সুখেতে থাকেন রাজা পুত্রের সহিত।
ঋতুরাজ বসন্ত হইল উপনীত।।
বসন্ত-কালেতে বন হইল শোভিত।
নানা বৃক্ষগণ সব হইল পুষ্পিত।।
পলাশ চম্পক আম্র অশোক কেশর।
পারিভদ্র কেতকী করবী পুষ্পবর।।
হৃদে আনন্দিত পাণ্ডু দেখিয়া কানন।
গহন নিকুঞ্জ বনে করেন ভ্রমণ।।
কুন্তীসহ পুত্রগণে রাখিয়া মন্দিরে।
মাদ্রীসহ ভ্রমে রাজা অরণ্য-ভিতরে।।
রাজার সহিত মাদ্রী, কুন্তী নাহি জানে।
গহন-কানন মধ্যে ভ্রমে দুই জনে।।
সঙ্গেতে যুবতী ভার্য্যা, বসন্ত-পবন।
বিমোহিত হইল যে তাহে প্রাণ মন।।
মদনের শরে হৈল অবশ রাজন।
সঘনে মাদ্রীর রূপ করে নিরীক্ষণ।।
বিকচ-কমল -সম সুচারু বদন।
শ্রবণে পরশে চারু পঙ্কজ-নয়ন।।
যুগল দাড়িম্ব সম দুই পয়োধর।
বিপুল নিতম্বভারে গমন মন্থর।।
কোমল মধুর ভাষে বরিষয়ে সুধা।
নিরখিয়া পাণ্ডুর জন্মিল কামক্ষুধা।।
মদনে অবশ রাজা হয়ে অচেতন।
হইলেন বিস্মৃত সে মুনির বচন।।
নিবৃত্ত হইতে নাহি পারিল রাজন।
তবে মাদ্রীর অঙ্গ করেন পরশন।।
নিবৃত্ত নিবৃত্ত ডাকে মদ্রের নন্দিনী।
অতি উচ্চৈঃস্বরে করে হাহাকার ধ্বনি।।
হাত পা আছাড়ে মাদ্রী ছটফট করে।
কটু ভাষে তবে মাদ্রী র্ভৎসে নৃপবরে।।
মৃগঋষি-শাপ প্রভু নাহিক স্মরণ।
ক্ষণেকে প্রমাদ হবে, না জান কারণ।।
তথাপি মদন-রসে হইয়া বিহ্বল।
পাণ্ডু নাহি শুনিল মাদ্রীর যত বোল।।
কালেতে যে করে তাহা কে খণ্ডিতে পারে।
পরম-পণ্ডিত বুদ্ধি কালেতে সংহারে।।
স্বরূপে জানহ তুমি এ সব বচন।
জানিয়া শুনিয়া কেন করিলে এমন।।
বিহার করিতে রাজা মাদ্রীর সহিত।
ঋষি-শাপে মৃত্যু আসি হৈল উপনীত।।
শরীর ত্যজেন রাজা দেখিল সুন্দরী।
ক্রন্দন করিছে মাদ্রী হাহাকার করি।।
পাণ্ডু না শুনিলা সতী মাদ্রীর বচন।
কাশী কহে, ব্রহ্মশাপ বড়ই ভীষণ।।
এখানে ভোজের কন্যা উচাটিত মন।
মাদ্রীর সহিত গেছে নাহিক রাজন।।
হইল অনেক বেলা, গেল কোথাকারে।
পুত্র সহ গেল কুন্তী দেখিতে রাজারে।।
কতদূর যাইতে শুনিল উচ্চধ্বনি।
হাহাকার শব্দে কান্দে মন্দ্রের নন্দিনী।।
শব্দ-অনুসারে যায় অতি শীঘ্রগতি।
দেখিল কান্দিছে মাদ্রী, কোলে নরপতি।।
বজ্রাঘাত মুণ্ডে যেন হৈল আচম্বিতে।
মূর্চ্ছিতা হইয়া কুন্তী পড়িল ভূমিতে।।
সঘনে নিশ্বাস ছাড়ে, উচাটন মন।
কান্দিয়া মাদ্রীর প্রতি বলিছে বচন।।
কি কর্ম্ম করিলা মদ্রকন্যে স্বামী বধি।
এই হেতু তোমারে ভোগাব নিরবধি।।
কেন একা এলে তুমি রাজার সংহতি।
কি হেতু নিবৃত্ত না করিলে নরপতি।।
যদি এই বনে সঙ্গে আনিতে নন্দন।
তবে কেন নৃপতির হইবে নিধন।।
হেন কর্ম্ম জানি তুমি করিলা কেমনে।
হারালে গুণের স্বামী মাতিয়া মদনে।।
মৃগ-ঋষি শাপ তোর না ছিল স্মরণে।
সকল ত্যজিয়া বনে বঞ্চ এ কারণে।।
অনিমিষে থাকি আমি রাজার রক্ষণে।
সঙ্গে আসিয়াছি তুমি জানিব কেমনে।।
আপনা খাইয়া মোর হেন হৈল গতি।
হারাইব কেন স্বামী থাকিলে সংহতি।।
বড়ই পাপিষ্ঠা তুই পতি-বিগাতিনী।
তোর জন্য হইলাম অমি অনাথিনী।।
মাদ্রী বলে, কুন্তী মোরে নিন্দ অকারণ।
বার বার তাঁরে দেবী করেছি বারণ।।
দৈবে যাহা করে তাহা খণ্ডে কোন্ জন।
না রাখি আমার বাক্য ঘটিল নিধন।।
কুন্তী বলে, ভাবী কর্ম্ম, না যায় খণ্ডন।
সম্প্রতি শুনহ তুমি আমার বচন।।
পঞ্চপুত্রে পালন করিহ ভাল মতে।
সহমৃতা হৈব আমি রাজার সহিতে।।
মাদ্রী বলে, হেন তুমি না বল আমারে।
তিলেক না জীব আমি না দেখি রাজারে।।
তোমার বিলম্বে এতক্ষণ আছে প্রাণ।
এখনি শরীর ত্যজি যাব প্রভু স্থান।।
আমা হেতু নৃপবর হারাইল জীবনে।
সেই হেতু আমি যাইব সহ-মরণে।।
তোমার নিকটে করি এক নিবেদন।
বিদায় তোমার কাছে মাগি যে এখন।।
পুনঃ পুনঃ তোমারে যে করি পরিহার।
যত্নেরে পালিবা দুটি কুমার আমার।।
ইহা বিনা আর কিছু না কহি তোমারে।
বিভেদ না ভেব দুটী আমার কুমারে।।
পিতৃ মাতৃ বিনা পুত্র সহজে অনাথ।
তুমি সর্ব্ববন্ধু জেন, তুমি মাতা তাত।।
এতেক বলিয়া মাদ্রী নিঃশব্দ হইল।
নিবিড় করিয়া শবে আলিঙ্গন দিল।।
আলিঙ্গন করি মাদ্রী ত্যজিল পরাণ।
শুনি শতশৃঙ্গ-বাসী এল সেই স্থান।।
ঋষিগণ মিলিয়া করিল এ বিচার।
পুত্র সহ ছিল পাণ্ডু আশ্রমে আমার।।
এখন শরীর ত্যাগ করিল রাজন।
অনাথ হইল কুন্তী, শিশু পঞ্চজন।।
রাজ-পুত্রগণে স্থিতি না শোভে কাননে।
দেশেতে লইয়া রাখ পাণ্ডু-পুত্রগণে।।
তবে সবাকার ধর্ম্ম থাকে, হেন বাসি।
বিচার করিল এই শতশৃঙ্গ-বাসী।।
মৃত শব কান্ধে করি লয় চরগণ।
পুত্র সহ কুন্তী লয়ে গেল ঋষিগণ।।
অল্প দিনে গেল কুন্তী হস্তিনা-নগর।
প্রবেশ করিল সবে নগর-ভিতর।।
রাজ-অন্তঃপুরেতে হইল সমাচার।
কুন্তী সহ এল পঞ্চ পাণ্ডুর কুমার।।
ভীষ্ম সোমদত্ত আর বাহ্লীক বিদুর।
ধৃতরাষ্ট্র-আদি যত বৈসে অন্তঃপুর।।
সত্যবতীসহ বধূ গান্ধারী সুন্দরী।
গৃহেতে বৈসেন আর যত বৃদ্ধা নারী।।
ঋষিগণে প্রণমিয়া দিলেন আসন।
কহিতে লাগিল বার্ত্তা সব ঋষিগণ।।
শতশৃঙ্গ-পর্ব্বতে ছিলেন পাণ্ডুরাজ।
ব্রহ্মচর্য্য করিতেন ঋষির সমাজ।।
দেব-বরে পঞ্চ পুত্র হইল তাঁহার।
কালেতে তাঁহারে কালে করিল সংহার।।
মদ্রকন্যা অতি ধন্যা ভুবনে মানিতা।
হইলেন সহমৃতা পাণ্ডুর বনিতা।।
এই কুন্তী সহ দেখ পুত্র পঞ্চজন।
পাণ্ডু-মাদ্রী-শব এনেছি করি বহন।।
যে মত বিচার হয় করহ বিধান।
এত বলি মুনিগণ করিল প্রস্থান।।
এত শুনি রোদন করেন সর্ব্বজন।
হাহাকার শব্দ মুখে, কাতর বচন।।
কান্দে সত্যবতী কান্দে অম্বিকা জননী।
শ্রীভীষ্ম বিদুর কান্দে, অন্ধ নৃপমণি।।
নগরের লোক করে বিলাপ ক্রন্দন।
বালবৃদ্ধ তরুণী কান্দয়ে সর্ব্বজন।।
ক্রন্দনের শব্দ উঠে গগন-উপরে।
মহা-কোলাহল হৈল হস্তিনা-নগরে।।
তবে ধৃতরাষ্ট্র বলে বিদুরে ডাকিয়া।
দুই শব দগ্ধ কর গঙ্গাতীরে লৈয়া।।
রাজ বিধান যেমন আছে পূর্ব্বাপর।
শুনিয়া বিদুর তবে হইল সত্বর।।
দুই শব কান্ধে করি লয়ে ক্ষত্রগণে।
চতুর্দ্দোল বিভূষিত বিবিধ বিধানে।।
উপরে ধরিল ছত্র যে রাজনীত।
শত শত চামর ঢুলায় চারিভিত।।
অগুরু চন্দনকাষ্ঠ আনিল বিস্তর।
কলসী কলসী ঘৃত আনে ভারে-ভার।।
মন্ত্র পড়ি দ্বিজগণ পাবক জ্বালিয়া।
অগ্নিহোত্রে রাজার করিল দাহক্রিয়া।।
পঞ্চ ভাই দিলা পিণ্ড ক্ষত্রিয়-বিধান।
এয়োদশ দিনে করে শ্রাদ্ধ শান্তি দান।।
স্বর্ণদান ভূমিদান করে গবীদান।
কাঞ্চন-রজত-দান বিবিধ-বিধান।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।