৬৬তম অধ্যায়
নলকর্ত্তৃক দাবাগ্নিপতিত কর্কোটক-নাগের উদ্ধার
বৃহদশ্ব কহিলেন, “মহারাজ! এদিকে নলরাজ দময়ন্তীকে পরিত্যাগ করিয়া এক মহারণ্যে প্রবেশপূর্ব্বক দেখিলেন, ঐ বনে দারুণ দাবানল প্রজ্বলিত হইতেছে। সেই অনলমধ্য হইতে কোন প্রাণীর “হে পুণ্যশ্লোক নল! শীঘ্ৰ আসিয়া আমাকে পরিত্রাণ কর” এইরূপ চীৎকার-শব্দ তাঁহার কর্ণকুহরে বারংবার প্রবিষ্ট হইল। তখন তিনি ‘ভয় নাই’ বলিয়া তৎক্ষণাৎ সেই দাবানলামধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, এক প্রকাণ্ড-কলেবর ভূজঙ্গ কুণ্ডলাকার হইয়া তথায় শয়ান রহিয়াছে। নাগরাজ নিষধরাজকে সন্দর্শন করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কম্পান্বিতকলেবরে তাঁহাকে কহিতে লাগিল, ‘হে রাজন! আমি নাগবংশসম্ভূত, আমার নাম কৰ্কোটক। একদা মহাতপাঃ দেবর্ষি নারদকে প্রবঞ্চনা করাতে তিনি ক্ৰোধপরতন্ত্র হইয়া আমাকে শাপ প্ৰদান করিলেন যে, “তুমি অদ্যাবধি স্থাবরের ন্যায় চলৎশক্তিরহিত হইয়া এইস্থানেই অবস্থিতি কর। মহারাজ নল যাদৃচ্ছাক্রমে সমাগত হইয়া তোমাকে এস্থান হইতে অপনীত করিলেই তুমি আমার শাপ হইতে মুক্ত হইবে।” হে রাজন! আমি সেই মহর্ষির শাপপ্রভাবে তদবধি একপদও চলিতে পারি না। আপনি আমাকে পরিত্ৰাণ করুন। আমি আপনাকে শ্রেয়স্কর উপদেশ প্রদান করিব ও আপনার সখা হইব। হে রাজন! নাগবংশে আমার সমান আর কেহই নাই। আমাকে শীঘ্র এস্থান হইতে লইয়া স্থানান্তরে গমন করুন। আমাকে বহন করিতে আপনার কিছুমাত্ৰ কষ্ট হইবে না, আমি এক্ষণেই সাতিশয় লঘুভারসম্পন্ন হইব।” নাগরাজ এই বলিয়া অঙ্গুপ্ৰমাণ হইলে মহারাজ নল তাহাকে লইয়া নিরাগ্নি প্রদেশে প্রস্থান করিলেন; দাবানলও আকাশমার্গে সমুত্থিত হইয়া তৎক্ষণাৎ নির্ব্বাপিত হইল; নলরাজের অঙ্গস্পর্শও করিল না।
নলমন্তকে কর্কোটক দংশন
“এইরূপে মহারাজ নল সর্পরাজ কর্কোটিকে দাবদাহ হইতে উদ্ধার করিয়া পরিত্যাগ করিবার উদযোগ করিতেছেন, এমন সময়ে নাগরাজ তাহাকে কহিল, “হে নৈষধ! আপনি কতিপয় পদ গণনা করিয়া গমন করুন, তাহা হইলে আমি যৎপরোনাস্তি উপকার করিব।” নালরাজ নাগের নির্দেশানুসারে গণনাপূর্ব্বক পাদবিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। দশমপদ পরিপূর্ণ হইবামাত্র কর্কোটিক তাঁহাকে দংশন করিলে তৎক্ষণাৎ তাঁহার পূর্ব্বতন রূপ এককালে তিরোহিত হইল। মহারাজ নল তদর্শনে সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন।
ঋষিশাপমুক্ত কর্কোটকের স্বীয়লোকপ্ৰাপ্তি
“তখন নাগরাজ কর্কোটিক স্বীয় রূপধারণপূর্ব্বক নলকে সান্ত্বনা করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে মহারাজ! মানবগণ আপনাকে চিনিতে পরিবে না বলিয়াই আমি আপনার রূপ তিরোহিত করিয়াছি। হে রাজন! যে ক্রুর আপনাকে ঈদৃশ দুঃখ প্ৰদান করিতেছে, সেই দুরাত্মা আমার বিষ-প্রভাবে অতিকষ্টে আপনার শরীরে বাস করিবে। ঐ মন্দাত্মা যাবৎ আপনাকে পরিত্যাগ না করিবে, তাবৎকাল আমার তীক্ষ্ণবিষে জর্জ্জরিত হইতে থাকিবে। সেই পাপাত্মা ক্ৰোধ এবং অসূয়াপরবশ হইয়া নিরপরাধে আপনাকে সকল বিষয়ে বঞ্চিত করিয়াছে; কিন্তু আমি আপনাকে রক্ষা করিলাম। হে রাজন! আমার প্রসাদে দংষ্ট্রিগণ, শত্ৰুগণ বা ব্রহ্মবিদগণ হইতে আপনার কিছুমাত্র ভয় থাকিবে না, বিষনিমিত্তক ক্লেশও অনুভব হইবে না এবং আপনি সর্ব্বদা সংগ্রামে শক্ৰ-সকলকে পরাজয় করিতে পরিবেন। হে নিষধরাজ! আপনি এক্ষণে রমণীয় অযোধ্যানগরীতে ইক্ষাকুবংশপ্রভাব রাজা ঋতুপর্ণের নিকট গমন করুন। তিনি পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে কহিবেন, আমি সারথি, আমার নাম বাহুক। মহারাজ ঋতুপর্ণ দ্যূতক্রীড়ায় সাতিশয় সুনিপুণ; তিনি আপনার নিকট অশ্বচালন-বিদ্যা শিক্ষা করিয়া তাঁহার বিনিময়স্বরূপ স্বীয় অক্ষবিদ্যা আপনাকে প্রদানপূর্ব্বক আপনার পরম মিত্ৰ হইবেন। আপনি অক্ষবিদ্যায় সুনিপুণ হইলে শ্রেয়োলাভপূর্ব্বক ভাৰ্য্যা, পুত্র, কন্যা ও রাজ্য প্রভৃতি ঐশ্বৰ্য্যসকল পুনরায় প্রাপ্ত হইবেন, সন্দেহ নাই; শোক করিবেন না। আর যখন আপনার স্বীয় রূপ প্ৰাপ্ত হইবার ইচ্ছা হইবে, তখন আমাকে স্মরণ ও এই বসন পরিধান করিলেই আপনি স্বকীয় পূর্ব্বরূপ পুনর্ব্বার প্রাপ্ত হইবেন।”
“কর্কোটিক এই বলিয়া নলকে দিব্য বসনযুগল প্ৰদান ও প্রণয়সম্ভাষণপূর্ব্বক তাঁহার সমক্ষেই অন্তহিত হইল।”