৬১তম অধ্যায়
দমনকসহ শল্যপুত্ৰ সাংযমনিবধ
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! মহাবীর অশ্বত্থামা, ভূরিশ্রবা, শল্য, চিত্ৰসেন ও সাংযমনির পুত্র অভিমন্যুর সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইল। অর্জ্জুনতনয় সেই অতিতেজস্বী পঞ্চযোদ্ধার সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইয়া পঞ্চগজের সহিত যুধ্যমান সিংহশিশুর ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। ঐ পাঁচজনের মধ্যে কেহই কি লক্ষ্যবিষয়ে, কি শৌর্য্যে, কি পরাক্রমে, কি অস্ত্রসন্ধানে, কি হস্তলাঘবে কিছুতেই অভিমন্যুর সদৃশ হইতে পারিলেন না। মহাবীর অর্জ্জুন স্বীয় তনয়কে সংগ্রামে তাদৃশ পরাক্রম প্রকাশ করিতে দেখিয়া আহ্লাদিতচিত্তে সিংহনাদ করিতে লাগিলেন।
“হে রাজন! আপনার পক্ষীয় বীরগণ সৈন্যগণকে অভিমন্যুকর্ত্তৃক নিতান্ত পীড়িত নিরীক্ষণ করিয়া চতুর্দ্দিক হইতে তাঁহাকে আক্রমণ করিলেন। মহাবীর অর্জ্জুননন্দন অদীনচিত্তে সেইসমুদয় যোদ্ধাদিগের সম্মুখীন হইয়া ঘোরতর সংগ্রাম করিতে লাগিলেন। ঐ সময় তাঁহার শরাসন সূৰ্য্যসদৃশ প্রভাবসম্পন্ন বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। মহাবীর অভিমন্যু অশ্বত্থামাকে এক ও শল্যকে পাঁচবাণে বিদ্ধ করিয়া আট বাণ নিক্ষেপপূর্ব্বক সাংযমনির ধ্বজচ্ছেদন করিলেন। অনস্তর সৌমদত্তি তাঁহার উপর সুবর্ণদণ্ড ভীষণ ভুজঙ্গসদৃশ মহাশক্তি নিক্ষেপ করিলে মহাবীর অভিমন্যু নিশিতবাণদ্বারা তাহা ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর শল্য তাঁহার উপর শত শত শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন; তিনিও অনায়াসে তৎসমুদয় নিবারণ ও তাঁহার চারি অশ্ব বিনষ্ট করিলেন। ফলতঃ তৎকালে ভূরিশ্রবা, অশ্বত্থামা, সাংযমনি ও শল্য—ইঁহারা কেহই অভিমন্যুর বাহুবল অতিক্রম করিতে সমর্থ হইলেন না।
“তখন শক্রগণের অজেয় ধনুর্ব্বেদবিৎ ত্রিগর্ত্ত, মদ্র ও কৈকয় দেশীয় পঞ্চবিংশতি সহস্ৰসৈন্য দুৰ্য্যোধনের নির্দেশানুসারে সপুত্ৰ অর্জ্জুনকে বিনাশ করিবার মানসে চতুর্দ্দিক হইতে বেষ্টন করিলেন। পাণ্ডবগণের সেনাপতি অরতিনিপাতন ধৃষ্টদ্যুম্ন বিপক্ষ সৈন্যগণকর্ত্তৃক অর্জ্জুন ও তাঁহার তনয়ের রথ পরিবেষ্টিত দেখিয়া, বহুসহস্ৰ বারণ, রথ, অশ্ব ও পদাতিসমভিব্যাহারে ক্রুদ্ধচিত্তে ধনুর্বিস্ফারণ ও সৈন্য প্রেরণপূর্ব্বক মদ্র ও কৈকেয়সৈন্যগণের সম্মুখীন হইলেন। কীর্ত্তিমান দৃঢ়ধন্বা মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্নকর্ত্তৃক রক্ষিত প্রভূত রথ, হস্তী ও অশ্বশালী পাণ্ডবসৈন্য যুদ্ধের নিমিত্ত অধিকতর শোভা পাইতে লাগিল। মহাবীর পাঞ্চালনন্দন ক্ৰমে অর্জ্জুনের সমীপবর্ত্তী হইয়া প্রথমে তিনবাণে কৃপের জক্রদেশ বিদ্ধ, পরে দশবাণে মদ্রকগণের শরীরভেদ, অনন্তর শাণিতভল্লদ্বারা কৃতবর্ম্মার পৃষ্ঠরক্ষককে বিনাশ করিয়া বিপুল নারাচে মহাত্মা পৌরবের পুত্ৰ দমনককে শমনসদনে প্রেরণ করিলেন।
“তখন সাংযমনির পুত্র যুদ্ধদুর্ম্মদ দ্রুপদতনয় ও তাঁহার সারথিকে দশ-দশ বাণে বিদ্ধ করিলেন। মহাধনুৰ্দ্ধর ধৃষ্টদ্যুন্ন এইরূপে বাণবিদ্ধ হইয়া সৃক্কণী লেহনপূর্ব্বক সুতীক্ষ্ন ভল্লাস্ত্ৰে সাংযমনিতনয়ের শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর সত্বর পঞ্চবিংশতি বাণে তাঁহাকে বিদ্ধ করিয়া তাঁহার অশ্বসমুদয়, পাষ্ণি ও সারথিকে সংহার করিলেন। সাংযমনিনন্দন সেই অশ্ববিহীন রথে অবস্থানপূর্ব্বক রথস্থ যশস্বী পাঞ্চালনন্দনকে অবলোকন করিয়া অবিলম্বে মহাঘোর আয়োময় খড়্গ গ্রহণপূর্ব্বক পাদচারে তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। পাণ্ডবগণ ও মহাবীর দ্রুপদতনয় সেই খড়্গধারী মত্তবারণবিক্রম সাংযমনিতনয়কে সাগরতরঙ্গের ন্যায়, আকাশ হইতে নিপতিত আশীবিষের ন্যায়, কালপ্রেরিত অন্তকের ন্যায়, প্রচণ্ড মার্ত্তণ্ডের ন্যায় অবলোকন করিতে লাগিলেন। তৃণীরধারী মহাবলপরাক্রান্ত সাংযমনিতনয় অসামান্য ক্ষমতাপ্রভাবে পাণ্ডবসৈন্যগণের বাণবেগ নিবারণ করিয়া শাণিত কৃপাণহস্তে ধৃষ্টদ্যুম্নের রথসমীপে সমুপস্থিত হইবামাত্র পাঞ্চলতনয় ক্রুদ্ধচিত্তে গদাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর সাংযমনিতনয় গদাঘাতে প্ৰাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক ধরাতলে পতনোন্মুখ হইবামাত্র তাঁহার হস্ত হইতে প্রভাবশালী খড়্গ ও শরাসন নিপতিত হইল। ভীমবিক্রম মহাত্মা পাঞ্চালতনয় এইরূপে গদাঘাতে সাংযমনিতনয়কে সংহার করিয়া অসামান্য যশোলাভ করিলেন। হে মহারাজ! সেই রাজপুত্র নিহত হইবামাত্র আপনার সৈন্যমধ্যে মহান হাহাকার সমুত্থিত হইল।
“মহাবীর সাংযমনি পুত্রকে নিহত দেখিয়া ক্রোধান্বিতচিত্তে মহাবেগে রণদুর্ম্মদ পঞ্চালরাজতনয়ের প্রতি ধাবমান হইলেন। কৌরব ও পাণ্ডবপক্ষীয় সমুদয় ভূপতি পরস্পর মিলিত সেই বীরদ্বয়কে অবলোকন করিতে লাগিলেন। মহাবল পরাক্রান্ত সাংযমনি ক্রুদ্ধচিত্তে মহাহস্তীর উপর অঙ্কুশাঘাতের ন্যায় ধৃষ্টদ্যুম্নের উপর তিনবাণ নিক্ষেপ করিলেন। সমররসপারায়ণ [বীররসে অনুরাগী], শল্যও দ্রুপদতনয়ের বক্ষঃস্থলে বাণ নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। এইরূপে মহাসংগ্রাম সমুত্থিত হইল।”