৬৫তম অধ্যায়
ধৃতরাষ্ট্রের সবিলাপ যুদ্ধপ্রশ্ন
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! দেবদুষ্করকর্ম্মা [দেবগণেরও দুঃসাধ্য কর্ম্মসাধনক্ষম] পাণ্ডবদিগের কাৰ্য্য শ্রবণগোচর করিয়া আমার অন্তঃকরণে মহাভয় ও বিস্ময় উৎপন্ন হইয়াছে এবং পুত্ৰগণের পরাভব সংবাদ শ্রবণ করিয়া কিরূপ অবস্থা হইবে, এই বলবতী চিন্তা আমার হৃদয়ে নিরন্তর জাগরকে রহিয়াছে। মহাত্মা বিদুরের বাক্য স্মরণ করিয়া আমার হৃদয় দগ্ধপ্ৰায় হইতেছে; তিনি যেরূপ কহিয়াছিলেন, এক্ষণে দৈবযোগে তৎসমুদয়ই সেইরূপ দৃষ্ট হইতেছে। পাণ্ডুতনয়েরা সৈন্যসমভিব্যাহারে ভীষ্মপ্রভৃতি মহাবলপরাক্রান্ত প্রহরণধারী [অস্ত্রশস্ত্ৰধারী] বীরপুরুষের সহিত যুদ্ধ করিয়া নভোমণ্ডলে তারাগণের ন্যায় অক্ষয় হইয়া রহিয়াছে। জানি না, তাহারা কিরূপ তপস্যা করিয়াছে এবং কিরূপ বর ও কি প্রকার জ্ঞানলাভ করিয়াছে; পাণ্ডবেরা যে বারংবার আমাদের সৈন্য সংহার করিতেছে, আমি তাহা কোনক্রমেই সহ্য করিতে পারিতেছি না। পাণ্ডবেরা যেরূপ বাধার্হ [মরণশীল], আমার পুত্রেরাও সেইরূপ; কিন্তু দৈববশতঃ আমাতেই সেই নিদারুণ দণ্ড নিপতিত হইতেছে। হে সঞ্জয়! তুমি এই বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত বর্ণন কর। যেমন মনুষ্য ভুজবলে সন্তরণ করিয়া মহাসাগরের পার প্রাপ্ত হয় না, তদ্রূপ আমি এই দুঃখের সীমা অবলোকন করিতেছি না। এক্ষণে বোধ হইতেছে, পুত্ৰগণের অতি দারুণ বিপদ উপস্থিত হইয়াছে; মহাবীর ভীম তাহাদিগকে নিঃসন্দেহে বিনাশ করিবে; এক্ষণে আমার পুত্ৰগণকে রক্ষা করে, এমন কাহাকেও নিরীক্ষণ করিতেছি না। তাহারা নিশ্চয়ই রণস্থলে বিনাশপ্ৰাপ্ত হইবে; অতএব তুমি ইহার উপযুক্ত কারণ কীৰ্তন কর। দুৰ্য্যোধন স্বপক্ষদিগকে রণপরাঙ্মুখ নিরীক্ষণ করিয়া যেরূপ অনুষ্ঠান করিয়াছিল এবং ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, সুবলনন্দন শকুনি, জয়দ্ৰথ, অশ্বত্থামা ও বিকৰ্ণ আমার পুত্ৰগণ সমরপরাঙ্মুখ হইলে কিরূপ কর্ত্তব্যাবধারণ করিলেন, তাহাও আনুপূর্বিক বর্ণন কর।”
পাণ্ডববদিগের জয়কারণকথন
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আমি যাহা কহিতেছি, আপনি অবহিত হইয়া শ্রবণ করুন। পাণ্ডবগণ কোন মন্ত্রকৃত [অভিচার] বিষয়ের অনুষ্ঠান, মায়াজাল বিস্তার বা বিভীষিকা প্রদর্শন করিতেছেন না। তাঁহারা পরাক্রম প্রকাশ্যপূর্ব্বক ন্যায়ানুসারে যুদ্ধ করিতেছেন এবং যশোবাসনাপরবশ [একান্ত যশোলিপ্সু] হইয়া জীবিকা প্রভৃতি সমস্ত কাৰ্য্যেও ধর্ম্মানুসারে হস্তক্ষেপ করিয়া থাকেন। ধর্ম্মপরায়ণ শ্ৰীসম্পন্ন মহাবল পাণ্ডবগণ সমর হইতে নিবৃত্ত হইবেন না। হে রাজন! যে স্থানে ধর্ম্ম, সেই স্থানেই জয়; অতএব কেহই তাঁহাদিগকে বধ [অনিবাৰ্য্য মৃত্যু] করিতে পরিবে না, প্রত্যুত তাঁহারাই জয়যুক্ত হইবেন। আপনার পুত্রেরা সতত পাপকর্ম্মনিরত, দুরাত্মা, নিষ্ঠুর ও নীচকর্মী; এই নিমিত্তই তাঁহারা যুদ্ধে জয়লাভ করিতে সমর্থ হইতেছেন না। আপনার পুত্রেরা নিতান্ত নীচের ন্যায় বারংবার পাণ্ডবগণকে পরাভব ও তাঁহাদিগের প্রতি ক্রুরাচরণ করিয়াছেন, পাণ্ডবেরা আপনার পুত্ৰগণের সেইসকল পাপানুষ্ঠানবিষয়ে অনাদর প্রদর্শনপূর্ব্বক সহ্য করিয়াছিলেন; তথাচ আপনার পুত্রেরা তাঁহাদিগকে সমুচিত সমাদর করেন নাই। হে মহারাজ! সেই সতত অনুষ্ঠিত পাপের মহাকালফল সদৃশ ভয়ানক ফল সমুপস্থিত হইয়াছে। এক্ষণে আপনি পুত্র ও বান্ধবগণের সহিত উহা ভোগ করুন। বিদুর, ভীষ্ম ও মহাত্মা দ্রোণপ্ৰভৃতি বান্ধবগণ এবং আমি—আমরা আপনাকে বারংবার নিবারণ করিয়াছি, তথাপি মন্দ ব্যক্তি যেমন হিতকর ঔষধ অগ্রাহ্য করে, তদ্রূপ আপনি আমাদিগের হিতকর বাক্য হৃদয়ঙ্গম করিতেছেন না, প্রত্যুত আপনি পুত্ৰগণের তন্দানুবর্ত্তী হইয়া পাণ্ডবদিগকে জিতপ্ৰায় [প্ৰায় পরাজিত] বিবেচনা করিতেছেন।
“হে মহারাজ! পাণ্ডবগণ যে কারণে জয়লাভ করিয়া থাকেন, তাহা কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। একদিন মহারাজ দুৰ্য্যোধন মহারথ ভ্রাতৃগণকে রণস্থলে পরাজিত দেখিয়া নিশাকালে শোকাকুলিতমানে পিতামহসন্নিধানে গমন করিয়া বিনীতভাবে কহিলেন, “হে পিতামহ! আপনি, দ্রোণ, শল্য, কৃপ, অশ্বত্থামা, কৃতবর্ম্মা, হার্দ্দিক, সুদক্ষিণ, ভূরিশ্রবা, বিকর্ণ, ভগদত্ত এবং অন্যান্য সুবিখ্যাত জীবিতনিরপেক্ষ কুলতনয়েরা ত্ৰিলোকসংহার করিতে সমর্থ হইয়াও কি নিমিত্ত পাণ্ডবগণের বলবীৰ্য্য সহ্য করিতে পারিতেছেন না, এই বিষয়ে আমার সাতিশয় সংশয় জন্মিয়াছে এবং পাণ্ডবগণ কাহাকে আশ্রয় করিয়া পদে পদে আমাদিগকে পরাজিত করিতেছে, এইসকল বিষয় কীর্ত্তন করুন।”
“ভীষ্ম কহিলেন, “হে মহারাজ! আমি তোমাকে বারংবার বলিয়াছি, তথাপি তুমি তাহা কর নাই; কিন্তু এক্ষণে পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধিস্থাপন করা উচিত হইতেছে। তাহা হইলেই তোমার ও পৃথিবীর মঙ্গললাভ হইবে এবং তুমিও সুহৃদগণকে পরিতৃপ্ত ও বন্ধু দিগকে আনন্দিত করিয়া ভ্রাতৃবৰ্গসমভিব্যাহারে পরমসুখে পৃথিবী ভোগ করিতে পরিবে। আমি পূর্ব্বে তোমাকে নির্ব্বন্ধাতিশয়সহকারে যাহা কহিয়াছিলাম, তুমি তাহা শ্রবণ না করিয়া পাণ্ডবগণের অবমাননা করিয়াছ, এক্ষণে তাহারই প্রতিফল সমুপস্থিত হইয়াছে। আর তাহারা কি নিমিত্ত অবধ্য হইয়াছে, তাহাও কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। ভগবান বাসুদেব সতত পাণ্ডবগণের রক্ষণাবেক্ষণ করিয়া থাকেন; সুতরাং তাহাদিগকে পরাজয় করে, এমন লোক ত্ৰিলোকমধ্যে নয়নগোচর হয় না, হইবে না ও হয় নাই। মহর্ষিগণ আমার নিকট একটি পুরাতন ইতিহাস কীর্ত্তন করিয়াছেন, এক্ষণে তুমি তাহা শ্রবণ কর।
পাণ্ডবসহায় কৃষ্ণের বিভূতিবর্ণন
“ ‘পূর্ব্বকালে মহর্ষি ও সুরগণ সমবেত হইয়া গন্ধমাদনপর্ব্বতে পিতামহ ব্ৰহ্মার নিকট সমুপস্থিত হইলেন। প্রজাপতি ব্ৰহ্মা তাঁহাদিগের মধ্যে পরমসুখে উপবেশন করিয়া নভোমণ্ডলে অতি ভাস্বর রমণীয় এক বিমান নিরীক্ষণ করিলেন এবং ধ্যানদ্বারা সমস্ত বিদিত হইয়া হৃষ্টমনে কৃতাঞ্জলিপুটে পরমপুরুষ পরমেশ্বরকে নমস্কার করিলে মহর্ষি এবং সুরগণও গগনমণ্ডলে সমুত্থিত বিমান অবলোকন করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে দণ্ডায়মান হইয়া সেই অদ্ভুত ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিতে লাগিলেন। অনন্তর ভগবান ব্ৰহ্মা ত্ৰিলোকীনাথ বিষ্ণুকে বিধানানুসারে অৰ্চনা করিয়া স্তব করিলেন—হে বাসুদেব! তুমি বিশ্বাবসু, বিশ্বেশ্বর, বিশ্বমূর্ত্তি ও বিশ্বকসেন; আমি তোমাকে পরমদেবতা বলিয়া স্বীকার করি। হে মহাদেব! তুমি বিশ্ব, তুমি লোকের হিতানুষ্ঠানে নিরত, তুমি যোগেশ্বর, তুমি সকলের প্রভু, তুমি যোগপরায়ণ; হে অনঘ! হে পদ্মনাভ! হে বিশ্বলোচন! তুমি ঈশ্বরের ঈশ্বর, তুমি ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমানের প্রভু; হে প্রিয়দর্শন! তুমি আত্মজের আত্মজ, তুমি অসংখ্য গুণের আধার, তুমি লোকসকলের পরমগতি। হে নারায়ণ! হে শার্ঙ্গাধর! তোমার মহিমার পরিসীমা নাই, তুমি নিরাময়, তুমি লোকের কাৰ্য্যসাধনে তৎপর, তুমি মহোরগ ও মহাবরাহের আদি; হে পিঙ্গলকেশ! হে পীতাম্বর! তুমি দিকসকলের ঈশ্বর, তুমি বিশ্বনিকেতন [বিশ্বের আধার], তুমি অমিত ও অব্যয়, তুমি ব্যক্ত ও অব্যক্ত, তুমি সর্ব্বব্যাপী, তুমি জিতেন্দ্ৰিয়, তুমি অসংখ্যেয় [অসীম], তুমি আত্মভাবজ্ঞ, তুমি গভীর, তুমি কামদ, তুমি সতত সৎকাৰ্য্যেরই অনুষ্ঠান করিয়া থাক; হে অনন্ত! তুমি ব্ৰহ্মবিৎ, তুমি ভূতভাবন [প্ৰাণীপ্রসবকর্ত্তা], তুমি কৃতকর্ম্মা [সত্যসঙ্কল্প], তুমি প্রজ্ঞাবান, ধর্ম্মজ্ঞ, তুমি বিজয়, তুমি গূঢ়াত্মা [দুর্জ্ঞেয়], তুমি সর্ব্বযোগাত্মা; হে লোকেশ! তুমি জগতের কারণ, তুমি সকলভূতস্বরূপ, তুমি আত্মতত্ত্ব [আপনি আপনার বিদিত], তুমি স্বয়ম্ভু [স্বপ্ৰকাশ]; হে মহাভাগ! তুমি প্রলয়কর্ত্তা, উৎপত্তির কারণ, মনোভাব ও ব্রাহ্মণের প্রিয়, তুমি সৃষ্টিসংহারনিরত; হে কালেশ [কালনিয়ন্তা-মহাবল]! তুমি অমৃতসদ্ভুত, তুমি সৎস্বভাবসম্পন্ন, তুমি সর্ব্বদাতা, তুমি জয়যুক্ত হও। ভগবতী বসুন্ধরা তোমার চরণদ্বয়, দিকসমুদয় বাহু, গগনমণ্ডল মস্তক, আমি [ব্ৰহ্মা] মূর্ত্তি, দেবগণ দেহ, চন্দ্ৰসূৰ্য্য চক্ষু; তপ, সত্য, বল, ধর্ম্মকর্ম্ম আত্মজ, অগ্নি তেজ এবং সমীরণ নিশ্বাস। সলিলরাশি তোমার স্বেদ হইতে সম্ভূত হইয়াছে; অশ্বিনীকুমারদ্বয় তোমার শ্রবণযুগল, দেবী সরস্বতী জিহ্বা এবং বেদসকল তোমারই সংস্কারনিষ্ঠ। তুমি জগতের আশ্রয়, তোমার কি পরিমাণ, কি তেজ, কি পরাক্রম, কি বল, কিছুরই ইয়ত্তা নাই; আমরা তোমার জন্ম অবগত নহি, আমরা তোমার প্রতি ভক্তিপরায়ণ হইয়া নিয়ম দ্বারা তোমাকে আশ্রয় করিয়া রহিয়াছি। তুমি পরমেশ্বর ও মহেশ্বর। আমরা তোমাকে সতত অৰ্চনা করি। আমি তোমারই প্রসাদে দেবতা, ঋষি, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, রাক্ষস, পন্নগ, পিশাচ, মনুষ্য, মৃগ, পক্ষী ও সরীসৃপপ্রভৃতি সমস্ত জীবজন্তু সৃষ্টি করিয়াছি। তুমি দুঃখের অবসান করিয়া থাক, তুমি সর্ব্বভূতের গতি, তুমি সকলের নেতা এবং তুমিই জগতের আদি, দেবগণ তোমারই অনুগ্রহে সতত সুখে অবস্থান করিতেছেন। তোমারই অনুগ্রহে পৃথিবী নিৰ্ভয় হইয়াছে। এক্ষণে তুমি ধর্ম্মসংস্থাপন, দানবদলন ও পৃথিবীধারণের নিমিত্ত যদুবংশে অবতীর্ণ হও। হে বিভো! আমি যাহা নিবেদন করিলাম, তাহার অনুষ্ঠান কর; আমি তোমারই অনুগ্রহে পরম গুহ্যবিষয়সমুদয় কীর্ত্তন করিয়াছি, তুমিই আত্মার সাক্ষী, তুমি আত্মস্বরূপ সঙ্কর্ষণ, আত্মজস্বরূপ প্ৰদ্যুম্ন হইতে অনিরুদ্ধকে সৃষ্টি করিয়াছ; সকলে এই অনিরুদ্ধকে অব্যয় বিষ্ণুস্বরূপ বলিয়া অবগত আছেন; এই অনিরুদ্ধই আমাকে লোকধারী ব্ৰহ্মারূপে সৃষ্টি করিয়াছেন; অতএব আমিও তোমার বিনির্ম্মিত বাসুদেবস্বরূপ; এক্ষণে তুমি আপনাকে ঐ রূপ ভাগে বিভক্ত করিয়া মানুষকলেবর পরিগ্রহ কর। তুমি মনুষ্যলোকে সকলের সুখ সম্পাদনার্থ অসুর বধ, ধর্ম্ম ও যশোলাভ করিয়া পুনরায় স্বস্থানে গমন করিবে। হে অমিতবিক্রম! দেবতা ও ব্রহ্মর্সিগণ পৃথক পৃথক হইয়া তোমার সেই সকল নাম দ্বারা তোমাকেই পরমাদ্ভুত বলিয়া গান করিয়া থাকেন। ভূত সকল তোমাতে অবস্থান করিতেছেন; ব্রাহ্মণগণ তোমার আশ্রয় লাভ করিয়া তোমাকেই অনাদি, অমধ্য, অনন্ত, অসীম ও সংসারের সেতু বলিয়া কীর্ত্তন করিয়া থাকেন।