বহুকাল রহে পাণ্ডু বনের ভিতর।
সঙ্গে দুই ভার্য্যা আর কত অনুচর।।
নিরন্তর ভ্রমে পাণ্ডু মৃগ-অন্বেষণে।
পর্ব্বত-কন্দর ঘোর মহা শালবনে।।
সিংহ ব্যাঘ্র হ্স্তী খড়্গী ভল্লুক শূকর।
পাইয়া পাণ্ডুর শব্দ যায় বনান্তর।।
হেনমতে একদিন দেখে নৃপবর।
হরিণীযূথের মধ্যে মৃগ একেশ্বর।।
কিন্দম নামেতে সেই ঋষির কুমার।
মৃগরূপ ধরি করে মৃগীরে শৃঙ্গার।।
মৃগ দেখি পাণ্ডুরাজ প্রহারিল শর।
তীক্ষ্ণশরে ভেদিল ঋষির কলেবর।।
শরাঘাতে ঋষিপুত্র করে ছটফটি।
মৃগীর উপর হৈতে ভূমে পড়ে লুটি।।
ডাক দিয়া ঋষিপুত্র পাণ্ডু প্রতি বলে।
ধার্ম্মিক পণ্ডিত হৈয়া কি কর্ম্ম করিলে।।
মূর্খ দুরাচার যেই হিংসা করে পরে।
পরম শক্রকে হেন সময়ে না মারে।।
পাণ্ডু বলে, মৃগ তুমি নিন্দ কি কারণ।
ক্ষত্রধর্ম্ম মৃগ মারি পাই হে যখন।।
করিলা অগস্ত্যমুনি ভক্ষ্য মৃগগণ।
দেবঋষি-ভক্ষ্য হেতু মৃগের সৃজন।।
রিপু সম মৃগে অস্ত্র করিব প্রহার।
নীতিশাস্ত্রে কহে, হেন ক্ষত্রিয়-আচার।।
ঋষি কহে, মৃগবধ ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম।
রমণে বিরোধ করা মহাপাপ কর্ম্ম।।
কুরুবংশে জন্মি কর হেন অনুচিত।
রতিরস জ্ঞাত সব শাস্ত্রেতে পণ্ডিত।।
রাজা হয়ে নিজে কর হেন পাপাচার।
রাজা যদি পাপ করে মজিবে সংসার।।
ঋষির নন্দন আমি, তপের সাগর।
সকল ত্যজিয়া থাকি বনের ভিতর।।
মৃগরূপে করি আমি হরিণী রমণ।
হেনকালে তুমি মোরে করিলে নিধন।।
ব্রাহ্মণ বলিয়া তুমি না জান আমারে।
সেই হেতু ব্রহ্মবধ নহিবে তোমারে।।
মৃগদেহ মারিলে ইহাতে পাপ নয়।
এই পাপ মারিলা যে মৈথুন-সময়।।
এই হেতু শাপ আমি দিতেছি রাজন্।
মৈথুন সময়ে হবে তোমার মরণ।।
আমি যেমত অশুচিতে যাই পরলোকে।
এই মত অশুচিতে যাবে যমলোকে।।
স্বর্গেতে যাইতে শক্তি নহিবে তোমার।
কভু মিথ্যা নহিবেক বচন আমার।।
এত বলি ঋষিপুত্র ত্যজিল জীবন।
দেখিয়া পাণ্ডুর হৈল বিষণ্ণ বদন।।
শোকেতে আকুল হৈয়া করেন ক্রন্দন।
প্রদক্ষিণ করি মৃত-ঋষির নন্দন।।
ভার্য্যা সহ কান্দেন যেমন বন্ধুশোকে।
অশেষ বিশেষে রাজা নিন্দে আপনাকে।।
কেন হেন বড় কুলে হইল উদ্ভব।
আপনার কর্ম্মভোগ করে লোক সব।।
শুনিয়াছ পিতা করিলেন কদাচার।
কামলোভে অল্পকালে তাঁহার সংহার।।
তাঁর ক্ষেত্রে জন্ম মম সহজে অধম।
দুষ্টবুদ্ধি দুরাচার তেঁই ব্যতিক্রম।।
রাজনীতি ধর্ম্ম কত আছয়ে সংসারে।
সব ত্যজি ভ্রমি মৃগ-বধ অনুসারে।।
সমুচিত ফল তার হৈল এতকালে।
খণ্ডন না হয়, কর্ম্ম-অনুসারে ফলে।।
আজি হৈতে ত্যজিলাম সংসার-বিষয়।
শরীর ত্যজিব তপ করিয়া নিশ্চয়।।
একাকী হইয়া পৃথ্বী করিব ভ্রমণ।
সকল ইন্দ্রিয়গণে করিব দমন।।
কুন্তী মাদ্রী প্রতি রাজা বলিছে বচন।
হস্তিনা-নগরে দোঁহে করহ গমন।।
ভীষ্ম জ্যেষ্ঠতাত আর অম্বালিকা মাতা।
সত্যবতী আই আর অন্ধরাজ ভ্রাতা।।
বিদুর প্রভৃতি যত সুহৃদ সকল।
যে দেখিলা শুনিলা কহিবা অবিকল।।
এত শুনি দুই জনে করেন ক্রন্দন।
কান্দিতে কান্দিতে কহে করুণ বচন।।
কি দোষে আমরা দোষী তোমার বচণে।
তোমা বিনা হস্তিনায় যাইব কেমনে।।
তোমা বিনা শরীর ধরিব কোন্ কাজে।
কিবা ফল পাইব থাকিয়া গৃহমাঝে।।
তোমা বিনা রাজা গতি নাহি আমাদের।
তোমার যে গতি সেই গতি দুজনের।।
তপস্যা করিব মোরা তোমার সংহতি।
তোমার সেবনে রাজা পাইব সদগতি।।
ফলাহারী হৈব করি ইন্দ্রিয়-নিগ্রহ।
নানা তীর্থে স্বচ্ছন্দে ভ্রমিব তব সহ।।
হেনমতে আশ্রম আছয়ে সন্ন্যাসীতে।
ধর্ম্মপত্নী দোঁহে, দোষ নাহিক ইহাতে।।
নিশ্চয় নৃপতি যদি না লবে সংহতি।
ক্ষণেক রহিয়া যাহ শুন নরপতি।।
তোমার অগ্রেতে মোরা পশিব আগুনে।
স্বচ্ছন্দে গমন কর যেখানে সেখানে।।
অনেক বিনয় করি কান্দে দুইজন।
দেখিয়া ব্যাকুলচিত্ত হইল রাজন।।
পাণ্ডু বলে, নিশ্চয় সহিত যদি যাবে।
তোমরা অশেষ ক্লেশ অরণ্যেতে পাবে।।
গাছের বাকল পর, ত্যজহ বসন।
শিরে জটা ধর, আর ত্যজ আভরণ।।
ফল-মূলাহরী হও ত্যজ দিব্য হার।
কাম ক্রোধ লোভ মোহ ত্যজ অহঙ্কার।।
স্বামীর বচন তবে শুনি দুই জন।
ততক্ষণে পরিত্যাগ করে আভরণ।।
কবরী এলায়ে কৈল শিরে জটাভার।
নৃপতির অগ্রে দিল সব অলঙ্কার।।
দেখিয়া নৃপতি মনে হইল বিস্ময়।
দোঁহার দেখিয়া বেশ বিদরে হৃদয়।।
তবে রাজা ত্যজিলেন নিজ অলঙ্কার।
করিয়া সকল ত্যাগ তপস্বী-আচার।।
রত্ন অলঙ্কার দ্বিজে করিলেন দান।
তপস্যা করিতে রাজা করেন প্রস্থান।।
অনুচরগণ যত আছিল সংহতি।
সবাকারে বলিলেন পাণ্ডু নরপতি।।
হস্তিনা-নগরে সবে করহ গমন।
সবাকারে কহিবা আমার বিবরণ।।
যত্নে প্রবোধিবে সবে মায়ের ক্রন্দনে।
ধৃতরাষ্ট্রে প্রবোধিবে মধুর বচনে।।
পাণ্ডুর বচন যত শুনি সর্ব্বজনে।
হাহাকার করি সবে করয়ে ক্রন্দন।।
সঘনে নিশ্বাস, মুখে কাতর বচন।
হস্তিনা-নগর সবে করিল গমন।।
একে একে সবারে কহিল সমাচার।
শুনি পুরলোকে সবে করে হাহাকার।।
অন্তুঃপুরে উঠিল ক্রন্দন-মহারোল।
প্রলয়কালেতে যেন সাগর-কল্লোল।।
গাঙ্গেয় বিদুর আদি আর যত জন।
পাণ্ডুর শোকেতে করে সকলে ক্রন্দন।।
শুনি ধৃতরাষ্ট্র রাজা অত্যন্ত অস্থির।
নাহি রুচে অন্ন জল না হন বাহির।।
রত্নময় পালঙ্ক ছাড়িয়া নৃপবর।
ভূমে গড়াগড়ি যায় শোকেতে কাতর।।
হেনমতে রোদন করিছে বন্ধুজন।
হেথা পাণ্ডু প্রবেশিল গহন কানন।।
চৈত্ররথ নামে বন অতি সে বিস্তার।
গন্ধর্ব্ব অপ্সরা তথা করিছে বিহার।।
সে বন ত্যজিয়া যান নৈমিষকানন।
বহু নদনদী দেশ করিয়া লঙ্ঘন।।
তিনে হিমালয়ে করিলেন আরোহণ।
তথা হৈতে চলিলেন শ্রীগন্ধমাদন।।
তথায় আছয়ে ইন্দ্রদ্যুন্ন সরোবর।
মহাপুণ্য তীর্থ যাহে বাঞ্ছিত অমর।।
তাহে স্নান করিয়া গেলেন তিন জন।
শতশৃঙ্গ-পর্ব্বতে করেন আরোহণ।।
মহা উচ্চ গিরিবর দেখিতে উত্তম।
অনেক তপস্বী ঋষিগণের আশ্রম।।
পর্ব্বত পাইয়া রাজা আনন্দিত মন।
তপস্যা করেন তথা সহ ঋষিগণ।।
করেন কঠোর তপ তথা তিন জন।
দিনশেষে ফলমূল করেন ভক্ষণ।।
বরিষা আতপ শীত সহে কালধর্ম্ম।
কেবল শরীর, তিনে সার অস্থিচর্ম্ম।।
ঘোর তপ দেখিয়া বাখানে ঋষিগণ।
তপস্যাতে সিদ্ধ হইলেন তিনজন।।
স্বর্গেতে যাইতে শক্তি হৈল, হেন বাসি।
তথা হেতে গেলেন প্রণমি সব ঋষি।।
অতি উচ্চ গিরিবর পরশে গগন।
স্বর্গেতে যাইতে করিলেন আরোহণ।।
পথেতে দেখেন সব দেবতার স্থান।
নানা রত্নে বিভূষিত বিচিত্র নির্ম্মাণ।।
দেখেন বহিছে গঙ্গা মৃদুল তরঙ্গে।
দেবকন্যাগণে তথা ক্রীড়া করে রঙ্গে।।
কোন স্থানে দেখিলেন পর্ব্বত উপর।
জলধরগণে বৃষ্টি করে নিরন্তর।।
তাহার অন্তরেতে অগম্য ভূমি দেখি।
আছুক অন্যের কাজ, যেতে নারে পাখী।।
তিন জনে দেখিলেন তথা ঋষিগণ।
ডাক দিয়া উষিগণ বলেন বচন।।
কোথাকারে যাও হে তোমরা তিনজন।
অগম্য বিষম ভূমি, যাহ কি কারণ।।
তোমাদের কোথা ধাম কহিবে নিশ্চয়।
কিবা নাম কোথা হৈতে আইলে হেথায়।।
ঋষিগণ-বচনে বলেন নরপতি।
পাণ্ডু নামে আমি, কুরুবংশেতে উৎপত্তি।।
অপুত্রক হইলাম নিজ কর্ম্মদোষে।
সংসার ত্যজিয়া আমি যাই স্বর্গবাসে।।
শুন শুন মহামুনি করি নিবেদন।
নিশ্চয় কহিব আমি তব বিদ্যমান।।
মর্ত্তেতে মানব জন্ম হইল আমার।
ঋণ হইতে যে না পাইনু নিস্তার।।
সংসারের মধ্যে ঋণ শুন মুনিবর।
বিস্তারিয়া সব কথা কহি বরাবর।।
চারি ঋণ লইয়া মনুষ্য দেহ ধরে।
ঋণ হৈতে পার হৈলে মুক্ত কলেবরে।।
যজ্ঞ করি দেব-ঋণে হইবেক পার।
মুনিগণে তুষিবেক করি ব্রতাচার।।
পিতৃ-ঋণে মুক্ত হয় পিতৃপিণ্ড দিয়া।
মনুষ্যে হইবে পার অতিথি ভুঞ্জিয়া।।
ঋণে পার হইলাম আমি তিন স্থানে।
কিন্তু না হইনু পার পিতৃগণ-ঋণে।।
আপন কুকর্ম্ম ফল না হয় খণ্ডন।
শরীর ত্যজিতে আমি যাই সে কারণ।।
ঋষিগণ বলে, তুমি পণ্ডিত সুজন।
ধার্ম্মিক সুবুদ্ধি সর্ব্বশাস্ত্রে বিচক্ষণ।।
পুত্রহীন জন স্বর্গে যাইতে না পারে ।
দ্বারপালগণ তথা দ্বাররক্ষা করে।।
অকারণে তথাকারে যাও নরপতি।
কদাচিৎ না পাইবা স্বর্গেতে বসতি।।
শুন ওহে মহারাজ আমার বচন।
মর্ত্ত্যেতে জন্মিলে হয়া অবশ্য মরণ।।
পৃথিবীতে জন্ম হয় মহাপুণ্য-ফলে।
তাহার বৃত্তান্ত আমি কহিব সকলে।।
পৃথিবীতে বহু দান পুণ্য লোক করে।
বহু তপজপ করে সংসার-ভিতরে।।
পুত্রহীন হৈলে স্বর্গে যাইতে না পারে।
নীতিশাস্ত্রে হেন কহে বেদের বিচারে।।
স্বর্গেতে যতেক বৈসে দেব সিদ্ধঋষি।
মর্ত্ত্যে পুত্র জন্মাইয়া সবে স্বর্গবাসী।।
এত শুনি বলে রাজা বিনয়-বচন।
কি করিব, মোরে আজ্ঞা কর তপোধন।।
ইহার উপায় মোরে কহ মুনিবর।
অবশ্য পালিব আমি করি অঙ্গীকার।।
মুনিগণ বলে, রাজা থাক এই স্থানে।
হইবেক পুত্র তব দেব-বরদানে।।
দিব্যচক্ষে মোরা সব করি দরশন।
মহাবীর্যবন্ত হবে তব পুত্রগণ।।
ঋষিগণ-বচনে নিবর্ত্তে নরপতি।
শতশৃঙ্গ পর্ব্বতে করিলেন বসতি।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।