এত শুনি জিজ্ঞাসিল ধর্ম্মের নন্দন।
কহ শুনি মুনি সিন্ধু পূরণ কথন।।
কে বা ভগীরথ, জ্ঞাতি কারণ কি হয়।
বিস্তারিয়া মুনিরাজ কহ মহাশয়।।
লোমশ বলেন, শুন ধার্ম্মিক রাজন।
সগর নামেতে রাজা বাহুর নন্দন।।
তালজঙ্ঘ হৈহয়াদি রাজা বশ করি।
পৃথিবী পালন করে দুষ্টজনে মারি।।
পুত্র বাঞ্ছা করি রাজা হইল চিন্তিত।
তপস্যা করিতে গেল ভার্য্যার সহিত।।
শৈব্যা আর বৈদর্ভী যুগল ভার্য্যা তাঁর।
কৈলাস পর্ব্বতে তপ করে বহুবার।।
তাঁর তপে আর্বিভূত হয়ে মহেশ্বর।
বলিলেন সগরেরে, মাগি লহ বর।।
বংশ হেতু এই বর মাগিল রাজন।
দেহ ষাটি সহস্র তনয় ত্রিলোচন।।
হর বলিলেন, বর মাগিলে রাজন।
হইবে তোমার ষাটি সহস্র নন্দন।।
সময়ে সবাই এককালে হবে ক্ষয়।
বংশ রক্ষা করিবেক একই তনয়।।
শৈব্যার উদরে যেই এক পুত্র হবে।
তাহাতে ইক্ষ্বাকু বংশ উন্নতি পাইবে।।
এত বলি অন্তর্দ্ধান হইলেন হর।
সগর চলিয়া গেল আপনার ঘর।।
মিথ্যা না হয় কভু শঙ্করের বরদান।
কতদিনে দোঁহাকার হৈল গর্ভাধান।।
সময়ে প্রসব কৈল রাণী দুই জন।
শৈব্যা প্রসবিল এক সুন্দর নন্দন।।
বৈদর্ভীর গর্ভে এক অলাবু জন্মিল।
দেখিয়া নৃপতি ফেলাইতে আজ্ঞা দিল।।
হেনকালে ঘোরনাদে হৈল শূন্যবাণী।
কি কারণে বংশ ত্যাগ কর নৃপিমণি।।
যত বীচি আছে এই অলাবু ভিতর।
ঘৃতপূর্ণ হাঁড়ি মধ্যে রাখ নৃপবর।।
ইহাতে পাইবে ষাটি সহস্র নন্দন।
এই শুনি নরপতি রাখে সেইক্ষণ।।
ঘৃত হাঁড়ি প্রতি এক ধাত্রী নিয়োজিল।
ষাইট সহস্র পুত্র তাহাতে জন্মিল।।
তেজে বীর্য্যে রূপে সবে সগর সমান।
মদগর্ব্বে সবাকারে করে অল্প জ্ঞান।।
দেবতা গন্ধর্ব্ব যক্ষ নাগ নরগণ।
সবার করিল পীড়া সগর নন্দন।।
দেবগণ জানাইল ব্রহ্মার গোচরে।
সৃষ্টিনাশ কৈল প্রভু সগর-কুমারে।।
ব্রহ্মা বলিলেন, না চিন্তিহ দেবগণে।
কর্ম্মদোষে সকলে মরিবে অল্পদিনে।।
এত শুনি চলি গেল যতেক অমর।
কত দিনে যজ্ঞদীক্ষা লইল সগর।।
অশ্বমেধ আরম্ভিল বাহুর নন্দন।
অশ্ব রক্ষিবারে নিয়োজিল পুত্রগণ।।
সসৈন্যে তাহারা ষাটি সহস্র নন্দন।
ঘোড়া রক্ষিবারে গেল পর্ব্বত কানন।।
জলহীন সিন্ধুমধ্যে করয়ে ভ্রমণ।
ঘোড়ার রক্ষণে তবে থাকে সর্ব্বজন।।
দেবরাজ ভাবে, বুঝি মম রাজ্য যায়।
শত যজ্ঞ সাঙ্গ হৈলে কি হবে উপায়।।
যজ্ঞ বিঘ্ন না করিলে রাজা ইন্দ্র হয়।
মন্ত্রণা করিল ইন্দ্র চরি করি হয়।।
স্বপদ রাখিতে ইন্দ্র করিল চাতুরী।
আপনি আসিয়া শেষে অশ্ব করে চুরি।।
চুরি করি নিয়া ঘোড়া রাখে পাতালেতে।
যেখানে কপিল মুনি ছিলেন যোগেতে।।
যেখানে রাখিয়া ঘোড়া শত্রু পলাইল।
প্রাতঃকালে সেনাগণ জাগিয়া উঠিল।।
সিন্ধুমধ্যে ঘোড়া নাহি দেখি আচম্বিতে।
কেহ না জানিল ঘোড়া গেল কোন্ ভিতে।।
সমকে সমুদ্রে ঘোড়া করে অম্বেষণ।
নদ নদী গিরি গুহা নগর কানন।।
কোথা না দেখিয়া অশ্ব চিন্তিত হইয়া।
সগরের স্থানে সবে জানাইল গিয়া।।
শুনি রাজা দৈববশে করিল উত্তর।
ঘোড়া না আনিয়া কেন আইলি রে ঘর।।
খুঁজিয়া না পাও যদি পৃথিবী ভিতর।
তবে সিন্ধুমধ্যে ঘোড়া হইল অন্তর।।
যত্ন করি সেই স্থল খুঁজ গিয়া সবে।
ঘোড়া না আনিয়া গৃহে ফিরি না আসিবে।।
পিতৃ আজ্ঞা পাইয়া চলিল সর্ব্বজন।
কোদালি ধরিয়া পৃথ্বী করিল খনন।।
জলহীন জন্তুগণ মৃত্তিকাতে ছিল।
কোদালির প্রহারেতে অনেকে মরিল।।
স্কন্ধ শির হস্ত কার কাটা গেল পাদ।
প্রহারে সকল জন্তু করে ঘোর নাদ।।
পর্ব্বত প্রমাণ যত জন্তুগণ মৈল।
পুঞ্জ করি অস্থি সব স্থানে স্থানে থুইল।।
এইমত বারিনিধি খনিতে খনিতে।
অশ্ব অন্বেষণে গেল পৃথ্বী পূর্ব্বভিতে।।
তথায় খনিয়া ক্ষিতি বিদার করিল।
পাতালপুরেতে গিয়া সবে প্রবেশিল।।
তথা গিয়া দেখিল কপিল মহামুনি।
দীপ্তিমান তেজ যেন জ্বলন্ত আগুণি।।
তাঁহার আশ্রমেতে দেখিয়া হয়বর।
হৃষ্ট হয়ে ঘোড়া গিয়া ধরিল সত্বর।।
অহঙ্কারে মুনিবরে করে অনাদর।
দেখিয়া কপিল মুনি কুপিল অন্তর।।
বাহিরায় দুই চক্ষু হইতে অনল।
ভস্মরাশি করিলেক কুমার সকল।।
নারদের মুখে বার্ত্তা পাইল সগর।
শোকাকুল হয় রাজা বিরস অন্তর।।
স্তব্ধ হয়ে শোকাকুল চিন্তে নরপতি।
শিববাক্যে স্মরি শেষে স্থির করে মতি।।
অংশুমান পৌত্র অসমঞ্জের নন্দন।
তাহারে ডাকিয়া রাজা বলেন বচন।।
কপিলের ক্রোধে ভস্ম হৈল পুত্রগণে।
যজ্ঞ নষ্ট হইবেক অশ্বের বিহনে।।
পূর্ব্বে ত্যাগ করিয়াছি তোমার পিতায়।
তোমা বিনা অন্য নাহি যজ্ঞের উপায়।।
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসিল, কহ মুনিবর।
কি হেতু অত্যাজ্য পুত্রে ত্যজিল সগর।।
মুনি বলে, অসমঞ্জ শৈব্যাগর্ভে জন্ম।
যৌবন সময়ে বড় করিল কুকর্ম্ম।।
দুগ্ধমুখ শিশুগণ ধরি হস্তে গলে।
উপরে তুলিয়া ভূমে আছাড়িয়া ফেলে।।
একত্র হইয়া তবে যত প্রজাগণ।
সগর রাজার প্রতি কৈল নিবেদন।।
তাতরূপে আমা সবে করহ পালন।
দুষ্ট দৈত্য পরচক্রে করহ তারণ।।
অসমঞ্জ ভয় হৈতে কর রাজা পার।
প্রজাদুঃখ শুনি দুঃখ হইল রাজার।।
ক্রুদ্ধ হয়ে আজ্ঞা দিল যত মন্ত্রীগণে।
অসমঞ্জে বাহির করহ এইক্ষণে।।
এইমতে নিজপুত্রে ত্যজিল সগর।
পৌত্রে যে কহিল রাজা, শুন নরবর।।
তোমা বিনা কুলত্রাণ কেহ নাহি আর।
যজ্ঞবিঘ্ন নরক হইতে কর পার।।
পিতামহ বচন শুনিয়া অংশুমান।
যথায় কপিল মুনি, গেল তাঁর স্থান।।
প্রণাম করিয়া বহু করিল স্তবন।
তুষ্ট হয়ে বলে, ইষ্ট মাগহ রাজন।।
এত শুনি অংশুমান বলে যোড়করে।
কৃপা যদি কর প্রভু, দেহ অশ্ববরে।।
দ্বিতীয়ে মাগিল পিতৃগণের সদগতি।
বাঞ্ছাপূর্ণ হৌক বলি বলে মহামতি।।
সত্যশীল ক্ষমাশীল ধর্ম্মে তব জ্ঞান।
তব পিতা হইতে সগর পুত্রবান।।
মম ক্রোধে দগ্ধ যত সগর কুমার।
তব পৌত্র করিবেক সবার উদ্ধার।।
শিবে তুষ্ট করিয়ে আনিবে সুরধুনী।
যজ্ঞ সাঙ্গ কর অশ্ব লইয়া এখনি।।
মুনিলে প্রণাম করি লয়ে অশ্ববর।
অংশুমান দিল পিতামহের গোচর।।
আলিঙ্গন দিয়া বহু করিল সম্মান।
অশ্বমেধ যজ্ঞ তবে কৈল সমাধান।।
পৌত্রে রাজ্য দিয়া শেষে গেল তপোবন।
অংশুমান শাসিলেক সকল ভুবন।।
হইল দিলীপ নামে তাঁহার নন্দন।
দেখি আনন্দিত বড় হইল বাহির।।
দিলীপ পাইল নিজ পিতৃ-সিংহাসন।
শুনিল কপিল কোপে দগ্ধ পিতৃগণ।।
গঙ্গাহেতু তপষ্যা করিল বহুকাল।
তথাপি আনিতে গঙ্গা নারিল ভূপাল।।
তাঁহার নন্দন মহারথ ভগীরথ।
যাঁর যশঃ কর্পূরে পূরিল ত্রিজগৎ।।
কপিলের কোপানলে দগ্ধ পিতৃগণ।
লোক মুখে শুনি কথা চিন্তিত রাজন।।
মন্ত্রীরে করিয়া রাজা রাজ্য সমর্পণ।
গঙ্গার উদ্দেশে গেল দিলীপ নন্দন।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।