৬৩তম অধ্যায়
নল-পরিত্যক্তা দময়ন্তীর বিলাপ
বৃহদশ্ব কহিলেন, “বিষধরাজ প্রস্থান করিলে দময়ন্তীর নিদ্রাভঙ্গ হইল। তখন সেই বরবর্ণিনী জনশূন্য অরণ্যে আপনাকে একাকিনী ও পতিবিরহিণী নিরীক্ষণ করিয়া শোকাকুলিতচিত্তে মুক্তকণ্ঠে বিলাপ করিতে লাগিলেন, ‘হা নাথ! হা স্বামিন! হা মহারাজ! আমি অনাথা হইয়া এই মহারণ্যে বিনষ্ট হইলাম! হা জীবিতেশ্বর! আমি সাতিশয় ভীত হইয়াছি, আমাকে রক্ষা কর। হা মহাভাগ! আমাকে কি পরিত্যাগ করিলে? তুমি ধর্ম্মপরায়ণ ও সত্যবাদী, কিন্তু এক্ষণে তোমার সেই ধর্ম্মজ্ঞতা ও সেই সত্যবাদিতা কোথায় রহিল? নাথ! ধর্ম্মানুসারে তোমার সেবা করিতে কোনমতে আমি ত্রুটি করি নাই, তবে কি নিমিত্ত নিরপরাধা নিজ কামিনীকে একাকিনী পরিত্যাগ করিয়া গমন করিলে? অয়ি জীবিতনাথ! পূর্ব্বে লোকপালগণের সন্নিধানে যাহা সত্য করিয়াছিলে, এক্ষণে সেই সকল কথা কি এই নৃশংসাচারে পরিণত হইল? মনুষ্য কদাচ অকালে কালগ্ৰাসে পতিত হয় না; এই নিমিত্ত আমি এখনও জীবিত রহিয়াছি। নাথ! যথেষ্ট পরিহাস করা হইয়াছে; এক্ষণে আমি ভীত হইয়াছি; দর্শন দিয়া আমার প্রাণরক্ষণ কর। মহারাজ! এই যে তোমাকে দেখিলাম, আবার ঐ দেখিতেছি; তথাপি কেন আর লতাবিতানে আবৃত হইয়া সম্ভাষণ করিতেছ না? হা জীবিতেশ্বর! তুমি কি নৃশংস! আমি এত বিলাপ করিতেছি, তথাপি তুমি আমার নিকট আগমন করিয়া আশ্বাস প্ৰদান করিতেছ না? হা দময়ন্তী-জীবন! আমি তোমার নিমিত্ত অথবা অন্য কোন কারণবশতঃ শোক করিতেছি না; তুমি এক্ষণে অসহায় হইয়া কিরূপে কালাতিপাত করিবে, কেবল এই চিন্তা করিয়াই আমার শোকসাগর উচ্ছলিত হইতেছে। তুমি সায়ংকালে তৃষিত, ক্ষুধিত ও শ্রান্ত হইয়া তরুতলে আমাকে দর্শন না করিয়া কি করিবে?”
“ভীমরাজনন্দিনী এই প্রকার বিলাপ ও পরিত্যাগপূর্ব্বক শোকাকুলিতচিত্তে ক্রোধাভরে ইতস্ততঃ ধাবমান হইয়া কখন পতিত, কখন বা উত্থিত, কখন ভীত, কখন বা লুক্কায়িত, কখন বা উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিয়া বিহ্বল হইতে লাগিলেন। এইরূপে পতিব্ৰতা দময়ন্তী শোকসন্তপ্ত হইয়া রোদন করিতে করিতে দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক কহিলেন, “হে নিষধরাজ! যাহার অভিসম্পাতপ্রভাবে ঈদৃশ দুরবস্থায় পতিত হইয়াছ, তাহাকে ইহা অপেক্ষাও অধিকতর দুঃখ ভোগ করিতে হইবে। যে পাপত্মা সেই নিষ্পাপ পুরুষকে ঈদৃশ দুঃখাৰ্ণাবে মগ্ন করিয়াছে, সে তাহা অপেক্ষাও সমধিক দুঃখের সহিত জীবন-যাপন করিবে।’ নলমহিষী ভৈমী এবম্প্রকার পরিতাপ করিয়া সেই শ্বাপদ-সেবিত অরণ্যানীতে স্বামীর অন্বেষণে উন্মত্তার ন্যায় ‘হা নাথ!’ বলিয়া ইতস্ততঃ ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন।
দময়ন্তীকে অজগরের প্রাসোদ্যম
“ভীমকুমারী কান্তবিরাহিণী কুররীর [উৎক্রোশপক্ষিণী] ন্যায় করুণম্বরে ক্ৰন্দন ও বারংবার বিলাপপূর্ব্বক কাননমধ্যে ভ্রমণ করিতেছেন, এমন সময় এক মহাকায় অজগর সর্ব্ব ক্ষুধিত হইয়া সহসাগত সমীপবৰ্ত্তিনী সেই ভীমনন্দিনীকে গ্ৰাস করিতে উদ্যত হইল। তিনি অজগরগ্ৰস্ত ও শোকসাগরে নিমগ্ন হইয়া নৈষধের নিমিত্ত যত শোকাকুল হইতে লাগিলেন, আপনার মৃত্যুভয়ে তত কাতর হইলেন না। তিনি আপনার জীবনাশা পরিত্যাগ করিয়া কেবল নলের নিমিত্তই বিলাপ করিতে লাগিলেন, ‘হা নাথ! এই নির্জ্জনবনে বিষধর আমাকে অনাথা দেখিয়া গ্রাস করিতেছে, তুমি কি নিমিত্ত তাহার অনুধাবন করিতেছ না? আমি যখন তোমার স্মৃতিপথে আরূঢ় হইব, তখন তোমার কি অবস্থা ঘটিবে, বলিতে পারি না। হে নিষধনাথ! তুমি কি ভাবিয়া এই নির্জ্জন বনে আমাকে পরিত্যাগ করিয়া গমন করিলে? তুমি যখন শাপবিমুক্ত ও প্রকৃতিস্থ হইয়া পুনরায় ঐশ্বৰ্য্যলাভ করিবে, তখন তুমি শ্ৰান্ত, ক্ষুধার্ত্ত ও পরিম্লান হইলে কে তোমার শ্রমাপনোদন ও শুশ্রূষা করিবে?”
‘রাজমহিষী দময়ন্তী এইরূপে বিলাপ করিতেছেন, এই অবসরে এক ব্যাধ সেই গহনবিপিনে বিচরণপূর্ব্বক তাঁহার ক্ৰন্দনধ্বনি শ্রবণ করিয়া ত্বরিতপদে তথায় উপস্থিত হইল এবং সেই আয়তলোচনা ললনাকে বিষধরকর্ত্তৃক কবলিত প্রায় অবলোকন করিয়া সত্বরে নিশিত শস্ত্ৰদ্বারা সেই ভুজঙ্গাপসদের মুখদেশ বিপাটিত করিয়া ফেলিল। তখন বিষধর নিশিতশস্ত্ৰতাড়নে আশু গতাসু হইলে মৃগজীবন [মৃগয়ালব্ধ পশুপক্ষীদ্বারা জীবিকাকারী] দময়ন্তীকে তাহার গ্রাস হইতে মুক্ত করিয়া জলদ্বারা তাঁহার অঙ্গষষ্টি প্রক্ষালিত করিয়া দিল এবং আশ্বাসপ্রদানপূর্ব্বক তাঁহাকে ভোজন করাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “হে মৃগশাবকলোচনে! তুমি কাহার গৃহিণী, কি জন্যই বা এই অরণ্যে আগমন করিয়াছ? কেনই বা ঈদৃশ দুরবস্থায় পতিত হইয়াছ?”
“অনন্তর দময়ন্তী ব্যাধের নিকট আপনার সমস্ত বৃত্তান্ত যথাবৎ বর্ণনা করিলেন। পাপাত্মা ব্যাধ অৰ্দ্ধবসনাবৃতা দময়ন্তীর উন্নতশ্রোণী, পীনপয়োধর, নয়নযুগল অবলোকনে এবং সুমধুর সম্ভাষণশ্রবণে কন্দর্পের বশবর্ত্তী হইয়া বহুবিধ বিনয়পূর্ব্বক মধুরবাক্যে সান্ত্বনা করিতে লাগিল।
“মহানুভবা দময়ন্তী সেই লুব্ধকের দুরভিসন্ধি বুছিতে পারিয়া একেবারে রোষানলে প্ৰজ্বলিত হইয়া উঠিলেন। তখন কামার্ত্ত লুব্ধক কুপিত হইয়া তাঁহার প্রতি বলপ্রকাশ করিতে উদ্যত হইল, কিন্তু তাঁহাকে প্রজুলিত অগ্নিশিখার ন্যায় বোধ করিয়া তৎক্ষণাৎ নিশ্চেষ্ট হইল।
“অনাথা দময়ন্তী এই প্রকার বিষম সময় উপস্থিত দেখিয়া রোষাকুলিতচিত্তে শাপ প্রদান করিলেন, “যদি আমি নল ভিন্ন অন্যকে কদাচ চিন্তা না করিয়া থাকি, তাহা হইলে এই দুরাচার মৃগজীবন অবিলম্বেই হতজীবন হইয়া পতিত হউক।” এই কথা বলিবামাত্র সেই মৃগজীবী জীবন পরিত্যাগ করিয়া অগ্নিদগ্ধ তরুর ন্যায় ধরাশায়ী হইল।”