৬০তম অধ্যায়
ভাবী অনিষ্টাশঙ্কায় দময়ন্তীকর্ত্তৃক পিত্রালয়ে পুত্ৰাদি প্রেরণ
বৃহদশ্ব কহিলেন, “মহারাজ! দময়ন্তী রাজাকে দ্যূতক্রীড়ায় উন্মত্ত ও হতজ্ঞান নিরীক্ষণ করিয়া ভয় ও শোকে ব্যাকুল হইয়া তাঁহার সেই কাৰ্য্য অতি অনিষ্টকর বিবেচনা করিতে লাগিলেন। তিনি হৃতসর্ব্বস্ব ভূপতির সেই অক্ষরূপ অনিষ্টপাত অবলোকনপূর্ব্বক তদীয় প্ৰিয়চিকীৰ্ষু হইয়া তাঁহাকে ভৎসনাপূর্ব্বক বৃহৎসেনানামী পরিচারিকাকে কহিলেন, ‘ধাত্রি! তুমি মধুরভাষিণী, রাজার প্রতি বিশেষ অনুরাগিণী এবং কাৰ্য্যকুশল; অতএব মহারাজের আদেশে মন্ত্রিবর্গের নিকটে উপনীত হইয়া যে সমস্ত দ্রব্য পণে হৃত হইয়াছে এবং যাহা অবশিষ্ট আছে, তৎসমুদয় নিবেদন করিয়া তাহাদিগকে এস্থানে আনয়ন কর।” বৃহৎসেনা ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া মহিষীর নির্দেশ প্রতিপালন করিল।
“অনন্তর সচিবগণ রাজশাসন-শ্রবণে আপনাদিগকে পরম ভাগ্যবান বিবেচনা করিয়া তৎক্ষণাৎ নৃপনিকেতনে সমুপস্থিত হইলেন। তাঁহাদিগকে দ্বিতীয়বার সমাগত দেখিয়া মহিষী রাজাকে নিবেদন করিলেন, কিন্তু তিনি তাঁহাকে বাক্যে অভিনন্দন করিলেন না। তখন ভীমনন্দিনী স্বামীর এইরূপ অনভিনন্দনসন্দর্শনে যৎপরোনাস্তি লজ্জিত হইয়া বিষণ্নমনে স্বীয় ভবনে প্রবেশ করিলেন। তিনি প্রতিকূল অক্ষদ্বারা নলের সর্ব্বস্ব হৃত হইল শ্রবণ করিয়া পুনরায় ধাত্রীকে কহিলেন, ‘বৃহৎসেনে! মহৎকাৰ্য্য উপস্থিত; তুমি রাজার নির্দেশক্রমে সূতসন্নিধানে উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে আনয়ন কর।” বৃহৎসেনা দময়ন্তীর বাক্য শ্রবণ করিয়া কতিপয় বিশ্বস্ত পুরুষদ্বারা সূতকে আনয়ন করাইলে, দেশকালাভিজ্ঞা ভীমাত্মজা মধুরবাক্যে সারথিকে সান্ত্বনা করিয়া সময়োচিত বচনে কহিতে লাগিলেন, “সূত! রাজা সর্ব্বদা তোমার প্রতি যেরূপ ব্যবহার করিতেন, বোধ হয়, তুমি তাহা বিশেষরূপ জ্ঞাত আছ, এক্ষণে দুরবস্থাগ্রস্ত প্রভুর সাহায্য করা তোমার সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য।
রাজার দ্যূতরোগ উত্তরোত্তর ততই বর্দ্ধিত হইতেছে। অক্ষ-সকল তাহার এমত বশংবদ যে, যদুদেশে বিক্ষেপ করে তাঁহাই সিদ্ধ হয়; কিন্তু রাজবিক্ষিপ্ত ক্ষে কেবল বিপৰ্য্যয়ই লক্ষিত হইতে থাকে। তিনি মোহবশতঃ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবগণের বাক্যে কৰ্ণপাত এবং আমার বাক্যেও অভিনন্দন করেন না, বোধ হয়, তাহাতে তাহার দোষ নাই। হে সারথে! আমি এক্ষণে তোমার শরণাগত হইলাম; আমার কথা রক্ষা কর, এক্ষণে আমার আন্তরিক ভাবের স্থিরতা নাই; বোধহয়, সময়ক্রম বিনষ্ট হইবারও বিলক্ষণ সম্ভাবনা। অতএব তুমি অদ্য দ্রুতগামী তুরঙ্গ সংযোজিত রথে আমার কন্যা-পুত্ৰকে আরোহণ করাইয়া ভীমনগর কুণ্ডিনপুরে যাত্রা কর। তথায় আমার জ্ঞাতিবর্গের নিকট বালক, বালিকা, রথ ও অশ্বগণ রক্ষা করিয়া ইচ্ছা হয়। সেখানে বাস করিও, না হয়। অন্যত্র গমন করিও।”
“নলসারথি বার্ষ্ণেয় দময়ন্তীর বাক্য-শ্রবণানন্তর প্রধান প্রধান সচিবসমীপে সবিশেষ নিবেদন করায় তাঁহারা সমবেত হইয়া পরামর্শ স্থির করিয়া সারথির বাক্যে অনুমোদন করিলেন। সারথি রথে রাজকন্যা ও পুত্রকে লইয়া বিদর্ভদেশে প্রস্থান করিল। তথায় নলরাজের অশ্ব, রথ, ইন্দ্ৰসেনানামে কন্যা ও ইন্দ্ৰসেননামক পুত্রকে রক্ষা করিয়া রাজা ভীমের নিকট বিদায়গ্ৰহণপূর্ব্বক পদব্রজে অযোধ্যায় উত্তীর্ণ হইল এবং তত্ৰত্য রাজা ঋতুপর্ণের সারথ্যকর্ম্মদ্বারা কষ্টে জীবিকানির্ব্বাহ করিতে লাগিল।”