৬০তম অধ্যায়
চতুর্থ দিবসীয় যুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে রাজন! রজনী প্রভাত হইবামাত্র মহাবলপরাক্রান্ত শান্তনুতনয় কৌরবসৈন্যের অগ্রগামী হইয়া ক্ৰোধান্বিতচিত্তে শক্রগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর দ্ৰোণ, দুৰ্য্যোধন, বাহ্লীক, দুর্ম্মর্ষণ, চিত্ৰসেন ও মহাবলপরাক্রান্ত জয়দ্রথ এবং অন্যান্য ভূপতিগণ প্রভূত সৈন্যসমভিব্যাহারে তাঁহার সহিত গমন করিতে লাগিলেন। মহাবীর শান্তনুনন্দন সেইসমুদয় মহাবল, তেজস্বী, বীৰ্য্যবান, মহারথ ভূপতিগণে পরিবৃত হইয়া সুরমণ্ডলমধ্যবর্ত্তী সুররাজ পুরন্দরের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। সেনামুখে মহাগজের স্কন্ধে রক্ত, পীত, কৃষ্ণ, পাণ্ডুর প্রভৃতি নানাবর্ণের পতাকাসমুদয় দোধূয়মান [পুনঃ পুনঃ কম্পমান] হইতে লাগিল। কৌরবসৈন্যগণ মহাবীর ভীষ্ম, অন্যান্য মহারথীগণ ও প্রভূত গজবাজিদ্বারা বর্ষাকালীন সবিদ্যুৎ-সজল-জলদপটল-পরিশোভিত। গগনমণ্ডলের ন্যায় শোভমান হইল। সেই ভীষ্মাভিরক্ষিত প্ৰভূত কৌরবসৈন্য ভীষণ নদীবেগের ন্যায় অর্জ্জুনের অভিমুখে ধাবমান হইল।
“কপিকেতন মহাবীর ধনঞ্জয় বহুসংখ্যক প্রধানযোদ্ধা, গজ, অশ্ব, রথ ও পদাতিতে পরিপূর্ণ, মহামেঘসদৃশ কৌরববৃহৎ দূর হইতে অবলোকন করিয়া শ্বেত হয়যুক্ত রথে আরোহণপূর্ব্বক অসংখ্য সৈন্যসমভিব্যাহারে তাঁহাদিগের প্রতি ধাবমান হইলেন। হে মহারাজ! আপনার পুত্র ও অন্যান্য কৌরবপক্ষীয় বীরগণ কৃষ্ণসারথি অর্জ্জুনকে অবলোকন করিয়া বিষাদসাগরে নিমগ্ন হইলেন এবং অদ্বিতীয় মহারথী, উদ্যতায়ুধ, মহাবীর ধনঞ্জয়কর্ত্তৃক রক্ষিত পাণ্ডবব্যূহ অবলোকন করিতে লাগিলেন। ঐ ব্যূহে সহস্ৰ হস্তী চারি-চারিটিতে দলবদ্ধ হইয়া অবস্থান করিতেছিল। ধর্ম্মরাজ পূর্ব্বদিনে যে অদৃষ্টচর [গুপ্তপথবিশিষ্ট] অভূতপূর্ব্ব ব্যূহ নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন, অদ্যও সেইরূপ ব্যূহ রচনা করিলেন।
উভয়পক্ষের ভীষণ সংঘর্ষ-সৈন্যহতাহত
“হে মহারাজ! তৎপরে সংগ্রামস্থলে সহস্ৰ সহস্ৰ ভেরীনাদ, শঙ্খনিনাদ, তুৰ্য্যধ্বনি, সিংহনাদ ও বীরগণকর্ত্তৃক বিস্ফাৰ্য্যমাণ [আকৰ্ণ আকৰ্ষিত] সবাণ শরাসনের নিঃস্বন সমুত্থিত হইল। ক্ষণমধ্যেই সুগভীর শঙ্খনির্ঘোষে ভেরী ও পণবের ধ্বনি অন্তর্হিত ও গগনমণ্ডল সমাচ্ছন্ন হইয়া গেল। অন্তরীক্ষে ধূলিপটল সমুত্থিত হওয়াতে বোধ হইতে লাগিল যেন, গগনমণ্ডলে মহাবিতান লম্বমান রহিয়াছে। বীরগণ সেই বিতানাকার ভূরেণুনিচয় [ধুলিসমূহ] সন্দর্শন ও শঙ্খনাদ শ্রবণ করিয়া সহসা নিপতিত হইতে লাগিলেন। রথী রথীকর্ত্তৃক আহত হইয়া সারথি, অশ্ব, রথ ও কেতুর সহিত নিপতিত হইল এবং গজারোহী গজারোহীকর্ত্তৃক ও পদাতি পদাতিকর্ত্তৃক নিহত হইয়া ধরাশয্যা গ্ৰহণ করিল। ইতস্ততঃ ভ্রমণকারী অদ্ভুতাকার ঘোরদর্শন অশ্বারোহিগণ বিপক্ষ অশ্বারোহিদিগের খড়্গ ও প্রাসপ্ৰহারে নিহত হইল। সুবৰ্ণময় তারাপুঞ্জে বিভূষিত, সূৰ্য্যসদৃশ প্রভাসম্পন্ন তূণীরসমুদয় খড়্গ, প্রাস ও পরশুর আঘাতে বিদীর্ণ হইয়া ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল। কোন কোন রথী গজের দস্তাঘাতে ও কেহ কেহ শুণ্ডাঘাতে অশ্ব, রথ ও কেতুর সহিত ধরাশায়ী হইল। অনেক রথী রথিগণের বাণে আহত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল। অন্যান্য মানবগণ গজসমূহের বেগে আহত, নিপতিত, দন্ত ও গাত্রাবরণে তাড়িত অশ্বারোহী ও পদাতিদিগের আর্ত্তনাদ শ্ৰবণে ধরাতলে পতিত হইল।
ভীষ্মের অর্জ্জনসমীপে গমন—দ্বৈরথযুদ্ধ
“হে মহারাজ! এইরূপে গজারোহী, অশ্বারোহী ও রথিগণ উদ্ভ্ৰান্ত এবং পদাতি ও অন্যান্য বীরগণ নিহত হইতেছে, এমন সময়ে মহারথগণে পরিবৃত পঞ্চাতালকেতু মহাবীর ভীষ্ম মহাস্ত্ৰবেগপ্রভাবে সন্দীপ্ত কপিরাজকেতু অর্জ্জুনকে সন্দর্শন করিয়া তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর কৃপ, শল্য, বিবিংশতি, দুৰ্য্যোধন, ভূরিশ্রবা ও দ্রোণপ্ৰভৃতি মহারথগণও সেই ইন্দ্রসদৃশ তেজস্বী ইন্দ্রতনয় ধনঞ্জয়ের অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। সর্ব্বশস্ত্রকোবিদ, বিচিত্ৰ কাঞ্চনবর্ম্মধারী, অর্জ্জুনতনয় অভিমন্যু সেইসমুদয় বীরদিগকে পিতার অভিমুখীন অবলোকন করিয়া ক্ৰোধাভরে মহাবেগে সেনামুখ হইতে তাঁহাদের সমীপে গমন করিলেন এবং তাঁহাদের মহাস্ত্রসমুদয় ছেদন করিয়া জ্বালাকরাল [ভীষণ অনলযুক্ত] মহামন্ত্রাহুত হুতাশনের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তখন মহাবীর ভীষ্ম রণস্থলে রিপুগণের রুধিরনদী প্রবাহিত করিয়া অভিমন্যুকে অতিক্রমপূর্ব্বক অদীনচিত্তে মহারথ পার্থের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। মহাবীর কিরীটী গাণ্ডীবধ্বনি করিয়া অদ্ভুতদৰ্শন অস্ত্ৰজালে আরাতিগণের অস্ত্রসমুদয় নিবারণপূর্ব্বক সৈন্যগণকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। ঐ মহাবীর সর্ব্বধনুৰ্দ্ধারাগ্রগণ্য শান্তনুতনয়ের প্রতি নিশিত শরকিরণ ও বিমল ভল্পনিচয় নিক্ষেপ করিলে, মহাবলপরাক্রান্ত ভীষ্ম তৎসমুদয় মুহূৰ্তমধ্যে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর ভীষ্ম ও ধনঞ্জয় পরস্পর শরাসনধ্বনি করিয়া অদীনচিত্তে ঘোরতর দ্বৈরথসংগ্রাম আরম্ভ করিলেন। কুরু ও সৃঞ্জয়প্রভৃতি সমুদয় লোক বিস্মিতচিত্তে তাঁহাদের সেই সর নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।”