একদিন পাণ্ডু-নৃপে একান্তে দেখিয়া।
বলিতে লাগিল মাদ্রী নিকটেতে গিয়া।।
কুরুবংশে তিন বধূ যে আছে সম্প্রতি।
ইতি মধ্যে দুই জন হৈল পুত্রবতী।।
শুনিলাম গান্ধারীর শতেক নন্দন।
প্রত্যক্ষে কুন্তীর পুত্র দেখি তিন জন।।
অভাগিনী আমি ইথে হইনু বঞ্চিত।
তোমায় কি কব, মম কর্ম্মের লিখিত।।
দয়া করি কুন্তী যদি অনুগ্রহ করে।
মন্ত্রবলে জপি পুত্র লব দেব-বরে।।
সহজে সতিনী কুন্তী, কি বলিতে পারি।
দেয় বা না দেয় আমি চিত্তে ভয় করি।।
আপনি বলহ যদি কুন্তীরে এ কথা।
তোমায় বচন নাহি করিবে অন্যথা।।
মাদ্রীর বচন শুনি বলে নরবর।
মম চিত্তে এই কথা জাগে নিরন্তর।।
স্বামী-বাক্য কভু সেই না করে হেলন।
অবশ্য করিবে মম আদেশ পালন।।
তোমারে প্রকাশ আমি তেঁই নাহি করি।
শুন কি না শুন তুমি, হও ধর্ম্মনারী।।
আপনি এখন তুমি কহিলা আমারে।
তোমার কারণে আমি কহিব কুন্তীরে।।
মম বাক্য কুন্তী কভু না করিবে আন।
মাদ্রীরে কহিয়া রাজা যান কুন্তী-স্থান।।
কুন্তীরে একাত্নে পেয়ে কহেন নৃপতি।
কুলের কল্যাণ হেতু কহি, শুন সতি।।
ইন্দ্রত্ব পাইয়া ইন্দ্র নিত্য যজ্ঞ করে।
যশের কারণে আর শাস্ত্র-অনুসারে।।
বেদে তপে পারগ হইয়া দ্বিজগণ।
তথাপিহ করে তাঁরা গুরুর সেবন।।
সতী পতিব্রতা যেই অতি সুচরিত।
তাহার যতেক ধর্ম্ম জনিহ নিশ্চিত।।
সেই হেতু কুন্তী, আমি কহি যে তোমারে।
মাদ্রীরে উদ্ধার কর এ ভব-সংসারে।।
মাদ্রীর বংশের হেতু করহ উপায়।
তার পুত্র হৈলে হবে এ পুত্রের সহায়।।
এতেক শুনিয়া কুন্তী কহিল রাজায়।
একবার দিব মন্ত্র তোমার আজ্ঞায়।।
মাদ্রীরে ডাকিয়া তবে কুন্তী পাণ্ডুপ্রিয়া।
মন্ত্র বলি দিল তারে প্রসন্ন হইয়া।।
একবার দিব রাণী বলেন বচন।
চিন্তিত হইয়া মাদ্রী ভাবে মনে মন।।
একবার বিনা কুন্তী না দিবেক আর।
কি উপায়ে হবে তবে অধিক কুমার।।
হৃদয়ে ভাবিয়া মাদ্রী যুক্তি কৈল সার।
দেব মধ্যে যুগ্ম হয় অশ্বিনী-কুমার।।
অশ্বিনী-কুমারদ্বয়ে করিল স্মরণ।
মন্ত্রের প্রভাবে দোঁহে এল এতক্ষণ।।
তাঁদের ঔরসে গর্ভ হইল সঞ্চার।
প্রসবিল মাদ্রী দেবী যুগল কুমার।।
জন্মমাত্র শুনি শব্দ আকাশ উপরে।
রূপে গুণে শোভা দোঁহে করিবে সংসারে।।
হেনমতে ক্রমে পঞ্চ নন্দন হইল।
পর্ব্বত-নিবাসী ঋষি আসি নাম দিল।।
জ্যেষ্ঠ হেতু নাম তার হৈল যুধিষ্ঠির।
ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি সেই হৈল ভীমবীর।।
তৃতীয় অর্জ্জুন নাম রাখে ঋষিগণ।
চতুর্থ নকুল নাম মাদ্রীর নন্দন।।
সহদেব নাম রাখে পঞ্চম কুমার।
দিনে দিনে বাড়ে যেন দেব-অবতার।।
সিংহগ্রীব সিংহচক্ষু, কটি সিংহ সম।
মহা-বীর্য্যবন্ত পঞ্চ সিংহের বিক্রম।।
পঞ্চ পুত্র নৃপতির দেখিতে সুন্দর।
উজ্জ্বল করিল শতশৃঙ্গ গিরিবর।।
পুত্র নিরখিয়া রাজা হরিষ অপার।
হরষিত কুন্তী মাদ্রী দেখিয়া কুমার।।
পুত্র-সঙ্গ তিন জন তিলেক না ছাড়ে।
ক্ষণেক না করে রাজা নয়নের আড়ে।।
হেনমতে পঞ্চ পুত্র করেন পালন।
একদিন কুন্তী প্রতি বলেন রাজন।।
পুত্র সম সুখ নাহি সংসার ভিতর।
বঞ্চিত সকল সুখে পুত্রহীন নর।।
রাজ্যবন্ত ধনবন্ত বিদ্যাবন্ত জন।
পুত্র বিনা তার হয় সব অকারণ।।
ইহকালে সুখদায়ী, লোকেতে গৌরব।
পরকালে নিস্তারয়ে নরক রৌরব।।
ভাগ্যবন্ত ধৃতরাষ্ট্র শতপুত্র-পিতা।
সে কারণে কহি শুন ভোজের দুহিতা।।
পুনরপি মন্ত্র দেহ মদ্র-তনয়ারে।
বহুপুত্রে বহু সুখ হয় এ সংসারে।।
শুনিয়া বলেন কুন্তী যুড়ি দুই কর।
আর না করিবা আজ্ঞা শুন নৃপবর।।
পরম কপটী মাদ্রী, দেখহ আপনে।
একবার মন্ত্র সে পাইলা মম স্থানে।।
তাহে জন্মাইল মাদ্রী যুগল-নন্দন।
মাদ্রীরে আমার ভয় হয় সে কারণ।।
কৃতাঞ্জলি করি আমি নিবেদি তোমারে।
মাদ্রীর কারণে আর না কহ আমারে।।
মৌনী রহিলেন পাণ্ডু কুন্তীর বচনে।
আর পুত্র-বাঞ্ছা ত্যাগ করিলেন মনে।।
পাণ্ডবের জন্মকথা অপূর্ব্ব কথন।
স্ববাঞ্ছিত ফল লভে, শুনে যেই জন।।
ব্যাসের বচন ইথে নাহিক সংশয়।
পাঁচালী-প্রবন্ধে কাশীরাম দাস কয়।।