লোমশ বলেন, ডাকি ধর্ম্মের নন্দন।
শ্যেন কপোতের কথা করহ শ্রবণ।।
এই যে বিতস্তা নদী শিবিরাজ্য দেশে।
সারস সারসী ক্রীড়া করিছে উল্লাসে।।
জলা উপজলা দুই যমুনার পাশ।
মুনিগণ এই তটে করে অধিবাস।।
উশীনর নামে নৃপ আছিল তথায়।
যজ্ঞ অনুষ্ঠানে ইন্দ্র পরাভব পায়।।
যজ্ঞের প্রভাবে ধরা কাঁপে থর থর।
সুরাসুর যক্ষ রক্ষ ভাবিয়া কাতর।।
সুরপতি চিন্তাকুল স্বর্গের আসনে।
ইন্দ্রত্ব বা লয় বুঝি ভাবে মনে মনে।।
হেনকালে হুতাশন হন উপনীত।
উশীনর যজ্ঞ কথা করিল বিদিত।।
উভয়েতে যুক্তি করি অতি সঙ্গোপনে।
বিহগ মূর্ত্তিতে যান ছলিতে রাজনে।।
ধরিল কপোতরূপ দেব হুতাশন।
দেবরাজ শ্যেনরূপ করেন ধারণ।।
সভাতলে যজ্ঞে ব্রতী আছেন রাজন।
শ্যেনভয়ে কপোতক লইল শরণ।।
উশীনর ঊরুদেশে লুকায় ভয়েতে।
আক্রমণ করি শ্যেন আইল পশ্চাতে।।
ছদ্মবেশী কপোতক কহিল রাজায়।
লইনু শরণ প্রভু, রাখ ঘোর দায়।।
কপোতের অরি শ্যেন নিরদয় হয়ে।
নাশিতে জীবন মোর আসিয়াছে ধেয়ে।।
কপোতে ব্যাকুল হেরি কহে উশীনর।
তোমায় রক্ষিতে দিব নিজ কলেবর।।
আশ্রিতে রক্ষিতে যদি যায় মোর প্রাণ।
তথাপি এ পণ কভু নাহি হবে আন।।
শ্যেন কহে, মহারাজ এ কি আচরণ।
মোর ভক্ষ্যে রক্ষ তুমি কিসের কারণ।।
সবে কহে ধর্ম্মনিষ্ঠ রাজা উশীনর ।
ধর্ম্মহীন কর্ম্ম কেন কর নৃপবর।।
মহাপাপ খাদ্যে বাধা ক্ষুধার সময়।
ভক্ষ্য ছাড়ি দেহ মোর, হয়ে সদাশয়।।
রাজা বলে, পক্ষিরাজ কি করিব আমি।
অনর্থক না বুঝিয়া নিন্দ মোরে তুমি।।
কপোত প্রাণের ভয়ে লয়েছে শরণ।
কেমনে তোমার গ্রাসে করিব অর্পণ।।
পরিত্যাগ করে যেবা শরণ আগতে।
গো ব্রাহ্মণ বধ সম ভুঞ্জিবে পাপেতে।।
শ্যেন বলে, মহারাজ করহ শ্রবণ।
আহার বিহনে নাহি বাঁচে জীবগণ।।
ধন জন ছাড়ি বাঁচে যাবৎ জীবন।
আহার ছাড়িলে জীব না বাঁচে কখন।।
ক্ষুধায় আকুল আমি না সরে বচন।
ক্ষণেক বিলম্ব হৈলে যাইবে জীবন।।
আমি যদি মরি, এবে আহার বিহনে।
দারা পুত্র আদি মম মরিবে জীবনে।।
এক প্রাণী নিলে যদি বাঁচে বহু প্রাণী।
অধর্ম্ম না হয় তাহে, সত্য ধর্ম্ম গণি।।
সামান্য লাভেরে ত্যজি বহু লাভ যাহে।
লইবে আশ্রয় তার শাস্ত্রমতে কহে।।
রাজা বলে, যদি তব খাদ্যে প্রয়োজন।
অন্য খাদ্য খাও তুমি রহিবে জীবন।।
বৃষ মৃগ ছাগ মেষ মহিষ বরাহ।
এখনি আনিয়া দিব, যেই মাংস চাহ।।
শ্যেন বলে, অন্য মাংস মোরা নাহি খাই।
কপোত মোদের খাদ্য, দেহ মোরে তাই।।
কপোতের মাংস দেহ করিব ভোজন।
এত শুনি সকাতরে কহেন রাজন।।
শিবিরাজ্য চাহ কিম্বা যাহা মোর আছে।
এখনি দানিব তোমা, না ডরিব পাছে।।
যা বলিবে করিব তা, যাহে তুষ্ট তুমি।
আশ্রিত কপোতে কিন্তু নাহি দিব আমি।।
এত শুনি কহে শ্যেন, শুনহ রাজন।
কপোত যদ্যপি তব স্নেহের ভাজন।।
নিজ মাংস খণ্ড করি কপোত সমান।
দেহ মোরে তুলা যন্ত্রে করি পরিমাণ।।
তব মাংস কপোতের তুল্য যদি হয়।
সেই মাংসে তৃপ্ত হব, শুন মহাশয়।।
ছদ্মবেশে বহ্নি ইন্দ্র ছলেন রাজনে।
উশীনর মুগ্ধ হৈল দোঁহার ছলনে।।
পূণ্য ধর্ম্মময় মহাভারতের কথা।
কাশী রচে ছন্দে উশীনর-নৃপ-গাথা।।