্দরী কন্যা ব্রতে অনুরতা।
যজ্ঞ-হোম তপে নিষ্ঠা সতী পতিব্রতা।।
যজ্ঞ-তপ-ফলে তাঁর হইলে নন্দন।
জন্মমাত্র পুত্র করিলেক অশ্বের গর্জ্জন।।
হেনকালে আচম্বিতে হৈল শূন্যবাণী।
জন্মমাত্র পুত্র করিলেক অশ্বধ্বনি।।
অশ্বত্থামা নাম তার হবে সে কারণে।
দীর্ঘজীবী হবে, আর পূর্ণ সর্ব্বগুণে।।
পুত্রে দেখি দ্রোণাচার্য্য আনন্দিত মন।
নানা বিদ্যা তারে করালেন অধ্যয়ণ।।
তবে কত দিনে দ্রোণ করেন শ্রবণ।
জমদগ্নি-সুতের দানের বিবরণ।।
নানা রত্ন ধন বিপ্রে দিতেছেন দান।
পৃথিবীতে শব্দ হৈল দানের বাখান।।
মহেন্দ্র-পর্ব্বত মধ্যে রামের নিলয়।
তথায় গেলেন ভরদ্বাজের তনয়।।
দ্রোণে জিজ্ঞাসেন জমদগ্নির নন্দন।
কোথা হৈতে আইলেন, কোন প্রয়োজন।।
দ্রোণ বলিলেন, মোর দ্রোণাচার্য্য নাম।
জনক আমার ভরদ্বাজ গুণধাম।।
বহুদান কর তুমি, শুনি লোকমুখে।
বার্তা পেয়ে আইলাম তোমার সম্মুখে।।
পূর্ণ করি ধন দিবা আমারে হে রাম।
সকুটুম্ব মোর যেন পুরে মনস্কাম।।
শুনিয়া বলেন জমদগ্নির নন্দন।
সব ধন দিয়া আমি এই যাই বন।।
হেনকালে এলে তুমি ব্রাহ্মণ-কুমার।
কোন্ দ্রব্য দিয়া তুষ্টি করিব তোমার।।
পৃথিবীর মধ্যে মম নাহি অধিকার।
কশ্যপে দিলাম আমি সকল সংসার।।
আছে মাত্র প্ত্রাণ আর ধনুঃশর তূণ।
যাহা ইচ্ছা মম স্থানে মাগি লহ দ্রোণ।।
দ্রোণাচার্য্য মাগিলেন তবে ধনুর্ব্বাণ।
মন্ত্র সহ অস্ত্র দেন ভৃগুর সন্তান।।
ধনুর্ব্বেদে নিপুণ হইয়া দ্রোণাচার্য্য।
পরে চলিলেন তিনি দ্রুপদের রাজ্য।।
অত্যন্ত দরিদ্র দ্রোণ, না মাগেন কারে।
পুত্রের দেখিয়া কষ্ট ভাবেন অন্তরে।।
বালক কালের সখা দ্রুপদ রাজন।
তাঁর স্থানে গেলে হবে দারিদ্র-ভঞ্জন।।
এত ভাবি গেল দ্রোণ পাঞ্চাল-ভঞ্জন।।
এত ভাবি গেল দ্রোণ পাঞ্চাল-নগর।
উত্তরেন যথায় দ্রুপদ নরবর।।
পিন্ধন মলিন জীর্ণ কৃষ্ণবর্ণ দুঃখে।।
রাজারে বলেন দ্রোণ, শুন মহারাজ।
আমি তব সখা, হেথা আসিয়াছি আজ।।
এত শুনি নরপতি কটাক্ষেতে চায়।
নয়ন লোহিত-বর্ণ, কহে কম্পকায়।।
কোথায় দ্বিজ তুমি দরিদ্র ভিক্ষুক।
অজ্ঞান বাতুল কিবা হইবা দুর্ম্মুখ।।
আমি মহারাজ হই পাঞ্চাল-ঈশ্বর।
কোন্ লাজে সখা বল সভার ভিতর।।
ধনীর নির্ধন সখা কভু না যুয়ায়।
সুর-নরলোকে কভু সখ্য নাহি হয়।।
কোথা সখ্য হইয়াছে নৃপতি ভিক্ষুকেক।
সমানে সমানে সখ্য হয় অতি সুখে।।
উত্তমে অধমে সখ্যে হয় অতি সুখ।
অধমে উত্তমে দ্বন্দ্ব সেইরূপ দুঃখ।।
কোথা হৈতে এলে তুমি দরিদ্র এখানে।
দেখেছি কি না দেখেছি, নাহি পড়ে মনে।।
এতেক শুনিয়া তাঁর নিষ্ঠুর উত্তর।
অভিমানে দ্রোণের কম্পিত কলেবর।।
মুহূর্ত্তেক স্তব্ধ হৈয়া রহিলেন দ্রোণ।
ক্রোধে নেত্রদ্বয় করে অগ্নি বরিষণ।।
পুনশ্চ না দেখিলেন রাজার বদন।
না বলিয়া কারে কিছু করিলা গমন।।
শ্যালক-আলয়ে যান হস্তিনা-নগর।
দ্রোণে দেখি কৃপাচার্য্য হরিষ-অন্তর।।
দারা পুত্র সহ দ্রোণ থাকেন তথায়।
হেনমতে গুপ্তবেশে কত দিন যায়।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সিঞ্চিত।
পাঁচালী-প্রবন্ধে কাশীরাম বিরচিত।।