৬০তম অধ্যায়
দুৰ্য্যোধনকর্ত্তৃক নিজ জয়সম্ভাবনাবৰ্ণন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! অতিকোপনস্বভাব দুৰ্য্যোধন পিতার বাক্য শ্রবণান্তর যৎপরোনাস্তি ক্রোধাপরবশ হইয়া কহিতে লাগিলেন, “হে তাত! দেবতারা পাণ্ডবগণের সহায়, এই নিমিত্ত তাহাদিগকে অজেয় বোধ করিয়া আপনার যে ভয় হইয়াছে, তাহা পরিত্যাগ করুন। পূর্ব্বে দ্বৈপায়ন ব্যাস, মহাতপাঃ নারদ ও জমদগ্নিনন্দন পরশুরাম আমাদিগকে এই পৌরাণিক কথা কহিয়াছেন যে, দেবগণ কাম, দ্বেষ, লোভ ও দ্রোহ পরিত্যাগ এবং সকল বিষয়ে ঔদাসীন্য অবলম্বন করিয়াছেন বলিয়াই দেবত্ব প্রাপ্ত হইয়াছেন; অতএব তাঁহারা মানুষ্যের ন্যায় কাম, ক্ৰোধ, লোভ বা দ্বেষের বশীভূত হইয়া কোনো কাৰ্য্য করেন না। যদি অগ্নি, বায়ু, ধর্ম্ম, ইন্দ্র ও অশ্বিনীকুমার কামনার অনুগত হইয়া কাৰ্য্য করিতেন, তাহা হইলে পাণ্ডবগণকে দুঃখভোগ করিতে হইত না। ফলতঃ এইসকল দেবগণ সতত দৈববিষয়েই অনুরক্ত; অতএব আপনি চিন্তিত হইবেন না। যদি দেবগণ কামনাপরতন্ত্র হইয়া লোভ বা দ্বেষ প্রদর্শন করেন, তাহা হইলে তাঁহাদিগের দৈবশক্তি ও পরাক্রম প্রভৃতির হানি হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।
“হে তাত! কেবল তাহারাই দেববলে যে বলীয়ান, এমন নয়, আমিও প্রতিনিয়ত হুতাশনকে আমন্ত্রণ করিয়া থাকি; তিনি চতুর্দ্দিকে বিক্ষিপ্ত হইয়া সকল লোক ভস্মীভূত করিবার অভিলাষে প্রশান্ত হইয়া আছেন। দেবগণ যে প্রকার অনুপম তেজে তেজস্বী, তাঁহাদিগের প্রসাদে আমিও সেই প্রকার তেজঃ প্রাপ্ত হইয়াছি। আমি বিদীৰ্য্যমাণা বসুধা ও উন্নত গিরিশিখরসকল আহ্বান করিয়া দর্শকগণের সমক্ষে সংস্থাপিত করিতে পারি। চেতনাচেতন সমস্ত চরাচর বিনষ্ট করিবার নিমিত্ত যে ভীষণ প্রস্তরবৃষ্টি ও যে সমীরণ ঘোরতর শব্দ করিয়া আবির্ভূত হয়, আমি প্রাণীগণের প্রতি করুণা প্রকাশ করিয়া সকল লোকের সমক্ষে তাহা পুনঃ পুনঃ নিবারণ করি। আমি যে জলস্তম্ভ করি, রথী ও পদাতিগণ তাহার মধ্যে গমন করিয়া থাকে। আমি একাকী দেবাসুরপ্রভৃতি সকল জীবের প্রবর্ত্তক। আমি অক্ষৌহিণীসমভিব্যাহারে যেসকল দেশে গমন করিবার সঙ্কল্প করি, আমার অশ্বগণ আপনা হইতেই সেই সকল স্থানে গমন করিতে প্ৰবৃত্ত হয়। আমার রাজ্যের মধ্যে ভুজঙ্গপ্রভৃতি ভীষণ জন্তু সকল দৃষ্টিগোচর হয় না; হিংস্ৰ জন্তুগণ অত্ৰত্য মন্ত্ররক্ষিত [সপবিষনাশক মন্ত্রে-সাপুড়ের মন্ত্রপ্রয়োগে] জীবগণের হিংসা করে না; ইন্দ্ৰদেব যথেষ্ট বারিবর্ষণ করেন; প্ৰজাগণ ধর্ম্মানুগত; ঈতি[অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, পঙ্গপাল প্রভৃতি পতঙ্গ, মুষিক, পাখী, যুদ্ধার্থ স্বরাষ্ট্র সন্নিহিত স্থানে পররাষ্ট্রপতির উপস্থিতি—এই ছয়টি ঈতিভাব]ভয়ের লেশমাত্ৰও নাই, অতএব অশ্বিনীকুমারযুগল, বায়ু, অগ্নি, ইন্দ্র ও ধর্ম্ম সমস্ত সুরগণসমভিব্যাহারেও আমার বিপক্ষগণকে রক্ষা করিতে সমর্থ হইবেন না। যদি তাঁহারা উহাদিগকে বলপূর্ব্বক পরিত্রাণ করিতে পারিতেন, তাহা হইলে পাণ্ডবগণকে ত্ৰয়োদশ বৎসর দুঃখভোগ করিতে হইত না। আমি সত্য কহিতেছি, কি দেব, কি গন্ধৰ্ব, কি অসুর, কি রাক্ষস, কেহই আমার শত্রুগণকে রক্ষা করিতে পারিবে না। আমি মিত্র বা অমিত্রের বিষয়ে যখন যাহা চিন্তা করি, তাহা শুভই হউক বা অশুভই হউক, কদাপি তাহাতে আমার অনিষ্টঘটনা হয় নাই। আমি যখন যাহা করিয়াছি, কখন তাহার অন্যথা হয় নাই, অতএব আমাকে সত্যবাদী বলিয়া অবধারণ করিবেন। সকল লোকই আমার এই সর্ব্বদেশপ্ৰসিদ্ধ মাহান্ত্র্যের সাক্ষী; আমি কেবল আপনাকে আশ্বাসিত করিবার নিমিত্তই এরূপ কহিতেছি, আত্মশ্লাঘা করা আমার উদ্দেশ্য নহে। আমি পূর্ব্বে কখন আত্মশ্লাঘা করি নাই; অসাধু লোকই আত্মপ্রশংসা করিয়া থাকে।
“হে তাত! আপনি তৎকালে শ্রবণ করিবেন যে, আমি পাণ্ডব, মৎস্য, পাঞ্চাল ও কেকয়গণকে এবং সাত্যকি ও বাসুদেবকে পরাজিত করিয়াছি। যেমন নদীসকল সাগরপ্রাপ্ত হইয়া বিনষ্ট হয়, সেইরূপ পাণ্ডবগণ আমার সহিত সমাগত হইলেই সবংশে ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে। আমার বুদ্ধি, তেজ, বীৰ্য্য, বিদ্যা ও উপায় তাহাদিগের অপেক্ষা উৎকৃষ্ট এবং পিতামহ, দ্রোণ, কৃপ, শল্য ও শল যেসকল অস্ত্রকৌশল অবগত আছেন, আমিও তৎসমুদয় জ্ঞাত আছি।”
রাজা ধৃতরাষ্ট্র দুৰ্য্যোধনের কথিত সমস্ত বাক্য সঞ্জয়কে কহিয়া, যুদ্ধার্থী পাণ্ডবগণের সময়োচিত কাৰ্য্যজাত পরিজ্ঞাত হইয়া পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন।