৬৪তম অধ্যায়
ক্ষাত্রধর্ম্মপ্রসঙ্গে ইন্দ্ৰ-মান্ধাতার উপাখ্যান
ভীষ্ম কহিলেন, “হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ। চারি-আশ্রমের ধর্ম্ম, যতিধৰ্ম্ম, লোকাচারপ্রথা ও কাৰ্য্যসমুদয় ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মপ্রভাবে জনসমাজে প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। ঐ ধর্ম্মের প্রাদুর্ভাব থাকাতেই প্রজাগণ নিরাপদে কালযাপন করিতেছে। আশ্রমবাসীদিগের ধর্ম্ম অপ্রত্যক্ষ ও নানাবিধ। কতকগুলি লোক বিরুদ্ধ শাস্ত্ৰদ্বারা সেই শাশ্বত ধৰ্ম্মের যথার্থ ধৰ্ম্মও বিপরীত করিয়া তুলেন, আর অনেকে ধর্ম্মতত্ত্বনির্ণয়ে একান্ত হতবুদ্ধি হইয়া পড়েন; কিন্তু ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্ম সুখভূয়িষ্ঠ [সুখবহুল], কাপট্যরহিত ও সমুদয় লোকের হিতকর। গৃহস্থধর্ম্মের ন্যায় রাজধর্ম্ম ব্রাহ্মণাদি বর্ণচতুষ্টয়ের ধর্ম্মসাধনের মূল। আমি বলিয়াছি যে, বহুতর মহাবলপরাক্রান্ত নরপতি রাজধৰ্ম্ম প্রধান, কি আশ্ৰম ধর্ম্ম প্রধান, ইহা স্থির করিবার নিমিত্ত ভূতপতি নারায়ণের নিকট গমন করিয়াছিলেন। ভগবান্ প্রজাপতিকর্ত্তৃক সৰ্ব্বাগ্রে সৃষ্ট সাধ্য, সিদ্ধ, বসু, রুদ্র, বিশ্বদেব ও অশ্বিনীকুমার প্রভৃতি দেবগণ ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মানুসারে অবস্থান করিতেছেন।
“মহারাজ! পূৰ্ব্বকালে দানবগণের প্রাদুর্ভাবনিবন্ধন সমুদয় উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিয়াছিল। ঐ সময় মহাবলপরাক্রান্ত মহাত্মা মান্ধাতা রাজপদে অভিষিক্ত হইলেন। ঐ মহাত্মা জন্মমৃত্যু বিবর্জ্জিত পরমপিতা নারায়ণের দর্শনমানসে এক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া তাঁহার উদ্দেশে ভক্তিভাবে অভিবাদন করিতে লাগিলে তখন ভগবান বিষ্ণু ইন্দ্ররূপ ধারণপূৰ্ব্বক সেই যজ্ঞস্থলে মান্ধাতাকে দর্শন প্রদান করিলেন। মান্ধাতাও ইন্দ্ররূপী নারায়ণকে অবলোকন করিয়া পরমপরিতুষ্টচিত্তে অন্যান্য পার্থিবগণসমভিব্যাহারে তাঁহার অর্চ্চনা করিতে লাগিলেন। ঐ সময় রাজা মান্ধাতা ও ইন্দ্ররূপী নারায়ণ বিষ্ণুর উদ্দেশে যেরূপ কথোপকথন করিয়াছিলেন, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।
“ইন্দ্র কহিলেন, মহারাজ! তুমি কেন বৃথা সেই অপ্রমেয় অমিতপরাক্রমশালী দেবাদিদেব নারায়ণকে নিরীক্ষণ করিবার অভিলাষ করিতেছ? আমি এতাবৎকাল তাঁহার দর্শনলাভে কৃতকাৰ্য্য হইতে পারি নাই এবং ব্রহ্মাও তাঁহাকে দেখিতে পান নাই। তুমি ভূলোকের অধিপতি, অতএব তোমার আর যে-কোন অভিলাষ থাকে, প্রার্থনা কর, আমি অবিলম্বে তাহা সফল করিব। তুমি শান্তিগুণাবলম্বী, ধর্ম্মপরায়ণ, জিতেন্দ্রিয়, মহাবলপরাক্রান্ত, দেবগণের প্রতি দৃঢ়ভক্তিসম্পন্ন এবং শ্রদ্ধা ও বুদ্ধিবলে সৰ্ব্বোৎকৃষ্ট, এই নিমিত্ত আমি তোমাকে বিষ্ণুদর্শন ভিন্ন অভীষ্ট বরপ্রদানে প্রস্তুত আছি।’
“মান্ধাতা কহিলেন, ‘ভগবন্! আমি আপনার চরণে প্রণিপাতপূৰ্ব্বক প্রসন্ন করিয়া কহিতেছি, সেই আদিদেবের দর্শনলাভ ভিন্ন আমার অন্য কোন অভিলাষই নাই। অতঃপর আমি ভোগাভিলাষ পরিত্যাগপূর্ব্বক ধর্ম্মপরায়ণ হইয়া অবিলম্বেই অরণ্যে প্রস্থান করিব। অরণ্যই সাধুজনসেবিত উৎকৃষ্ট পথ। আমি ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মানুসারে দিব্যলোকসমুদয় অধিকার ও বিপুল যশোলাভ করিয়াছি; কিন্তু সেই আদিদেব হইতে যে ধর্ম্ম প্রবৃত্ত হইয়াছে, আমি সেই ধর্ম্মের অনুষ্ঠানে সমর্থ নহি।
ইন্দ্ৰকর্ত্তৃক ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মের শ্রেষ্ঠতা কীৰ্ত্তন
“ইন্দ্র কহিলেন, ‘মহারাজ! যে ক্ষত্রিয় রাজা নহে, সে অবলীলাক্রমে সমস্ত ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্ম-প্রতিপালনে সমর্থ হয় না। ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্ম আদিদেব [বিষ্ণু] হইতে সব্বাগ্রে উৎপন্ন হইয়াছে। ঐ ধৰ্ম্মের পশ্চাৎ অন্যান্য ধর্ম্মের সৃষ্টি হয়। ধৰ্ম্ম নানাপ্রকার এবং উহাদের ফলও বিনশ্বর[নাশশীল]। যাহা হউক, সমস্ত ধর্ম্মই ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মের আয়ত্ত, এই নিমিত্ত ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্ম সকল ধৰ্ম্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হইয়াছে। পূৰ্ব্বে ভগবান্ বিষ্ণু ক্ষত্রিয় ধর্ম্মানুসারে শত্রুনাশ করিয়া দেবতা ও মহর্ষিগণকে রক্ষা করিয়াছিলেন। যদি সেই অপ্রমেয় পুরুষ শত্রুবর্গকে বিনাশ না করিতেন, তাহা হইলে কি ব্রাহ্মণ, কি ব্রহ্মা, কি আদিধর্ম্ম, কি অন্যান্য ধর্ম্ম কিছুই থাকিত না। যদি সেই দেবাদিদেব পরাক্রমপ্রকাশপূৰ্ব্বক অসুরগণকে পরাজয় না করিতেন, তাহা হইলে বর্ণচতুষ্টয় ও চারি-আশ্রম-ধৰ্ম্মসমুদয় বিনষ্ট হইয়া যাইত। ধর্ম্মসমুদয় উচ্ছিন্নপ্রায় হইয়াছিল, শাশ্বত ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মই তৎসমুদয় পুনরায় সুপ্রচার করিয়াছে। ঐ ধৰ্ম্মের প্রভাবে প্রতিযুগেই আদিধর্ম্ম বদ্ধমূল হয়। সমরমৃত্যু, সকলের প্রতি দয়া, লোকজ্ঞান[লোকচরিত্রের অভিজ্ঞতা], লোকপালন, বিপদ হইতে পরিত্রাণ, এই সমস্ত ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মপ্রভাবেই জনসমাজে বিদ্যমান রহিয়াছে। মৰ্য্যাদাশূন্য, স্বেচ্ছাচারপরায়ণ, ক্রোধাবিষ্ট ব্যক্তিরা রাজভয়ে অভিভূত হইয়াই পাপানুষ্ঠানে বিরত হয় এবং সদাচারসম্পন্ন ব্যক্তিরা রাজার শাসনপ্রভাবেই নির্ব্বিঘ্নে ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করিতে পারেন। লোকসকল ভূপালগণকর্ত্তৃক রাজধৰ্ম্মানুসারে সুতনিৰ্বিশেষে প্রতিপালিত হইয়া পরমসুখে কালাতিপাত করিয়া থাকে, সন্দেহ নাই। ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্ম সকল ধৰ্ম্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও অবিনশ্বর। উহার প্রভাবে সমুদয় সুশৃঙ্খল হইতে পারে।”