ত্রিষষ্টিতম অধ্যায়
উপরিচর বসুর পরিচয়
বৈশম্পায়ন কহিলেন, পুরুবংশে উপরিচর নামে এক পরম ধার্ম্মিক রাজা ছিলেন। তাঁহার অপর নাম বসু। তিনি সর্ব্বদা মৃগয়ায় আসক্ত থাকিতেন। মহারাজ বসু ইন্দ্রের উপদেশক্রমে রমণীয় চেদিরাজ্য অধিকার করেন। পরে অস্ত্র-শস্ত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক আশ্রমে প্রবেশ করিয়া অতি কঠোর তপস্যা আরম্ভ করিলেন। একদা ইন্দ্রাদি দেবগণ তদীয় আশ্রমে উপস্থিত হইয়া ভাবিলেন, ইনি যেরূপ তপস্যা করিতেছেন, ইহাতে বোধ হয়, ইন্দ্রত্ব গ্রহণ করিবেন, এই ভাবিয়া শান্তবাক্য দ্বারা তাঁহাকে তপস্যা হইতে নিবৃত্ত করিলেন। দেবতারা কহিলেন, ‘মহারাজ! যাহাতে পৃথিবীমধ্যে ধর্ম্ম সঙ্কীর্ণ হয়, তাহাই তোমার অবশ্য-কর্ত্তব্য কর্ম্ম। তুমি ধর্ম্ম প্রতিপালন করিতেছ বলিয়া লোক-সকল স্বধর্ম্মে ব্যবস্থিত আছে।” ইন্দ্র কহিলেন, “হে নরনাথ! তুমি অবহিত ও নিয়মশালী হইয়া সতত ধর্ম্মের অনুষ্ঠান কর, তাহা হইলেই নিত্য ও পবিত্র লোক দেখিতে পাইবে। তুমি ভূলোকে থাকিয়াও আমার প্রিয়সখা হইবে। তোমাকে এক সদুপদেশ দিতেছি, শ্রবণ কর। এই ভূমণ্ডলের মধ্যে যে প্রদেশ অতি রমণীয়, পবিত্র ও উর্ব্বরক্ষেত্রবিশিষ্ট এবং পশ্বাদির আবাস ও বিচিত্র ধনধান্যসম্পন্ন, তুমি সেই দেবমাতৃক [বৃষ্টির জল ব্যতীত যে-দেশে শস্য হয় না] প্রদেশে অবস্থিতি কর।
হে চেদিরাজ! চেদিদেশ প্রভূত ধনরত্নাদিবিশিষ্ট, তুমি তথায় গিয়া বাস কর। ঐ জনপদের অধিবাসীরা ধর্ম্মপরায়ণ ও সাধু। অধিক কি বলিব, তাহারা পরিহাসক্রমেও কদাচ মিথ্যা ব্যবহার করে না। পুৎত্রেরা পিতার হিতকার্য্যে তৎপর হইয়া একান্নে বাস করে। তত্রত্য লোকেরা দুর্ব্বল বলীবর্দ্দ [গো-বিশেষ—বলদ]দিগকে ভারবহন বা কৃষিকার্য্যে নিয়োগ করে না। তথায় ব্রাহ্মণ, ক্ষৎত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারিবর্ণ সতত সাবধান হইয়া স্ব স্ব ধর্ম্ম প্রতিপালন করিয়া থাকেন। হে মানপ্রদ! ত্রিলোকে যে-সকল ঘটনা হইবে, আমার প্রসাদে কিছুই তোমার অবিদিত থাকিবে না। মনুষ্যের মধ্যে কেবল তুমিই মদ্দত্ত এই দিব্য স্ফটিকনির্ম্মিত আকাশগামী বিমানে আরোহণ করিয়া বিগ্রহবান্ [শরীরধারী] দেবতার ন্যায় গগনমার্গে সঞ্চরণ করিতে পারিবে। আর তোমাকে এই বৈজয়ন্তীনাম্নী অম্লানপঙ্কজমালা [স্নিগ্ধ পদ্মপুষ্প মাল্য] অর্পণ করিতেছি, এই মালা সংগ্রামকালে তোমাকে রক্ষা করিবে ও ইহার প্রভাবে তুমি অক্ষতশরীরে রণস্থল হইতে প্রত্যাগত হইতে পারিবে। এই সুবিখ্যাত ইন্দ্রমালা তোমার একমাত্র অসাধারণ চিহ্নস্বরূপ হইবে।”
বৈশম্পায়ন কহিলেন, দেবরাজ ইন্দ্র রাজার প্রীতিবিস্তার করিবার উদ্দেশে শিষ্টপ্রতিপালনী নামে এক বেণুষষ্টি [বাঁশের লাঠি] প্রদান করিলেন। সংবৎসর অতীত হইলে ভূপতি শচীপতির আরাধনার নিমিত্ত সেই বেণুষষ্টি পৃথিবীতে প্রোথিত করিতেন। পরদিবস সেই বেণুষষ্টি গন্ধমাল্য ও বসন-ভূষণে বিভূষিত করিয়া উত্থাপনপূর্ব্বক তাহাতে ইন্দ্রের পূজা করিতেন। তদবধি অন্যান্য ক্ষিতিপালেরাও তন্নির্দ্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া ইন্দ্রের উপাসনা করিয়া থাকেন। ভগবান্ ইন্দ্র বসুরাজের প্রতি প্রসন্ন হইয়া হংসরূপ পরিগ্রহপূর্ব্বক অবনীতে অবতীর্ণ হইতেন এবং সেই প্রকার আকারেই পূজা স্বীকার করিয়া কহিতেন, “মহারাজ! তুমি যেরূপ সৎকার করিলে, তাহাতে আমি পরম প্রীতিলাভ করিলাম। এক্ষণে কহিতেছি, যে-সকল রাজা আমার প্রীত্যুদ্দেশে এই উৎসব করিবেন বা অন্য দ্বারা এই উৎসব করাইবেন, তাঁহাদিগের রাজ্যে ধনসমৃদ্ধির বৃদ্ধি ও বিজয়লাভ হইবে এবং তৎ-প্রদেশবাসীরা সর্ব্বদা সন্তোষে থাকিবে।” হে মহারাজ! এইরূপে বসুরাজ ইন্দ্র কর্ত্তৃক অভিহিত হইয়াছিলেন। ফলতঃ যে-নর ভূমি ও রত্নাদি প্রদান করিয়া ইন্দ্রোৎসব করিয়া থাকেন, তিনি পূজিত হয়েন। চেদীশ্বর বসু বরদান ও শক্রোৎসবের উপদেশ-কথন দ্বারা ইন্দ্র কর্ত্তৃক সম্মানিত হইয়া এই পৃথিবী ধর্ম্মতঃ পালন করিতেন এবং সুরপতির সন্তোষার্থে মধ্যে মধ্যে ইন্দ্রোৎসব করিতেন।
মহারাজ! বসুর মহাবল-পরাক্রান্ত পাঁচ পুৎত্র ছিল। তিনি তাঁহাদিগকে পৃথক্ পৃথক্ রাজ্যে অভিষিক্ত করেন। তাঁহার এক পুৎত্রের নাম বৃহদ্রথ। ইনি মগধদেশে মহারথ বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছিলেন। অপর পুৎত্রের নাম প্রত্যগ্রহ। আর একটির নাম কুশাম্ব, কেহ কেহ ইঁহার নাম মণিবাহন বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। অন্য পুৎত্রের নাম মাবেল্ল। অপরের নাম যদু। অমিত-পরাক্রমশালী বসুরাজার এই পঞ্চ পুৎত্র জন্মে। তন্মধ্যে যিনি যে-দেশে অভিষিক্ত হইয়াছিলেন, সেই দেশ তাঁহার নামে বিখ্যাত হইয়াছে। সেই ইন্দ্রতুল্য পঞ্চ ভূপতির পৃথক্ পৃথক্ বংশাবলী হইয়াছিল। যখন সেই বসুরাজা ইন্দ্রের প্রসাদলব্ধ সেই স্ফটিক-নির্ম্মিত রথে আরোহণ করিয়া পৃথিবীর উপরিভাগে আকাশপথে সঞ্চরণ করিতেন, তৎকালে গন্ধর্ব্ব ও অপ্সরা-সকল আসিয়া তাঁহার আরাধনা করিতেন। তিনি উপরি ভ্রমণ করিতেন, এই নিমিত্ত উপরিচর নামে প্রখ্যাত হইয়াছিলেন। তাঁহার রাজধানীর নিকটে শুক্তিমতী নামে এক নদী ছিল। কোলাহল নামে এক সচেতন অচল কামান্ধ হইয়া স্রোতস্বতী-সম্ভোগাভিলাষী হওয়াতে বসুরাজ তাহার শিরোদেশে পদাঘাত করিয়াছিলেন। রাজার পাদপ্রহারে পর্ব্বতবর বিদীর্ণ হইল। অতি বেদবতী স্রোতস্বতী শুক্তিমতী সেই প্রহারমার্গ দ্বারা বহির্গত হইতে লাগিল। উক্ত নদীর গর্ভে কোলাহলের এক পুৎত্র ও কন্যা উৎপন্ন হইল। নদী প্রীতমনে সেই কন্যা ও পুৎত্র লইয়া রাজাকে সমর্পূণ করিল। বসুপ্রদ বসুরাজ সেই পুৎত্রকে আপন সৈন্যাধিকারে নিয়োগপূর্ব্বক কন্যাকে পত্নীরূপে স্বীকার করিলেন। গিরিবালা গিরিকা ঋতুস্নাতা ও শুচি হইয়া সন্তান-বাসনায় রাজাকে আপন অবস্থা নিবেদন করিল। দৈবযোগে সে দিবস রাজার পিতৃলোকেরা প্রসন্ন হইয়া তাঁহাকে মৃগয়া করিতে আদেশ দিলেন। রাজা তাঁহাদিগের আজ্ঞা প্রাপ্তিমাত্রে মৃগয়ার্থ নির্গত হইলেন; কিন্তু অলোক-সামান্য রূপলাবণ্যবতী সাক্ষাৎ লক্ষ্মী-স্বরূপা গিরিকা তাঁহার স্মৃতিপথে সতত জাগরূক ছিলেন।
মৎস্যগন্ধার উৎপত্তি
রাজা সেই রমণীয় বসন্তকালে মৃগয়াক্রমে অশোক, চম্পক, চূত, অতিমুক্ত, পুন্নাগ, কর্ণিকার, বকুল, পাটল, চন্দন, অর্জ্জুন প্রভৃতি বহুবিধ বৃক্ষে পরিশোভিত; কোকিলালাপ-মুখরিত, মধুমত্ত মধুকরের ঝঙ্কারে সঙ্কুলিত; চৈত্ররথতুল্য মনোহর এক কাননে প্রবেশ করিলেন। কিন্তু গিরিকা-বিরহে নিতান্ত কাতর ও দুর্দ্দান্ত মদনবাণে একান্ত অধীর হইয়া যদৃচ্ছাক্রমে [যথেচ্ছ— ইচ্ছানুসারে] ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে করিতে এক বিকশিত অশোকতরু অবলোকন করিলেন। তিনি সেই তরুমূলে সুখাসীন হইয়া বায়ু-সেবন দ্বারা অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন। এই অবসরে তাঁহার রেতঃস্খলন হইল। রেতঃনিতান্ত নিষ্ফল না হয়, এই মনে করিয়া চেদিরাজ এক পত্রপুটে তাহা ধারণ করিলেন। পরে পত্নীর ঋতুকাল ও আপনার রেতঃ বিফল না হয়, মনে মনে এই বিবেচনা করিয়া রাজা মন্ত্রোচ্চারণপূর্ব্বক বীজ-শোধন করিয়া সমীপবর্ত্তী অতি দ্রুতগামী এক শ্যেনপক্ষীকে কহিলেন, “হে সৌম্য! অদ্য আমার মহিষীর ঋতুকাল, অতএব তুমি অতি সত্বর আমার এই রেতঃ লইয়া তাঁহাকে প্রদান কর।”
বেগবান্ শ্যেন সেই শুক্র লইয়া আকাশপথে উড্ডীন হইল। পথিমধ্যে আর একটি শ্যেনপক্ষী ঐ দ্রুতগামী শ্যেনের তুণ্ডাগ্রে স্থির শুক্র দেখিয়া আমিষ আশঙ্কা [সম্ভাবনা] করিয়া তাহার নিকট আসিল এবং “মাংসখণ্ড বলপূর্ব্বক লইব,” এই ভাবিয়া তাহার সহিত তুণ্ডযুদ্ধ আরম্ভ করিল। যুদ্ধ করিতে করিতে সেই শুক্র যমুনার জলে পতিত হইল। তথায় অদ্রিকা নামে এক অপ্সরা ব্রহ্মশাপ প্রভাবে মীনরূপ প্রাপ্ত হইয়া বাস করিত। সেই মৎস্যরূপা অদ্রিকা শীঘ্র আসিয়া শ্যেনতূণ্ডপরিভ্রষ্ট বীজ ভক্ষণ করিল। বীজ-ভক্ষণের পর দশম মাসে মৎস্যোপজীবীরা সেই মৎসীকে জালে বন্ধ করিল। অনন্তর তাহার উদরাভ্যন্তর হইতে এক কন্যা ও এক পুৎত্র বহির্ভূত হইল। মৎস্যজীবীরা এই অদ্ভুত ব্যাপার দর্শনে চমৎকৃত হইয়া ঐ দুই সন্তানকে ভূপাল-সমক্ষে লইয়া গিয়া নিবেদন করিল, “মহারাজ! এক মৎসীর গর্ভে এই দুই মানুষ জন্মিয়াছে।” উপরিচর রাজা সেই মৎসীগর্ভ-সম্ভৃত পুৎত্রকে গ্রহণ করিলেন। সেই মৎসীপুত্র পরমধর্ম্মিক ও স্থিরপ্রতিজ্ঞ মৎস্যরাজ নামে বিখ্যাত হইয়াছিলেন। শাপপ্রদানকালে ভগবান্ ইন্দ্র অপ্সরা অদ্রিকাকে কহিয়াছিলেন, “তুমি মানুষ প্রসব করিয়া শাপ হইতে পরিত্রাণ পাইবে।” এক্ষণে সেই নির্দ্দিষ্টকাল উপস্থিত দেখিয়া মৎস্যরূপা অপ্সরা মৎস্যরূপ পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বকীয় পূর্ব্বাকার স্বীকার করিয়া আকাশপথে প্রস্থান করিল। মৎসাগর্ভসম্ভৃতা দুহিতা রাজার আদেশক্রমে সেই মৎস্যজাবীর কন্যা হইল। মৎস্যঘাতীর সম্পর্কে তাহার নাম মৎস্যগন্ধা হইয়াছিল, ফলতঃ তাহার নাম সত্যবতী। সত্যবতী পিতৃশুশ্রূষার নিমিত্ত যমুনা নদীতে নাবিকের কার্য্য করিত।
ব্যাসের জন্মবৃত্তান্ত
একদা পরাশর ঋষি তীর্থপর্য্যটনক্রমে যমুনায় উপস্থিত হইয়া অলৌকিক-রূপলাবণ্যবতী মুনিজনমনোহারিণী সুচারুহাসিনী দাসনন্দিনীকে দেখিবামাত্র মদনবেদনায় অতিমাত্র ব্যাকুল হইয়া কহিলেন, “হে কল্যাণি! তুমি আমার মনোভিলাষ পূর্ণ কর।” সে কহিল, “হে ভগবান্! ঐ দেখুন, নদীর উভয় পারে পার হইবার নিমিত্ত ঋষিগণ উপস্থিত আছেন, এ অবসরে কিরূপে আপনার মনোরথ-সিদ্ধি হইবে।” তাহার এই কথা শুনিয়া ঋষিবর পরাশর কুজ্ঝটিকা সৃষ্টি করিয়া তৎপ্রদেশ তমোময় করিলেন। ঋষিসৃষ্ট কুজ্ঝটিকা দৃষ্টে কন্যা লজ্জিতা ও বিস্ময়াবিষ্টা হইয়া কহিল, “ভগবন্! আমি পিতার অধীন। অদ্যাবধি আমার বিবাহ হয় নাই। আপনার সহযোগে আমার কুমারীভাব দূষিত হইবে। কন্যাভাব দূষিত হইলে কিরূপে গৃহে প্রবেশ করিব এবং কি প্রকারেই বা লোকসমাজে জীবনধারণ করিব? হে ভগবান্! এই সমস্ত আদ্যোপান্ত অনুধাবন করিয়া যাহা উচিত হয়, বিধান করুন।” পরাশর শুনিয়া প্রীতমনে কন্যাকে কহিলেন, “হে ভীরু! আমার অভিলাষ পূর্ণ করিলে তোমার কন্যাভাব দূষিত হইবে না। আমি তোমার প্রতি প্রসন্ন হইয়াছি; ইচ্ছানুরূপ বর প্রার্থনা কর। আমার প্রসন্নতা কখনই নিষ্ফল হয় নাই।” তাঁহার এই কথা শুনিয়া কন্যা কহিল, “আমার সর্ব্বাঙ্গ হইতে সৌগন্ধ নির্গত হউক।” ঋষি “তথাস্তু” বলিয়া তাহার অভিলাষানুরূপ বর প্রদান করিলেন। অনন্তর ধীবরকন্যা অভাষ্ট-বরলাভে সন্তুষ্ট হইয়া মহর্ষির মনোবাঞ্ছা পরিপূর্ণ করিল। তদবধি সেই যুবতীর নাম গন্ধবতী বলিয়া ত্রিভূবনে বিখ্যাত হইল। লোকে একযোজন অন্তর হইতে তাহার গাত্রগন্ধের আঘ্রাণ পাইত, এই নিমিত্ত তাহার অপর একটি নাম যোজনগন্ধা হইয়াছিল।
সত্যবতী এইরূপে যমুনা নদীর দ্বীপে এক পুৎত্র প্রসব করিলেন। প্রভূততেজা পরাশরপুৎত্র মাতৃনির্দেশক্রমে তপস্যায় অভিনিবেশ করিলেন এবং জননীকে কহিলেন, “মাতঃ! কার্য্যকাল উপস্থিত হইলে আমাকে স্মরণ করিলেই আমি আসিব।” এইরূপে পরাশরের ঔরসে সত্যবতীর গর্ভে ব্যাসদেব জন্ম পরিগ্রহ করেন। তিনি যমুনা-দ্বীপে জন্মেন, এই নিমিত্ত তাঁহার নাম দ্বৈপায়ন হইল এবং যুগে যুগে ধর্ম্মের পাদক্ষয় ও মনুষ্যদিগের আয়ুঃ ও শক্তির হ্রাস দেখিয়া বেদের স্থায়িত্ব ও ব্রাহ্মণগণের প্রতি অনুকূলতা-প্রযুক্ত বেদের বিভাগ করিয়াছিলেন, এই নিমিত্ত তাঁহার নাম বেদব্যাস হয়। মহর্ষি বেদব্যাস সুমন্তু, জৈমিনি, পৈল, বৈশম্পায়ন এবং পুৎত্র শুকদেবকে বেদ ও মহাভারত অধ্যয়ন করান; তাঁহারাই ভারতের পৃথক্ পৃথক্ সংহিতা প্রকাশ করেন।
সংক্ষিপ্ত ক্ষৎত্রিয় বংশবর্ণন
মহাবীর্য্য মহাযশাঃ শান্তনু-পুৎত্র ভীষ্ম অষ্টবসুর সহযোগে গঙ্গাগর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। আণীমাণ্ডব্যনামক এক মহর্ষি ত্রিলোকে বিখ্যাত ছিলেন। সেই বেদবেত্তা মহাযশাঃ ভগবান্ চৌর্য্যাপবাদে শূলে আরোপিত হয়েন। তিনি শূলারোপণ-কালে ধর্ম্মকে আহ্বান করিয়া এই কথা কহিলেন, “হে ধর্ম্ম! আমি শৈশবকালে ইষীকাস্ত্র [কুশতৃণ] দ্বারা এক শকুন্তিকা[পক্ষী]কে বিদ্ধ করিয়া ছিলাম। আমার স্মরণ হইতেছে, সেই এক দুষ্কর্ম্ম করিয়াছি। তদ্ভিন্ন আর কোন পাপকর্ম্ম করি নাই। কিন্তু আমি তদপেক্ষা সহস্রগুণ তপস্যা করিয়াছি, তদ্দ্বরা কি আমার সেই পাপের শাস্তি হয় নাই? অন্যান্য প্রাণিবধ অপেক্ষা ব্রাহ্মণবধ গুরুতর পাতক। হে ধর্ম্ম! তুমি ব্রাহ্মণবধ করিতে হওয়াতে এক্ষণে তোমার অন্তরে পাপের সঞ্চার হইয়াছে, অতএব আমি অভিশাপ দিতেছি, তুমি শূদ্রযোনি প্রাপ্ত হইবে।” ধর্ম্ম তদীয় শাপ-প্রভাবে বিদুররূপে শূদ্রযোনিতে জন্মগ্রহণ করেন। বিদুরের শরীরে সাক্ষাৎ ধর্ম্ম আবির্ভূত আছেন। সূত গবল্গণ হইতে মুনিতুল্য সঞ্জয় সঞ্জাত হয়েন। কুন্তীর কন্যকাবস্থায় সূর্য্যের ঔরসে তদীয় গর্ভে মহাবল কর্ণ জন্মগ্রহণ করেন।
সর্ব্বলোক-পূজিত, জগৎকর্ত্তা, অনাদিনিধন নারায়ণ লোকদিগকে অনুগ্রহ করিবার নিমিত্ত বসুদেবের ঔরসে দেবকীর গর্ভে আবির্ভূত হয়েন। লোকে যাঁহাকে অব্যক্ত, অবিনাশী ব্রহ্ম, ত্রিগুণাত্মক, আত্মা, অব্যয়, প্রকৃতি, প্রভাব, প্রভু, পুরুষ, বিশ্বকর্ম্মা, সত্ত্বগুণসম্পন্ন, ধ্রুব, অক্ষর, অনন্ত, অচল, দেবহংস, নারায়ণ, বিধাতা, অজ, মোক্ষ-স্বরূপ এবং নির্গুণ বলিয়া নির্দ্দেশ করে; সেই সর্ব্বভূতপিতামহ ধর্ম্মসংবর্দ্ধনের নিমিত্ত অন্ধক-বৃষ্ণিবংশে অবতীর্ণ হয়েন। অস্ত্রজ্ঞ ও সর্ব্বশাস্ত্র-বিশারদ মহাবলপরাক্রান্ত সাত্যকি ও কৃতবর্ম্মা সত্যক ও হৃদিকের ঔরসে জন্মগ্রহণ করিলেন।
এক দ্রোণীতে অর্থাৎ কুম্ভে উগ্রতপা মহর্ষি ভরদ্বাজের রেতঃপাত হয়, তাহাতেই দ্রোণাচার্য্যের জন্ম হইল। অশ্বত্থামার জননী-কৃপী ও মহাবল পরাক্রান্ত কৃপ, শরৎকালীন শরস্তম্বে প্রসিক্ত গৌতমের রেতঃ হইতে উদ্ভূত হইলেন। দ্রোণাচার্য্য হইতে অশ্বত্থামা জন্মগ্রহণ করিলেন। প্রভূত-পরাক্রমশালী প্রদাপ্ত অনলসম তেজস্বী ধৃষ্টদ্যুন্ন দ্রোণ-বিনাশের নিমিত্ত ধনুগ্রহণপূর্ব্বক যজ্ঞবেদী হইতে আবির্ভুত হয়েন। ঐ যজ্ঞবেদী হইতে অলৌকিক রূপলাবণ্যবতী গুণবতী দ্রৌপদী জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রহ্লাদের শিষ্য নগ্নজিৎ ও সুবলের জন্ম হইল। গান্ধাররাজ সুবলের শকুনি নামে এক পুৎত্র ও দুর্য্যোধনের জননী গান্ধারী নামে কন্যা জন্মিল। কিন্তু দৈবকোপে শকুনি অধার্ম্মিক হইয়াছিল। রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও মহাবলপরাক্রান্ত পাণ্ডু ব্যাসের ঔরসে মহারাজ বিচিত্রবীর্য্যের ক্ষেত্রে জন্মগ্রহণ করিলেন। দ্বৈপায়নের ঔরসে শূদ্রযোনিতে ধর্ম্মার্থবেত্তা ধীমান্ বিদুর জন্মিলেন। পাণ্ডু রাজার দুই স্ত্রীর গর্ভে পাঁচ পুৎত্র হয়। ধর্ম্ম হইতে যুধিষ্ঠির, বায়ু হইতে ভীম, ইন্দ্র হইতে সর্ব্বশাস্ত্র-বিশারদ অর্জ্জুন এবং অশ্বিনীতনয়দ্বয় হইতে অতি-রূপবান্ যমজ নকুল ও সহদেব। তন্মধ্যে যুধিষ্ঠির সর্ব্বাপেক্ষা অধিক গুণবান্ ছিলেন। ধীমান ধৃতরাষ্ট্রের দুর্য্যোধন প্রভৃতি একশত পুৎত্র জন্মে এবং তাঁহার যুযুৎসু ও করণ নামে আর দুই পুৎত্র জন্মিয়াছিল। তদনন্তর দুঃশাসন, দুঃসহ, দুর্ম্মর্ষণ, বিকর্ণ, চিত্রসেন, বিবিংশতি, জয়, সত্যব্রত, পুরুমিত্র, বৈশ্যাপুৎত্র, যুযুৎসু, এই একাদশ মহারথ জন্মিয়াছিলেন। অর্জ্জুনের ঔরসে সুভদ্রার গর্ভে অভিমন্যুর জন্ম হয়। অভিমন্যু কৃষ্ণের ভাগিনেয় ও মহাত্মা পাণ্ডুর পৌৎত্র। এক দ্রৌপদীর গর্ভে যুধিষ্ঠিরের ঔরসে প্রতিবিন্ধ্য, ভীমসেনের ঔরসে সুতসোম, অর্জ্জুনের ঔরসে শ্রুতকীর্ত্তি, নকুলের ঔরসে শতানীক এবং সহদেবের ঔরসে শ্রুতসেন, এই পঞ্চপুৎত্র জন্মে। ভীমের ঔরসে হিড়িম্বার গর্ভে ঘটোৎকচের জন্ম হয়। দ্রুপদ রাজার শিখণ্ডী-নাম্নী এক কন্যা জন্মে—স্থণ নামে এক যক্ষ আপন প্রিয়কার্য্য সম্পাদন করিবার অভিপ্রায়ে যাহাকে পুরুষ করিয়া রাখিয়াছিল। এতদ্ভিন্ন কুরুপাণ্ডবদিগের যুদ্ধে শত সহস্র রাজা সংগ্রাম-বাসনায় সমাগত হইয়াছিলেন। সেই অসংখ্যা রাজাগণের নাম অযুত বর্ষেও নির্দ্দেশ করা দুষ্কর; অতএব এই উপাখ্যানের মধ্যে যাঁহারা প্রধান, তাঁহাদিগেরই নাম কীর্ত্তিত হইল।