৬৩তম অধ্যায়
জ্ঞাতিবিরোধে দোষদর্শন
বিদুর কহিলেন, “হে নরনাথ! আমি প্রাচীন লোকের মুখে শ্ৰবণ করিয়াছি, কোন ব্যাধ পক্ষী ধরিবার নিমিত্ত ভূমির উপরে পাশ যোজনা করিয়াছিল; দুটি সহচর পক্ষী তাহাতে বদ্ধ হইবামাত্র তাহা গ্রহণ করিয়া আকাশে পলায়ন করিল; তদ্দর্শনে সেই শাকুনিক সাতিশয় দুঃখিত হইয়া সেই পক্ষিদ্বয়ের অনুসরণক্ৰমে ধাবমান হইতেছে, এমন সময় আশ্রমাসীন কৃতাহ্নিক কোন তপস্বীর নেত্রপথে নিপতিত হইল। মহর্ষি ব্যাধকে দ্রুতবেগে আকাশগামী বিহগদ্বয়ের অনুসরণ করিতে দেখিয়া সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে শাকুনিক! পক্ষীরা আকাশপথ অবলম্বন করিয়া পলায়ন করিতেছে, আর তুমি ভূমিপথ আশ্রয় করিয়া তাহাদিগের অনুধাবন করিতেছি, ইহাতে আমি অত্যন্ত বিস্ময়াবিষ্ট হইয়াছি।”
“শকুনিক কহিল, “হে তপোধন! এই পক্ষী দুটি এক্ষণে ঐকমত্য অবলম্বনপূর্ব্বক আমার একমাত্র পাশ অপহরণ করিয়া গমন করিতেছে বটে, কিন্তু যখন উহারা পরস্পর বিবাদ করিবে, তখনই আমার বশবর্ত্তী হইবে।”
“অনন্তর সেই দুর্বুদ্ধি শকুন্তদ্বয় পরস্পর বিবাদ করিয়া ভূমিতলে নিপতিত হইবামাত্র শাকুনিক অজ্ঞাতসারে তাহাদের সমীপবর্ত্তী হইয়া তাহাদিগকে গ্ৰহণ করিল।
“এইরূপ যেসকল জ্ঞাতি অর্থের নিমিত্ত পরস্পর যুদ্ধ করিতে প্রবৃত্ত হইয়া থাকে, তাহাদিগকে ঐ বিবদমান শকুন্তযুগলের ন্যায় অমিত্ৰগণের বশীভুত হইতে হয়। ভোজন, কথোপকথন, জিজ্ঞাসাবাদ ও সহবাস জ্ঞাতিগণের কর্ত্তব্য ; পরস্পর বিরোধ করা কদাচ বিধেয় নহে। যেসকল মনস্বী সমুচিত সময়ে বৃদ্ধগণের সেবা করিয়া থাকেন, তাঁহারা সিংহসংরক্ষিত অরণ্যের ন্যায় অন্যের অনভিভাবনীয় [অবশীভূত] হয়েন। যিনি নিরন্তর অর্থপ্ৰাপ্ত হইয়াও দীনের ন্যায় ব্যবহার করেন, তিনি আপনার শ্ৰী শক্রগণকে প্রদান করেন। জ্ঞাতিগণ উল্মুকের [জ্বলন্ত কাষ্ঠ] ন্যায়; যখন তাঁহারা পৃথক পৃথক অবস্থান করেন, তখন কেবল প্রধূমিত হয়েন এবং একত্র মিলিত হইলেই প্রজ্বলিত হইয়া থাকেন।
অপরিণামদর্শী কিরাতরাজের উপাখ্যান
“মহারাজ! আমি গন্ধমাদনপর্ব্বতে যাহা অবলোকন করিয়াছিলাম, তাহাও কহিতেছি, শ্রবণ করিয়া যাহা শ্রেয়স্কর হয়, করুন। একদা আমরা কতকগুলি কিরাত ও দেবকল্প মন্ত্র্যযন্ত্রাদি এবং ঔষধ-প্রসাধনাদি [বেশবিন্যাসের উপকরণ] বৃত্তান্তের অভিজ্ঞ ব্রাহ্মণগণসমভিব্যাহারে চতুর্দ্দিকে লতাপরিবৃত দীপ্যমান-পর্ব্বতের ঔষধিসমূহে মণ্ডিত সিদ্ধগন্ধর্ব্বসেবিত গন্ধমাদনপর্ব্বতে গমন করিতে করিতে তত্রত্য কোন বিশেষ প্রদেশে কুম্ভপরিমিত সুবর্ণমাক্ষিকনামে ধাতুবিশেষ অবলোকন করিলাম। আমাদের সমভিব্যাহারে সেই সকল ব্ৰাহ্মণ কহিলেন, “ঐ ধাতু রাজরাজ কুবেরের অত্যন্ত প্রীতিকর; আশীবিষগণ উহা রক্ষা করিয়া থাকে। উহা প্রাপ্ত হইলে মনুষ্য অমরত্ব, অন্ধ নয়ন ও বৃদ্ধ যৌবন লাভ করে।” কিরাতগণ সেই ধাতু সন্দর্শনে সাতিশয় লোলুপ হইয়া গমন করিবামাত্র সেই সসর্প গিরিগহ্বরে নিপতিত ও বিনাশপ্ৰাপ্ত হইল। সেইরূপ আপনার পুত্র একাকী এই সমস্ত পৃথিবী ভোগ করিতে অভিলাষী হইয়াছেন, কিন্তু পশ্চাতে যে পতন হইবে, তাহা মোহবশতঃ বিবেচনা করিতেছেন না। দুৰ্য্যোধন সব্যসাচীর সহিত যুদ্ধ করিতে সমুৎসুক হইয়াছে; কিন্তু ইহার তাদৃশ তেজ বা বিক্রম আছে বলিয়া বোধ হয় না। অর্জ্জুন যে একাকী রথারোহণপূর্ব্বক সমস্ত পৃথিবী জয় করিয়াছেন এবং ভীষ্ম, দ্রোণ প্রভৃতি যোদ্ধৃগণ যে বিরাটনগরের যুদ্ধে ভীত হইয়া ভঙ্গ দিয়াছিলেন। আপনি কি তাহা বিস্মৃত হইয়াছেন? তিনি কেবল সময়প্রতীক্ষায় আপনার বীক্ষণ সহ্য করিতেছেন। দ্রুপদ, মৎস্যরাজ ও ধনঞ্জয় বাতেরিত অগ্নির ন্যায় ক্রুদ্ধ হইলে কিছুতেই ক্ষান্ত হইবে না। অতএব আপনি রাজা যুধিষ্ঠিরকে ক্রোড়ে করুন; যে পক্ষ পরাজিত হয় কেবল সেই পক্ষেরই যে অনিষ্ট ঘটে, এমন নয়; জয়শীল ব্যক্তিদিগকে অনেক অপকার ভোগ করিতে হয়।”